You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৯ই জুন, শনিবার, ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

দুঃখজনক এ দুর্ঘটনা

ঢাকা ডেমরা রোডে গত পরশুদিন এক মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মতে কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশ জন যাত্রী এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আহত হয়েছেন চল্লিশ জন। আহতদের একজনের অবস্থা খারাপ হেতু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে মহিলা ও কয়েকজন শিশু রয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ। দুর্ঘটনায় পতিত বাসে কতজন যাত্রী ছিলেন এবং কতজন নিহত ও কত জনকে উদ্ধার করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া সম্ভব হয়নি। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানা গেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনের যে বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে তা একটি বেবিট্যাক্সি সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। বাস খানা আদমজীনগর থেকে আসছিল এবং ওই বেবিট্যাক্সিটি যাচ্ছিল আদমজী নগরের দিকে। সংঘর্ষের ফলে বাসটি দ্রুত পাস কাটাবার প্রচেষ্টা করতেই অনেক নিচু কাদের মধ্যে কয়েকটি চক্কর খেয়ে পড়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে মাতুয়াইল কাঠের পুল এর নিকটে। মাতুয়াইল গ্রামের জনসাধারণ সর্বাগ্রে দুর্ঘটনায় পতিত বাসের উদ্ধার কাজে যোগদান করেছিল। তাদের মধ্যে পানিতে ডুবে যায় তখন ভেসে যাওয়া তিনটি বাচ্চাকে উদ্ধার করেছে জৈনিক মাতুয়াইলবাসী। কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক যে ঘটনা তাহলো দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত দমকল, পুলিশ ও বিআরটিসি বা কোন সরকারি কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার লোক ঘটনাস্থলে যান নি। সংবাদে বলা হয়েছে- দুর্ঘটনা ঘটেছিল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। আর দমকল বাহিনীর একটি গাড়ি ঘটনাস্থলে প্রথম পৌঁছেছে দশটার দিকে। পুলিশের লোক পৌঁছেছে প্রায় এগারোটার দিকে। তারা উদ্ধার কাজে যোগ দেননি। অন্য একটি খবরে জানা গেছে যে, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরও উদ্ধার কাজের জন্য উপস্থিত দলের গরিমশি উপস্থিত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং পুলিশের ও দমকল বাহিনী লোকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির পর্যায়ে উপনীত হয়। পুলিশ এসময় জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বহু বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে সড়ক পরিবহন সংস্থার বাস দুর্ঘটনা স্বাধীনতার পর এটাই প্রথম। এবং মর্মান্তিক। ইতিপূর্বে স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কুমিল্লা রোডে ইঞ্জিন ব্লাস্ট করে একটি বিআরটিসি বাস দুর্ঘটনা হয়। এতে ড্রাইভার কন্টাকটার সহ মোট ৬২ জন যাত্রী নিহত হয়েছিল। তবে ব্যক্তি মালিকানার বাস প্রায়শই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা একটি দায়িত্বশীল সংগঠন। এই সংস্থার বাস গুলোর প্রতি স্বাভাবিক কারণেই জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। সময় চালনা ও সকল ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিক থেকে সড়ক পরিবহন সংস্থার যানবাহন মানুষের আস্থা অর্জন করেছে অনেকখানি। কিন্তু বর্তমানে মানুষের সেই আস্থাও বিলীন হবার পথে। সরকারি যানবাহন যেন আজ আরও বেশি অনিশ্চয়তার আখড়া হতে বসেছে। উল্লেখিত গত পরশুদিন এর বাস দুর্ঘটনার মধ্য থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে তাহলো দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি বাস বেবিট্যাক্সিকে ধাক্কা দিয়েছে, রাস্তা প্রশস্ত নয় বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতেই দুর্ঘটনায় পতিত, দায়িত্বহীন ড্রাইভার এবং বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের তালবাহানা ও দায়িত্ব পালনের শৈথিল্য, সাধারণ গ্রামবাসীর মানবতাবাদি দ্রুত উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশের বাড়াবাড়ি, নিহত-আহতদের সংখ্যা বলতে গিয়ে হাসপাতাল, পুলিশ, দমকল ও বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের একে অন্যের সঙ্গে বৈপরীত্য প্রদর্শন প্রভৃতি। অতীতেও দেখা গেছে যে, কোন একটি দুর্ঘটনার বেলাই উদ্ধারকারী বাহিনীগুলোর শৈথিল্য এবং তথ্য প্রদানের ব্যাপারে একে অন্যের সঙ্গে কন্ট্রাডিকশন এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এর পরিসমাপ্তি হওয়া দরকার। প্রত্যেকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী বা ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব পালনে অবশ্যই তৎপর হতে হবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়তা থাকা আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। রাস্তার প্রশস্ততা কম বলে এবং ওভারটেক করার প্রচেষ্টার দরুন সর্বোপরি ড্রাইভারদের খামখেয়ালীর জন্যই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এরপর রয়েছে বাসের ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা অত্যন্ত বিপদজনক কার্যকলাপ। তাছাড়া হাইওয়ের যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে যে নিয়ম বা আইন রয়েছে তা কেন কার্যকরী হয় না তাও বোধগম্য নয়। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দুর্ঘটনার কারণে যে সকল মহিলা ও শিশুসহ অন্যান্যদের জীবন বিনষ্ট হয়েছে আমরা তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের শোকসম্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। বাস দুর্ঘটনার ব্যাপারে অবিলম্বে একটা তদন্ত পরিচালনা করা হোক এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান করে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করা হোক।

খাদ্য মন্ত্রীর আশ্বাস

চালের দর বাড়ছে। বাড়ছে তো বাড়ছেই। এবার আর কোনো শেষ নেই। কোথায় গিয়ে এই মূল্য স্থিতিশীল হবে তা কেউ বলতে পারে না। চুয়াত্তরের এক’ মাসেই চালের দাম বেড়েছে প্রায় একশ টাকা। খাদ্যমন্ত্রী এপ্রিলের প্রথম দিনেই জনসাধারণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন দু-একদিনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় চালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। সেদিন ঢাকার বাজারে চালের দাম ছিল একশ পয়তাল্লিশ থেকে একশ পঞ্চাশ টাকা। তখন সরকারি গুদামে প্রচুর চাল মজুদ থাকা থেকে শুরু করে সারাদেশে নিয়মিত ও ব্যাপকভিত্তিক মার্কেটিং অপারেশন শুরু করা-এসব আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে আশ্বাসে কাজ হয়নি। মন্ত্রীমহোদয়ের অভয়বাণী সংবাদপত্র প্রকাশের দশ দিনের মধ্যে চালের দাম দশ টাকা বেড়ে যায়। মণপ্রতি চালের দাম দাঁড়ায় একশ ষাট টাকা থেকে পয়ষট্টি টাকা।
সেই রেশ আজ পর্যন্ত চলছে। মফস্বল শহর থেকে খবর আসছে সে সকল স্থানে ইতিমধ্যেই চালের দাম দু’শ’ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কোথাও কোথাও চাল বিক্রি হচ্ছে দু’শ’ দশ-পনেরো টাকায়। খাদ্যমন্ত্রী চালের এই অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে গত পরশু বার্তা সংস্থা এনার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পুনরায় সারাদেশে খাদ্যশস্যের দাম কমানো ও তার স্থিতিশীল করার জন্য আশু ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন দেশের সর্বমোট খাদ্য চাহিদার ১১১ লাখ টন খাদ্যশস্য ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছে; এছাড়া জরুরি চাহিদা মোকাবেলায় উদ্দেশ্যে ‘বাফার স্টক’ রাখার জন্য তিন লক্ষ টন খাদ্যশস্য আনয়ন করা হচ্ছে।
দু’মাস আগে তিনি খাদ্য সংকটকে কৃত্তিম বলে অভিহিত করেছিলেন। চাল ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ভালো কথায় কাজ না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত পরশু সাক্ষাৎকারে তিনি কিন্তু সেই ব্যবসায়ীদের শুধু দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন প্রতিকূল আবহাওয়া, টাকার মূল্যমানের স্থিতিশীলতা, অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিকেও। আমরা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি না, কিন্তু একই সঙ্গে এটিও মেনে নিতে পারি না শুধু এই কারণগুলোর জন্য চালের দাম দু’শর কোঠা পেরিয়ে যাবে এবং তারপর ও নিশ্চয়তা থাকবেনা কোথায় গিয়ে এই রেসের অবসান ঘটবে।
খাদ্যমন্ত্রী আরেকটি কথা বলেছেন যা আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করছি। তিনি বলেছেন খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দুর্গত এলাকা গুলোতে সরকার দ্রুত খাদ্যশস্য পাঠাবেন এবং বিশেষ বরাদ্দ মঞ্জুর করবেন। সরকার যাই বলুন বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তারা ইচ্ছে করলেই চালের দাম কমাতে পারবেন না। আর চালের দাম কমানোর জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল, নানা স্থানে নানা ভাবে সরকারি এবং সরকার দলীয় নেতারা যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন সেগুলো বাস্তবায়নে সরকার সফল হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার সে পথও মাড়ায়নি। এখন দুর্গত এলাকায় দ্রুত খাদ্যশস্য সরবরাহ এবং বিশেষ বরাদ্দ মঞ্জুরের ব্যবস্থা সরকার যদি সত্যি গ্রহণ করেন তবে সেই দুর্গত এলাকায় দুর্গতি আংশিকভাবে হলেও কমবে।
সর্বশেষে আমার সরকারের কাছে আমরা একটি আবেদন রাখবো। দেশের অবস্থা আসলেই ভীষণ খারাপ। অনাহারে আর খাদ্যের অভাবে কচুঘেচু খেয়ে নানারকম ব্যাধির শিকারে পরিণত হয়ে মানুষ মরছে। নির্ধারিত লোকেরা একটা দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন-যাপন করছে। চালের কথা তো ছেড়েই দিলাম-গ্রাম অঞ্চলের কৃষকদের কাছে আটা গমও দুর্লভ সামগ্রী হয়ে পড়েছে। তাদের এ দুঃসহ দুর্ভোগের বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ আর সরকারি-বেসরকারি নেতৃবৃন্দের পারস্পারিক দোষারোপ করে কোন ফায়দা হবে না। মানুষ বাঁচতে চায়। সুন্দরভাবে না হোক স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তাদের দিতেই হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!