You dont have javascript enabled! Please enable it! 1963.02.22 | বরকত-জননী কর্তৃক শহীদ মিনারের উদ্বোধন | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

আজাদ
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩

বরকত-জননী কর্তৃক শহীদ মিনারের উদ্বোধন
অমর ২১শে স্মরণে ছাত্র-জনতার অপূৰ্ব্ব মিছিল
বাংলা ভাষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের বজ্রকঠোর সঙ্কল্প গ্রহণ
অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষার স্বীকৃতি দাবী

(ইউনিভার্সিটি রিপাের্টার)
গতকল্য বৃহস্পতিবার ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য নব-নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ বরকতের ৭২ বৎসর বয়স্কা জননী হাসিনা বেগম এই মিনারের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনের পর সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা কমিটির চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন উজিরে আলা জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত এক সভায় মােট আটজন বক্তা বক্তৃতা করেন। বক্তাগণ অফিসআদালত, স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য সকল সরকারী পর্যায়ে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রবর্তনের দাবী জানান।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারী সরকারীভাবে “শহীদ দিবস ঘােষণা করার দাবী জানানাে হয়।
বিভিন্ন বক্তা তাঁহাদের বক্তৃতায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, বর্তমান সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করার দ্বারা জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আর এক দফা জয় সূচিত হইল।
গতকাল সহস্র তাজা প্রাণ তরুণ ছাত্র-ছাত্রীর কণ্ঠ নিঃসৃত সংগীত কাকলীতে রক্তস্নাত অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর বেদনাময় ইতিহাসের প্রতিধ্বনি বহন করিয়া আনে আর একটি সকাল। প্রাণের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ১১ বৎসর পূর্বে যে সকল বীরের বুকের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হইয়াছিল, সেই শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য গতকল্য (বৃহস্পতিবার) সঙ্গীতমুখর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং জনসাধারণ সূর্যোদয়ের বহু পূৰ্ব্ব হইতেই প্রভাতফেরী বাহির করিয়া গান গাহিতে গাহিতে আজিমপুর কবরস্থানে আগমন করেন। অতঃপর তাহারা শহীদ বরকত ও সালামের কবর জেয়ারতের পর পুষ্পমাল্য প্রদান করেন।
ভাবগম্ভীর পরিবেশে কবর জিয়ারতের পর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং জনসাধারণের বিরাট মিছিলটি অত্যনত শৃংখলার সহিত ক্রমে ক্রমে ঢাকেশ্বরী রােড, মেডিক্যাল কলেজ হােষ্টেল, বকশী বাজার, টিবি ক্লিনিক, রেলওয়ে হাসপাতাল, জিন্নাহ এ্যাভিনিউ, আবদুল গনি রােড, কার্জন হল প্রভৃতি প্রদক্ষিণ করিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে আসিয়া জমায়েত হয়। এই মিছিলে প্রাক্তন উজিরে আলা জনাব আতাউর রহমান খান, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় উজির জনাব জহীরুদ্দীন, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দও অংশগ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে শহীদ বরকতের বৃদ্ধা মাতা হাসিনা বেগম কবর জেয়ারত করিয়া শহীদ মিনারে উপস্থিত হইয়াছিলেন।
পূৰ্ব্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি হাজার হাজার ছাত্র জনতার আবেগ-আকুল দৃষ্টির সম্মুখে কালাে ফিতা কাটিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মিনারের উদ্বোধন করেন।
অসংখ্য পুষ্প এবং লতাপাতা সজ্জিত মিনারের ধাপগুলি অতিক্রম করিয়া বরকত জননী একগুচ্ছ পুষ্প প্রদান করেন।
অতঃপর জনাব আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মােট আটজন বক্তা বক্তৃতা করেন। ছাত্রনেতা জনাব ওবায়দুর রহমান বলেন, এইদিন শপথ গ্রহণের দিন। ভাষা আন্দোলনের মূলে যে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী, তাহা আদায়ের সংগ্রাম আজও অব্যাহত।
তিনি মায়ের মুখের ভাষাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছাত্র ও জনসমাজের প্রতি কঠোর ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলা ভাষা চালু করার দাবী জানান।
কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জনাব মােহাম্মদ আনীস বলেন, আমাদের বিচার করা উচিত আমরা বাংলা ভাষাকে কতটুকু মৰ্য্যাদা দিতে পেরেছি! কতটুকু আমাদের আচার ব্যবহারে, কাজে-কর্মে ব্যবহার করতে পেরেছি! তিনি বন্দী ছাত্রদের মুক্তি এবং সর্বপ্রকার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরাইয়া দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
জনাব সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যারা শহীদ হইয়াছেন তাহাদের প্রতিটি রক্তকণার মূল্য সেইদিন আদায় হইবে যেদিন আমরা বাংলা ভাষার পূর্ণ মৰ্য্যাদা প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইব। তিনি অর্থনৈতিক অবহেলা ও সর্বপ্রকার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাড়াইবার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। জনাব হায়দার আকবর খান বলেন, আজিকার এইদিন দাবী আদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের দিন। ভাষা অধিকার চির জাগ্রত তাহা এখনাে মানিয়া লওয়া হয় নাই। বক্তৃতায় ছাত্র নেতা জনাব আবুল হাসনাত এবং মীজানুর রহমান শেলী শহীদদের প্রতি তাঁহাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া দেশের গণতান্ত্রিক দাবী আদায়ের সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানান। রিক্সা চালক সমিতির পক্ষ হইতে বক্তৃতা করেন জনাব সুলতান আহমদ। এছাড়াও ছাত্র নেতা জনাব শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ ও জনাব সিরাজুল আলমও সভায় বক্তৃতা করেন।

সভাপতির ভাষণ
জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রক্তদান ব্যতীত কোনাে মহৎ কাজ সিদ্ধ হয় না। এই দিনের আন্দোলনের মধ্য দিয়া আমরা যে শক্তি সঞ্চয় করিয়াছি তাহার নিকট আগামী সকল চক্রান্ত ধূলিসাৎ হইতে বাধ্য।
বক্তৃতা শেষে তিনি হাত তুলিয়া শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
আতাউর রহমানের প্রতি জনতার ক্ষোভ প্রকাশ
তাঁহার ও জাতির আমলে কেন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে যথােপযুক্ত মৰ্য্যাদা দেওয়া হয় নাই এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক সমাপ্তির জন্য শহীদ মিনারের নির্মাণকাৰ্য্য তাহারা কেন অসমাপ্ত রাখিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে জনতার পক্ষ হইতে জনাব আতাউর রহমান খানকে প্রশ্ন করা হইলে সভায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইহাতে শহীদ দিবসের ভাব-গম্ভীর পরিবেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব