সংবাদ
২রা অক্টোবর ১৯৬২
শেখ মুজিবর কর্তৃক সাংবাদিক সম্মেলনে
গুজরানওয়ালার ঘটনা আলােকপাত সম্পর্কে
গতকল্য (সােমবার) এক সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, গুজরানওয়ালায় সােহরাওয়ার্দীকে লক্ষ্য করিয়া গুলী বর্ষণের পশ্চাতে যে সরকারী ইঙ্গিত রহিয়াছে, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নাই। ভীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে জাতীয় ফ্রন্টের লক্ষ্য ও কর্মপন্থাকে রােধ করা যাইবে না।
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
করাচী হইতে সদ্য প্রত্যাগত সাবেক আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান গতকল্য (সােমবার) ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলন বলেন যে, গুজরানওয়ালার সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে সরকার যে প্রেসনােটে প্রকাশ করিয়াছেন, উহা প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রণীত। তিনি বলেন যে, ঘটনার সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী ছাড়া জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব কামরুজ্জামান, জনাব হােসান মনসুর, জনাব আমজাদ হােসেন এবং পাঞ্জাবের জাতীয় পরিষদ সদস্য নবাবজাদা নসরুল্লা খানসহ বহু সংখ্যক দায়িত্বশীল নেতা ও কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন যে, ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে লইয়া ট্রেনটি গুজরানওয়ালা ষ্টেশনে পৌছিলে এক বিরাট জনসমুদ্র তাঁহাকে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপন করে এবং জনতার সেই ভীড় ঠেলিয়া সামনে অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়ে। তখন চেরাগ পাহলােয়ান ও অপর কতিপয় বলিষ্ঠ কর্মী জনাব সােহরাওয়ার্দীর গা বাঁচাইয়া তাহাকে মােটরের দিকে আগাইয়া লইতে থাকেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী নীচু হইয়া গাড়ীতে প্রবেশ করিতেই কর্ণবিদারী শ্লোগানের মধ্যে অকস্মাৎ বহু পটকার আওয়াজ শ্রুত হইতে থাকে। ইত্যবসরে চেরাগ পাহলােয়ান বুলেট বিদ্ধ হইয়া চীৎকার করিয়া উঠেন; কিন্তু কেহ ব্যাপারটি বুঝিবার আগেই জনাব সােহরাওয়ার্দীর গাড়ীটি ছাড়িয়া যায়। চেরাগ পাহলােয়ান তাহার ডান পার্শ্বের নিতম্ব চাপিয়া ধরিয়া চীষ্কার করিতে থাকিলে সকলের দৃষ্টি তাহার দিকে নিবদ্ধ হয়।
ইত্যবসরে বেদনায়-কাতর চেরাগ পাহলােয়ানের হাতের চাপে বুলেটটি মাটিতে পড়িয়া যায় এবং সে নিজে উহা তুলিয়া লয়। বুলেটসহ চেরাগকে উপস্থিত কর্মীবৃন্দ গুজরানওয়ালা সরকারী মেডিক্যাল অফিসারের নিকট লইয়া যায়। ক্ষতস্থান দেখিয়া তিনি বুলেটের আঘাতে বলিয়া মন্তব্য করেন। এবং অবিলম্বে পুলিশ কেস করিবার পরামর্শ দেন। বুলেটটি তিনি পুলিশের নিকট ফরােয়ার্ড করিতে চাহিলে কর্মীবৃন্দ বিনা রসিদে উহা সমৰ্পণ করিতে অসম্মতি জানায়। ফলে যথারীতি রশিদ লইয়াই বুলেটটি পুলিশ কর্তৃপক্ষের হস্তে সমর্পণ করা হয়। মেডিক্যাল অফিসার চেরাগের ক্ষতস্থানটি পরীক্ষাকালে অকস্মাৎ তাহার টেলিফোন বাজিয়া উঠে। প্রাথমিক আলাপের এক পর্যায়ে তিনি এ ঘরে বহু লােক থাকায় শােনা যাইতেছে না” বলিয়া পাশের ঘরে অন্য টেলিফোনে চলিয়া যান। মিনিট কয়েক পর তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি পুনরায় চেরাগের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিতে থাকেন এবং বেশ কিছুক্ষণ পর মত পাল্টাইয়া “ক্ষতটি পটকার আঘাতজনিত” বলিয়া মন্তব্য করেন। তাঁহার এই মন্তব্যে সকলে বিস্মিত হন। অপর এক প্রশ্নোত্তরে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, লাহাের ও লয়ালপুরের ঘটনা গুজরানওয়ালার তুলনায় কিছুই নহে। বরং তাহারা মনে করেন যে, লাহাের ও লায়ালপুরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করিয়া রাজনৈতিক হত্যায় সিদ্ধহস্ত কায়েমী স্বার্থবাদী দল জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রাণনাশেরই পরিকল্পনা করিয়াছিল; কিন্তু খােদার মেহেরবাণীতে তাহাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে।
এক প্রশ্নোত্তরে শেখ সাহেব বলেন যে, গুজরানওয়ালার এসব ঘটনার সাক্ষী কেবল কর্মীরাই নহেন, সাক্ষী হইবেন পাঞ্জাবের জাতীয় পরিষদ সদস্য নবাবজাদা নসরুল্লা খান, জনাব হাসান মনসুর, জনাব আমজাদ হােসেন, জনাব কামরুজ্জামান, পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতা জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব আবিদ হােসেন প্রমুখ। নাগরিক সম্বৰ্ধনাকালীন ঘটনাবলীর বিবরণ দান প্রসঙ্গে শেখ সাহেব বলেন যে, অপরাহ্নে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নাগরিক সম্বর্ধনাকালেই উক্ত সময়ে অদূরে যে ৩০/৪০ জন বিক্ষোভকারী জাতীয় ফ্রন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করিতেছিল প্রয়ােজনীয় জ্ঞানের অভাবে তাহারা সকল শ্লোগানের মধ্যে “থানেদার সাব (ওসি) জিন্দাবাদ” “মিয়া সাব জিন্দাবাদ,” “হাওলাদার সাব জিন্দাবাদ” ধ্বনি তুলিতে থাকে। এই ঘটনার পর জাতীয় ফ্রন্ট বিরােধী বিক্ষোভকারীদের পশ্চাতে যে সরকারী ইঙ্গিত রহিয়াছে ইহা বুঝিতে কোন কষ্ট হয় না। লাহাের ও লায়ালপুরের পর ঘটনার এই ধরনের ক্ষোভ পরিগ্রহ করিতে দেখিয়া পাঞ্জাবের জাতীয় পরিষদ সদস্য নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, ন্যাপ নেতা জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কর্ণেল আবিদ হােসেন। প্রমুখ স্বার্থান্বেষী চক্রের কারসাজি সম্পর্কে রীতিমত সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন হইয়া পড়েন। অতঃপর শেখ সাহেব গুজরানওয়ালাতে জনসভা বাতিল করার কারণ বর্ণনা করেন।
করাচীর ঘটনা
লাহাের হইতে ৩০শে সেপ্টেম্বর জনাব সােহরাওয়ার্দী করাচী ষ্টেশনে পৌছিলে যে ঘটনা ঘটে, সে সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, বিপুল জনসমুদ্র যখন ষ্টেশনে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে সম্বর্ধনা জানায় তখন প্লাটফর্মের বাহিরে সাতখানি ট্রাকের (তন্মধ্যে দুইখানি পুলিশের) উপর কালাে পতাকা হস্তে কতিপয় বিক্ষোভকারীকে দেখা যায়। জনাব সােহরাওয়ার্দী যেন মুহূর্তেই ষ্টেশন ত্যাগ করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ অকস্মাৎ প্লাটফর্মের উপরই জনাব সােহরাওয়ার্দীর সম্বর্ধনাকারীদের উপর লাঠি ও ব্যাটন চার্জ শুরু করে। ঐ সময় অন্ততঃ ১৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
পদব্রজে শােভাযাত্রা করা নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও জনতা শােভাযাত্রা করায় পুলিশ লাঠি চার্জ করিয়াছে বলিয়া কর্তৃপক্ষ দাবী করিয়াছেন এই মর্মে জনৈক সাংবাদিক মন্তব্য করিলে শেখ মুজিবর বলেন, মিথ্যা কথা। লাঠি চার্জ করা হইয়াছে তাে প্লাটফরমের উপর। সুতরাং শােভাযাত্রার প্রশ্ন উঠিল কি করিয়া?
প্রেসিডেন্টের মন্তব্য প্রসঙ্গে
জনাব সােহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানে আশ্রয় দেওয়া হইয়াছে বলিয়া সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট যে মন্তব্য করিয়াছেন, সাংবাদিক সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে শেখ সাহেব তাহার প্রতিবাদ করিয়া বলেন ও পাকিস্তান ইস্যুর উপর নির্বাচনে জনাব সােহরাওয়ার্দী পাক-ভারত উপমহাদেশের এই অংশে মুসলীম লীগকে কিভাবে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন এবং সেই চরমতম পরীক্ষার দিনেও জনাব সােহরাওয়ার্দীই যে সমগ্র উপমহাদেশের একমাত্র মুসলীম লীগ প্রধান মন্ত্রী ছিলেন, একথা যেন কেহ ভুলিয়া না যান। তিনি বলেন, আর কেহ না জানিলেও বাংলার অধিবাসী হিসাবে আমরা জানি, পাকিস্তান সংগ্রামে জনাব সােহরাওয়ার্দী কতদূর ত্যাগ স্বীকার করিয়াছিলেন। সুতরাং জনাব সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে আশ্রয় চাহিতে আসেন নাই- আসিয়াছেন তাহার অধিকারবলেই। উপসংহারে তিনি বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তান তথা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপণ সংগ্রাম করিতেছিলেন, অনেকেই তখন বৃটিশ সরকারের সেবা করিতে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, শেখ মুজিবরের সহিত করাচী হইতে সদ্য প্রত্যাগত জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব সৈয়দ আবদুস সুলতান ও বেগম রােকাইয়া আনওয়ারও এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নে শেখ মুজিবরের সহিত একই মত প্রকাশ করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব