বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮জুন, শুক্রবার, ২৪শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
আজ মহান সাতই জুন
আজ ঐতিহাসিক সাতই জুন। ১৯৬৬ সালের সেই মহান সাতই জুন। বাঙালি জাতির মহা জাগরণের দিন। প্রতি বছর এই দিনটি আমাদের মাঝে ফিরে আসে। আমরা এর উপস্থিতিতে স্মৃতিচারণ করে শপথ গ্রহণ করি। মূলত সাতই জুন বাংলার মানুষের প্রথম একটি সুস্পষ্ট দাবি ভিত্তিক সফল আন্দোলনে অংশগ্রহণের দিন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত তথাকথিত যুদ্ধের পর অনিবার্য যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছিল তা হলো বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণে কোন ব্যবস্থাই শাসকগোষ্ঠীর নেই। ’৬৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রাপ্ত কমিশনের বৈঠকে যোগদান করে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রখ্যাত ছয় দফা দাবি পেশ করেন। বৈঠকে যোগদান কারী নেতারা ছয় দফা দাবির বিরোধিতা করায় বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে দেশে ফিরে এসে সাংবাদিকদের মাধ্যমে ছয় দফা ঘোষণা করেন। পরে বঙ্গবন্ধু আরো বিস্তারিত ভাবে ছয় দফার ব্যাখ্যা দান করেন। জনগণ ছয়দফার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে শাসকগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে উঠে। যে সকল বিরোধী দল প্রাপ্ত কমিশনের যোগদান করে ছয় দফার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিল তারা শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করে। যখন ছয় দফার কর্মসূচিতে জনগণ সাড়া দিতে থাকে তখন শাসকগোষ্ঠীর পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেন ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বাংলার গ্রাম গঞ্জের ছয়দফার বাণী পৌঁছে দেবার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি শুরু করেন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলার মানুষ ছয় দফা কর্মসূচির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ছ’দফার জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয়ে তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় হুমকি প্রদান করেন এবং তারপরই বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও সাতই জুন দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হরতাল ডাকা হয়। ছেষট্টির সাতই জুন গোটা জাতির সামনে একটি পরীক্ষামূলক দিন ছিল। হরতাল সফল হবেই এমন আশা করা সেদিন ছিল দুরাশা মাত্র। শাসক গোষ্ঠীর তার সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করেছিল এ হরতালের। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র এবং শক্তিকে পরাভূত করে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ শহর সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। জনগণ তাদের প্রাণের দাবী কে পূর্ণ হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়। সাতই জুনের আন্দোলনে অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি দিক রয়েছে তা হলো দেশের শ্রমিক সমাজ তাদের পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করেছিল হরতাল পালনের মাধ্যমে। বোধকরি ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো তাদের একাত্মতা ও সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেছিল সাতই জুনে।
নানা কারণে সাতই জুন আমাদের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রথম বাংলার শ্রমজীবী মানুষ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত থেকে সেই আন্দোলনকে বৈপ্লবিক আন্দোলনের রূপ দান করেন। সনাতন ও বনেদি ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের দ্বিধাগ্রস্থ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখে বাংলার শ্রমিক সমাজ প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগ্রামের তাদের ভূমিকা পালনের কল-কারখানার গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাতারে শামিল হন। এর পূর্বে কোন রাজনৈতিক সংগ্রামের শ্রমিক সমাজের এমন সার্বিক একাত্মতা পরিলক্ষিত হয়নি। অন্যদিকে গোটা জাতিকে একটি সুস্পষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে একাত্ম করার প্রচেষ্টা এটাই প্রথম বলে অভিজ্ঞজনের ধারণা। দেশের এতকালের রাজনীতির যেন সাতই জুনে এসে একটি পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরিত্র পায়। গোটা জাতি ছ’দফা কর্মসূচির মাধ্যমে যেন তাদের দাবি-দাওয়া পূর্ণ ছবি দেখতে পায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগোছালো কর্মপ্রবাহ ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। সাতই জুনের হরতালে তাই মনু নিয়া সহ বিভিন্ন স্থানে শাসক বাহিনীর গুলি বর্ষণে যেসকল সাথীরা শহীদ হন তাঁরা আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বিজয়ের বীর আত্মা। তাদের আত্মত্যাগীই জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মহা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। ঔপনিবেশিক শাসনের মুলভে দিতে গিয়ে সজোরে আঘাত করেছিল সাতই জুন এর আন্দোলনের সাফল্য। শাসকগোষ্ঠীর যথার্থ প্রমাদ গুনেছিল সাতই জুন এর সাফল্য দেখে। সাতই জুনের হরতালের সাফল্য দেখে দেশের অসার তাত্ত্বিক ও হঠকারী বিপ্লবীরাও সেদিন প্রমাদ গুনেছিলেন। ছ’দফা যে সত্যিকার অর্থে জনগণের মুক্তির সনদ একথা স্বীকার করেননি সেদিন অনেকেই। ফলে অসার তাত্ত্বিকরা ও তথাকথিত বাম হঠকারী বিপ্লবীরা সাতই জুনের কর্মসূচির বিরুদ্ধে চালিয়েছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ষড়যন্ত্র। বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কে নস্যাৎ করার জন্য তারা সেদিন তৎপর হয়ে উঠেছিল। সাতই জুনের আন্দোলনের মধ্যে সি, আই এর হাত এবং পেন্টাগনের চক্রান্ত আবিষ্কার করে গণবিরোধী স্বৈরাচারী শাসক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে বক্তব্য বিবৃতি ও তারা সেদিন প্রচার করেছিল। তথাকথিত বামপন্থী নেতৃত্বের এই গনবিরোধী ভূমিকা সেদিন ছ’দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিল তা রোধ করতে পারেনি। আন্দোলনে গণ নির্ঘোষ ও বিবর্তনের পথ ধরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সাতই জুনের আন্দোলন ছিল আজকের স্বাধীনতার প্রথম সুস্পষ্ট বিকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যার সূচনা হয়েছিল, ছেষট্টির আন্দোলনে তার বিকাশ ঘটেছিল। এই বিকাশই একদিন জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এনে উপস্থিত করেছিল। সাতই জুন এর শহীদ মনু মিয়া ও অন্যান্যদের বিদেহী আত্মার প্রতি আমরা সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। স্মৃতিচারণের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা বলব ছয়দফার যে সুস্পষ্ট কর্মসূচি একদিন জাতিকে পথ দেখিয়েছিল তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা সামনে রেখে আজকের স্বাধীনতা স্বাধীন দেশে আমাদের উচিত হবে এই সুস্পষ্ট কর্মসূচির অধীনে প্রতিক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া।
একটি নয়ঃ একশ’ পঁচিশটি
এ আর নতুন কোন খবর নয়। পুরনো খবর। পুরানো কথাতেই আবার নতুন করে বলতে হয়। কেননা দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেটুকু উন্নতি হয়েছে তারই মধ্যে দু একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে সবকিছুতেই লেজেগোবরে এক করে দিচ্ছে।
স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে যে, পাবনা সদর মহকুমার ফরিদপুর থানা মান্নান গ্রামে প্রায় ২৫ জন কুখ্যাত সশস্ত্র ডাকাত ১২৫টি বাড়িতে ডাকাতি করেছে। ওই গ্রামের একটি প্রতিনিধিদল পাবনার পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে এই তথ্য প্রকাশ করেন। তারা জানমালের নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেন।
ডাকাতি যেমন গ্রামে হচ্ছে তেমনি শহরেও ডাকাত মুক্ত নয়। এইতো গত ৩রা জুন রাত ১০টায় চট্টগ্রাম ছেড়ে আসা এক নম্বর আপ ঢাকা মেলে ডাকাতদের হাতে ১জন যাত্রী নিহত দুজন গুরুতর আহত হন। ডাকাতরা চলন্ত ট্রেন থেকে ৪ জন যাত্রীকে ফেলে দিয়েছে। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে ৪২ হাজার টাকা লুট করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ট্রেনে ডাকাতি আরো হয়েছে। গত মাসের ১৮ তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অদূরে রাজশাহী এক্সপ্রেস এর ডাকাতি হয়েছে সে সময় ডাকাতরা দুজন যাত্রীকে ছুরিঘাতে মারাত্মকভাবে আহত করে।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, গ্রামে শহরে প্রায় একই অবস্থা বিদ্যমান। এ যেন সেই কুজোর মতই অবস্থা। কুজোর চিৎ হলেও যা উপুৎ হলেও তাই। দুই অবস্থাতেই তার কোন সুবিধা নেই।
একথা তো আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, জানমালের নিরাপত্তার অভাব জাতীয় জীবনের সুষ্ঠু বিকাশের পথে অন্তরায়। আমাদের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সুস্থ ও সবল করে তুলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে উপাদান বৃদ্ধি। সে উৎপাদন বৃদ্ধি হতে হবে কলে কারখানায় ক্ষেতে-খামারে সর্বত্রই। অথচ স্বাধীনতার পর এক শ্রেণীর সমাজবিরোধীরা দেশের সর্বত্রই সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। ওরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আজকের দিনে গ্রামের মানুষকে একটা অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। কখন দুর্বৃত্তরা হামলা করবে এ চিন্তায় তারা জর্জরিত।
গ্রামবাংলায় ডাকাতি, ট্রেন ডাকাতি, লঞ্চ ডাকাতি, বাস ডাকাতি ইত্যাকার ডাকাতি এখন কিছু অভাবনীয় ব্যাপার নয়। এ গা সহা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা এমন কথা বলবো না যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি একেবারেই হয়নি। হয়েছে। তবে যেটুকু হওয়া প্রয়োজন তা হয়নি। অথচ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন না হলে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে আমরা একটা নতুন উৎপাত এর কথা উল্লেখ করতে চাই। এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, এক মহাকুমা থেকে অন্য মহাকুমায় অথবা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে খাদ্যশস্য আদান-প্রদান করা বেআইনি নয়। অথচ প্রায়ই এমন ঘটনা কথা শোনা যাচ্ছে যে, একশ্রেণীর সমাজবিরোধীরা এসব খাদ্যশস্য আনা নেওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছেন। এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে খাদ্যশস্য আনা-নেওয়া করা। আর এরই পরিণতিতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। লক্ষ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খাদ্যশস্যের দামের মধ্যে খুব একটা ভারসাম্য থাকছে না।
আমরা আবার পুরনো কথাই নতুন করে বলবো যে, সরকারী প্রশাসনযন্ত্রকে সাহায্য করার জন্য সরকার যেখানে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেছেন সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে এটাই দেশের জনসাধারণ আশা করে। তা না হয়ে যদি ট্রেন ডাকাতি লঞ্চ ডাকাতির অথবা একই রাতে যদি ১২৫টি ডাকাতি একই গ্রামে হয় তাহলে ভাববার কথা বৈকি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক