You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
২১শে অক্টোবর ১৯৬৩

গণদাবীর প্রতি ক্রমাগত উপেক্ষার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি
পূর্বাপর পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে শেখ মুজিব কর্তৃক বাস্তব অবস্থা ব্যাখ্যা
উপনির্বাচনে সরকারী হস্তক্ষেপের ব্যাপকতা বিশ্লেষণ

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
“পরিস্থিতির নিদারুণ পরিণতিতে আজ আমরা বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইতেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান একটি উপনিবেশে পর্যবসিত হইয়াছে এবং এই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতে হইলে আমাদের অবিরাম সংগ্রাম করিয়া যাইতে হইবে। জনসাধারণের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া এবং দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খা এবং দাবী-দাওয়ার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন। করিয়া সরকার যে খেলায় মাতিয়াছেন, তাহা আগুন লইয়া খেলারই নামান্তর এবং এই খেলার পরিণতি অবশ্যই আজিকার রাষ্ট্র নায়কদের ভােগ করিতে হইবে।
গতকল্য (রবিবার) ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবর রহমান উপরােক্ত মন্তব্য করেন। গত চার সপ্তাহ গােপালগঞ্জের নির্বাচনী কেন্দ্রে কর্মব্যস্ততার মধ্যে যাপন করিয়া তিনি গত শুক্রবার ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
গােপালগঞ্জে জাতীয় পরিষদের একটি শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানকালে গভর্নর হইতে শুরু করিয়া অধস্তন সরকারী কর্মচারীরা পর্যন্ত কি ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। ভােটারদের বিশেষ করিয়া সংখ্যালঘু ভােটারদের কি জঘন্যভাবে ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন তাহার এক নগ্নচিত্র তুলিয়া ধরিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, সীমিত ভােটাধিকার এবং তথাকথিত গণতন্ত্রের আমলেও অত্যল্প সংখ্যক ভােটার পর্যন্ত স্বাধীনভাবে ভােট দিতে সমর্থ হন নাই।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পাঁচটি কাজের উপর রাষ্ট্রের পরিচালনাকার্য নির্ভরশীল, সেই পাঁচটির কোনটাতেই পূর্ব পাকিস্তানের যথাযথ অংশ নাই।
কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, কেন্দ্রীয় রাজধানী, পুঁজি গঠন, সৈন্যবাহিনী এবং রাজনৈতিক সমতা- এই পাঁচটি বিষয়কে শেখ মুজিব রাষ্ট্র পরিচালন ক্ষেত্রের পাঁচটি স্তম্ভ হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীর শতকরা ৯০ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানী সাবেক কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত করা হইয়াছে, নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়া পাকিস্তানের সংগঠিত পুঁজির সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের করায়ত্ত করা হইয়াছে, সৈন্যবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত নগণ্য এবং দেশবাসীর রাজনৈতিক অধিকারও আজ নাই।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, এই পাঁচটি স্তম্ভের চারটিতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের কোন অধিকার নাই এবং ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র অধিকার ছিল রাজনৈতিক অধিকার- তাহাও আজ আর নাই।
শেখ সাহেব বলেন যে, এই পরিস্থিতিতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্র পরিচালন ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের আজ আর কোন অংশ নাই। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল অর্থের বিনিময়ে যে করাচী গড়িয়া উঠিয়াছিল, জনাব মােনেম খানের মন্ত্রী-পরিষদ উহার পশ্চিম পাকিস্তানভুক্তি স্বীকার করিয়া লইয়া পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে ছুরিকাঘাত করিয়াছেন। সরকারের যদি ন্যূনতম সততাও থাকিয়া থাকে, তবে করাচীর পশ্চিম পাকিস্তানভুক্তির প্রশ্নে একটি গণভােট অনুষ্ঠানের জন্য শেখ মুজিব সরকারের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জদান করেন।
আন্তঃপ্রাদেশিক সাম্যের অর্থ কি?
শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় আন্তঃপ্রাদেশিক সাম্যের প্রশ্নটি যেভাবে পালিত হইতেছে, তাহাতে আজ আর সংখ্যাসাম্য মানিয়া নেওয়া যায় না। তিনি সরকারকে স্মরণ করাইয়া দিয়া বলেন যে, আন্তঃপ্রাদেশিক সংখ্যাসাম্য অর্থে শুধু জাতীয় পরিষদে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি থাকায়ই বুঝায় না, সংখ্যাসাম্যের অর্থ জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে সমান অংশ। এই পর্যায়ে শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অনুন্নত অর্থনীতিকে সর্বপ্রকারে সঞ্জীবিত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের অগ্রসর অর্থনীতির সমকক্ষ করার জন্য সরকারী সাহায্য যাহাতে প্রচুর পরিমাণে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণের ব্যবস্থা থাকে, সেই ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বনের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি পত্রস্বাক্ষরের মধ্য দিয়াই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ১৯৫৫ সালের জুন মাসে আন্তঃপ্রাদেশিক সংখ্যাসাম্য মানিয়া লইয়াছিলেন।
মধ্যবিত্ত সমাজ ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র
বর্তমান কর ধার্য করার রীতিনীতির তীব্র সমালােচনা করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, বর্তমান কর ধার্য নীতির মধ্য দিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মেধার মেরুদণ্ড মধ্যবিত্ত সমাজকেই ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছেন। তিনি বলেন যে, আজ সরকারের করনীতির ফলে ৩০ বিঘার কম জমিওয়ালারা কিছুতেই তাহাদের সংসার চালাইতে সক্ষম নন। তাছাড়া ওয়াপদা যে সকল অঞ্চলে খাল খনন করিয়াছে, সেইসব অঞ্চলে বিঘা প্রতি ২৫ টাকা করিয়া কর চাপাইয়া দিয়া সরকার কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছেন বলিয়া শেখ মুজিব অভিযােগ করিয়াছেন। শিল্প ক্ষেত্রে প্রচলিত কর মওকুফের প্রথার মত ৩০ বছরের জন্য ৩০ বিঘা কম জমিওয়ালা চাষীদের ভূমি রাজস্ব মওকুফ করিয়া দিয়া দেশে কৃষি ব্যবস্থা সুষ্ঠু এবং সমর্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শেখ মুজিব দাবী জানাইয়াছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবর রহমান একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেনঃ আমার মহকুমা গােপালগঞ্জে উপনির্বাচন হইয়া গেল। উহার ফলাফলও প্রকাশিত হইয়াছে। গােপালগঞ্জে কর্মব্যস্ত চারটি সপ্তাহ যাপন করিয়া সবে আমি ঢাকায় ফিরিয়া আসিয়াছি।
আপনাদের হয়তাে স্মরণ আছে যে, এই সেদিন আমি সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, অগণতান্ত্রিক এবং অসদাচরণে লিপ্ত হওয়ার অভিযােগ করিয়াছিলাম। সেবার আমি বলিয়াছিলাম যে, উপনির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করাইলেও কনভেনশন লীগের কর্মকর্তারা বিস্ময়করভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অনুপস্থিত থাকিতেছেন, আর নির্বাচনী প্রচারণা বা তৎপরতা বলিতে যা কিছু সবই স্বয়ং গভর্নর ও তাঁহার অধঃস্তন কর্মচারীরাই পরিচালনা করিতেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় বেপরােয়া সরকারী যানবাহন ব্যবহারের কথাও আপনাদের বলিয়াছি।।
সংখ্যালঘুদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন
যাহাদের হাতে আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ন্যস্ত, তাহারাই আবার কিভাবে ভােট বাগানাের জন্য সংখ্যালঘুদের ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন তাহাও আমি আপনাদের বলিয়াছি। গােপালগঞ্জের রিটার্নিং অফিসার এবং এস,ডি,ওর (একই ব্যক্তি) কার্যকলাপ সম্পর্কে তদন্তের জন্য নির্বাচনী কমিশনের সদস্যদের আমি গােপালগঞ্জ সফরের আমন্ত্রণও জানাইয়াছিলাম। উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিচর বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিশন দ্বারা নির্বাচন প্রাক্কালীন অবস্থা তদন্তের জন্যও প্রেসিডেন্টের কাছে আমি দাবী জানাইয়াছিলাম। গত ২৭শে সেপ্টেম্বরে আপনাদের মারফত আমি দেশ ও জাতির কাছে মােটামুটিভাবে এই কয়টি কথাই তুলিয়া ধরিতে চাহিয়াছিলাম।
স্বীকার করিয়াও অস্বীকার?
আনন্দের কথা যে, গভর্নর এবং পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন লীগের প্রধানসংগঠক আমার সে অভিযােগগুলি হিসাবে আনিয়াছেন এবং কয়েকটি অভিযােগের সত্যতার স্বীকৃতি দিয়া উহার যৌক্তিকতা জাহির করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট বলিয়াছেন যে, মন্ত্রীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করিতে পারিলে গভর্নররা পারিবেন না কেন, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন না। আমি দুঃখিত,কারণ প্রেসিডেন্টের যুক্তি বা উপসংহার কোনটার সহিতই আমি একমত হইতে পারিতেছি না। আমার মনে হয়, যে দ্রলােকেরা প্রেসিডেন্টের ভাষণ প্রস্তুত করিয়াছেন তাঁহাদের চিন্তাধারা তালগােল পাকাইয়া গিয়াছে। কে না জানে যে, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট নিজ ইচ্ছানুযায়ী তাঁহাকে কেবল পরামর্শ দেওয়ার জন্যই মন্ত্রী নিয়ােগ করিয়া থাকেন এবং মন্ত্রিগণও কেবল প্রেসিডেন্টের কাছেই দায়ী থাকেন। অপরপক্ষে, পার্লামেন্টারী পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রিগণ পরিষদের কাছে তথা জনগণের কাছে দায়ী থাকেন।
জনগণের প্রতি গভর্নরের দায়িত্ব
প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসনে গভর্নর জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং জনগণের কাছে দায়ী থাকেন। তাই জনসাধারণের কাছে হাজির হওয়ার অধিকারও তাঁহার থাকে। কিন্তু পাকিস্তানে অবস্থা অন্যরূপ।
এখানে গভর্নর প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত। তাই জনগণের সামনে হাজির হওয়ার কোন অধিকার তাহার নাই। আসল কথা হইতেছে যে, তিনি জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতাসীন হন, তিনিই তাহার ভােটরদের কাছে হাজির হইতে পারেন, কেননা সেই ভােটাররাই তাঁহার ক্ষমতার উৎস। কিন্তু, প্রশাসনিক প্রধান কর্তৃক যিনি নিযুক্ত তিনি শুধু প্রশাসক হিসাবেই কার্য পরিচালনা করিতে পারেন।
এদিকে সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করিয়া বর্তমানে যে সার্কুলার জারি করা হইয়াছে, মহকুমা হাকিম, ডেপুটি কমিশনার, কমিশনার এবং প্রায় পুলিস কর্মচারীদের সরকারী দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী সভাসমিতিতে হাজির থাকা এবং অংশগ্রহণের মধ্য দিয়া উহাই আবার বাতুলতায় পর্যবসিত হইয়াছে।

গভর্নরের স্বীকারােক্তি
গভর্নর স্বয়ং এবং তাহার কর্মচারীরা যে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, একথা তিনি অস্বীকার করিতে পারেন নাই। অধিকন্তু ১৯১৭ সালে পটুয়াখালির নির্বাচনে স্যার নাজিমুদ্দিন অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া যুক্তি দেখাইতে গিয়া প্রকারান্তরে তিনি উপনির্বাচনে নিজ হস্তক্ষেপের কথাই স্বীকার করিয়াছেন এবং উহার যৌক্তিকতা জাহিরের জন্যই স্যার নাজিমুদ্দিনের দোহাই দিয়াছেন। গভর্নর সাহেবের এ যুক্তি যেমন উদ্ভট তেমনি আজগুবী। যুক্তিটি অনেকটা জনৈক অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের মতই চুরির অপরাধে ধৃত হইয়া বিচারার্থ আদালতে নীত হইলে সে পাল্টা অভিযােগ করে যে, তাঁহার মত আরও কত লােক চৌর্যকর্মে লিপ্ত রহিয়াছে অথচ তাহাদের কাহাকেও ধরাও হয় নাই বা কারাগারেও নেওয়া হয় নাই, অতএব তাহার বিচার চলিতে পারে কোন যুক্তিতে। গভর্নর তাঁহার সাম্প্রতিক এক বক্তৃতার মধ্য দিয়া প্রকারান্তরে একথাই স্বীকার করিয়াছেন যে, সবসময় অগণতান্ত্রিক কাজকর্মেই তিনি বিশ্বাসী। তিনি আরও স্বীকার করিয়াছেন যে, তাহার তদানীন্তন গুরুর নির্দেশে তাঁহারই নিজ জেলা ময়মনসিংহে তিনি বিরােধীদলের নেতৃবৃন্দকে সভা করিতে দেন নাই এবং তাঁহার তৎকালীন নেতা জনাব নূরুল আমীনকে রক্ষার জন্য তিনি নিজেই লাঠি লইয়া গুণ্ডামি করিয়াছেন। বলাবহুল্য, সে লাঠি তিনি ব্যবহার করিয়াছিলেন তাঁহার নিজ জেলাবাসীরই উপর। বস্তুত: এই সব নজির উপস্থাপিত করিয়া গভর্নর বিশ্বের দরবারে এই কথাই প্রতীয়মান করিতে সমর্থ হইয়াছেন যে, তিনি সৎ রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাদিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি শুধু প্রভুর খেদমতই করিতে জানেন এবং যখন যিনিই তাহার প্রভু হউন না কেন, তাঁহার জন্য তিনি সবকিছুই করিতে পারেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তবে কি এইসব গুণের জন্যই তাঁহাকে গভর্নর নিযুক্ত করা হইয়াছে।
এক জেলায় অতীতে তিনি যে সব অপকর্ম করিয়াছেন, আজ প্রদেশের অপর ১৬টি জেলায়ও উহা সম্প্রসারিত করার জন্যই কি তিনি আদিষ্ট হইয়াছেন, যাহাই হােক, তিনি যে খােলাখুলিভাবে স্বীকারােক্তি করিয়াছেন, তজ্জন্য আমি তাহাকে অভিনন্দনই জানাই।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে গভর্নর
গভর্নর সম্প্রতি যে কতিপয় কুৎসা প্রচার করিয়াছেন সে সম্পর্কে কিছু না বলিয়া পারিতেছি না, আন্তঃপ্রাদেশিক বৈষম্যের আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার মনে যাহাতে সন্দেহের অবকাশ না থাকিতে পারে তার জন্য আমি তাহাকে সরকারী দলিল-দস্তাবেজ ঘাটিয়া দেখার পরামর্শ দিতেছি। মাত্র দুই বত্সর স্থায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় কোষাগার হইতে বৃহত্তর অংশ আদায়ে সক্ষম হয়। এই সময়েই প্রদেশদ্বয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীকরণের জন্য অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সরকারী মুদ্রা বরাদ্দ করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়।
ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানার্থ আমরা কেবল সকল রাজবন্দীকেই মুক্তি দান করি নাই, বরঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর চাপ সত্ত্বেও তাহাদের পুনরায় গ্রেফতার করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিয়াছি এবং নিরাপত্তা আইন বাতিল করিয়াছি। এশিয়া বা আফ্রিকার কোন দেশেই এমন করিয়া নিরাপত্তা আইন বাতিল করা সম্ভব হয় নাই। জনগণের উপর আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস সর্বদাই সুস্পষ্ট এবং সেজন্য আমরা গর্বিতও।
বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ সরকারের এইসব এবং অন্যান্য প্রগতিশীল পদক্ষেপ পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করিয়া তথাকার শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য কায়েমীস্বার্থীসহ প্রতিক্রিয়াশীল মহলে ক্রোধাগ্নির সঞ্চার করে। সরকারের পতন ঘটাইবার পক্ষে ইহাদের শক্তির কথা কাহারও অজানা নাই।
সেই ৮০ জনের একজন
সার্বভৌম সংস্থা গণপরিষদের সদস্যরূপে সাত বত্সর যাবৎ পাকিস্তানকে যাহারা শাসন করিয়াছেন, সেই ৮০ জনের মধ্যে জনাব মােনায়েম খান অন্যতম। তিনি তদানীন্তন সরকারের সকল কাজকেই সমর্থন দান। করিয়াছিলেন এবং তাহারই পরিণতি স্বরূপ দেশের দুই অংশের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং দেশকে শাসনতন্ত্র প্রদানে যাঁহারা অসম্মতিজ্ঞাপন করিয়াছিলেন জনাব মােনায়েম খান তাঁহাদের অন্যতম। যে চক্রটি দেশে তাঁহাদের শাসন চিরস্থায়ী করার গভীর ষড়যন্ত্র করিয়াছিল তিনিও যে তারই অন্যতম অংশীদার ছিলেন, একথা কি তিনি অস্বীকার করিতে পারেন?
উপনির্বাচনের কি ও কেন
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শাসনতন্ত্রের কতিপয় সংশােধনী সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বিধিবহির্ভূত ঘােষণার পর বিরােধী দলসমূহ উপনির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিরােধী দলের এই সিদ্ধান্ত ঘােষণার অব্যবহিত পরেই মন্ত্রী ও গভর্নরদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের অনমুতি দিয়া প্রেসিডেন্ট নয়া অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এই ব্যবস্থাই সঙ্গত বলিয়া যদি প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাহা হইলে শুরুতেই এই ধরনের বিধান শাসনতন্ত্রের অঙ্গীভূত করা হয় নাই কেন? অথবা জাতীয় পরিষদে অনুরূপ বিল উত্থাপনের মাধ্যমে তাহাকে পার্লামেন্টের আইনে পরিণত করা হইল না কেন? সে ক্ষেত্রে বিরােধীদলসমূহ উপনির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বিষয়টি অন্যভাবে বিবেচনা করার সুযােগ পাইত এবং তাহাদিগকে অপ্রতিভ অবস্থায় পতিত হইতে হইত না। কে না জানে যে, অর্ডিন্যান্স জারির কয়েক দিন পূর্বেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলিতেছিল। কে না জানে যে, কেবল অত্যন্ত জরুরী অবস্থাতেই অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। অর্ডিন্যান্স জারির উদ্দেশ্য জাতীয় পরিষদের অধিকার ও দায়িত্বের উপর হামলা নয়। যে অর্ডিন্যান্সের ফলে মূল প্রসঙ্গেরই চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টাইয়া গেল, তাহা জারি করা কি ন্যায়তঃ সমীচীন হইয়াছে? সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয় না, জনমত পরিমাপ এবং দলীয় ভাবধারা প্রচারই উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্য। উপনির্বাচন উপলক্ষে দেশে জরুরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হইতে পারে না।
জনমতের প্রকৃত রায় কি?
উপনির্বাচনে প্রতিফলিত জনমতের রায় মানিয়া লওয়া বিরােধী দলের উচিত বলিয়া প্রেসিডেন্ট যে মন্তব্য করিয়াছেন, তাহাতে আমি কৌতুক বােধ করিতেছি। আমি বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট গুরুত্বের সঙ্গে উক্ত মন্তব্য করেন নাই। কারণ, জনসাধারণ ও মৌলিক গণতন্ত্রীদের মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে তিনি অবহিত। জনমত সম্পর্কে তিনি সামরিক ও বেসামরিক গােয়েন্দা দফতরের রিপাের্ট ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই পাইয়াছেন। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে জনমতকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হইবে। কিন্তু উপনির্বাচনে এত ব্যাপকভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হইয়াছে যে, তাহা কাহারও অগােচর থাকার কথা নয়। তাই গােয়েন্দা বিভাগ নির্বাচনে সরকার পক্ষের অনুসৃত দুর্নীতির প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে বলিয়া আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি। পূর্বেও আমি বলিয়াছি এবং এখনও জোর দিয়া বলিতেছি যে, উপনির্বাচনে বিরােধী দল সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নাই। বরং সংগ্রাম করিয়াছে গভর্নর এবং তাঁহার অফিসারদের সহিত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভােটারদের হুমকি দেওয়া হইয়াছে, সন্ত্রস্ত করা হইয়াছে এবং প্রলােভিত করা হইয়াছে। অফিসাররা তাহাদের ভারত হইতে মুসলিম উচ্ছেদের পরিণতির কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। তাহারা যদি উপযুক্ত আচরণ না করে, তবে পরিণতির জন্য তাহাদের হুঁশিয়ার থাকিতে বলা হইয়াছে। স্বাভাবিকভাবেই তাহারা এই ধরনের হুমকির মােকাবিলায় বিব্রত হইয়া পড়ে। গােপালগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভােটাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জানমালের উপর এতসব হুমকি সত্ত্বেও আমাদের প্রার্থী অন্ততঃ শতকরা ২০ ভাগ হিন্দু ভােট লাভ করিয়াছে। তাদের সংকল্প ও সাহসের জন্য আমি তাহাদের মােবারকবাদ জানাইতেছি। পরিণতি সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন থাকিয়াও যে ১৭৫ জন ভােটার বিরােধী দলের পক্ষে ভােট দান করিয়াছেন এই সুযােগে আমি তাঁহাদের অভিনন্দন জানাইতেছি। শক্তি ও অর্থের নিকট নতি স্বীকারে অসম্মতি জানাইয়া ন্যায়ের পক্ষে যেসব সাহসী কর্মী ও জনসাধারণ কাজ করিয়াছেন, দেশ তাঁহাদের নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
নির্বাচনে এস-ডি-ও’র ভূমিকা
আমি প্রকাশ্যভাবে গােপালগঞ্জের এস,ডি,ও’র নিন্দা না করিয়া পারি না। রিটার্নিং অফিসার হিসাবে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন থাকার পরিবর্তে তিনি এই বলিয়া ভােটারদের হুমকি দিয়াছেন যে, কে কাহাকে ভােট দিতেছে রিটার্নিং অফিসাররূপে তিনি তাহা জানিতে পারিবেন। মনে হয়, বিশেষ উদ্দেশ্য লইয়া নির্বাচনের মাত্র তিনমাস পূর্বে তাঁহাকে গােপালগঞ্জে বদলী করা হইয়াছিল। বিগত ১৭ বৎসরকাল তিনি এস,ডি,ও গিরি করিতেছেন। পাকিস্তানের না হউক অন্ততঃপক্ষে ‘আপন মুরুব্বীদের খেদমত করার জন্য সুদীর্ঘকাল পরে তাঁহার পদোন্নতি ঘটে কি-না এক্ষণে তাহাই আমাদের লক্ষ্যণীয়।
গতবারে আমি আপনাদের নিকট সরকারী লঞ্চ ও স্পীডবোেট ব্যবহারের কথা উল্লেখ করিয়াছিলাম। এম, এল, উইনফ্রেড, এডিথ এম, ভি, মেরী, ‘রইছুল বাহার, মােল্লি, ‘আই, ডব্লু, টি, এ’ ‘কাউখালী’, ‘জি, এমএল মধুমতী’ প্রভৃতি কয়েকটিকে আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। সরকারী কার্যে ব্যবহারের জন্য এস,ডি,ও’কে প্রদত্ত লঞ্চটিকে বিভিন্ন ভােট গ্রহণ কেন্দ্রে ভােটারদের বহনের জন্য ব্যবহার করা হইয়াছে।
সবুর ও ওয়াহিদুজ্জামানের বিবৃতি প্রসঙ্গে
এখানে ফিরিয়া আসার পর জনাব ওয়াহিদুজ্জামান ও জনাব সবুরের বিবৃতির প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। মনে হয় জনাব জামান আমার নাম পর্যন্ত বিস্মৃত হইয়া আমাকে জনৈক “শেখ মুজিবর রহমান” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি আমার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া প্রায় দশসহস্র ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার কথাও কি তিনি এত তাড়াতাড়ি ভুলিয়া গিয়াছেন? শিশুরা নিশীথের দুঃস্বপ্নকে ভুলিবার চেষ্টা করে। কিন্তু জনাব জামান যে বাস্তব সত্যকে ভুলিতে চাহিতেছেন। বাংলাভাষা এবং বাংলা ও পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য কারাবরণ করিতে হওয়ায় আজ মুজিবর রহমানের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার নাই। অন্যথায় জনাব জামানকে আবার দুঃস্বপ্ন দেখিতে হইত। প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের যে কোন নির্বাচন কেন্দ্র হইতে আমার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বহু পূর্বেই তাঁহাকে চ্যালেঞ্জ দিয়াছি। এই ক্ষেত্রেও অধিকতর স্পষ্টরূপে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটিলে আমি রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করিব। জনাব সবুর সম্পর্কে বলিতে গেলে আমার মনে হয় যে, তিনি সবসময় বিশেষ একটি প্রভাব হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিতে পারেন না বলিয়া বল্লা ঠিক রাখা তাঁহার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষমাসে জম্ভ বিশেষের অবস্থা সম্পর্কে জনাব সবুরের উক্তি যেরূপ ঘৃণার যােগ্য আমি তাঁহাকে সেই মর্যাদাই দিব।
দেশের পক্ষে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এই ধরনের একটি লােক আজ জাতীয় পরিষদে সরকারী দলের নেতৃপদে অধিষ্ঠিত রহিয়াছেন। রাজনীতিতে সাধারণভাবে যেটুকু শালীনতাবােধ থাকা উচিত, তাহা তাহাকে শিখাইয়া দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা রহিয়াছে।
উপসংহারে আমি বলিতে চাই, সরকার দলীয় প্রার্থীকে ভােট না দিলে ভারতে তাড়াইয়া দেওয়া হইবে বলিয়া এস,ডি,ও, ডি, সিও, জনৈক শীর্ষস্থানীয় পুলিশ অফিসার এবং বাণিজ্য মন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেভাবে গােপালগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভােটারদের ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন এবং ভােটারদের লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়া ঐ সমস্ত ব্যক্তি যেরূপ দুর্নীতি চালাইয়াছেন, প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তাহা প্রত্যক্ষ করিলে তিনি নিজেই লজ্জিত বােধ করিতেন। এবং তাহার পদ্ধতির ব্যর্থতার কথা স্বীকার করিতেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!