You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
২০শে মার্চ ১৯৬৪

মরিচীকার ব্যুহ ভেদ করিয়া জনতা জাগিয়া উঠিয়াছেঃ
ভােটাধিকারের দাবীতে ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালন
প্রাপ্তবয়স্কের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েমের গণ-দাবী
পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লােকের সমাবেশ ও মিছিল

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমবায়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা ও পূর্ণ গণতন্ত্রের দাবীতে গতকল্য প্রদেশের অন্যান্য জেলাসহ ঢাকায় যে হরতাল, জনসভা ও বিরাট শােভাযাত্রা বাহির হয় এবং এই ব্যাপারে ছাত্র, যুবক বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল স্তরের জনসাধারণের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ উদ্দীপনা ও কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয় তাহাতে একথা আর একবার প্রমাণিত হইল যে, বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের পিছনে জনসাধারণের কোনই সমর্থন নাই এবং তাহারা পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভােটাধিকার অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রহিয়াছে।
তবে গতকল্যকার জনসভায় যাহারা যােগদান করিয়াছেন তাহাদের প্রায় সকলেই দেশের সর্বসাধারণের জীবন মরণের প্রশ্নের সহিত জড়িত ভােটাধিকার দাবীর সংগ্রামে ঐক্যের অভাব লক্ষ্য করিয়া মর্মাহত হইয়াছেন। একই দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র বৃহৎ নির্বিশেষে সকল দলের ও সকল মতের প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের সমবায়ে একক কর্মসূচী লইয়া আন্দোলনে অবতীর্ণ হইতে পারিলেই জনসাধারণ আরও উৎসাহিত হইত এবং গণতান্ত্রিক শিবিরের শক্তিও বৃদ্ধি পাইত।
গণতন্ত্র ও ভােটাধিকার অর্জনের দাবীতে সংগ্রামকারী গণতান্ত্রিক শিবির এখনও পর্যন্ত মােটামুটি ত্রিধাবিভক্ত অবস্থায় রহিয়াছে। অথচ ইহারা সকলেই যদি মান-অভিমানের পুরাতন অভ্যাসসমূহ বৰ্জন করিয়া সম্পূর্ণরূপে একমত ও একপ্রাণ হইয়া জনতাকে নেতৃত্ব দিতে পারিতেন তাহা হইলে আন্দোলন যে আরও কতগুণ শক্তিশালী হইত তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।
নেতাদের মধ্যে দলগত অথবা ব্যক্তিগত মান-অভিমান যাহাই থাকুক না কেন, দেশ প্রেমের জ্বলন্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ আমাদের সরলপ্রাণ জনসাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঝাণ্ডার পিছনে একতাবদ্ধ রহিয়াছে। তাই আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠিবার প্রাক্কালে নেতৃবৃন্দকে ভিন্ন ভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত দেখিয়া তাহারা সুখী হইতে পারে নাই। তবে জনতার ঐক্যের দাবীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে অনতিবিলম্বে নেতারাও এক প্লাটফরমে একমন একপ্রাণ হইয়া একতাবদ্ধ হইবেন বলিয়া দেশবাসী আশা পােষণ করে।
গতকল্য ঢাকায় সরকারী দলের বাধাদান ও ভ্রান্ত প্রচারণা, পুলিশের লাঠিচার্জ, ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার এবং গণবিরােধী অসৎ ব্যক্তিদের হামলা ও নানা ধরনের প্ররােচনা সত্ত্বেও অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে হরতাল পালন, পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভায় কঠোর শপথ গ্রহণ এবং পরিশেষে লক্ষ কণ্ঠের গগন বিদারী শ্লোগানসহ বিরাট শােভাযাত্রা শহরের প্রধান প্রধান রাজপথ অতিক্রমের মধ্য দিয়া সাফল্যজনকভাবে দাবী দিবস উদযাপিত হয়।
সৰ্ব্বদলীয় সার্বজনীন ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে শহরের সকল শ্রেণীর জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজের মধ্যে ভােটাধিকার পুনরুদ্ধারের দাবী জ্ঞাপনের প্রবল উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয় এবং সৰ্ব্বত্র দোকানপাট, স্কুল-কলেজ ও যানবাহন বন্ধ রাখিয়া হরতাল পালন করা হয়।
কিন্তু সকাল ৯টা হইতে দুইজন প্রাদেশিক উজির নওয়াব হাসান আসকারী ও কাজী আবদুল কাদের এবং সরকার দলীয় কনভেনশন লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব আবদুল জব্বার খান চকবাজার, ইসলামপুর ও সদরঘাটে গমন করিয়া দোকানপাট খােলা রাখার আবেদন জানাইতে গিয়া নাজেহাল হন। নওয়াব হাসান আসকারী চকবাজারে গিয়া হুমকি দিয়া কতিপয় দোকান খুলিতে বাধ্য করেন কিন্তু তিনি চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথেই পুনরায় দোকানগুলি বন্ধ হইয়া যায়। অপর উজির কাজী কাদেরও ইছলামপুরে অনুরূপভাবে নাজেহাল হন। সদরঘাটে নওয়াব হাসান আসকারী এক অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হইয়া নাজেহাল হন।
ঐতিহাসিক শােভাযাত্রা
বৈকাল সাড়ে ৫টায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আউটার ষ্টেডিয়ামে এক বিরাট জনসমুদ্র বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে শােভাযাত্রাসহ নওয়াবপুর রােড হইয়া অগ্রসর হইলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। শােভাযাত্রায় প্রায় একলক্ষ লােক অংশ গ্রহণ করেন।
জনসভায় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা
গতকল্য বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভায় সভাপতি মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন যে, সার্বজনীন ভােটাধিকারের দাবী কোন ব্যক্তি বিশেষের বা কোন একটি রাজনৈতি দলের দাবী নহে, বরং দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের দাবী। সুতরাং একমাত্র গণ আন্দোলন দ্বারাই এই দাবী আদায় করিতে হইবে।
শেখ মজিবর রহমান
আওয়ামী লীগের সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীদের ভােটাধিকারের দাবী আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়িয়া তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করার আহ্বান জানান।
মওলানা তর্কবাগীশ
বক্তৃতায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বলেন, মৌলিক অধিকার ও সার্বজনীন ভােটাধিকার আদায়ের জন্য আমরা যে কোনাে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রহিয়াছি।
এছাড়াও জনাব মহীউদ্দীন আহমদ, মওলানা আবদুল আলী ও জনাব রফিকুল্লা চৌধুরীও সভায় বক্তৃতা করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!