You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.24 | ছাত্র নেতৃবৃন্দের হুঁশিয়ারী : বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমা করা হইবে না | দৈনিক পয়গাম - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক পয়গাম
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
ছাত্র নেতৃবৃন্দের হুঁশিয়ারী : বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমা করা হইবে না
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

গতকল্য (রবিবার) রমনা রেসকোর্সে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক জনাব তোফায়েল আহমদ তাঁহার তেজস্বী বক্তৃতায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করিয়া ঘোষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার দাবী দাওয়ার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিলে দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা কোন নেতাকেই এমন কি শেখ মুজিবের ন্যায় জনপ্রিয় নেতাকেও ক্ষমা করিবে না। সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত শেখ মুজিবের সম্বর্ধনা সভায় সভাপতির ভাষণদানকালে ছাত্র নেতা জনাব তোফায়েল আহমদ উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাবেশে ভাষণদানকালে জনাব তোফায়েল আহমদ বলেন, বিগত ৯ই ফেব্রুয়ারী আমরা শপথ গ্রহণ করিয়াছিলাম যে, যতদিন পর্যন্ত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া না হইবে-যতদিন পর্য্যন্ত বাংলার কারাগার হইতে বাংলার মানুষকে বাহির করিয়া আনিতে না পারিব ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন থামিবে না। সম্বর্ধনা সভায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা জনাব মাহবুবুল হক দুলন, জনাব সাইফুদ্দিন মানিক জনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী ও জনাব মাহবুব উল্লাহ বক্তৃতা করেন।
জনাব তোফায়েল আহমদ আবেগময় ভাষায় বক্তৃতাকালে বলেন যে, ১১ দফা দাবী আদায়ের জন্য ছাত্র শ্রমিক, কৃষক, শহীদ হইয়াছেন এবং শহীদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের নেতাকে আমাদের মাঝে পাইয়াছি। তিনি শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন, তোমার প্রতি এদেশের মানুষের অগাধ বিশ্বাস রহিয়াছে, কিন্তু তাহার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিলে এদেশের মানুষ তোমাকেও ক্ষমা করিবে না। জনাব তোফায়েল আহমদ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ছাত্র সমাজ পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা দেশবাসীর মধ্যে ঐক্য স্থাপন করিতে সক্ষম হইয়াছে। আজ বাংলার শ্রমিক-কৃষক মাঝি তথা মেহনতি মানুষ শিখিয়াছে কিভাবে তাহাদের ন্যায্য অধিকার ছিনাইয়া আনিতে হয়।
জনাব তোফায়েল আহমেদ বক্তৃতাকালে মঞ্চের চারিদিক হইতে তাঁহার উপর পুষ্পস্তবক ও ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করা হয় এবং জনতা হর্ষধ্বনি করিয়া তাহাকে সমর্থন জানায়। তিনি বলেন যে, সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই সম্পৃক্ত করিয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছি। একমাত্র আমাদের মধ্যে ফিরিয়া আসে নাই সার্জেন্ট জহুরুল হক। জনাব তোফায়েল বলেন যে, সার্জেন্ট জহুরুল হক তাঁহার বুকের রক্ত দিয়া আমাদের এই সংগ্রামের পথকে সুগম করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলেন যে, আমরা সব সময়ই শান্তি চাহিয়াছি।
জনাব তোফায়েল জনসংখ্যার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবী রক্ষা না হইলে গোলটেবিল আলোচনা হইতে ফিরিয়া আসার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আবেদন জানান। ইহা ছাড়া বাংলা ভাষায় ‘জাতীয় সঙ্গীত’ ও ফৌজি ভাইয়েরা যেন ফৌজি অনুষ্ঠান বাংলায় শুনিতে পারে রাওয়ালপিণ্ডিতে গমন করিয়া সেই ব্যবস্থা করার জন্য জনাব তোফায়েল শেখ মুজিবের প্রতি অনুরোধ জানান।
জনাব তোফায়েল পূর্ব বাংলা হইতে কিণ্ডার গার্টেন স্কুল বিলোপ করার দাবী জানান। তিনি ১১ দফার ভিত্তিতে সংগ্রামে শরীক হওয়ার জন্যও শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানান। সর্বশেষে অন্ধকার বিদূরিত করিয়া যেন লাল সূর্য উঠে সেই কামনা করিয়া জনাব তোফায়েল তাঁহার ভাষণ শেষ করেন।

মাহবুবুল হক দুলন
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা জনাব মাহবুবুল হক দুলন সম্বর্ধনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ১১ দফার ভিত্তিতে যে আন্দোলন শুরু করিয়াছিল উহার স্বার্থক রূপায়ণ হিসাবে আমরা শেখ মুজিবর রহমানকে আমাদের মধ্যে পাইয়াছি।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবের প্রতি আমাদের পূর্ণ-বিশ্বাসপূর্ণ সমর্থন রহিয়াছে। কিন্তু সাথে সাথে ছাত্র সমাজ শেখ মুজিবকে স্মরণ করাইয়া দিতে চায় যে, দেশের ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকের একমাত্র কর্মসূচী হইতেছে ১১ দফা। তিনি বলেন, ১১ দফা দাবীকে একমাত্র কোন গণতান্ত্রিক সরকারই গ্রহণ করিতে পারে—আইয়ুব সরকারের ন্যায় কোন স্বৈরাচারী সরকার এই দাবী মানিতে পারে না। জনাব মাহবুবুল হক দুলন বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের সংগ্রামে সংগ্রামী মানুষ হিসাবে আপনাকে আমরা আমাদের সাথে চাই।
তিনি বলেন যে, ১১ দফা দাবীর সার্থক রূপায়ণ ছাড়া যে কোন আলোচনা হউক না কেন, বাংলার মানুষ কখনও তাহা মানিয়া নিবে না। তিনি বলেন, বাংলার মানুষ প্রমাণ করিয়া গিয়াছে যে, আজ যে গণ- আন্দোলনের সূচনা হইয়াছে ছাত্র সমাজই উহার পৃথিকৃৎ।
জনাব মাহবুব শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে, যদি আপনি ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু করেন তাহা হইলে বাংলার ছাত্র সমাজ আপনার পিছনে থাকিবে।

সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক
সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক রেসকোর্সের সম্বর্ধনা সভায় বলেন যে, ব্যাপক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে আজ আমরা শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পাইয়াছি। জনাব সাইফুদ্দিন মানিক স্বভাব সুলভ তেজস্বী কণ্ঠে বলেন যে আপনাকে পাইয়া দেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এখনও বহু রাজনৈতিক কর্মীই বহু দেশপ্রেমিকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি রহিয়াছে।
তিনি বলেন, আপনার নিকট আমাদের দাবি-যে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আপনাকে ফিরাইয়া আনিয়াছি। সেই আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়া আপনি রাজনৈতিক কর্মীদের ফিরাইয়া আনুন।
জনাব সাইফুদ্দিন মানিক বলেন, আমাদের পূর্বশর্ত এখনও পূরণ করা হয় নাই। গণ-আন্দোলনে যাহারা পুলিশ সামরিক বাহিনীর গুলীতে বেয়নেটে নিহত বা আহত হইয়াছেন তাহাদের ক্ষতিপূরণ আজও দেওয়া হয় নাই। তিনি বলেন, কাজেই আমাদের অনুরোধ আপনি গোলটেবিল বৈঠকে যাইবেন না।
জনাব সাইফুদ্দিন মানিক বলেন, যে আইয়ুব সরকার আমাদের মায়ের বুক হইতে পুত্রকে ছিনাইয়া নিয়াছে-ভাইয়ের বুক হইতে ভাইকে ছিনাইয়া নিয়াছে-বন্ধুর কাছ হইতে বন্ধুকে ছিনাইয়া নিয়াছে সেই আইয়ুবকে ক্ষমতায় রাখিয়া কোন আলোচনা হইতে পারে না। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের বুকের রক্ত দিয়া যে আন্দোলনকে আগাইয়া নিয়াছে-সেই সংগ্রামে শরীক হওয়ার জন্য জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক শেখ মুজিবকে অনুরোধ জানান। জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক বলেন, আজ আইয়ুব শাহী নানা রকম টোপ-নানা রকম প্রলোভন প্রদান করিতেছে। তিনি ঘোষণা করেন, আমরা শাসনতন্ত্র সংশোধন চাইনা–আমরা এই শাসনতন্ত্র বাতিলের দাবী করিতেছি।
তিনি বলেন যে, আইয়ুব সরকার কোন রকম প্রলোভন দিয়াই পূর্ব বাংলার জনসাধারণকে ধোঁকা দিতে পারিবে না।

খালেদ মোহাম্মদ আলী
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের দাবী আদায়ের একমাত্র পথ রহিয়াছে সংগ্রামের পথে।
তিনি শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, পূর্ব বাংলার মানুষ আজ নেতার দিকে তাকাইয়া আছে-নেতার বহু সহকর্মী এখনও হুলিয়ার ভয়ে আত্মগোপন করিয়াছে। এইসব রাজকর্মীর মুক্তির ব্যবস্থার জন্য জনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানান।

মাহবুবুল্লাহ
সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা জনাব মাহবুবুল্লাহ সম্বর্ধনা সভায় ভাষণদানকালে বলেন, এদেশের শত শত বীরের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পাইয়াছি।
তিনি শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন, বহু শহীদের বুকের রক্তে লেখা যে নাম-সেই ১১ দফাকে আপনি সংগ্রামের মাধ্যমে আগাইয়া নিয়া চলুন।
জনাব মাহবুবুল্লাহ বলেন যে, এখনও বহু রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি রহিয়াছে ফলে বহুকর্মী এখনও আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছে।
তিনি শেখ মুজিবের উদ্দেশে বলেন, আজ আমাদের দাবী একটি মাত্র রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধেও হুলিয়া জারি থাকা পর্যন্ত আপনি গোলটেবিল বৈঠকে যাইবেন না।
তিনি বলেন যে, আজও প্রেস ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল হয় নাই। তিনি বলেন, আইয়ুব সরকারের সহিত কোন আপোষ নাই। এ সরকারের সহিত আমাদের মরণজয়ী লড়াই। জনাব মাহবুবুল্লাহ বলেন, যতদিন পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কায়েম না হইবে যতদিন পর্যন্ত ১১-দফা দাবী কায়েম না হইবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলিবে।
তিনি বলেন, মানুষ আজ মরণকে ফুলের মালার মত বরণ করিয়া নিয়াছে। কাজেই জানাইয়া দিতে চাই সাম্রাজ্যবাদীর শৃঙ্খল ভিন্ন ও অর্থনৈতিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলিবে। জনাব মাহবুবুল্লাহ মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের আহ্বান জানান। সব শেষে তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলার মানুষ সংগ্রামে প্রস্তুত রহিয়াছে কিন্তু সংগ্রাম করিতে হইলে শৃংখলা ও শান্তির প্রয়োজন রহিয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯