৩০ মার্চ ১৯৭১ঃ কলকাতার পথে তাজউদ্দীন
সকাল
সকালে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। এবার সোহরাব হোসেনের সহযোগিতায় একটি জিপ পাওয়া গেল। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে জীপ এগিয়ে চলল। পথের দু’ধারে বাংলার নব বসন্তের অপূর্ব শোভা, মায়াভরা বাংলারই প্রতিচ্ছবি বিরাজমান। অনুভূতির স্তরে স্তরে বার বার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন সৃষ্টি, ‘পায়ে চলার পথে’র কথা ‘এ যে চলার পথ ফেরার পথ নয়।’
কিন্তু আমি যেন মনে মনে বলেছি, কবিগুরু এ পথেই যে আমাদের ফিরে আসতে হবে। না হলে তুমি, এই শাশ্বত বাংলা ধরণীর ধূলায় বিলীন হয়ে যাবে। ১০টা ৩০ মিনিটে ঝিনাইদহে উপস্থিত হলাম। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য এমএ আজিজ ও এসডিপিও মাহবুবের সঙ্গে দেখা হলো। স্থানীয় খবরাখবর আদানপ্রদান হলো। এমএ আজিজ আমাকে একটি লুঙ্গি দিলেন। সেই লুঙ্গি পরে এবার আমরা চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
চুয়াডাঙ্গা
চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে মেজর ওসমানকে সংবাদ পাঠালাম। ইতোমধ্যে সংসদ সদস্য ডা. আসাবুল হক, আফজালুর রশীদ বাদলসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়। সীমান্তের আরও নিকটবর্তী হবার জন্য আমরা জীবননগর থানায় পৌঁছাই। আমাদের দুজনের সঙ্গে ছিলেন এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী এবং মাহবুব। সেখানে টঙ্গীর খালের ওপর এক কালভার্টের কাছে যাই। তৌফিক ও মাহবুব আমাদের খবর নিয়ে সীমান্তের ওপারে গিয়েছে।
আমীর উল ইসলাম ও আমি ওই কালভার্টের ওপর বসে থাকি। কি খবর আসে সেই অপেক্ষায়। আমি ভেবে নিয়েছি, সিগন্যাল যদি বাংলার স্বাধীনতার পরিপন্থী আসে তবে ওপারে যাব না। সীমান্তের ওপারে গিয়ে জীবন বাঁচিয়ে লাভ নেই। দেশের ভেতরে থেকেই যা কিছু আছে তাই নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখব। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই ন্যায়ের সংগ্রামে, বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রামে বিশ্ববাসীর নৈতিক সমর্থন আমরা পাবই।
নানা কিছু ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ড্রাইভার এসে সংবাদ দিল সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর একজন অফিসার এসেছেন। সেই অফিসার আমাদেরকে স্যালুট করলেন। বললেন, ডিআইজি গোলক মজুমদার সীমান্তের ওপারে অপেক্ষায় আছেন।
সীমান্ত
পায়ে হেঁটে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করলাম। গোলক মজুমদার জানালেন তিনি দিল্লীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছেন। আলোচনার সঙ্কেত পাওয়া গেল। ভবিষ্যৎ ভবিষ্যতেরই হাতে। গোলক মজুমদার সরাসরি দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন। সেখানে গোলক মুজমদার আমাকে একখানা চশমা এনে দিলেন। যেটার প্রয়োজন ছিল সব চাইতে বেশি।
রুস্তমজি
রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে আইএএফ-এর বিমান এলো দিল্লি থেকে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক রুস্তমজি রাজা গোপাল এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। তারপর একসঙ্গে গাড়িতে করে রাত দেড়টায় অসম ভবনে পৌঁছালাম। এতদিন দাড়ি কামানো হয়নি।
কাপড়চোপড় ছেঁড়া ময়লা। রুস্তমজি আমাদের দুজনকে পায়জামা পাঞ্জাবি দিলেন পরতে। তার আতিথেয়তায় খাবার শেষে সেই রাতেই আমাদের কথাবার্তা শুরু হলো।