You dont have javascript enabled! Please enable it! 1960.05.26 | শেখ মুজিবুরের মামলার শুনানী সমাপ্ত- জনাব সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক বাদীপক্ষের যাবতীয় অভিযােগ খণ্ডন | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
২৬শে মে ১৯৬০

শেখ মুজিবুরের মামলার শুনানী সমাপ্ত
জনাব সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক বাদীপক্ষের যাবতীয় অভিযােগ খণ্ডন

(স্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (বুধবার) ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ জনাব এ, এস, এম রাশেদের এজলাসে শেখ মুজিবুর রহমান ও তদীয় ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে আনীত মামলার শুনানী সমাপ্ত হয়। সরকার পক্ষের কৌসুলীর সওয়াল-জওয়াবের উত্তরে বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁহার সওয়াল-জওয়াব শুরু করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের প্রত্যেকটি ধূলিসাৎ হইয়াছে।
পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ আবু নাসের তাঁহাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে মামলাটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন ঃ জনসাধারণের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটার পর একটা মিথ্যা মামলা করা হইতেছে। স্পেশাল জজ আসামী ৩১শে মে পর্যন্ত রায়দান স্থগিত রাখিয়াছেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী তাঁহার সওয়াল-জওয়াব প্রসঙ্গে বলেন, আল আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজের সহিত শেখ আবু নাসেরের পার্টনার শীপ দলীল সম্পাদন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান এতটুকু অবহিত ছিলেন বাদীপক্ষ ঘুণাক্ষরেও উহা প্রমাণ করিতে পারেন নাই।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেনঃ বাদীপক্ষ স্বীকার করিয়াছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়াছে, এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নাই। তিনি বলেনঃ সমগ্র চিত্রের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াটিও দেখা যাইতেছে না এবং তাঁহার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের সম্পূর্ণ অভাব পরিলক্ষিত হইতেছে। এই ব্যাপারে তাহার কোন কিছুই করণীয় ছিল না।
এক্ষণে আমাদের দেখিতে হইবে যে, তিনি আর্থিক সুবিধা অর্জনের জন্য তাঁহার সরকারী ক্ষমতা প্রয়ােগ করিয়াছেন কিনা? দেখা যাইতেছে যে, ১৯৫৭ সনের ৩০শে মার্চ তৎকালীন শিল্প বিভাগের ডিরেক্টর জনাব রুহুল কুদ্স পূর্ব পাকিস্তানে ৩২টি শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করিয়া ইচ্ছুক শিল্পপতিদের উদ্দেশে এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন। এখন পরিস্থিতি পর্যালােচনা করিলে দেখা যাইবে যে, কেন্দ্রীয় সরকার চলতি বাণিজ্য মৌসুমে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ৩৩লক্ষ টাকা ও পরবর্তী বাণিজ্য মৌসুমের জন্য আরও ৬৬লক্ষ টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন, উহা অবগত হওয়ার অব্যবহিত পরেই ডিরেক্টর এই বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী এখানে উল্লেখ করেন যে, এই বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাসাধিককাল পূর্বে আল-আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজের পার্টনার ও শেখ আবু নাসেরের মধ্যে তিন আনা শেয়ারের ভিত্তিতে একটি পার্টনারশীপ দলীল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রী হয়। তদুপরি আল-আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজ ১৯৫৬ সনের আগস্ট মাসে প্রথম ক্যালেণ্ডারিং মিল স্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু তৎকালে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবশতঃ তাহাদের যেমন অনুমতি লাভে বিলম্বিত হয়, তেমনি লাইসেন্সের জন্য আবেদনেরও প্রশ্ন উঠিতে পারে না। অতএব বৈদেশিক মুদ্রা না পাওয়া পর্যন্ত কাহাকেও ঘুষ বা উৎকোচ প্রদানের প্রশ্নই উঠিতে পারে না। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, এখানে আশ্চর্যের ব্যাপার যে, যে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগ তহবিলের জন্য ১৫শত টাকা দেওয়া হইয়াছে বলিয়া বাদীপক্ষ উল্লেখ করিয়াছেন, সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের বিষয়টি সম্পর্কে কাহারও কোন ধারণাই ছিল না।
জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও বলেনঃ ৩২টি বিশেষ শিল্পের জন্য ডিরেক্টর কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি প্রচারের পূর্বে ক্যালেণ্ডারিং কারখানা স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রদান বা লাইসেন্স মঞ্জুর করা হইবে উহাও কাহারও ধারণার মধ্যেও ছিল না।
জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও বলেন যে, ৩০শে মার্চে বিজ্ঞপ্তিতে দরখাস্ত গ্রহণের জন্য অত্যন্ত কম সময় প্রদান করা হয় এবং ৭ই এপ্রিলের মধ্যে দরখাস্ত দাখিলের জন্য নির্দেশ প্রদত্ত হয়। ইহার দ্বারা লাইসেন্সের জন্য দ্রব্য তালিকা সমাপ্ত করার অত্যন্ত জরুরী প্রয়ােজনীয়তা প্রমাণিত হইতেছে।
এতদ্ব্যতীত পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য আই, সি, এ, এককোটি ডলার প্রদানের প্রস্তাব করে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আই,সি,এ এত অল্প সময় প্রদান করে যে, পাকিস্তান সরকারের সাপ্লাই ও ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেলের অফিস হইতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে কোন কিছু অবহিত না করিয়াই তাহাদের অফিসে ইতিপূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাপ্ত দরখাস্তের উপর ভিত্তি করিয়া তাহারা ২৫/২৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। উক্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন শিল্প বিভাগীয় ডিরেক্টর জনাব রুহুল কুদুস করাচীতে অবস্থান করিতেছিলেন এবং তিনি বিষয়টি জানিতে পারিয়া পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে কিছু না জানাইয়া তাহাদের অফিসে প্রাপ্ত দরখাস্ত অনুযায়ী পার্টি নির্বাচনের জন্য তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। ফলে তাহাকে পার্টির তালিকা আনয়নের জন্য মাত্র একদিনের সময় প্রদত্ত হয়। পরদিন রবিবার ছিল। তথাপি জনাব কুদুস রাত্রে করাচী হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া সারাদিন তাহার অফিসারদের সহিত কাজ করিয়া একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া ২/১ দিন পরে করাচীতে লইয়া যান এবং উক্ত তালিকা পেশ করার পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আই, সি, এ প্রদত্ত অর্থ হইতে ৫০লক্ষ টাকা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করেন। এই সকল তালিকাও দ্রুত প্রণয়ন করিতে হয়।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের শিল্প বিভাগের ডিরেক্টরের সহিত এব্যাপারে সরাসরি যােগাযােগ করায় জনাব কুদুসকে অত্যন্ত দ্রুত এই সমস্ত তালিকা প্রস্তুত করিতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে শিল্প বিভাগের ডিরেক্টরের বিজ্ঞপ্তির ফলে প্রায় ৫হাজার দরখাস্ত পাওয়া যায়। ডিরেক্টর জনাব কুদ্দুস ও ডিরেক্টরেটের অন্যান্য বিশেষজ্ঞ এই সকল দরখাস্ত পরীক্ষা করিয়া একটি তালিকা প্রস্তুত করেন এবং পরে ডিরেক্টর ও বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প বিভাগের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারী এবং অপর একজন অফিসার একত্রে বসিয়া এই সকল আবেদনপত্র যাচাই করিয়া প্রত্যেকটি আবেদনপত্রের গুণাগুণ বিচার ও উহাতে সুপারিশ করিয়া চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য ১৯৫৭ সনের ২৫শে জুন বিভাগীয় সেক্রেটারীর নিকট প্রেরণ করেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী আরও উল্লেখ করেন যে, বিষয়টি ইতিমধ্যে বিলম্বিত হইয়া যাওয়ায় ডিরেক্টর শিল্প উন্নয়নের কমিশনারের সহিত দেখা করেন। তিনি বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করার জন্য ডেপুটি সেক্রেটারীকে বলার জন্য জনাব কুদ্দুসকে বলেন। তদুপরি বিভাগীয় সেক্রেটারী জনাব কাদরী তখন ছুটিতে যাইতেছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ জনাব কুদুসকে পরবর্তী সিনিয়র অফিসার হিসাবে সব কাজ সম্পন্ন করার জন্য বলিয়া থাকিবেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী উপরােক্ত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করিয়া বলেন যে, সমস্ত দরখাস্ত শিল্প ডিরেক্টর কর্তৃক আহূত হইয়াছে। বিভাগীয় বিশেষজ্ঞগণ উহা পরীক্ষা করিয়াছেন এবং বিভাগীয় উচ্চপদস্থ ও দায়িত্বশীল অফিসারগণ প্রত্যেকটি আবেদনপত্রের গুণাগুণ বিচার করিয়া তালিকা প্রস্তুত করিয়া সবশেষ সুপারিশক্রমে বিভাগীয় সেক্রেটারীর নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। পরে মন্ত্রীর নিকট উত্থাপন করা হইলে তিনি উহা অনুমােদন করিয়াছেন মাত্র। অতঃপর তিনি ক্ষমতার কোন প্রকার অপব্যবহার করেন নাই।
মুজিবুরের বিরুদ্ধে মামলার পটভূমিকা বর্ণনা
জনাব সােহরাওয়ার্দী তাঁহার সওয়াল-জওয়াব প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে এই মামলার পটভূমিকা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক আইন প্রবর্তন করা হয়। সামরিক আইন প্রবর্তনের যৌক্তিকতা হিসাবে প্রাক্তন রাজনীতিকদের উপর যাবতীয় দোষারােপ করা হয় এবং এমন সব বিবৃতি ও বক্তৃতা চলিতে থাকে যে, রাজনীতিকগণ যেন সকলেই অপরাধী। এই রাজনীতিকদের অপদস্ত করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়। অর্ডিন্যান্স বলে দুর্নীতি দমন আইন সংশােধন, নিরাপত্তা আইন সংশােধন, এবডাে আদেশজারি এবং সম্ভাব্য অন্যান্য সকল প্রকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়। জনাব মুজিবুর রহমানও একজন বড় রাজনীতিক। তিনি তৎকালীন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ছিলেন। অতএব একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসাবে তিনি যাবতীয় আইনের শিকারে পরিণত হন। সামরিক আইন প্রবর্তনের ৩/৪ দিন পরে অর্থাৎ ১১ই অক্টোবর ৭২নং অর্ডিন্যান্স জারি ও পর দিবস গ্রেফতার করিয়া জেলে প্রেরণ করা হয়। জেলখানাই তাহার উপর জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে আটক রাখার নির্দেশ প্রদত্ত হয়। জেলখানায় থাকিতেই তাহার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধি ৪২০ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। তাহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে বর্তমান মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমান মামলা ছাড়া উপরােক্ত সব কয়টি অভিযােগ হইতে তিনি মুক্তিলাভ করিয়াছেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটকের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই তাহাদিগকে এই মামলা করিতে হইয়াছে।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, এই মামলার তদন্ত ১৯৫৯ সালের নবেম্বর পর্যন্ত চলে। কোন মামলা, কোন প্রকার তথ্য, কোন চার্জ, কোন কাগজপত্র বা এজাহার ছাড়াই সরকার মামলা করিয়াছেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, জেলের মধ্যে আটক রাখার উদ্দেশ্যে জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে তাঁহাকে গ্রেফতার করা হয়। এমতাবস্থায় সরকারের পক্ষে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করিয়া উপায়ান্তর ছিল না।
সাক্ষীদের ভীতি প্রদর্শন
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, আনােয়ার আলী, গােলাম হায়দর চৌধুরীর মত ব্যক্তিদের যদি বলা হয় যে, তাহারা সাক্ষ্য প্রদান না করিলে তাহাদের গ্রেফতার করা হইবে। উহা হইলে তাহাদের মুখ খােলার উপায় নাই। কিন্তু কোর্টই হইল সত্য কথা বলার জন্য উপযুক্ত স্থান। কোর্ট ছাড়া আর কাহার কাছে তাহারা সত্য কথা বলিবে।
এজাহার প্রসঙ্গে
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেনঃ ইন্সপেক্টর জনাব জলিল খানের এজাহারে ১৫শত টাকা প্রদানের উল্লেখ ছিল না। মামলার ব্যাপারে তদন্তের পর্যায়ে তিনি অনুসন্ধান চালাইয়াছেন। তিনি মেসার্স মুজিবুর রহমান চৌধুরী, আনােয়ার আলী ও গােলাম হায়দার চৌধুরীর জবানবন্দী গ্রহণ করিয়াছেন। কতিপয় কাগজপত্র উদ্ধার করিয়াছেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তদন্ত করিয়া এজাহার প্রদান করিয়াছেন।
এই এজাহার ও চার্জশীট পর্যালােচনা করিলেও বিবাদীকে মুক্তি প্রদান করিতে হয়।
তদুপরি জনাব জলীল খান সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেন যে, এই মামলার ব্যাপারে ফাইন্যাল রিপাের্ট প্রদানের কথা তিনি বলিয়াছেন কি-না, উহা তাঁহার স্মরণ নাই। এই ইঙ্গিতটিও মুজিবরের বিরুদ্ধে মামলার অসারতা প্রমাণ করে।
জনাব সােহরাওয়ার্দী এজাহারের একটি অংশ পাঠ করিয়া বলেন যে, উহাতে বলা হইয়াছে, তাহারা (মুজিবুর রহমান চৌধুরী, গােলাম হায়দর চৌধুরী, আনােয়ার আলী ও সেকান্দর আলী) এইরূপ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আমরা যদি শেখ আবু নাসেরকে পার্টনার হিসাবে গ্রহণ করি উহা হইলে অনুমতি ও লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রীর সাহায্য পাইব? এই উক্তি হইতে দেখা যাইতেছে যে, এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে শেখ আবু নাসেরের কোন হাত ছিল না। এই সিদ্ধান্ত আল-আমিন ইণ্ডাষ্ট্রীজের উপরােক্ত পার্টনারদের ঘরােয়া ব্যাপার মাত্র।
তদুপরি এজাহারে “লাইসেন্স মঞ্জুরীর ব্যাপারে অফিসের কার্য পদ্ধতি লঙ্ন করা হইয়াছে বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছে। এক্ষেত্রেও শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কোন কথা বলা হয় নাই।
জনাব সােহরাওয়ার্দী উপসংহারে এজাহার প্রদান ও চার্জশীট দাখিল ইত্যাদির ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, প্রকৃত পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না থাকায় তাহাদিগকে এই দীর্ঘ সময় গ্রহণ করিতে হইয়াছে।
আদালতের এখতিয়ার
শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হওয়ার পর আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিবাদী পক্ষের কৌসুলী যে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন, উহার উত্তরে গতকল্য স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর যুক্তি প্রদর্শন করেন। তিনি ১৯৫৮ সনের সংশােধিত ফৌজদারী আইন, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি দমন আইন, বাতিল শাসনতন্ত্র প্রভৃতি হইতে সরকারী কর্মচারী বলিতে কি বুঝায়, উহা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কোন অফিসার কোন ফি বা কমিশন গ্রহণ করিয়া সরকারী দায়িত্ব পালন করিলে তাহাকে সরকারী কর্মচারী বুঝায়। অবশ্য তিনি বলেন যে, বাতিল শাসনতন্ত্রে মন্ত্রিগণ সরকারী কর্মচারী নহেন বলিয়া উল্লিখিত থাকিলেও প্রকৃত প্রস্তাবে নীতি হিসাবে মন্ত্রিগণ সরকারী কর্মচারী রূপে পরিগণিত হইয়া আসিতেছেন। অতএব, এই আদালতে প্রাক্তন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিচারের এখতিয়ার রহিয়াছে।
বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, জনাব আবুল মনসুর আহমদের মামলায় বিবাদীর পক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব আতাউর রহমান এ ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করিবেন। অতএব, তিনি এই মামলায় এ ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন হইতে বিরত থাকিতেছেন।
মূল মামলার সরকার পক্ষের কৌশুলীর যুক্তি প্রদর্শন
অতঃপর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটার জনাব আজীজ উদ্দীন আহমদ মূল মামলায় সরকার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন শুরু করেন। তিনি বলেন যে, এই মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সকল কাগজপত্র উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট মঞ্জুরীর জন্য পেশ করা হয়। দুর্নীতি দমন ব্যুরাের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারী, এডভােকেট জেনারেল সকল স্তরে কাগজপত্র পেশ করার পর এই মামলা পরিচালনার জন্য মঞ্জুরী পাওয়া গিয়াছে। এই মামলার তদন্তের পূর্বে যথাযথভাবে ঢাকা সদর মহকুমা হাকিমের অনুমতি গ্রহণ করা হইয়াছে। এই মামলা পরিচালনার জন্য আইনসম্মত সকল ব্যবস্থা অবলম্বিত হওয়ায় এই সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠিতে পারে না।
অতঃপর তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা দুর্নীতি ও বে-আইনী পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া তাহার ছােট ভাই শেখ আবু নাসেরের জন্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং আলআমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজ হইতে আওয়ামী লীগ তহবিল অথবা নিজের জন্য ১৫০০ টাকার আর্থিক সুবিধাও তিনি গ্রহণ করিয়াছেন। আনােয়ার আলী মৌখিক সাক্ষ্য প্রদানকালে বলিয়াছিলেন যে, একাউন্ট খাতা তাঁহার নিজের হাতের লেখা কিন্তু পরে বলিয়াছেন যে, প্রকৃতপক্ষে কোন অর্থ দেওয়া হয় নাই। কিন্তু তাহার পূর্ববর্তী জবানবন্দী ও ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত বিবৃতিতে প্রমাণ হইতেছে যে, উক্ত অর্থ সত্য সত্যই দেওয়া হইয়াছে। একাউন্ট বহিতে গত ১৯৫৮ সনের ২৬শে জুন এফিডেভিট ইত্যাদি খরচ বাবত একটি অঙ্ক প্রদর্শিত হইয়াছে। উহাই এই খাতার শেষ হিসাব। আনােয়ার আলী ও তাহার পিতা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ করায় ইহাই স্বাভাবিক হইয়াছে যে, এই একাউন্ট বহিতে সঠিক হিসাব প্রদর্শিত হইয়াছে।
জনাব আজিজুদ্দীন বলেন, এই মামলায় দুইজন প্রধান সাক্ষী পর পর “প্রতিকূল” ঘােষিত হওয়ার পর বাকী তিনজন প্রধান সাক্ষী স্বভাবতঃ বিবাদীর দ্বারা বশীভূত হইয়াছে এই মর্মে আমরা আদালতে দরখাস্ত দিয়াছি এবং তাহাদের সাক্ষী হিসাবে হাজির করিতে অসম্মতি প্রকাশ করিয়াছি। ফলে এই মামলায় সরাসরি কোন সাক্ষী না থাকায় আমাদিগকে রেকর্ড-পত্র ও প্রকৃত পরিস্থিতির উপর নির্ভর করিতে হইতেছে।
তিনি আরও বলেন যে, মুজিবুর রহমান চৌধুরী পুলিসের নিকট ডায়রীতে বলিয়াছেন যে, বিবাদীপক্ষ তাহাকে ধমক দিতেছে। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম হইতে বিমান ডাকে লিখিত একখানা পত্রেও শেখ আবু নাসের কর্তৃক ভীতি প্রদর্শনের কথা জানাইয়াছেন। ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত বিবৃতিতে ঘটনার কথা ব্যক্ত করিয়াছেন। কোথাও তিনি পুলিসের জুলুম ও ভীতি প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেন নাই। অনুরূপভাবে আনােয়ার আলীও কোথাও পুলিসের জুলুম ও অত্যাচারের কথা ইতিপূর্বে ব্যক্ত করেন নাই। পুলিসের নিকট জবানবন্দী, একাউন্ট বহি প্রদান, ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত বিবৃতি সব কিছুতেই তাহার সদিচ্ছার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু কোর্টে আসিয়া আনােয়ার আলী তাহার সাক্ষ্য পাল্টাইয়া দেওয়ায় তাহার সাক্ষ্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রহিয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, এই মামলায় সরাসরি সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়া গেলেও বা এজাহারে আওয়ামী লীগ তহবিলে ১৫শত টাকা প্রদানের কথা উল্লেখ না থাকিলেও উহাতে তদন্তকালে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পাওয়াতে কোন ত্রুটি ঘটে নাই। তিনি বলেন, তদন্ত কার্য অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে সাক্ষিগণ বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন। ফলে আদালত রেকর্ড-পত্র ও পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন বলিয়া তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অভিযােগ গঠন
গতকল্য সরকার পক্ষের সর্বশেষ সাক্ষী তদন্তকারী অফিসার জনাব মেহরাব আলীর জেরা সমাপ্ত হইলে স্পেশাল জজ জনাব এ, এস, এম, রাশেদ অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তি করিয়া কতিপয় চার্জ গঠন করেন এবং প্রত্যেকটি চার্জ তাহাকে শুনাইয়া তৎসম্পর্কে তাঁহার বক্তব্য কি জিজ্ঞাসা করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান তাহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ, যথা ১৯৫৬ সনের সেপ্টেম্বর মাস হইতে ১৯৫৭ সনের অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প বিভাগের মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে স্বীয় সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া আল-আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজকে একটি বস্ত্র ক্যালেণ্ডারিং মিল স্থাপনে অনুমতি প্রদান ও লাইসেন্স মঞ্জুরীর আশ্বাস দিয়া তাহার ভাই শেখ আবু নাসেরকে বিনা মূলধনে উক্ত প্রতিষ্ঠানের তিন আনা শেয়ার ও তজ্জন্য একটি পার্টনারশীপ দলীল করার ব্যাপারে বাধ্য করা এবং এইরূপে তাহার ভাই-এর জন্য আর্থিক সুবিধা গ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ ফান্ডের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠান হইতে ১৫০০ টাকা গ্রহণ করিয়া নিজের অথবা-আওয়ামী লীগ পার্টির জন্য আর্থিক সুবিধা গ্রহণ অভিযােগকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিবুর রহমান উপরােক্ত অভিযােগের উত্তরে আরও বলেন যে, আল আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজের সহিত তাহার সম্পর্ক কিছু ছিল কিনা উহা তিনি কখনও অবহিত ছিলেন না। তিনি বলেন যে, তিনি কোন প্রকার দলীল সম্পাদন সম্পর্কেও কিছুই জানিতেন না। তিনি বলেন, তিনি মন্ত্রী থাকাকালে নিজের জন্য বা তাহার ভাই-এর জন্য বা অপর কাহারও জন্য কোন প্রকার আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন নাই।
জনাব মুজিবুর রহমান আরও বলেন যে, আওয়ামী লীগ তহবিলের জন্য তিনি ১৫শত টাকা গ্রহণ করিয়াছেন, উহা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজান। কোন লােকই আল আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজের পক্ষ হইতে আওয়ামী পার্টির জন্য কোন টাকা দেয় নাই।
অতঃপর কোর্ট তাহাকে উপরােক্ত উক্তি ছাড়া আর কোন কথা থাকিলে বলার জন্য আহ্বান জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন বলেন : “মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। জনসাধারণের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটার পর একটা মিথ্যা মামলা করা হইতেছে। আমি যতদিন মন্ত্রী ছিলাম, কোনদিন আমি আমার ক্ষমতার অপব্যবহার করি নাই। জনসাধারণের খেদমত এবং কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়াই আমি দেশের জন্য কাজ করিয়াছি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়া সকলকে খুশী করা যায় না এবং কাহারও পক্ষে উহা সম্ভবপর নহে।”
তিনি আরও বলেন ঃ আমরা যারা পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ছিলাম- যখনই আমরা পূর্ব বাংলার প্রতি ন্যায় বিচার করার কথা বলিয়াছি, তাহাদিগকে ছলে-বলে-কৌশলে ও ষড়যন্ত্র করিয়া মিথ্যা মামলায় আসামী করিয়া জনসাধারণের কাছে ছােট করার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমরা যাহা করিয়াছি দেশের মঙ্গলের জন্যই করিয়াছি।
অতঃপর আদালত শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠন করেন। তাহার ভাই শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশে শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে তাহাকে দিয়া আল আমীন ইণ্ডাষ্ট্রিজের একটি বস্ত্র ক্যালেণ্ডারিং মিল স্থাপনের অনুমতি গ্রহণ ও লাইসেন্স প্রাপ্তির আশ্বাস ক্রমে উক্ত আল আমিন ইণ্ডাষ্ট্রিজে কোন মূলধন না খাটাইয়া তিন আনা শেয়ার প্রদানের শর্তে একখানা পার্টনারশীপ দলীল। সম্পাদনে বাধ্য করার অভিযােগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানকে পার্টনারশীপ দলীল সম্পাদনের অভিযােগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানকে তাহার সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার ও তাহার জন্য আর্থিক সুবিধা আদায়ে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার অভিযােগ আনয়ন করা হয়। তদুপরি আওয়ামী লীগ ফাণ্ডের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পার্টনার জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর নিকট হইতে নগদ ১৫শত টাকা গ্রহণ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রদানের অভিযােগও আনয়ন করা হয়।
শেখ আবু নাসের উত্তরে বলেন, আমার ভাই-এর সঙ্গে এ সম্পর্কে কোন আলাপ হয় নাই। আমি ১৯৫০ সাল হইতে ব্যবসা করিতেছি এবং আমার সঙ্গে ডকুমেন্ট আছে। আমার ভাই মন্ত্রী হওয়ার পূর্বেই মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সহিত আমার পানের ব্যবসা ছিল। আওয়ামী লীগ ফাণ্ডের জন্য টাকা নেওয়ার ব্যাপারটি সমস্তটা মিথ্যা। ক্যালেণ্ডারিং মিল স্থাপনের জন্য প্রয়ােজনীয় অনুমতি ও লাইসেন্স আমাদের কাগজ পত্রের ভিত্তিতেই পাইয়াছি। উহাতে আমার ভাই-এর কোন সম্পর্ক ছিল না। এই মামলায় বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌসুলী জনাব সােহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন। এডভােকেট জনাব আবদুস সালাম খান, জনাব জহীর উদ্দিন, জনাব এম, আজম, জনাব জিল্লুর রহীম ও জনাব কোরবান আলী। পক্ষান্তরে বাদী পক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটার জনাব আজিজ উদ্দিন আহমদ মামলা পরিচালনা করেন। তাঁহাকে সাহায্য করেন জনাব মােয়াজ্জেম হােসেন খান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব