আজাদ
২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৩
সীমাবদ্ধ ভােটাধিকারের অনিবার্য পরিণতি-
উপনির্বাচনে সরকারী শাসনযন্ত্রকে বেআইনীভাবে ব্যবহারের অভিযোগ
শেখ মুজিব কর্তৃক অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবী
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা ও সাবেক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব শেখ মুজিবর রহমান খুলনা ও গােপালগঞ্জের উপনির্বাচনী এলাকা সফরান্তে গতকল্য ঢাকার এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে উপনির্বাচনে বেআইনীভাবে শাসনযন্ত্র ও সরকারী কাজে লাগানাে, দুর্নীতি এবং ভােটারদের ভীতি প্রদর্শনের গুরুতর অভিযােগ আনয়ন করেন। শেখ মুজিবর রহমান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপনিৰ্বাচনে সরকারী কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ, ব্যাপক দুর্নীতি ও নানারূপ ভীতি প্রদর্শন করিয়া জোর জবরদস্তিমূলক ভােট আদায়ের কৌশল অবলম্বনের গুরুতর অভিযােগ আনয়ন করিয়া প্রেসিডেন্টকে এই অভিযােগগুলির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি সমবায়ে গঠিত একটি কমিশন নিয়ােগ করিয়া বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবী জানান।
ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জের উপনির্বাচনী এলাকা সফর করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর গতকল্য শুক্রবার অপরাহ্নে শেখ মুজিবর রহমান তাহার ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন উপনির্বাচনী এলাকায় সরকারী কর্মচারীদের ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের অভিযােগ আনয়ন করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, সীমাবদ্ধ ভােটাধিকারের সুযােগ লইয়া শাসন কর্তৃপক্ষ মৌলিক গণতন্ত্রীদের নানারূপ হয়রানী ও ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন। তিনি খুলনা ও গােপালগঞ্জের উপনির্বাচনী এলাকায় জনাব সবুর ও জনাব ওয়াহিদুজ্জামানের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ প্রদান করিয়া বলেন যে, প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হইলে তাহাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হইবে। যদি জামানত বাজেয়াপ্ত না হয় তবে তিনি ঘােষণা করেন যে, তিনি ও তার দল সেক্ষেত্রে আগামী ৫ বৎসর পর্যন্ত বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য করিবেন না।
শেখ সাহেব বলেন যে, তিনি ১৯৪১ সালের নাটোর বালুরঘাট এলাকার উপনির্বাচন হইতে শুরু করিয়া বহু নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু বর্তমানের উপনির্বাচনে যেসব কৌশল অবলম্বন করা হইতেছে তাহাকে তিনি ইতিহাসে নজিরবিহীন বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, সরকারী কর্মচারীগণ নির্বাচনে সাধারণতঃ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করিবেন। ইহার সকলের কাম্য হইলেও বর্তমানে নানাস্থানে সরকারী কর্মচারীগণই সরকারী দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাইতেছেন এবং মৌলিক গণতন্ত্রীদের নানারূপ ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন। তিনি আরও অভিযােগ করেন যে, সরকার দলীয় প্রার্থী মনােনয়নের ব্যাপারে সরকারপক্ষীয় কনভেনশন মােছলেমলীগের প্রধান সংগঠক বা কর্মকর্তাগণ কোন ঘােষণা প্রকাশ করিতেছেন না বা তাহাদিগকে নিৰ্বাচনী এলাকায় কোন প্রচার চালাইতে সভা-সমিতি করিতে বা বিবৃতি দিতে দেখা যাইতেছে না। বরং গবর্ণর তাহার উজিরগণ এবং নানা জায়গায় সরকারী কর্মচারীগণই নিৰ্বাচনে প্রচারকার্য চালাইতেছেন।
বর্তমান ব্যবস্থায় গবর্ণর ও তাহার উজীরগণ শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারী মাত্র। সুতরাং গবর্ণর স্বয়ং যদি নির্বাচনী প্রচারকার্য পরিচালনা করেন তবে সেক্ষেত্রে স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদেরও তদনুযায়ী কাজ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কতিপয় সরকারী কর্মচারীকে তিনি এই ব্যাপারে প্রশ্ন করিলে তাহাদের কেহ কেহ শেখ সাহেবকে জানাইয়াছেন যে, গবর্ণরের অধীনে তাহারা চাকুরী করেন সুতরাং গবর্ণরের নির্দেশক্রমেই তাহাদিগকে কাজ করিতে হয়। ফলে অবস্থা এই দাড়াইয়াছে যে, বর্তমানের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দল বা প্রার্থীদের মধ্যে নহে, বরং জনসাধারণ ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে হইতেছে।
শেখ মুজিবর রহমান অভিযােগ করেন যে, বিভিন্ন আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৫খানা বৃহদাকার সরকারী লঞ্চ গােপালগঞ্জ এলাকায় সরকার দলীয় প্রার্থীর প্রচারকার্য্যের জন্য নিয়ােজিত করা হইয়াছে। এইসব লঞ্চ ছাড়াও উজিরগণ ব্যক্তিগতভাবে রিকুইজিশন দিয়া অন্যান্য লঞ্চ ও ৬টি স্পীডবােট এই কাজে লাগানাে হইয়াছে। তদুপরি স্থানীয় মহকুমার শাসন কর্তৃপক্ষ মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিকট বিজ্ঞপ্তি জারী করিয়া আলােচনা বৈঠকের নামে নির্বাচনের ৩/৪ দিন পূর্বে এই সকল বৃহদাকার লঞ্চে সমবেত করার প্রচেষ্টা করা হইতেছে। এইরূপ আশঙ্কা করা হইতেছে যে, লঞ্চে উঠাইয়া তাহাদের আটক করা হইবে ও অন্য এলাকায় লইয়া যাওয়া হইবে।
তিনি আরও অভিযােগ করেন যে, আগামীকল্য রবিবার পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের একটি আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ওয়াপদা, টেলিফোন বিভাগ এবং বাণিজ্য ও শিক্ষা দফতরের সরকারী কর্মকর্তাগণের এক বিরাট দল গােপালগঞ্জ গমন করিতেছেন। তথায় মাত্র ২৫টি টেলিফোন লাইনের এক্সচেঞ্জ উদ্বোধনের অজুহাতে তাহারা গমন করিবেন, অথচ ইতিপূৰ্ব্বে অন্যান্য এলাকায় ৫০টি লাইনের এক্সচেঞ্জ উদ্বোধনকালে ইহারা গমন করেন। নাই বা সরকারী অর্থ এইভাবে অহেতুক অপচয় করেন নাই। এছাড়া কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতর গােপালগঞ্জে বর্তমানে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য উজির জনাব ওয়াহিদুজ্জামানের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে একটি ক্ষুদ্রকায় অফিস স্থাপন করা হইয়াছে। এছাড়াও দলীয় কৃপাভাজন ব্যক্তিদের মাঝে সমানে জিরা, গােলমরিচ, শুপারী ও পানের পারমিট বিতরণ করা হইতেছে। সরকারী অর্থ লইয়া ছিনিমিনি করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব