You dont have javascript enabled! Please enable it! 1960.05.25 | শেখ মুজিবুরের মামলা সরকার পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
২৫শে মে ১৯৬০

শেখ মুজিবুরের মামলা সরকার পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (মঙ্গলবার) ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ জনাব এ, এস, এম, রাশেদের এজলাসে শেখ মুজিবুর রহমান ও তদীয় ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে আনীত মামলায় সরকার পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়। এই দিবসে কেবলমাত্র তদন্তকারী অফিসার জনাব মেহরাব আলীর জেরা বাকী রহিয়াছে। অদ্য (বুধবার) সকাল ৭:১০ টায় আদালতের কাজ শুরু হইলে বিবাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাক্ষীকে জেরা করিবেন। বলিয়া আশা করা যাইতেছে।
গতকল্য সরকার পক্ষে যশােরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও তৎকালীন শিল্প বিভাগের ডিরেক্টর জনাব রুহুল কুদ্সসহ মােট ৭জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গৃহীত হয়। বিবাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব সােহরাওয়ার্দীর জেরার উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, ১৯৫৬ সনে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত করা হয় নাই, একথা সঠিক নহে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। ১৯৫৬ সনে অবস্থা এই ছিল যে, প্রাক্তন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকারকে শিল্প সম্পর্কে ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য সকল ক্ষমতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ কেন্দ্রের তালিকা হইতে শিল্পকে প্রাদেশিক তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরের সহিত প্রাদেশিক সরকার বহু সংখ্যক চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান করেন। এতদ্ব্যতীত বৈদেশিক মুদ্রার অভাব সম্পর্কেও বহু সংখ্যক চিঠি-পত্রের-আদান প্রদান হয়।
নয়া আবেদনপত্র বাছাই প্রসঙ্গে
এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব রুহুল কুদুস বলেন যে, শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাপ্ত সমস্ত নয়া আবেদনপত্র ও পেণ্ডিং আবেদনপত্র শিল্প ডিরেক্টরেটের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরীক্ষিত হয়। আমি স্বয়ং এবং ডিরেক্টরেটের অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ এক সঙ্গে বসিয়া এই সকল আবেদনপত্র পরীক্ষা করি এবং ঐগুলির গুণাগুণের উপর নির্বাচন করি। অতঃপর আমি স্বয়ং, তৎকালীন সি, এল এণ্ড আই বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারী জনাব আবুল খায়ের এবং জনাব ইয়াহিয়া চৌধুরী পুনরায় ঐ সকল আবেদন পত্র বাছাই করি।

আবেদনপত্র পরীক্ষায় মন্ত্রীর হাত ছিল না
এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব কুদ্স স্বীকার করেন যে, (চূড়ান্ত বাছাই-এর পরে) প্রত্যেকটি আবেদনপত্রের ক্ষেত্রে সুপারিশের পরে সেগুলি সি, এল এণ্ড আই বিভাগে প্রেরিত হয়। আবেদনপত্রসমূহ পরীক্ষার ব্যাপারে মন্ত্রীর হাত ছিল না। এমন কি মন্ত্রী মহােদয় (তৎকালীন বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রী) কোন আবেদনপত্র তালিকার অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে বিশেষ করিয়া আমাকে সুপারিশ করিয়াছেন কি-না উহা আমার স্মরণ নাই।
আই, সি, এ-এর সাহায্য প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেনঃ ১৯৫৭ সনের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি করাচীতে অবস্থানকালে জানিতে পারি যে, বেসরকারী খাতে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সহযােগিতা সংস্থা এক কোটি ডলার সাহায্য প্রদানের প্রস্তাব করিয়াছেন এবং উহার জন্য তাঁহারা অত্যন্ত অল্প সময় প্রদান করিয়াছেন। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সাপ্লাই ও ডেভেলপমেন্টের এবং উহার জন্য তাঁহারা অত্যন্ত অল্প সময় প্রদান করিয়াছেন। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সাপ্লাই ও ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেলের অফিস হইতে জানিতে পারি যে, পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁহাদের অফিসে ইতিমধ্যে যে সকল আবেদনপত্র মজুত ছিল, ঐগুলিকে এক কোটি ডলারের মধ্যে ২৫/২৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এই নামমাত্র বরাদ্দ এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে পার্টি নির্বাচনে জিজ্ঞাসা না করার দরুন আমি প্রতিবাদ জ্ঞাপন করি। উহার ফলে আমাকে পার্টি আনয়নের জন্য মাত্র একদিন সময় দেওয়া হয়। পরদিন রবিবার পড়ে। আমি ঐ রাত্রেই বিমানযােগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া রবিবার সারাদিন আমার অফিসারদের সহিত বসিয়া কাজ করি। এবং পার্টি নির্বাচন করিয়া উহার তালিকা পরদিন অথবা আরও একদিন পরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পেশ করি। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৫০লক্ষ ডলার বরাদ্দ করেন।
আল আজিজ ইণ্ডাষ্ট্ৰীজ প্রসঙ্গে
এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী স্বীকার করেন যে, “আল-আমিন ইণ্ডাষ্ট্রীজ” কে তালিকাভুক্ত করার কালে শেখ আবু নাসের উক্ত প্রতিষ্ঠানের পার্টনার ছিলেন। কিনা, উহা তিনি জানিতেন না।

পুলিসের নিকট জবানবন্দী
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, পুলিস তাহার জবানবন্দী গ্রহণ করিয়াছে এবং তিনি দুর্নীতি দমন পুলিসের নিকট একটি বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, পুলিস যখন তাঁহার জবাবনবন্দী গ্রহণ করে তখনও তিনি যশােরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
এতদসম্পর্কে আর একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রকাশ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের রিকুইজিশন পাইয়া তিনি দুই দফা ঢাকা আগমন এবং পুলিসের নিকট বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন যে, এই দফার মধ্যে একদফা তিনি এডভােকেট জেনারেলের বাসভবনে ও দ্বিতীয় দফা তিনি প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে দুর্নীতি দমন ব্যুরাের দফতরে জবানবন্দী ও বিবৃতি প্রদান করেন।
গতকল্য সরকার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকালে অন্যতম সাক্ষী দুর্নীতিদমন বিভাগের ইন্সপেক্টার জনাব আবদুল জলিল খান তাঁহার সাক্ষ্যে বলেন, তিনি এই মামলা সম্পর্কে রমনা থানায় এজাহার প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলেন, গত ১৯৫৮ সনের ২২শে নবেম্বর তিনি আল আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজ সম্পর্কিত কতিপয় কাগজপত্র জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর নিকট হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। সাক্ষী বলেন যে, তিনি এ ব্যাপারে সেক্রেটারীয়েট ও অন্যত্র বহু স্থানে অনুসন্ধানকার্য চালাইয়া এজাহার প্রদান করিয়াছেন। অতঃপর বিবাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী সাক্ষীকে জেরা করেন।
কতিপয় প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, তিনি এই ব্যাপারে আনােয়ার আলীর সহিত কথাবার্তা চালাইয়াছেন। হাজী সেকান্দর আলীর সহিতও সাক্ষীর দেখা হয়, কিন্তু তিনি তাহার সহিত কথা বলেন নাই। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সহিত সাক্ষাতের পর তিনি আল-আমিন ইণ্ডাষ্ট্রিজ সম্পর্কিত কাগজপত্র তাহাকে বুঝাইয়া দেওয়ার ৪/৫ দিন পরে আনােয়ার আলীর সহিত দেখা করেন।
সাক্ষী আরও স্বীকার করেন যে, তিনি এই মামলা সম্পর্কিত ব্যাপারে জনাব গােলাম হায়দর চৌধুরীর সহিতও সাক্ষাৎ করিয়াছেন।
সাক্ষী স্বীকার করেন যে, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা ও জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরী, জনাব আনওয়ার আলী, জনাব গােলাম হায়দর চৌধুরী ও অন্যান্য অফিসারের সহিত আলােচনার পর তিনি এজাহার প্রদান করিয়াছেন।
সাক্ষী বলেন যে, দুর্নীতি দমন ব্যুরাের এসিসট্যান্ট ডিরেক্টরের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি এজাহার প্রদান করিয়াছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, দুর্নীতি দমন ব্যুরাের এসিসট্যান্ট ডিরেক্টরের চাপে পড়িয়া তিনি এই এজাহার প্রদান করিয়াছেন, উহা সত্য নহে।
সাক্ষী বলেন যে, তিনি এই মামলার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জে জনাব আনােয়ার আলীর সহিত দেখা করেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী সাক্ষীকে বলেন, আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকার্য চালাইতে গিয়া এজাহার করার মত কিছুই পান নাই এবং উক্ত কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ফাইনাল রিপাের্ট প্রদানের প্রস্তাব করিয়াছিলেন।
সাক্ষী তদুত্তরে বলেন যে, তিনি ফাইনাল রিপাের্ট প্রদানের পরামর্শ দিয়াছিলেন কিনা উহা তাঁহার মনে নাই। পূর্বাহ্নে সাক্ষী বলেন যে, দুর্নীতি দমন ব্যুরাের ডিরেক্টর জেনারেল জনাব মহীউদ্দীন শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাইবার জন্য তাহাকে নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি তাহার প্রাপ্ত সূত্র সম্পর্কে ডিরেক্টর জেনারেল, এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।
মামলার তদন্ত
গতকল্য এই মামলার তদন্তকারী অফিসার জনাব মেহরাব আলী বলেন যে, তিনি ১৯৫৯ সনের ১০ই ফেব্রুয়ারী হইতে এই মামলার তদন্ত শুরু করেন এবং এই উদ্দেশ্যে তৎকালীন ঢাকা সদর মহকুমা হাকিম জনাব ই, কবিরের নিকট হইতে অনুমতি গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন যে, তিনি ঐ বৎসর ২০শে ফেব্রুয়ারী জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরী ও গােলাম হায়দর চৌধুরীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন। তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারী আনােয়ার আলী ও ১৬ই মার্চ হাজী সেকান্দর আলীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন। তিনি সেক্রেটারিয়েটে সি, এল, আই বিভাগ হইতে বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করেন। তিনি বলেন যে, ২১ শে ফেব্রুয়ারী আনােয়ার আলীর নিকট হইতে একটি গােপন হিসাবের খাতাও তিনি উদ্ধার করিয়াছেন।
তিনি বলেন যে, তিনি খুলনায় জনৈক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট শেখ আবু নাসেরকে হাজির করাইয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে তাহার সাধারণ হাতের লেখা ও দস্তখতের নমুনা গ্রহণ করেন। এবং এই নমুনা, পার্টনারশীপ দলীল, আল-আমিন ইণ্ডাস্ট্রীজের প্রসিডিং বহি ইত্যাদি হস্তাক্ষর বিশেষজ্ঞের নিকট পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৯৫৯ সনের ৯ই নবেম্বর তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ও তদীয় ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। গতকল্য সি, এল, আই বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারী জনাব আবুল খায়ের, জয়েন্ট স্টক কোম্পানীজের রেজিষ্টার জনাব বি, হক ও প্রাক্তন হেড এসিস্ট্যান্ট এবং বর্তমান সেকশন অফিসার জনাব এ, ডব্লিউ, চৌধুরী, রমনা থানার এ, এস, আই আব্দুল আজিজ প্রমুখ কতিপয় সাক্ষী কতিপয় কাগজপত্র ও নােট ইত্যাদি প্রমাণ করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব