সংবাদ
২১ই আগস্ট ১৯৬২
বরিশালের জনসভায় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা
রাজধানী স্থানান্তরের তীব্র সমালােচনা
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
বরিশাল, ২০শে আগষ্ট।- “বিশ্বের অপরাপর জাতি যখন উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হইতেছে তখনও আমরা প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত রহিয়াছি। বর্তমানে আমরা যে পাকিস্তান পাইয়াছি, এই পাকিস্তান কায়েদে আজমের কাম্য ছিল না। যে দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে জনসাধারণের পূর্ণ কর্তৃত্ব নাই সেই দেশের জন্য লক্ষ লক্ষ মুসলমান রক্তপাত করে নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনসাধারণ দেশের প্রকৃত মালিক না হইবে, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সংগ্রাম শেষ হইবে না।”
গতকল্য রবিবার এখানে অনুষ্ঠীত ৫০ হাজার লােকের এক মহতী জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপরােক্ত ঘােষণা করেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, পাকিস্তান হাসেলকারী জনসাধারণ তাহাদের ভােটাধিকারের সদ্ব্যবহারে অপারগ- ইহা মনে করা শােভন নহে; কারণ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে এই জনসাধারণই পাকিস্তান কায়েম করিয়াছে। নেতৃবৃন্দ উভয় প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও করাচী হইতে রাজধানী স্থানান্তরের তীব্র সমালােচনা করেন। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সকল রাজবন্দীর মুক্তি ইত্যাদি দাবীতে আহূত জনসভায় প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান, প্রাক্তন মন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক, সাবেক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান, সাবেক ন্যাপের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব মাহমুদ আলী, সাবেক কৃষক শ্রমিক পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী জনাব মােহাম্মদ সােলায়মান, জনাব ইকবাল আনসারী এবং জনাব শামসুল আলম বক্তৃতা করেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক কে, এস, পি নেতা ও প্রাক্তন এমপি জনাব বি,ডি, হাবিবুল্লাহ।
আতাউর রহমান খানের ভাষণ
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান তাঁহার বক্তৃতায় দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তনের আনুপুর্বিক ইতিহাসে এবং বর্তমান শাসনতন্ত্রের ইতিহাসের বিবরণ দেন। তিনি বর্তমান শাসনতন্ত্রকে “অগণতান্ত্রিক এবং জনসাধারণের গ্রহণের অনুপযুক্ত” বলিয়া আখ্যায়িত করেন। তিনি জনসাধারণকে আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, “নয়া শাসনতন্ত্রে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হইয়াছে। এই হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারকল্পে তাহাদিগকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। বর্তমান শাসনতন্ত্র জনসাধারণের গ্রহণযােগ্য কিনা, এই প্রশ্নে তিনি প্রেসিডেন্টকে গণভােটের সম্মুখীন হইতে বলেন। প্রসঙ্গতঃ তিনি বলেন যে, যদি শতকরা দশভাগের বেশি ভােট এই শাসনতন্ত্রের পক্ষে দেওয়া হয় তবে তিনি দেশত্যাগ করিবেন। অপরপক্ষে যদি শতকরা ৯০ ভাগের উপর ভােট বর্তমান শাসনতন্ত্রের বিপক্ষে যায় তবে প্রেসিডেন্ট যেন গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করিবার স্বপক্ষে পদত্যাগ করেন।
জনাব রহমান তাহার বক্তৃতায় বলেন যে, পাকিস্তান অর্জনকারী জনসাধারণ তাহাদের ভােটের অধিকার ব্যবহারে অপারগ, ইহা মনে করা শােভন নহে। কারণ, ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে এই জনসাধারণই পাকিস্তান কায়েম করিয়াছে। তিনি আরও বলেন যে, একটি শাসনতন্ত্র যত উত্তমই হউক না কেন, যদি ইহার পশ্চাতে জনসমর্থন না থাকে তবে ইহার কোন কার্যকারিতা থাকিতে পারে না।
জনসাধারণের একতা অধিকতর শক্তিশালী
শেখ মুজিবর রহমান তাঁহার বক্তৃতায় জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী (সম্প্রতি মুক্তি পাইয়াছেন), মওলানা ভাসানী, খান আবদুল কাইয়ুম খান এবং আবদুল গফফার খানের মত জননেতাদের গ্রেফতার এবং বিনাবিচারে আটক রাখার তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, কোন সরকারই যত শক্তিশালীই হউন না কেন, শেখ পৰ্য্যন্ত জনসাধারণের মতের প্রতি নতি স্বীকার করিতেই হইবে। প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, জনসাধারণ একতা সরকারের বন্দুক ও বেয়নেটের অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী।
জনাব মুজিবর রহমান তাহার বক্তৃতায় পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং করাচী হইতে রাজধানী স্থানান্তরের সমালােচনা করেন। কোন উস্কানিতে কর্ণপাত না করিয়া থাকিবার জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব