আজাদ
২১শে মে ১৯৬০
শেখ মুজিবের মামলা
সরকার পক্ষের প্রথম সাক্ষী বিরােধী ঘােষিত
(কোর্ট রিপাের্টার)
ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ জনাব এ, এস, এম রাশেদের এজলাসে গতকল্য [শুক্রবার] প্রাক্তন প্রাদেশিক শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রী ও অধুনালুপ্ত প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবুনাসেরের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও দুর্নীতিতে সহযােগিতার অভিযােগে আনীত মামলায় সরকার পক্ষের প্রথম সাক্ষী জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরী বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে সাক্ষী বলেন, তিনি তাহার আবেদনের বলেই লাইসেন্স পান এবং এজন্য তিনি সেক্রেটারীয়েটের বাহিরে কাহারও নিকট তদবির করিতে যান নাই এবং দুর্নীতি দমন বিভাগের চাপে পড়িয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট (শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁহার ভাইএর উপর দোষারােপ করিয়া) জবানবন্দী দেন।
গতকল্য সকাল ৮টায় যথারীতি এই মামলার শুনানী আরম্ভ হইলে জনাব মুজিবর রহমান চৌধুরী এক নং সরকারী সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দান করিতে দাঁড়ান। তিনি বলেন যে, তিনি আমদানী রফতানীর ব্যবসায় করেন। তিনি জনাব গােলাম হায়দার ও হাজী সেকেন্দার আলী ও তাঁহার পুত্র আনােয়ার আলীকে চেনেন না। তাহাদের ঢাকা জেলার বাবুর হাটে কাপড় ক্যালেণ্ডারিংয়ের কারবার আছে।
তাহারা সাক্ষীকে বলেন যে, তাঁহারা কাপড় ক্যালেণ্ডারিং-এর একটা কারখানা খুলিতে চান। অতঃপর সাক্ষী ও গােলাম হায়দারকে “ম্যানেজিং পার্টনার” হাজী সেকেন্দার আলী ও আনােয়ার আলীকে “ফাইন্যান্সিং পার্টনার” করিয়া মেসার্স “আল আমীন ইন্ডাষ্ট্রিজ” নাম দিয়া একটী অংশীদারী ব্যবসা ভােলা হয়। এই প্রতিষ্ঠান মােমেনশাহী জেলার টাঙ্গাইলের সতীহাটীতে একটা কাপড় ক্যালেণ্ডারিং এর কারখানা খুলিবেন এবং নারায়ণগঞ্জের এম, এন রায় রােডে তাঁহাদের হেড অফিস থাকিবে বলিয়া স্থির হয়।
অতঃপর ৪ জন অংশীদারের স্বাক্ষরে ১৯৫৬ সালের আগষ্ট মাসে প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম দফতরে উক্ত কারখানা খােলার অনুমতি চাহিয়া দরখাস্ত করা হয়। ঐ সময় প্রাদেশিক সরকারের উক্ত অনুমতিদানের ক্ষমতা ছিল না। কেন্দ্রের আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু প্রাদেশিক সরকারের সােপারেশ আবশ্যক হইত।
দরখাস্ত করার পর উক্ত অনুমতি পাওয়া যায় না। সাক্ষী তাহাদের দরখাস্তের কি হইল জানার জন্য সেক্রেটারিয়েটে যাইয়া খােজ খবর লইতেন।
অতঃপর আওয়ামী লীগ সরকার কায়েম হয় এবং সরকার নূতন শিল্প ইউনিট খােলার দরখাস্ত আহ্বান করেন। তখন সাবেক দরখাস্তের বিষয় উল্লেখ করিয়া তাহারাও দরখাস্ত পেশ করেন। সাক্ষী উক্ত দরখাস্ত সম্পর্কে খােজ খবর লওয়ার জন্য সেক্রেটারীয়েটে যাইতেন এবং লাইসেন্সের ব্যাপারে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অতঃপর তাঁহারা দরখাস্তের গুণের ভিত্তিতে লাইসেন্স পান।
এই সময় সরকার পক্ষের এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, তিনি আগে হইতেই শেখ মুজিবর রহমানকে চিনিতেন এবং শেখ আবু নাসেরকে তাঁহার ছােট ভাই বলিয়া জানিতেন।
সেক্রেটারীয়েটে কোথায় খােজ খবর লইতেন, এই প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন যে, তিনি সেক্রেটারীর নিকট যাইতেন।
সেক্রেটারীয়েটের বাহিরে আর কাহারও নিকট গিয়াছিলেন কি? সরকারী উকিল প্রশ্ন করেন। উত্তরে সাক্ষী বলেন, ‘না’।
ইহার পর সাক্ষী আরও বলেন যে, দরখাস্ত করার পর এবং লাইসেন্স পাওয়ার আগে তাঁহারা শেখ আবু নাসেরকে তিন আনা শেয়ার দিয়া অংশীদার করেন। এই মর্মে একটি দলিল হয় এবং তাহারা ৪ জনেই স্বাক্ষর করেন। শেখ আবু নাসের কোন মূলধন নিয়ােগ করেন নাই কারণ ঐ সময়ে তাহার আবশ্যক ছিল না। জমি ক্রয়, কারখানার গৃহ নির্মাণ যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রভৃতি প্রাথমিক খরচ হাজী সেকেন্দার আলী ও আনােয়ার আলীর বহন করার কথা ছিল। তাহারা এই অংশীদারী কারবার চালানাের জন্য আবুনাসেরকে অংশীদার হইতে অনুরােধ করেন।
সাক্ষী আরও বলেন যে, ৮/৪/৫৯ তারিখে তিনি একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ীতে যাইয়া জবানবন্দী করেন। ম্যাজিষ্ট্রেট তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা দুর্নীতি দমন বিভাগের চাপে পড়িয়া বলিয়াছিলেন।
অতঃপর সরকারী উকিল সাক্ষীকে বিরােধী ঘােষণার ও তাঁহাকে জেরা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আদালত উক্ত প্রার্থনা মঞ্জুর করিলে সরকারী উকিল সাক্ষীকে জেরা করেন।
জেরায় সাক্ষী বলেন যে, তিনি ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আবদুল মজিদের নিকট উক্ত জবানবন্দী দান করেন। তিনি যাহা বলিয়াছিলেন ম্যাজিষ্ট্রেট সঠিকভাবেই তাহা লিপিবদ্ধ করেন। তবে ঐ সময় তিনি যাহা বলেন তাহা সত্য ছিল না। সাক্ষী আরও বলেন যে, তাঁহার উপর প্রদত্ত চাপ সম্পর্কে তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটকে ইশারা করেন।
তিনি আরও বলেন যে, সেদিন তিনি সত্য কথা বলেন নাই। আজ সত্য কথা বলিতেছেন। কারণ তিনি এখন সত্য কথা বলার সুযােগ পাইয়াছেন। বিবৃতির অংশ বিশেষ সরকারী উকিল তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলে তিনি বলেন যে, তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটকে উহা বলিয়াছিলেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, এই চাপ দেওয়ার কথা তিনি কোন ম্যাজিষ্ট্রেট বা সামরিক, বেসামরিক কোন ব্যক্তির নিকট ইতিপূর্বে প্রকাশ করেন নাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, জনাব সেকেন্দার আলী ও আনােয়ার আলী টাকা সরবরাহের অক্ষমতার জন্য এফিডেভিট দিয়া চলিয়া গেলে তিনি প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি লইয়া ফকির চাঁদ নামক এক ব্যক্তির নিকট যাইয়া তাহাকে এই ব্যবসায়ে অর্থ সরবরাহকারী হওয়ার অনুরােধ জানান।
সাক্ষীর জেরা শেষ হইলে আদালতের অধিবেশন অদ্য সকাল পর্যন্ত মুলতবী থাকে।
গতকল্য আদালত কক্ষে পূৰ্ব্ব দিনের মত লােকের ভীড় ছিল।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব