You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
৪ঠা জুলাই ১৯৬১

শেখ মুজিবরের মামলার শুনানী সমাপ্ত

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (সােমবার) ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব আছির এবং বিচারপতি জনাব আলীর এজলাসে প্রাদেশিক মন্ত্রী এবং অধুনালুপ্ত প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী শেখ মুজিবরের বিরুদ্ধে আনীত মামলার আপীলের শুনানী সমাপ্ত হয়। বিচারপতিদ্বয় মামলার রায়দান স্থগিত রাখিয়াছেন।
গত ২১শে জুন হইতে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব আসির ও বিচারপতি জনাব আলীর এজলাসে প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী ও অধুনালুপ্ত প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ও জনাব কিউ, এ, নাসেরের আপীল মামলার শুনানী শুরু হয়। প্রসংগতঃ উল্লেখযােগ্য যে, ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব ও জনাব নাসের হাইকোর্টে এই আপীল করেন।
স্মরণ থাকিতে পারে যে, মন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া বন্ধুর (নাসের) আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করিয়া অপরাধমূলক আচরণ করার দায়ে শেখ মুজিবকে এবং এ ব্যাপারে তাহাকে প্ররােচিত করার দায়ে জনাব নাসেরকে সিনিয়র স্পেশাল জজ দোষী সাব্যস্ত করেন এবং গত বৎসর ১২ই সেপ্টেম্বর মামলার রায়ে তিনি উহাদের উভয়কেই দুই বত্সর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০০০ টাকা করিয়া জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
সিনিয়র স্পেশাল জজের রায় সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তদানীন্তন ডিরেক্টর জনাব রুহুল কুদ্দুসের পক্ষ হইতে একটি রিভিসনের আবেদন পেশ করা হয়। প্রসংগতঃ উল্লেখযােগ্য যে, নিম্ন আদালতে জনাব কুদ্দুস শেখ মুজিবের মামলায় সরকার পক্ষের সাক্ষী ছিলেন। স্পেশাল জজ তাহার রায়ে সাক্ষী হিসাবে জনাব কুদ্দুসের সত্যবাদিতা ও হাবভাবের প্রশ্নে কতিপয় প্রতিকূল মন্তব্য করেন।
শেখ মুজিবরের মামলায় সরকার পক্ষের অভিযােগে বলা হয় যে, ১৯৫৫ সালের ৮ই জানুয়ারীর এক টেণ্ডার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কয়লা উৎপাদনের ও ভারত হইতে আনীত কয়লার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মােট ২১টি টেণ্ডার পাওয়া যায়। তন্মধ্যে, মেসার্স হাসান আহমদ এ্যাণ্ড কোং কে এজেন্ট নির্বাচিত করা হয়। জনাব নাসের (যিনি মেসার্স কোল মাইনিং এ্যাণ্ড ট্রেডিং কোং (পাক) লিঃ-এ কিছুকাল কাজ করিয়াছিলেন) এই সময় টেণ্ডার দাখিল করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার দরখাস্তটি অগ্রাহ্য হয়। অভিযােগে আরও বলা হয় যে, জনাব নাসের (শেখ মুজিবরের বন্ধু বলিয়া কথিত) শেখ মুজিবর রহমান প্রাদেশিক মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর আলােচ্য এজেন্সীর প্রশ্নে তাঁহার সাহায্য কামনা করেন। জনাব মুজিবরের বিরুদ্ধে আরও অভিযােগ করা হইয়াছে যে, তিনি আকস্মিকভাবে এবং কোনরূপ কারণ না দর্শাইয়া মেসার্স হাসান আহমদ লি:-এর এজেন্সী বাতিল করেন এবং বিভাগীয় সেক্রেটারীর আপত্তি সত্ত্বেও নূতন টেণ্ডার আহ্বান না করিয়া জনাব নাসেরের ফার্মকে তাহা প্রদান করেন। এতদ্ব্যতীত জনাব মুজিবর রহমান দর্শনায় একটি কোক ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার জন্য জনাব নাসেরের ফার্মকে অনুমতি প্রদান করেন এবং তাহার ফার্মের ব্যবহারের জন্য ভারত হইতে ৫শত টন হার্ডকোক আমদানির নিমিত্ত জনাব নাসেরকে অনুমতি দেন। আপীলকারীদের উভয়েই তাহাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ অস্বীকার করিয়া নিজেদের নির্দোষ ঘােষণা করেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করিয়া জনাব রহমানের পক্ষ হইতে বলা হয় যে, দেশের বৃহত্তম স্বার্থে সদুদ্দেশ্য প্রণােদিত হইয়া এবং সুবিচার প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই তিনি এজেন্সী সংক্রান্ত সব কিছু করিয়াছেন।
তিনি (জনাব মুজিবর রহমান) জনাব নাসেরের সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব থাকার কথাও অস্বীকার করেন। মেসার্স হাসান আহমদ এ্যাণ্ড কোং-এর এজেন্সী বাতিলের আদ্যোপান্ত বিবরণ প্রদান প্রসঙ্গে আপীলকারী জনাব মুজিবর রহমানের পক্ষ হইতে বলা হয় যে, জনাব নাসেরের কোল মাইনিং এ্যাণ্ড ট্রেডিং-এর সর্বনিম্ন টেণ্ডার দান এবং সংশ্লিষ্ট কাজে উক্ত ফার্ম অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত তথ্য গােপন করিয়া যে-আইনীভাবেই মেসার্স হাসান আহমদ এ্যাণ্ড কোং- কে প্রথম এজেন্সী দেওয়া হইয়াছিল। তাছাড়া মেসার্স হাসান আহমেদ এ্যাণ্ড কোং-এর বিরুদ্ধে বহু অভিযােগও ছিল। সুতরাং মন্ত্রিত্বভার গ্রহণের পর জনাব মুজিবর রহমান মেসার্স হাসান আহমেদ এ্যাণ্ড কোং- কে বে-আইনীভাবে প্রদত্ত এজেন্সী বাতিল করিয়া সর্বনিম্ন টেণ্ডার দাখিলকারী কোল মাইনিং এ্যাণ্ড ট্রেডিংকে তাহা প্রদান করেন।
অপরদিকে অন্যতম আপীলকারী জনাব নাসেরের পক্ষ হইতে আত্মপক্ষ সমর্থন করিয়া বলা হয় যে, তিনি কোন সময়ই জনাব মুজিবর রহমানের বন্ধু ছিলেন না এবং তিনি কোন সময় জনাব মুজিবর রহমানের অনুকম্পা লাভের জন্য তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই। এমতাবস্থায় যােগ-সাজসের প্রশ্নই উঠে না।

জনাব সােহরাওয়ার্দীর যুক্তি প্রদর্শন
আপীলকারী জনাব মুজিবর রহমানের পক্ষ সমর্থন করিয়া জনাব হােসেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দী যুক্তি প্রদর্শন করিয়া বলেন যে, এজেন্সী সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্ত্রী হিসাবে জনাব মুজিবর রহমান যাহা কিছু করিয়াছেন, প্রদেশের শিল্পায়নকার্য ত্বরান্বিত করা এবং পরিণামে দেশের বিদেশী মুদ্রা বাঁচাইবার মহৎ উদ্দেশ্যেই করিয়াছেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও বলেন, একথা স্বীকৃত হইয়াছে যে, জনাব নাসেরের কোল মাইনিং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং উক্ত ফার্ম ১৯৪৭ সাল হইতেই সরকারকে কয়লা সরবরাহ করিয়া আসিতেছে। অপরপক্ষে মেসার্স হাসান আহমেদ এ্যাণ্ড কোং-এর ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে নবাগত এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিম্ন মানের কয়লা সরবরাহ ও ওজন কমের বহু অভিযােগ ছিল। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, জনাব মুজিবর রহমান কোল মাইনিং কোং-কে একটি প্লাষ্টেন পারমিট এবং সর্বনিম্ন টেণ্ডারদাতা হিসাবে এজেন্সী প্রদান করিয়াছিলেন। কারণ তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করিয়াছিলেন যে, একই প্রতিষ্ঠানকে উভয় কাজ দেওয়া হইলে কাজের সুবিধা হইবে এবং কোক উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে উহার আমদানী হ্রাস পাইবে এবং ক্রমশঃ দেশ কয়লার ব্যাপারে আত্মনির্ভরশীলতার দিকে আগাইয়া যাইবে। তাছাড়া দেশকে শিল্পায়িত করাও জনাব মুজিবর রহমানের উক্ত কার্যের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বলিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী যুক্তি প্রদর্শন করেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও বলেন যে, দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিধায় সংশ্লিষ্ট অর্ডার কোন প্রকারেই অনিয়মতান্ত্রিক হয় নাই। কারণ, অনুরূপভাবেই মেসার্স হাসান আহমদের এজেন্সী বাতিলের পূর্বে জনৈক আজাদ খানের এজেন্সী বাতিল করা হইয়াছিল।
জনাব সােহরাওয়ার্দী আদালতকে জানান যে, প্রকৃতপক্ষে পারমিট লাভের পর জনাব নাসেরের প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করিয়াছিল এবং সস্তা দামেই ক্রেতাদের নিকট কয়লা বিক্রয় করিয়াছিল। ইহার ফলে সরকারও কিছুটা উপকৃত হইয়াছিল এবং সেই জন্য জনাব মুজিবর রহমানের পদত্যাগের পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ চালাইয়া যাইতে অনুরােধ করিয়াছিলেন। এমনকি উক্ত প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় আমদানী লাইসেন্সও মঞ্জুর করা হইয়াছিল। ইহার পরে জনাব নাসেরকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে তাঁহার এজেন্সী ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ হইয়া যায়।
জনাব সােহরাওয়ার্দী অতঃপর বলেন, যদি জনাব মুজিবর রহমানের অনুসৃত দূরদর্শী নীতি অনুসরণ করিয়া জনাব নাসেরকে নির্বিঘ্নে কয়লা উৎপাদন করিয়া যাইতে দেওয়া হইত, তাহা হইলে এতদিনে দেশ কয়লার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হইয়া উঠিত।
জনাব মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার জন্য যেভাবে মঞ্জুরী গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহার উল্লেখ করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, উহা বিবেচনা করিলেও জনাব মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা টিকিতে পারে না।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, বিশেষ কার্যবিধি অনুযায়ী একজন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসাবে জনাব মুজিবর রহমানের বিচার করা হইয়াছে এবং তদনুযায়ী পূর্বাহ্নে মঞ্জুরী গ্রহণ অত্যাবশ্যক। অথচ প্রকৃত তথ্যাবলী গােপন ও অসত্য তথ্যাবলী প্রদান করিয়াই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে মজুরী গ্রহণ করা হইয়াছিল। কিন্তু প্রদত্ত তথ্যাবলী পেশ করা হইলে মঞ্জুরী প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর অনুমতি দিতেন না। সুতরাং অসম্ভবে মঞ্জুরী গ্রহণের ফলে সমগ্র বিচারকার্যই ত্রুটিপূর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
এ প্রসঙ্গে জনাব সােহরাওয়ার্দী গােলাম সাদিকের মামলায় (প, এল, ডি ১৯৬০ এস, সি ৩৫১) নজীর উত্থাপন করিয়া বলেন যে, যদি কোন পাবলিক সার্ভেন্টের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার জন্য মঞ্জুরী গ্রহণকালে উক্ত ব্যক্তি চাকুরীতে বহাল না থাকেন তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট মঞ্জুরী আইনত ত্রুটিপূর্ণ এবং উক্ত ব্যক্তির বিচারের এখতিয়ার স্পেশাল জজের নাই। জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও বলেন যে, কোন মন্ত্রীকে কোন প্রকারেই পাবলিক সার্ভেন্ট বলা চলে না।
পাকিস্তান দণ্ডবিধি আইনের ২১নম্বর ধারার কোন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন মন্ত্রীকে পাবলিক সার্ভেন্ট বলা চলে জনাব সােহরাওয়ার্দী তৎসম্পর্কে প্রশ্ন তােলেন। কারণ, যেখানে একজন মন্ত্রী রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন, যেখানে পাবলিক সার্ভেন্টের পক্ষে রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
পদ-মর্যাদার দিক দিয়া মন্ত্রীর স্থান উপরে, না সেক্রেটারীর স্থান উপরে তৎসম্পর্কে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, পদ মর্যাদার দিক দিয়া একজন মন্ত্রীর স্থান নিঃসন্দেহে সেক্রেটারীর উপর এবং সেক্রেটারীর মতামত অগ্রাহ্য করার পূর্ণ ক্ষমতা মন্ত্রীর রহিয়াছে। এমতাবস্থায় জনাব মুজিবর রহমান যদি মন্ত্রী হিসাবে তাঁহার সেক্রেটারীর আপত্তি অগ্রাহ্যও করিয়া থাকেন, তাহা হইলেও তিনি কোন অপরাধ করেন নাই। বিষয়টি ব্যাখ্যা করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন কার্যকরী হওয়ার পর মন্ত্রিগণই দেশ শাসনের প্রকৃত মালিক হইয়া দাঁড়ান এবং তাহাদের নির্দেশাবলী বাস্তবায়নের জন্যই সেক্রেটারিগণকে তাহাদের (মন্ত্রীদের) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। জনাব মুজিবর রহমান ও জনাব নাসেরের বন্ধুত্বের বিষয় উল্লেখ করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী জনৈক সরকারী সাক্ষীর সাক্ষ্য আদালতে পড়িয়া শােনান। উক্ত সাক্ষী বলিয়াছেন যে, তিনি জনাব মুজিবর রহমানকে কয়েকবার জনাব নাসেরের বাড়ীতে যাইতে দেখিয়াছেন। সাক্ষ্য প্রদানকালে উক্ত ব্যক্তি বলিয়াছেন যে, ১৯৫৪ সাল হইতেই তিনি জনাব মুজিবর রহমানকে একখানা লাল রং-এর জীপে করিয়া জনাব নাসেরের গৃহে যাইতে দেখিয়াছেন। অথচ জনাব মুজিবর রহমানের লাল রংএর জীপখানা ১৯৫৭ সালে নির্মিত ও আমদানী হইয়াছিল। তাছাড়া সাক্ষী যে সময় জনাব মুজিবর রহমানকে জনাব নাসেরের বাড়ীতে দেখিয়াছেন বলিয়া সাক্ষ্য দিয়াছেন সেই সময়ে জনাব মুজিবর রহমান নিবর্তনমূলক আইনে। আটক ছিলেন বলিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী জানান।
এজাহারকারী পুলিশ কর্মচারীর সাক্ষ্যের বিষয় উল্লেখ করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, কিভাবে একটি এজাহার এতদুদ্দেশ্যমূলক ও অসত্য তথ্যাবলীপূর্ণ হইতে পারে, তাহা অচিন্ত্যনীয়। অতঃপর জনাব সােহরাওয়ার্দী সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মচারীর সাক্ষ্যের একটি অংশ পড়িয়া শােনান। উক্ত অংশে বলা হইয়াছে যে, তিনি (পুলিশ কর্মচারী) অতীতে জনাব মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে আরও দুইটি এজাহার করিয়াছিলেন এবং সর্বমােট জনাব মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের হইয়াছিল। কিন্তু জনাব মজিবর রহমান তিনটি মামলা হইতেই অব্যাহতি (হয় তিনি বেকসুর খালাস পাইয়াছেন, না হয় তাহার বিরুদ্ধে আনীত মামলা খারিজ হইয়া গিয়াছে) পাইয়াছেন।
উপসংহারে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, মামলা রুজু সংক্রান্ত মঞ্জুরী গ্রহণের ব্যাপার এবং উদ্দেশ্যমূলক সাক্ষ্য প্রমাণের বিষয় বিবেচনা করিলে জনাব মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা বহাল থাকিতে পারে না।

জনাব নাসেরের কৌসুলীর যুক্তি প্রদর্শন
অন্যতম আপীলকারী জনাব কিউ, এ নাসেরের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করিয়া এডভােকেট জনাব আবদুস সালাম খান বলেন যে, জনাব নাসেরকে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্ট নির্দেশের সহিত জড়িত করার মত কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। জনাব খান বলেন, অভিযােগে বর্ণিত বে-আইনী অর্ডারের ব্যাপারে জনাব নাসেরের যােগসাজসের প্রশ্নই উঠে না। কারণ তাহার অজ্ঞাতসারেই তাহার ফার্মকে এজেন্সী ও পারমিট প্রদান করা হইয়াছিল। বিভাগীয় মন্ত্রীই স্বীয় উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম স্বার্থে সদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত হইয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ একটি ফার্মকে পারমিট দেওয়ার নির্দেশ দিয়াছিলেন।
জনাব খান আরও বলেন যে, অনুরূপ পারমিট প্রাপ্তিকে আর্থিক দিক দিয়াও সুনির্দিষ্টভাবে লাভজনক বলা চলে না। অপরপক্ষে নির্ধারিত কাজে অকৃতকার্য হইলে তাহা জনাব নাসেরের পক্ষে ধ্বংসেরই সামিল হইত। এমতাবস্থায় জনাব নাসেরের বিরুদ্ধে প্রদত্ত কোন দণ্ড বহাল থাকিতে পারে না।
সরকার পক্ষের বক্তব্য
সরকার পক্ষের বিশেষ কৌসুলী জনাব আজিজ উদ্দীন আহমদ তাহার বক্তব্যে বলেন যে, মেসার্স হাসান আহমদ লিঃ-এর এজেন্সী বাতিল এবং কোল মাইনিং কোং- কে তাহা প্রদানের ব্যাপারে জনাব মুজিবর রহমান ভুল করিয়াছেন। সরকারী কৌসুলী বলেন যে, সেক্রেটারী তাহাকে সংশ্লিষ্ট রুল দেখাইয়া বলিয়াছিলেন যে, অনুরূপভাবে এজেন্সী বাতিল করিয়া নূতন টেণ্ডার আহ্বান না করিয়া অন্য ফার্মকে তাহা দেওয়া হইলে তাহা আইনতঃ ত্রুটিপূর্ণ হইবে।
জনাব আজিজউদ্দীন বলেন, জনাব মুজিবর রহমান মন্ত্রী হইয়াই স্বীয় উদ্যোগে কোল মাইনিং কোং- কে এজেন্সী ও পারমিট প্রকাশের ব্যাপারে যে তাড়াহুড়া নীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা হইতেই জনাব মুজিবর রহমানের মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়া জনাব নাসের যে জনাব মুজিবর রহমানের বন্ধু ছিলেন এবং তাহার বাড়ীতে আসা-যাওয়া করিতেন তাহারও প্রমাণ রহিয়াছে। তিনি বলেন যে, মন্ত্রী মহােদয়ের রুলের বিরুদ্ধে কাজ করা উচিত হয় নাই এবং যদি তিনি তাহা করিয়া থাকেন, তবে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের দোষে দোষী।
মামলার মঞ্জুরী সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ করিয়া জনাব আজিজউদ্দীন বলেন যে, মঞ্জুরীর বিষয় বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে যে, মামলায় বিচার আইন। সঙ্গতভাবেই সম্পাদিত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট প্রাসঙ্গিক সকল তথ্য ও ফাইলপত্র পেশ করিয়াই মঞ্জুরী গ্রহণ করা হইয়াছিল। সুতরাং মামলা রুজুর পূর্বে মঞ্জুরী গ্রহণ অত্যাবশ্যক হইলে তাহা সঠিকভাবে গৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু তাহার মতে অত্র মামলায় মঞ্জুরী ব্যতিরেকেই বিচারকার্যে অগ্রসর হওয়া যাইত।

জনাব আজিজ উদ্দীন জানান যে, ফৌজদারী আইনের ১৯৪৮ সালের সংশােধনী অনুযায়ী যে কোন অভিযােগের জন্যই মঞ্জুরীর প্রয়ােজন রহিয়াছে। তবে ত্রুটিপূর্ণ মঞ্জুর বা কোন মঞ্জুরী গ্রহণ না করিলেও মামলার বিচারকার্য বে-আইনী হইতে পারে না।
১৯৫৮ সালের সংশােধনী অনুযায়ীই জনাব মুজিবর রহমানের বিচার করা হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, অভিযুক্ত করার সময় কোন ব্যক্তি পাবলিক সার্ভেন্ট না থাকিলে তাহার বিরুদ্ধে মামলা রুজুর জন্য কোন মঞ্জুরীর প্রয়ােজন নাই। পক্ষান্তরে যাহারা অভিযুক্ত করার সময় চাকুরীতে বহাল থাকিবেন, কেবলমাত্র তাহাদের বেলায়ই মঞ্জুরীর প্রয়ােজন। এমতাবস্থায় অত্র মামলায় যদি মঞ্জুরী গ্রহণ করা হইয়া থাকে, তবে তাহা অনাবশ্যকভাবেই গৃহীত হইয়াছে।
অনুরূপ কারণে তিনি গােলাম সাদিকের মামলা (P. L. D. 1960 S. C ৩৫১) এবং আবুল মনসুরের মামলার (DL. R. xii ৩৫৩) নজীরের মধ্যে পার্থক্য দেখাইবার চেষ্টা করেন। প্রথমােক্ত মামলা ১৯৪৮ সালের সংশােধনী অনুযায়ী পরিচালিত হইয়াছিল এবং তাহাতে মঞ্জুরী অত্যাবশ্যক ছিল। অপরপক্ষে দ্বিতীয় মামলা ১৯৫৮ সালের সংশােধনী অনুযায়ী পরিচালিত হইয়াছিল এবং ইহাতে মঞ্জুরীর প্রশ্ন অনাবশ্যক ছিল। একজন মন্ত্রী পাবলিক সার্ভেন্ট কিনা, তৎসম্পর্কে জনাব আজিজ উদ্দীন বলেন যে, পাকিস্তান। দণ্ডবিধি আইনের ৯ম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রী পাবলিক সার্ভেন্ট। তাছাড়া ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং আমাদের সাবেক শাসনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রী গভর্ণরের অধীনে একজন কর্মচারী মাত্র এবং সরকারী কোষাগার হইতেই তাহাকে বেতন দেওয়া হইয়া থাকে। সুতরাং এমতাবস্থায় জনাব মুজিবর রহমান একজন পাবলিক সার্ভেন্ট ছিলেন। জনাব আজিজ উদ্দীন আরও বলেন যে, কোল মাইনিং- কে প্রদত্ত এজেন্সী পারমিটের বিষয়কে নিয়মতান্ত্রিক করার উদ্দেশ্যেই কোক প্ল্যান্টের প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে অনুরূপ কোন কোক প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই।
জনাব আজিজ উদ্দীন আরও বলেন যে, জনাব মুজিবর রহমান কোল মাইনিং কেই এজেন্সী দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন এবং যেভাবে তিনি ফাইলপত্র ব্যবহার করিয়াছেন, একজন বন্ধুকে ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া অনুকম্পা প্রদর্শনের ব্যাপারটি তাহা হইতেই পরিষ্কার হইয়া পড়ে।
উক্ত আপীল মামলায় জনাব এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী জনাব মুজিবর রহমানের পক্ষে বক্তব্য পেশ করেন। এ ব্যাপারে তাঁহাকে সহায়তা করেন। জনাব হুমায়ুন কবির চৌধুরী। জনাব সিরাজুল হকের সহায়তায় জনাব আবদুস সালাম খান জনাব নাসেরের পক্ষ অবলম্বন করেন। অপরপক্ষে জনাব এ, ডব্লিউ, মল্লিকের সহায়তায় জনাব আজিজ উদ্দীন আহমদ সরকার পক্ষ সমর্থন করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!