You dont have javascript enabled! Please enable it! 1963.03.18 | দাবী মানিয়া লইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত আমাদের আর কোন বিরােধ নাই- ঢাকার জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণা | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

আজাদ
১৮ই মার্চ ১৯৬৩

দাবী মানিয়া লইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত
আমাদের আর কোন বিরােধ নাই
ঢাকার জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণা
পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে নূরুল আমীনের হুশিয়ারী

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমরা দাবী জানাইতেছি এবং এই দাবী মানিয়া লইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত আমাদের আর কোন বিরােধ নাই।
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক ও সাবেক উজিরে আলা জনাব নূরুল আমীন উক্ত জনসভায় বলেন যে, কোন কোন মহল হইতে আমাদিগকে প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বলিয়া প্রচার করার অপচেষ্টা চালানাে হইতেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাহারা পূর্ব পাকিস্তানকে ন্যায্য অংশ হইতে বঞ্চিত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ গড়িয়া তুলিতেছেন তাহারাই প্রাদেশিকতাকে পােষণ করিতেছেন।
গতকল্য অপরাৱে পল্টন ময়দানে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের উদ্যোগে আহূত এক জনসভায় সভাপতির অভিভাষণ দানকালে তিনি উপরােক্ত মন্তব্য করেন।
গতকল্যকার এই সভায় শাহ আজিজুর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব রমিজুদ্দিন আহমদ, জনাব হামিদুল হক চৌধুরী ও জনাব মাহমুদ আলী বক্তৃতা করেন।
জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, বৈদেশিক ঋণ হইতে শুরু করিয়া সকল বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হইতেছে। অথচ প্রাদেশিকতার অপবাদ চাপানাে হইল পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের উপর। তিনি বলেন যে, প্রদেশের জনসাধারণের অন্তরের দাবী দাওয়াকে তাহারা প্রতিফলিত করিতেছেন বলিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে এই অপবাদের বােঝা চাপানাে হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন যে, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানীদের সহিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন বিরােধ নাই। শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন।
তিনি বলেন যে, জাতীয় পরিষদের বর্তমান অধিবেশনে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যে সংশােধনী বিল উত্থাপন করা হইয়াছে, তাহা লােক দেখানাে ব্যাপার। ইহাতে কোন কাজ হইবে না। তিনি আরও বলেন, “আমরা এই সংশােধনী বিলটি সমর্থন করি না।
জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, বর্তমান শাসনতনত্রের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দানা বাধিয়া উঠিয়াছে, জাতীয় পরিষদের বিরােধী দলীয় সদস্যদের মধ্যেও তাহা প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। তিনি জনসাধারণের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং শাসনতন্ত্র বাতেলের দাবী আদায়ের জন্য ব্যাপক এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। জনসাধারণের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মুখে কোন সরকারের বেশি দিন টিকিয়া থাকা সম্ভবপর নয়।
পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পৃথক হইয়া যাইতে চাহে বলিয়াও স্বার্থবাদী মহল হইতে যে প্রচার চালানাে হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব নুরুল আমিন দৃপ্ত কণ্ঠে জানান যে, জনসাধারণের সকল অধিকার অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম শুরু হইয়াছে, তাহা একদিন সফল হইবেই। তবে ইহা সময়সাপেক্ষ হইতে পারে এই মাত্র।
তিনি বলেন যে, এই আন্দোলন ক্ষমতার লড়াই নহে। জনসাধারণের আশাআকাক্ষার প্রতিফলন এই আন্দোলন। সুতরাং কোন প্রকার প্রলােভন দ্বারা এই সংগ্রাম বন্ধ করা যাইবে না।
শাহ আজিজুর রহমান
শাহ আজিজুর রহমান বলেন যে, ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী কলেজ শিক্ষকদের দাবী, রেলকর্মচারী এবং বিভিন্ন কর্মচারীদের যে দাবীদাওয়া উত্থাপিত হইয়াছে, তাহা কোন এক শ্রেণীর লােকের দাবী নহে, উহা সামগ্রিকভাবে প্রদেশের জনসাধারণের দাবী।
তিনি বলেন যে, কিন্তু বর্তমান সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হইতেছে বাকস্বাধীনতা, জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, বৈদেশিক ঋণ হইতে শুরু করিয়া সকল বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হইতেছে। অথচ প্রাদেশিকতার অপবাদ চাপানাে হইল পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের উপর। তিনি বলেন যে, প্রদেশের জনসাধারণের অন্তরের দাবী দাওয়াকে তাহারা প্রতিফলিত করিতেছেন বলিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে এই অপবাদের বােঝা চাপানাে হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন যে, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানীদের সহিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন বিরােধ নাই। শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন।
তিনি বলেন যে, জাতীয় পরিষদের বর্তমান অধিবেশনে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যে সংশােধনী বিল উত্থাপন করা হইয়াছে, তাহা লােক দেখানাে ব্যাপার। ইহাতে কোন কাজ হইবে না। তিনি আরও বলেন, “আমরা এই সংশােধনী বিলটি সমর্থন করি না।
জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, বর্তমান শাসনতনত্রের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দানা বাধিয়া উঠিয়াছে, জাতীয় পরিষদের বিরােধী দলীয় সদস্যদের মধ্যেও তাহা প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। তিনি জনসাধারণের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং শাসনতন্ত্র বাতেলের দাবী আদায়ের জন্য ব্যাপক এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। জনসাধারণের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মুখে কোন সরকারের বেশি দিন টিকিয়া থাকা সম্ভবপর নয়।
পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পৃথক হইয়া যাইতে চাহে বলিয়াও স্বার্থবাদী মহল হইতে যে প্রচার চালানাে হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব নুরুল আমিন দৃপ্ত কণ্ঠে জানান যে, জনসাধারণের সকল অধিকার অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম শুরু হইয়াছে, তাহা একদিন সফল হইবেই। তবে ইহা সময়সাপেক্ষ হইতে পারে এই মাত্র।
তিনি বলেন যে, এই আন্দোলন ক্ষমতার লড়াই নহে। জনসাধারণের আশাআকাক্ষার প্রতিফলন এই আন্দোলন। সুতরাং কোন প্রকার প্রলােভন দ্বারা এই সংগ্রাম বন্ধ করা যাইবে না।
শাহ আজিজুর রহমান
শাহ আজিজুর রহমান বলেন যে, ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী কলেজ শিক্ষকদের দাবী, রেলকর্মচারী এবং বিভিন্ন কর্মচারীদের যে দাবীদাওয়া উত্থাপিত হইয়াছে, তাহা কোন এক শ্রেণীর লােকের দাবী নহে, উহা সামগ্রিকভাবে প্রদেশের জনসাধারণের দাবী।
তিনি বলেন যে, কিন্তু বর্তমান সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হইতেছে বাকস্বাধীনতা, জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং
২০২
মৌলিক অধিকারের সমস্যা। তিনি বলেন যে, আমরা বিদেশী শাসকদের নিকট হইতে যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছি তাহার মৌলিক অধিকার আজ বিপন্ন।
দেশের উকিল, সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের ভােটাধিকার নেই। সেই অধিকার রহিয়াছে কেবলমাত্র ৪০ হাজার মৌলিক গণতনত্রীদের। জনাব রহমান আরও বলেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রের প্রধানতঃ (১) জনসাধারণের প্রতি অনাস্থা, (২) বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা এবং (৩) আইনসভার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা হইয়াছে।
তিনি বলেন যে, সরকার চলতি পরিষদ অধিবেশনে বিরােধী দল কর্তৃক উত্থাপিত একটি বিলে বিরােধী দলের নিকট এক ভােটে পরাজিত হওয়ার পরেও সরকার বহাল তবিয়তে থাকার অর্থ হইতেছে আইন সভার প্রতি অনাস্থা।
শাহ আজিজুর রহমান আরও বলেন যে, বর্তমান আইন সভা একটা প্রহসন। ব্যতীত আর কিছুই নহে। জনসাধারণের লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া এই প্রহসন অনুষ্ঠান অর্থহীন।
উভয় প্রদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, সামরিক শাসনের পরে বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে পশ্চিম পাকিস্তান ৬ শত কোটি টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানে তিনশত কোটি টাকা ব্যয় হইয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, উন্নয়নখাতে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থব্যয় বন্ধ করিয়া সমুদয় অর্থ যদি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা যায়, তাহা হইলে দশ বৎসরের মধ্যে উভয় দেশের বৈষম্য দুরীভূত হইবে।
তিনি বলেন যে, দেশের এক অংশ সমৃদ্ধ হইবে আর অপর অংশ পঙ্গু হইবে, এছলামের নীতি এমন নহে।
রমিজুদ্দিন আহমদ
জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব রমিজুদ্দিন আহমদ বলেন যে, বর্তমান শাসনতনত্রের দ্বারা গঠিত জাতীয় পরিষদের সদস্য বলিয়া পরিচয় দিতেও আমি লজ্জা বােধ করি। তিনি বলেন যে, বর্তমানে দেশের যাবতীয় ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হস্তে কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। তিনি মৌলিক অধিকার প্রশ্নে জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার আহ্বান জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান
সাবেক প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবুর রহমান দাবী করেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্র যাচাইয়ের জন্য যদি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে গণভােট আহ্বান করা হয়, তাহা হইলে শতকরা দশভাগের বেশী লােক উহা সমর্থন করিবে না। তিনি বলেন যে, জনসাধারণের দাবী দাওয়া মানিয়া লইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত তাহাদের কোন বিরােধ নাই।
তিনি আরও বলেন যে, আমরা দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টি করিতে চাহি না। কিন্তু যদি ইহার সৃষ্টি হয়, তজ্জন্য সরকার পক্ষই দায়ী থাকিবেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, উক্ত সংগ্রামে জনসাধারণের জয় একদিন আসিবেই। তিনি দেশের যুবসমাজের প্রতি সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, কত লােককে এই সরকার বন্দী করিতে পারে আজ তাহারই পরীক্ষা হইয়া যাইবে।
তিনি ইউকাসেপের ধর্মঘট বেআইনী ঘােষণা করার কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, জনসাধারণের স্বাধীনতা কোথায়?
তিনি প্রশ্ন করেন যে, ৫ শত কোটি টাকা ব্যয়ে নয়া কেন্দ্রীয় রাজধানী নির্মাণ করা হইতেছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যার্তদের ক্ষুধার অন্ন জোগানাের জন্য অর্থাভাব দেখা দেয়।
হামিদুল হক চৌধুরী
জনাব হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে, বর্তমানে শাসন বিভাগের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি প্রবেশ করিয়াছে।
তিনি গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ আন্দোলন করার আহ্বান জানান।
মাহমুদ আলী
সাবেক ন্যাপ নেতা জনাব মাহমুদ আলী বলেন যে, অতীতে বৃটিশ সরকার জনসাধারণকে যতখানি স্বাধীনতা মনজুর করিয়াছিলেন, বর্তমান জাতীয় সরকার তাহাও হরণ করিয়াছেন।
জনাব আলী বলেন যে, সরকারের গুলী-বন্দুকের বিরুদ্ধে আমাদের একমাত্র অস্ত্র হইতেছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। তিনি ৫ হাজার কর্মচারী ছাটাইয়ের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, উহাদের পুনঃনিয়ােগের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব