দৈনিক ইত্তেফাক
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
প্রয়োজন হইলে সংগ্রাম করিয়া আবার কারাগারে যাইব,
কিন্তু দেশবাসীর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিব না :
ঢাকার বুকে সর্বকালের বৃহত্তম গণসম্বর্ধনা সভায় মুজিবের ঘোষণা
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঢাকার বুকের সর্বকালের বৃহত্তম গণসম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গতকাল (রবিবার) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকার পক্ষের সহিত প্রস্তাবিত রাজনৈতিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করিয়া দেশের উভয় অংশের পক্ষ হইতে দেশবাসীর অধিকারের দাবী উত্থাপন করিবেন এবং যদি উত্থাপিত দাবী গ্রাহ্য করা না হয় তবে সে বৈঠক হইতে ফিরিয়া আসিয়া দাবী আদায়ের জন্য তিনি দুর্বারতর গণ- আন্দোলন গড়িয়া তুলিবেন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জয়মাল্য কণ্ঠে ধারণ করিয়া বজ্রনির্ঘোষে তিনি ঘোষণা করেন যে, সংগ্রাম করিয়া আমি আবার কারাগারে যাইব, কিন্তু মানুষের প্রেম-ভালবাসার ডালি মাথায় নিয়া দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না। মুহুর্মুহু করতালি ও গগনভেদী জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন যে, বঞ্চিত বাঙ্গালী, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, পাঠান আর বেলুচের মধ্যে কোন তফাৎ নাই-কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ হইতে দেশের উভয় অংশের জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ হইল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক আজাদী।
গণ-সম্বর্ধনায় সংগ্রামী ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব শেখ মুজিবের স্কন্ধে অর্পণ করিয়া তাঁহার নেতৃত্বের প্রতি ছাত্র-জনতার পক্ষ হইতে অকৃত্রিম আস্থা প্রকাশ করে।
অভূতপূর্ব গণমহাসাগরের সামনে দাঁড়াইয়া শেখ মুজিবর রহমান সাম্প্রতিক কালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যাহারা আত্মাহুতি দিয়াছেন তাঁহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, জেলের তালা ভাঙ্গিয়া আমাদেরকে যে মুক্ত করিয়া আনা হইয়াছে তা ছাত্রজনতার সংগ্রামের এক মহাস্মরণীয় বিজয়। এই বিজয়ের দিনে তিনি ছাত্রদের ১১-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া ১১-দফার সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে শরিক থাকিবেন বলিয়াও সবাইকে আশ্বাস দান করেন।
প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর যোগদানের প্রশ্নে তিনি স্পষ্টভাষায় বলেন যে, আলোচনায় আমি অবশ্যই যাইব-কারণ নির্ভীক আপোষহীনভাবে কিভাবে দাবী পেশ করিতে হয় আমি তা জানি। দাবী আদায় না হইলে আবার আমি সংগ্রামকে দুর্বার হইতে দুর্বারতর করিয়া তুলিব, আবার আমি কারাগারে যাইব, আবার ছাত্র-জনতা সংগ্রাম করিয়া জেল হইতে আমাকে বাহির করিয়া আনিবে।
তাঁহার রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সংক্ষিপ্ত রূপরেখার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাই, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সার্বভৌম পার্লামেন্ট চাই, এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকুরি- বাকুরি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্ব পর্যায়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব চাই। আমি শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্যমূল্য চাই, কৃষকের উৎপন্ন দ্রব্যের উপযুক্ত মূল্য চাই, সাংবাদিকদের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই অঞ্চলের জন্যই আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাই। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যদি এক ইউনিট বাতিল করিতে চায় তবে অবশ্যই এক ইউনিট বাতিল করিতে হইবে এবং সাবেক প্রদেশগুলি “প্রাদেশিক” স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হইবে।
শেখ মুজিবর রহমান ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য মহল্লায় মহল্লায়, শহর, বন্দর, গঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া তিনি বলেন যে, আন্দোলন আমাদের চলিবেই; কিন্তু যে প্রকারেই হোক আমাদের শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখিতে হইবে। সেই সাথে তিনি সরকারকেও সর্বপ্রকার উস্কানিমূলক কার্য- কলাপ হইতে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
সরকারের প্রতি তিনি রাজনৈতিক হুলিয়া ও সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নেওয়ার দাবী জানান। প্রতিদানে তিনি সরকারকে আশ্বাস দেন যে, দেশে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব সংগ্রাম কমিটিই বহন করিবে।
মৃত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য প্রসঙ্গে
শেখ মুজিবর রহমান প্রদেশব্যাপী সাম্প্রতিক গণহত্যার ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের (নিহত ও আহত) জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দানের দাবী জানান। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি বেসরকারী সাহায্য কমিটি গঠন করা হইবে এবং উক্ত তহবিলের জন্য সকল মহলের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহ অভিযান চালানো হইবে।
গণ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে গণনায়ক শেখ মুজিবর রহমান ছাড়াও অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব তোফায়েল আহমদ, ছাত্র নেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন মানিক, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবুল হক দোলন ও মাহবুবুল্লাহ নেতাকে অভ্যর্থনা জানাইয়া ভাষণ দান করেন।
ইসলামাবাদ যড়যন্ত্র মামলা
শেখ মুজিবর রহমান অতঃপর তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে “ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা” নামে অভিহিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
শেখ মুজিব গতকাল রেসকোর্স ময়দানে “ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলার” পটভূমি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন যে, বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত যখন লাহোর আক্রমণ করে তখন পূর্ব পাকিস্তানের ৬ কোটি মানুষ দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে যে লাহোরের উপর আক্রমণ পূর্ব পাকিস্তানের উপরই আক্রমণ। এই মনোভাবের মধ্য দিয়া পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ঐক্যের এক চরম প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যাপক দূরত্বের ফলে সৃষ্ট বাস্তব সমস্যাদি প্রকট হইয়া দেখা দেয় এবং সবাই উপলব্ধি করিতে শিখে যে এক রাষ্ট্র হইলেও চরম বিপদের সময় কেহ কারও প্রত্যক্ষ কোন উপকারে আসে না। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরাইয়া দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান হয়।
এই উপলব্ধির আলোকে আমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে ছয়- দফা প্রণয়ন করি।
শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করিতে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ছয় দফায় তাই শঙ্কিত হইয়া উঠে এবং যে কোন প্রকারের হিংস্রতা ও বর্বরতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া হইলেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসেেনর এই দাবীকে দাবাইতে বদ্ধপরিকর হয়। এর ফলশ্রুতিই হইল এই তথাকথিত আগরতরা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলা সাজানোর মন্ত্রণালয় ছিল ইসলামাবাদ।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯