পূর্ববাংলায় নজরুল
আমি আপনার বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিকের গ্রাহক ও নিয়মিত পাঠক। ২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত শ্রীহাসান মুরশীদের পূর্ব বাংলায় নজরুল’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। নজরুলকে সামনে রেখে পূর্ববাংলায় যে রবীন্দ্র বিরােধী ও ব্যাপক অর্থে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিরােধী চক্রান্ত চলেছিল, তার মুখােস শ্রীমুরশীদ খুলে দিয়েছেন। নজরুলের দুর্ভাগ্য বিকৃত ও খণ্ডিত অবস্থায় তার কাব্য কবিতা হাতিয়ার জুগিয়েছে চক্রান্তকারী পশ্চিম পাকিস্তানী ও তাদের ধ্বজাধারীদের হাতে। একাধিক প্রতিভার তুলনা করতে যাবার ভিতরে-বিশেষত তাদের একজনকে বড় আর অন্যজনকে ছােট প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে প্রণােদিত প্রয়াসের মধ্যেই একটা মূঢ়তা আছে। তার উপর যে সব যুক্তির সাহায্যে নজরুলের মহত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলিও অনেকাংশে অর্থহীন, কতগুলি তাে বেশ হাস্যকরও। মহৎ কবি মাত্রই যে সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বচারী, তথাকথিত সেই নজরুল প্রেমিকরা তা ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন। যে রবীন্দ্রনাথের বিরাট প্রতিভার ছত্রছায়ায় তার সাহিত্য সাধনার স্তরে স্তরে বাংলা ভাষা তার শক্তি ও সৌন্দর্যের সন্ধান পেয়ে পরিপুষ্ট করেছে নিজেকে, তার কাছে ঋণ তার সমকালীন ও পরবর্তীকালের সকল কবি ও লেখকের অনস্বীকার্য। রবীন্দ্ররীতি অস্বীকার করে কাব্যচর্চায় একদিন যারা অগ্রণী হয়েছিলেন, উত্তরকালে তারা অনেকেই অকুষ্ঠিতভাবে রবীন্দ্র ঋণ স্বীকার করে গেছেন। নজরুলও সেই ঋণ স্বীকারে কার্পণ্য করেননি। নজরুল সংকীর্তনের বিপুল আওয়াজ তুলে রবীন্দ্রনাথকে অপসারণের যে প্রয়াস পূর্ববাংলায় চলেছিল স্বাভাবিক কারণেই তা ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সংস্কারমুক্ত চিন্তাধারার জাগরণ হবার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয়েই স্বস্থানে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, এটা আমার জন্য খুবই আনন্দজনক। কেবল বেদনা বােধ হয় এই ভেবে যে আজীবন অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহী কবি নজরুল তাকে ঘিরে এই ধর্মান্ধতাকেন্দ্রিক এই যে অকারণ মাতামাতি যা অস্পষ্টতই তার প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ অথবা শ্রদ্ধাবােধ থেকে উৎসারিত নয়-তার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠতে আজ তিনি অক্ষম।
-শ্রীদিপঙ্কর গােস্বামী
কটক
নজরুল প্রসঙ্গে
দেশ পত্রিকার ২৯ সংখ্যায় (৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮) হাসান মুরশিদের লেখা পূর্ব বাংলায় নজরুল প্রবন্ধটি পড়লাম। নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী মনােভাবের জন্য এবং বক্তব্যের স্পষ্টতা ও ঋজুতার জন্য স্বভাবতই আমাদের প্রাণের কবি। উপরােক্ত প্রবন্ধে হাসান মুরশিদ সাহেব ওপার বাংলায় নজরুল চর্চা সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠা আলােচনা করেছেন এবং সেই সঙ্গে নজরুল এর উপর অবিচার এবং তার সাহিত্য সৃষ্টিকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে ব্যবহার করার একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরেছেন। কিছুদিন আগে “সূফী জুলফিকার হায়দারের নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়” গ্রন্থের এপার বাংলায় প্রকাশিত সংস্করণটি পড়বার সৌভাগ্য হয়েছিল। মুরশিদ সাহেবের প্রবন্ধে ঐ প্রবন্ধের উল্লেখ দেখে এ সম্পর্কে কিছু লিখতে আগ্রহান্বিত হলাম। “সূফী জুলফিকার হায়দার লিখেছেন, নজরুল নামে মুসলমান এবং কার্যত হিন্দু ছিলেন। তিনি মনে করেন এর জন্য কবির হিন্দু স্ত্রীর প্রভাবই প্রধানত দায়ী। কিন্তু নজরুলের প্রাক বিবাহ যুগের ঘটনাগুলি বিচার করলে, এ কথা সহজ হয়ে যাবে যে সে সময়েও তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোন আচরণাদিই পালন করতেন না। তাই বিশেষ কোন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নজরুল প্রতিভার বিশ্লেষণ করতে বসলে ভুল করার সম্ভাবনাই খুব বেশী। নজরুলের পুত্রদের খৎনা হয়নি, এ খবর জুলফিকার সাহেবকে ব্যথিত করেছে। শুনেছি সম্পূর্ণ কোরান শরীফ কণ্ঠস্থ করলেই ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিরা সূফী’ উপাধি লাভ করেন। তার মত সুপণ্ডিত এ কথা নিশ্চয়ই জানেন ‘খ’ মুসলমানদের অবশ্যকরণীয় কোন প্রথা নয়। এই প্রথা প্রথম প্রচলিত ছিল ইহুদীদের মধ্যে বহু প্রাচীনকালে। তবে প্রথাটি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালাে এই কারণের জন্য খৎনা মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। সুতরাং এই তথ্যে জুলফিকার সাহেবের বিচলিত হওয়ার মতাে কিছু নেই। সূফী জুলফিকার হায়দার তাঁর গ্রন্থে অপপ্রচার ধর্মী মনােভাব নিয়ে নজরুলের মূল্যায়ন করেছেন এবং কবি জীবনের শেষের দিকের দারিদ্রপীড়িত শােচনীয় অবস্থার কথা আলােচনা করতে গিয়ে স্বয়ং কবি এবং তার বহু আত্মীয় ও বন্ধুদের প্রতি (বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য গিরিবালা দেবী) সজ্ঞানে অবিচার করেছেন। জুলফিকার সাহেবের ভুল ভ্রান্তিগুলাে ধরিয়ে দিয়ে এবং তথ্যের অসঙ্গতিগুলাে শুধরে দিয়ে এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা করেছেন কমরেড মুজাফফর আহমেদ সাহেব তার “কাজী নজরুল ইসলাম : তার স্মৃতি কথা” বইতে (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৯৬৯ প্রকাশক ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড) আমরা উৎসাহী পাঠকদের বইটি পড়ে দেখতে অনুরােধ করব। এ সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখকের ব্যাখ্যা (পাকিস্তানী অপপ্রচারে বিরক্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সাহিত্যিক তার জানা তথ্যগুলাে উদঘাটিত করে নজরুলকে তার আপন স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আমি মেনে নিতে রাজী নই। কারণ প্রথমত লেখক নিজেই জুলফিকার সাহেবের প্রয়াসে অপপ্রচারের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া (অর্থাৎ অপপ্রচার ধর্মিতা) স্বীকার করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত গত উনিশ বছর ধরে রুদ্ধবাক এক কবির সম্বন্ধে অপপ্রচার নিশ্চয়ই অপরাধ। এই ধরনের স্কুল মনােভাবের নিন্দা করা উচিত। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এ সম্বন্ধে আমি অন্যান্য পাঠকের মতামত জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী। সব মিলিয়ে দেশ-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটি সফল ও সার্থক। ধন্যবাদ দিয়ে লেখককে আর ছােট করব না, তবে বাংলাদেশের মানুষেরা নজরুল সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন, এই সংবাদ উৎসাহব্যঞ্জক। সম্ভবত পাকিস্তান সরকার ও নজরুল অ্যাকাদেমীর অপপ্রচার তাদের মনে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। এ বছর আমরা দুই বাংলার অধিবাসীরা কবির জন্মদিনে একযােগে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছি। তাছাড়া আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেলেও নজরুল তাে কোনদিনই দ্বিখন্ডিত হননি। সেই জন্য নজরুলকে স্ব-সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের একহয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নজরুল সম্বন্ধে আমাদের মনে আবেগ ও ভক্তি যতটা আছে, আন্ত রিকতা ও নিষ্ঠা ততটা নেই। তাই নজরুল সম্বন্ধে আলােচনা করতে গিয়ে আমরা প্রধানত আবেগের দ্বারাই পরিচালিত হই। কিন্তু এ ধরনের মনােভাব প্রকৃত তথ্য প্রকাশ হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। পরিশেষে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে জানাই অকুণ্ঠ অভিনন্দন।
অংকুর সাহা
মােদিনীপুর
সূত্র: দেশ ৪ আষাঢ় ১৩৭৮
গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯