কেন নেই পাক দুঃসাহসের যােগ্য উত্তর
মঙ্গলবার, বিশে জুলাই। বেলা তখন একটা। আকাশ পরিষ্কার। শ্রীনগরে উড়ে এল একটি পাক জঙ্গী বিমান। আকাশে ঘুরপাক খেল। তারপর চলে গেল। পেছনে পড়ে রইল ভারতীয় এলাকায় তার আট মিনিট অবস্থানের দুঃসাহসিক কাহিনী। তার পরদিন একটি সমরে জম্মুতে ঘটল এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিমানসন্ধানী যন্ত্রে ধরা পড়েছিল পাক-বিমানের অনুপ্রবেশ। কিন্তু বাধ্য দেবার জন্য আকাশে উঠল না কোন ভারতীয় জঙ্গী বিমান। মাটি থেকে ছুড়ল না কেউ বিমাল বিধ্বংসী কামানের গােলা। অক্ষত পাক-বিমান ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রামের। সৈন্যবাহিনীর তিন শাখার তিন প্রধানের সঙ্গে করলেন শলাপরামর্শ। তারপর নির্দেশ দিলেন ভারতের আকাশসীমা লঙ্ন করলেই গুলী করে ফেলতে হবে। যেকোন পাক-বিমান। ভাবখানা যেন এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ছিল না কোন গাফিলতী। বাকী ছিল শুধু হুকুমের। তাই ফিরে যেতে পেরেচে পাক-জঙ্গী বিমান। নইলে তাদের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ত ভারতের মাটিতে। কর্তব্যে গাফিলতী ঢাকার এই ছেলেমানুষী অজুহাত বিশ্বাস করবে কোন মহামূখ? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্নের সন্দেহাতীত সম্ভাবনা তৈরী হলে কি করা উচিত তাও কি বলে যেতে হবে সৈন্যবাহিনীর নায়কদের? ভারতের আকাশে আট মিনিটকাল উড়েছিল দুটি মিরাজ ৩ জঙ্গী বােমারু বিমান। প্রথম দিনের ঘটনাতেও সতর্ক হলেন না কর্তৃপক্ত। দ্বিতীয় দিনও হল তার পুনরাবৃত্তি। সহজে ভাঙ্গল না কুম্ভকর্ণের মহানিদ্রা। এর পরও শােনা যাচ্ছে সেই পুরানাে আস্ফালন—আমরা তৈরী।
অতন্দ্র প্রহরা চলছে ভারত সীমান্তে। কাশ্মীরে পাক-বিমানের অনুপ্রবেশ নয়াদিল্লী এবং জাতির সামনে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। ওরা কি অনাসৃষ্টি করে গেছে জানা নেই। হয়ত নিয়েছে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফ। ১৯৬৭ সালের আরব-ইস্রাইল লড়াই-এর পর দমেছে আরব দুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে মনের জোর বেড়েছে পাকিস্তানের। শুধুমাত্র বিমান বহরের অতর্কিত আক্রমণে যুদ্ধের গতি কি করে অনুকূল অবস্থায় আনা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছে ক্ষুদ্র দেশ ইস্রাইল। পাক-সমর নেতারা প্রকাশ্যেই ঘােষণা করেছিলেন, তাঁদের প্রধান কাজ বিমান-বহরের শক্তিবৃদ্ধি এবং আয়ত্তে আনা ইস্রাইলী কৌশল। তারপর থেকে বিরাম নেই ওদের চেষ্টার। কি করেছিলেন ইস্রাইলী সমর নায়করা? আগে-ভাগেই তারা নিয়েছিলেন মিশর এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলাের বিমান ঘাঁটিগুলাের নিখুত চিত্র। আরবীয় সৈন্য সমাবেশেরও ফটোগ্রাফী বাদ যায়নি। একজে তাদের নাকি সহায়ক ছিল মার্কিন বিমানগুলাে উড়ে গিয়েছিল বড় বড় গাছের প্রায় গােটা আরব দুনিয়ার বিমান শক্তি। মাটিতে খোয়া গিয়েছিল অধিকাংশ মিশরীয় এবং আরবীয় বিমান। হয়ত এ পথেই এগুচ্ছে পাকিস্তান। সতর্কতার অভাব দেখা যাচ্ছে ভারতের। সঙ্কল্পের দৃঢ়তা নেই নেতাদের। পূর্বসীমান্তে ভারতীয় এলাকায় পড়ছে পাকিস্তানি গােলা। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। দ্বিধাগ্রস্ত মন দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ছুড়ছে পাল্টা গােলা। কোন কোন ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না। নয়াদিল্লী প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েই খালাস। এই প্রতিবাদের ভাষা কোথাও নরম এবং কোথাও গরম। ইসলামাবাদ আগেও যা ছিলেন, এখনও তাই আছেন। বরং তাদের সাহস দিন দিন বাড়ছে। শ্রীনগর এবং জম্মুর আকাশে পাক-জঙ্গী বিমান তার প্রমাণ।
একথা সত্য, ১৯৬৭ সালের মিশরীয় সমর নায়করা ছিলেন একেবারেই আনাড়ি। ইস্রাইল যখন আরব দুনিয়ার উপর সামরিক পর্যবেক্ষণ ব্যস্ত তখন মিশরীয় সেনাপতিরা খেলছেন টেনিস। অতি-সতর্কতার প্রয়ােজনের কথা আসেনি তাদের মনে। গতানুগতিক জীবনযাত্রার হয়নি কোন ব্যতিক্রম। ছ’দিনের যুদ্ধে তাদের দিতে হয়েছিল অসতর্কতার চরম খেসারত। ভারতীয় সমর নায়কদের সম্পর্কে খাটে না এ ধরনের অভিযােগ। তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা প্রচুর। আধুনিক লড়াই-এর হালচাল নেই তাদের অজানা। গত ক’মাসে বহু হুশিয়ারী পেয়েছেন তারা। পাক-ভারত সীমান্ত উত্তপ্ত। যেকোন সময় ঘটতে পারে অঘটন। তা সত্ত্বেও ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী পাক-বিমান অক্ষত অবস্থায় ফিরে গেল নিজেদের ঘাটিতে। হুশিয়ারীর পরে এ ধরনের ঘটনা অমার্জনীয় অপরাধ। কেউ খুশী নন রাজ্যসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কৈফিয়তে। দেশবাসী মােটেই আশ্বস্ত নন তার প্রতিশ্রুতিতে। তারা চান না আস্ফালন এবং চান না পাইকারী প্রতিশ্রুতি। তারা চান কাজ। প্রতিশ্রুতির প্রত্যক্ষ ফল যেখানে অনুপস্থিত সেখানে মৌখিক বাক্য আড়ম্বর অর্থহীন। প্রতিরক্ষা খাতে অকৃপণ টাকা ঢালছেন জনসাধারণ। কোন বৈরী রাষ্ট্রের বিমান ঢুকতে পারবে না ভারতে। যদি ঢুকে তবে তাকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। প্রমাণ চাই কাজে। তা না হলে স্বস্তি পাবেন না সাধারণ মানুষ। কঠোর সমালােচনা থেকে রেহাই পাবেন না প্রতিরক্ষা দপ্তর।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ জুলাই ১৯৭১