You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
২১শে অক্টোবর ১৯৬৩

শেখ মুজিব বলেন-
আর সংখ্যাসাম্য নয় ৪ শতকরা ৫৬ ভাগ অংশ পূর্ব পাকিস্তানকে দিতে হইবে

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
অধুনালুপ্ত প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য রবিবার তাহার বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘকালব্যাপী অনুসৃত নীতির ফলে বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তান একটি উপনিবেশে পরিণত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, এই অবস্থা হইতে পরিত্রাণের জন্য আমাদের আন্দোলন করিতে হইবে।
শেখ মুজিব পূৰ্ব্ব পাকিস্তানীদের অর্থে গড়িয়া উঠা কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গণভােট দাবী করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত বলেন যে, গণভােট গ্রহণ করা হইলে একটাও পূৰ্ব্ব পাকিস্তানী উহার স্বপক্ষে ভােট দিবে না।
তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযােগ করিয়া বলেন যে, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া ফেলার জন্য এই সরকার উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। “ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল হইতে পরিত্রাণ লাভের জন্য আন্দোলন শুরু করার প্রশ্নে তিনি বলেন যে, ইহার অর্থ এই নয় যে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে চাই। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত একতাবদ্ধ থাকিয়া আমরা আমাদের ন্যায্য দাবী আদায় করিয়া লইতে চাই।
শেখ মুজিব আরও বলেন যে, আমরা আমাদের ন্যায্য অংশ ও ন্যায্য বিচার চাই। দেশের শতকরা ৫৬ ভাগ লােকের বাস পূর্ব পাকিস্তানে। সুতরাং জাতীয় সম্পদের শতকরা ৫৬ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানীকে দিতে হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৫৬ ভাগ অংশ দিতে হইবে।
তিনি অভিযােগ করেন যে, জাতীয় সম্পদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ক্ষেত্রে সকল সুবিধা হইতে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হইয়াছে।
করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, উহাতে করাচীর রাজস্ব হইতে কেন্দ্রীয় সরকারকে এবং তাহার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হইয়াছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, এই করাচী মহানগরীকে নির্মাণ করিতে পূৰ্ব্ব পাকিস্তানী জনসাধারণ নিজের মুখের গ্রাস দান করিয়াছে। জনমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন।
তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করার জন্য সরকারকে দায়ী করিয়া বলেন যে, যেহেতু এই আন্দোলন সমাজের বুদ্ধিজীবী তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্বারাই পরিচালিত হইতেছে, সেই জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূলােচ্ছেদ করার কাজে তাহারা কোমর বাঁধিয়া লাগিয়াছেন।
শেখ মুজিবর রহমান অতঃপর বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে যেমন এক শ্রেণীর মুষ্টিমেয় কোটিপতি ধনিক এবং অপরদিকে কোটি কোটি সৰ্বহারা মানুষের সমাজ ব্যবস্থা কায়েম রহিয়াছে, তেমনি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীর বিলুপ্ত করিয়া অনুরূপ দুই শ্রেণীর সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার ষড়যন্ত্র করা হইতেছে।
কেন্দ্রীয় রাজধানীর প্রশ্নে তিনি পুনরায় বলেন যে, করাচী হইতে রাজধানী এছলামাবাদে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। এই নয়া রাজধানী নিৰ্মাণ করিতে ৫শত কোটি টাকা ব্যয় হইবে। যখন পূর্ব পাকিস্তানে টাকার অভাবে বন্যানিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকরী করা যাইতেছে না, সেই সময়ে অনাবশ্যকভাবে নয়া কেন্দ্রীয় রাজধানী নির্মাণের জন্য এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অপব্যয়ের কি অর্থ হইতে পারে? তিনি ইহাকে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার একটা ফন্দি বলিয়া অভিহিত করেন।
জনাব মুজিবুর রহমান বলেন যে, বর্তমান সরকার জনমতের সহিত খেলা করিতেছেন। এখনও সঠিক পথে আসিলে তাহাদের বহু মূল্য দিতে হইবে। আওয়ামী লীগের বিঘােষিত ‘সমতা রক্ষার কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, তাঁহারা উভয় প্রদেশের প্রতিনিধিত্বের সমতা মানিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু এই মানার পিছনে লিখিত চুক্তি ছিল যে, জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে কেবল পরিষদের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রেই নয়- পূৰ্ব্ব পাকিস্তানকে সমান ভাগ দিতে হইবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ কেবল মাত্র পরিষদের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা স্বীকার করিয়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, এখন আর কেবলমাত্র সমতা রক্ষার শ্লোগান উঠাইলে লাভ হইবে না;- পূৰ্ব্ব পাকিস্তানকে সকল বিষয়ে শতকরা ৫৬ ভাগ অংশ দিতে হইবেঃ
উভয় প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ অনেকাংশে দায়ী বলিয়া প্রাদেশিক গবর্ণর জনাব আবদুল মােনায়েম খান সম্প্রতি যে অভিযােগ করিয়াছেন, তাহার উল্লেখ করিয়া জনাব মুজিবুর রহমান গবর্ণর ছাহেবকে সরকারী নথিপত্র ঘাটিয়া সত্যতা যাচাইয়ের উপদেশ দেন। তিনি দাবী করেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালেই সর্বপ্রথম উভয় প্রদেশের বৈষম্যের কথা উল্লেখ করা হয় এবং উহা দূর করার নীতি গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে বিরােধী দলসমূহের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, ইহার দ্বারা যে কেহ মনে না করেন যে, আমরা বর্তমান শাসনতন্ত্রকে গ্রহণ করিয়াছি। পক্ষান্তরে, আমরা বিশ্ববাসীকে দেখাইতে চাই যে, আয়ুব শাসনতন্ত্র কোন অবস্থাতেই গ্রহণযােগ্য নয়। তিনি বলেন যে, এই নির্বাচন কোন নির্বাচনই নয়। কিছু সংখ্যক ভােটার থাকায় নির্বাচনে যাহারা অধিক টাকা ব্যয় করিতে পারে তাহাদেরই জয় লাভের সম্ভাবনা থাকে। তিনি গােপালগঞ্জের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, এই নির্বাচন কেন্দ্রে অধিকাংশ ভােটার হইতেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােক। তাহাদের উপর সত্যিকার নানাপ্রকার চাপ প্রয়ােগ করিয়া একপ্রকার বলপূর্বক ভােট আদায় করার ফলেই এই কেন্দ্রের সরকারী প্রার্থী জয়লাভ করিয়াছেন। তিনি দাবী করেন যে, সংখ্যালঘু বাদে মুছলমান ভােটারদের শতকরা ৯০ ভাগ ভােট বিরােধীদলের প্রার্থী পাইয়াছেন।
ইহাছাড়া, সরকার পক্ষ নির্বাচনী প্রচারে সরকারী মানবাধিকার, ষ্টীমার, লঞ্চ, মােটর বােট ব্যবহার করিয়াছেন। গােপালগঞ্জের এস, ডি, এ’র তৎপরতার তীব্র নিন্দা করিয়া জনাব রহমান বলেন যে, প্রকাশ্যেই সরকারী প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালান।
শেখ মুজিবর রহমান গতকাল রবিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােপালগঞ্জের উপনির্বাচন সম্পর্কে তদন্ত করার উদ্দেশ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন নিয়ােগের জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নিকট আবেদন জানান।
তিনি গােপালগঞ্জ নিৰ্বাচন কেন্দ্র হইতে গত শনিবার প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারী শাসনযন্ত্র প্রত্যক্ষভাবে সরকারী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালায়। তিনি বলেন যে, সরকারী কর্মচারী এবং সরকারী যানবাহন এই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। অবিলম্বে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন নিয়ােগের দাবী জানান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!