You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.02.22 | একুশের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র পুনরায় প্রাণবন্যা | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪

‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’
মাতৃভাষার বীর শহীদানের আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্য
শ্রদ্ধাবনত প্রদেশবাসীর অগ্নি-শপথ
একুশের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র পুনরায় প্রাণবন্যা

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
ভাব-গম্ভীর ও বেদনা-বিধুর পরিবেশে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার তথা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আদর্শকে সমুন্নত রাখার ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান গতকল্য (শুক্রবার) অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর ‘শহীদ দিবস উদযাপন করে। ছাত্র-ছাত্রী, বালক-বৃদ্ধ, সাধারণ মানুষ, জননেতা প্রমুখ সকল শ্রেণীর নাগরিক দুঃখ-ভারাক্রান্ত অথচ গর্বোন্নত বক্ষে এই দিনে আবার নূতন করিয়া ১২বৎসর পূর্বে মাতৃভাষার জন্য প্রাণদানকারী বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করে। নূতন করিয়া তাহারা মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনের ওয়াদা গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের কন্দরে কন্দরে, পূর্ব পাকিস্তানীদের ঘরে ঘরে, মুখে মুখে, ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত, রণিত-অনুরণিত হইয়া উঠে “আমার ভাই-এর রক্তেরাঙা ২১শে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?”
সারা পূর্ব পাকিস্তান কোটি কণ্ঠের নয়- কোটি হৃদয়ের সমস্ত আকুলতা লইয়া ঘােষণা করে “নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” আর সেই সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠে শহীদ দিবসের বজ্রশপথ ‘বাংলা ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে, ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটি দিতে হবে, কণ্ঠরােধ করা। চলবে না, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’…।
নগ্নপদে প্রভাত ফেরী, কবর জিয়ারত, শহীদ-কবরে ও মিনারে পুস্পাঞ্জলি প্রদান, শােক-সূচক কালাে পতাকা উত্তোলন প্রভৃতির মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারী আরও ঘােষণা করে বীরের আত্মদান, মাতার অশ্রুধারা,ভাইবােনের বুকফাটা আর্তনাদ ব্যর্থ হয় নাই।
পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা-ভাষী সাড়ে ৫কোটি মানুষ মায়ের ভাষার যােগ্য মর্যাদার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী বীর শহীদদের ভুলে নাই, ভুলিবে না, ভুলিতে পারে না। তারা চিরস্মরণীয়, চির-বরণীয়। মরিয়াও তারা এদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় চির-অমর।
২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রভাতসূর্য
রাত্রির তমিস্রা বিদায়ের পরেই ঢাকা শহরের সকল অঞ্চল হইতে কালােপতাকা, পােষ্টার প্রভৃতি সম্বলিত নগ্নপদ প্রভাত ফেরীর মাধ্যমে। গতকল্য শহরে শহীদ দিবস পালনের সূচনা হয়। প্রত্যুষে বালক-বালিকা, নারী-পুরুষের সম্মিলিত কণ্ঠে প্রভাত ফেরীর গানে ঢাকা শহরের ঘুম ভাঙ্গে। মহল্লায় মহল্লায় ছেলে-বুড়া, যুবক-যুবতী ও নারী-পুরুষ প্রভাতী গান গাইতে গাইতে নগ্নপদে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদানের কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে আজিমপুর গােরস্থানের দিকে ধাবিত হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীগণ নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শােক-সূচক কালােপতাকা উত্তোলন করিয়া কালােপতাকা, বিভিন্ন দাবী সম্বলিত পােষ্টার ও পুষ্পমাল্য হস্তে দলবদ্ধভাবে আজিমপুরের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ভােরের আলাের পুতপবিত্র পরিবেশে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও ছেলে-বুড়া আজিমপুর গােরস্থানে সমাহিত ভাষা আন্দোলনের শহীদানের কবর জেয়ারত ও তথায় পুষ্প ও পুস্প্যমাল্য প্রদান করে। শহরবাসীর অর্ঘ্যমাল্য ও পুস্প্যে শহীদানের প্রত্যেকটি কবর ঢাকিয়া যায়। ছাত্রজনতা, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ছাড়া রাজনৈতিক নেতাগণও এইদিন শহীদানের কবর জেয়ারত ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী পূর্বদিন ঢাকা আসিয়া পৌঁছেন। তিনি অতি প্রত্যুষে শহীদানের কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে আজিমপুর গােরস্থানে উপস্থিত হন। অন্যান্য জননেতার মধ্যে মেসার্স আতাউর রহমান খান, মওলানা তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, জহিরুদ্দিন, তাজুদ্দিন, মহিউদ্দিন, নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও মােহাম্মদ সােলায়মান প্রমুখ শহীদানের কবর জেয়ারত ও পুষ্পমাল্য প্রদান করেন। বহু উর্দু ভাষাভাষীও এইদিন শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানসমূহে অংশগ্রহণ করেন। আঞ্জুমানে তরঙ্গী উর্দু সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে শহীদ মাজার ও মিনারে পুষ্পমাল্য প্রদান করা হয়। উর্দু ভাষাভাষী এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও সদস্যরা মিছিল ও শহীদ মিনারের সাধারণ সভায় অংশ গ্রহণ করেন এবং দাবী-দাওয়া সম্বলিত উর্দু ভাষায় লিখিত পােষ্টার বহন করেন। অনুমান ৭টায় আজিমপুর হইতে ছাত্র-জনতার বিরাট মিছিল শুরু হয়। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, তাজুদ্দিন, মহিউদ্দিন প্রমুখ মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন। মিছিলের পুরােভাগে থাকিয়া কিছু লােক বীরগাঁথা গাহিয়া মিছিলটি আগাইয়া লইয়া যান। মিছিলটি আজিমপুর হইতে আরম্ভ হয় এবং নিউমার্কেটের সম্মুখ মােড়, নীলক্ষেত রােড, ছাত্রী হলের সম্মুখ দিয়া আইয়ুব এভেনিউ, বাংলা একাডেমী, হাইকোর্ট গেট, সেগুন বাগিচা, ইডেন বিল্ডিংস সেকেণ্ড গেট, জেনারেল পােষ্ট অফিসের পাশ দিয়া জিন্নাহ এভেনিউ, রমনা টেলিগ্রাফ অফিস, রেলওয়ে হাসপাতাল, টিবি, ক্লিনিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখ দিয়া মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে শহীদ মিনারে উপনীত হয়। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া মিছিলটির শহীদ মিনারে পৌছিতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে। মিছিলের আগে আগে ট্রাফিক পুলিস সুচারুভাবে রাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে। এই দিন শােভাযাত্রার আগে পিছে আর কোন পুলিস ছিল না। শহীদ মিনারে পৌছিয়া মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে শহীদ মিনারের পাদদেশে পুষ্প প্রদান করা হয়। গােপীবাগ কর্মীদের পােষ্টার ও কমলাপুর পূর্বাঞ্চল পরিষদের বাংলা বর্ণমালা লিখিত পােষ্টার মিছিলের শােভা বর্ধন করে।
শহীদ মিনারের পাদদেশে
বেলা সােয়া ৯টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে একুশে’র মহতী জনসভায় বিভিন্ন বক্তা ভাষা-আন্দোলনের শহীদানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শেখ মুজিব
শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্ম-ইতিহাসের উল্লেখ করিয়া বলেন, ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাগে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করিয়া তকালীন গণপরিষদে একটি আইন পাসের জন্য করাচীতে ষড়যন্ত্র চলিতে থাকে। শাসন ও ভয়-ভীতি উপেক্ষা করিয়া ১১ই মার্চ উহার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠে। তিনি প্রকাশ করেন যে, সেই সময় বহু ছাত্র ও কর্মী পুলিসের হাতে আহত ও গ্রেফতার হয়। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্পাদক আরও ঘােষণা করেন যে, ভাষা আন্দোলন স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবী আদায়ের জন্য সাড়ে ৫ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর আন্দোলন। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কর্মী অত্যাচারিত হইয়াছেন ও জেল খাটিয়াছেন।
শেখ মুজিবর রহমান আবেগজড়িত কণ্ঠে সালাম-বরকতের নাম উল্লেখ করিয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। তিনি বলেন, জনগণের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, আদালতের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হইয়াছে। শেখ মুজিবর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে কঠোর ত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রাম করিতে হইবে। জনগণের মৌলিক অধিকার, সার্বজনীন ভােটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম অব্যাহত রাখার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। পরিশেষে, দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগ সম্পাদক ছাত্রদের প্রতি নেতৃত্ব দানের আহ্বান জানান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব