You dont have javascript enabled! Please enable it! 1963.03.19 | ক্ষমতাসীনদের ভ্রাতৃত্বের বুলি উপহাসে পরিণত হইয়াছে- পূর্ব পাকিস্তানী চাষীদের প্রতি পঃ পাকিস্তানের গভর্নরের মনােভাব সম্পর্কে শেখ মুজিব | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১৯শে মার্চ ১৯৬৩

ক্ষমতাসীনদের ভ্রাতৃত্বের বুলি উপহাসে পরিণত হইয়াছে
পূর্ব পাকিস্তানী চাষীদের প্রতি পঃ পাকিস্তানের গভর্নরের মনােভাব সম্পর্কে শেখ মুজিব

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মালিক আমীর মােহাম্মদ খানের বিবৃতির প্রত্যুত্তরে গতকল্য (শনিবার) এক বিবৃতিতে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী বসতকারী কৃষকদের পশ্চিম পাকিস্তানে পুনর্বাসনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ দায়িত্ব নাই বলিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ হইতে একটি সুস্পষ্ট বিবৃতি লাভ করিলে পূর্ব পাকিস্তান এ অবস্থায়ও তাহাদের ভ্রাতৃবর্গকে ফিরাইয়া লইতে প্রস্তুত রহিয়াছে। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান সাংবাদিকদের সহিত পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরের এক সাক্ষাৎকারের প্রকাশিত বিবরণের কথা উল্লেখ করেন। এই সাক্ষাৎকারে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য-বিড়ম্বিত চাষীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে তাহার সরকারের দায়িত্বের কথা নাকি সরাসরি অস্বীকার করেন। শেখ মুজিব তাঁহার বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে চাষীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ বিনিয়ােগের বদৌলতেই পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান শিল্প ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন সম্ভব হইয়াছে।
পিপি,এ পরিবেশিত এই বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইলঃ
“পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর কলাবাগের আর্মীদের সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের প্রকাশিত এক বিবরণের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। উক্ত সাক্ষাৎকারে নাকি কলাবাগের আমীর পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য-বিড়ম্বিত চাষীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে তাঁহার সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করিয়াছেন। এই হতভাগ্য চাষিগণ বর্তমানে করাচীর অদূরবর্তী মালির এলাকায় সহায়সম্বলহীন অবস্থায় রহিয়াছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় সেবা প্রতিষ্ঠানের অকিঞ্চিৎকর দানের উপর বাঁচিয়া আছে। আমি এই সেবা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাহাদের বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি; কিন্তু সেই সঙ্গে আমি জনাব কলাবাগের উদ্দেশে একথা বলিতে চাই যে, তাঁহার কাহাকেও ভয় করার কোন প্রয়ােজন নাই; কেননা, তিনি একজন গভর্নর। কিন্তু আমরা সকল সময় এইরূপ অবাঞ্ছিত কর্মপন্থাকে ভয়ের চোখে দেখি; কারণ, আমরা জনসাধারণের ইচ্ছা ও তাহাদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
“পূর্ব পাকিস্তানের হতভাগ্য বসতকারীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে গভর্নর তাঁহার দায়িত্ব অস্বীকার করিতে পারেন; কিন্তু এ বিষয়টির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ দায়িত্ব আছে কি-না, আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট হইতে উহা জানিতে চাই, কেননা, কেন্দ্রীয় সরকারই এই অসহায় ব্যক্তিগণকে বাস্তুত্যাগে উৎসাহিত করিয়াছিলেন এবং তাহাদের রাহা-খরচ যােগাইয়াছিলেন।
“পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসিগণ বর্তমানে দারিদ্র্যপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও প্রয়ােজন দেখা দিলে তাহারা ১৫ দিনের মধ্যেই তাহাদের ভ্রাতৃবর্গকে তাহাদের মধ্যে ফিরাইয়া আনিতে প্রস্তুত রহিয়াছে। কিন্তু জনাব কলাবাগের একথা স্মরণ রাখা উচিত যে, পূর্ব পাকিস্তানী কৃষকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ বিনিয়ােগের ফলেই কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান শিল্প অগ্রগতি ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন সম্ভব হইয়াছে। জনাব কলাবাগের ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে, এখানকার (পূর্ব পাকিস্তান) শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে বিপুল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী নিয়ােজিত রহিয়াছে। কিন্তু জনাব কলাবাগ এই নিঃস্ব পূর্ব পাকিস্তানী কৃষকগণের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত করিতে প্রস্তুত নহেন; অথচ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সহিত আলােচনাক্রমেই কেন্দ্রীয় সরকার ইহাদিগকে পশ্চিম পাকিস্তানে লইয়া যান।
“ক্ষমতাসীন ব্যক্তিগণ বরাবর দেশের উভয় অংশের মধ্যে সম অনুভূতি এবং ভ্রাতৃত্বের মনােভাব গড়িয়া তােলার কথা বলিয়া থাকেন; কিন্তু যখন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরই স্বয়ং এইরূপ চরম ব্যবস্থা অবলম্বনের হুমকি দ্বারা এই অনুভূতির একেবারে শিকড় কাটিতে যাইতেছেন, তখন উহাকে কি (ভ্রাতৃত্বের মনােভাব সৃষ্টির কথাকে) একটি প্রহসন বলিয়া মনে হইতেছে না?
“এ প্রসঙ্গে আমি বলিতে চাই যে, উপরােক্ত বিষয়টির ব্যাপারে জনাব কলাবাগ উপর্যুপরি আমার নাম উল্লেখ করাতেই আমি এই পাল্টা বিবৃতি দানে বাধ্য হইয়াছি। ”

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব