বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ
১৭ই জুলাই সংখ্যার দেশে প্রকাশিত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ প্রসঙ্গে সবিনয়ে কিছু বক্তব্য পেশ করতে চাই।
লেখক মুসলিম সমাজ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। যার ফলে তার আসল উদ্দেশ্যের প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারেন নি বলে আমার ধারণা (মুসলমান সমাজকে আত্মােদ্বোধিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য বলেই আমার মনে হয়) তার বক্তব্য-ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের কোন ভূমিকা নেই বললেই হয়। তিনি কেবলমাত্র খান আব্দুল গাফফার খান ও তার দলবলের নাম উল্লেখ করেছেন দেশপ্রেমিক বলে। তিনি ভুলে গেছেন হসরৎ মােহানির নাম, যিনি ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব এনেছিলেন, যে প্রস্তাব প্রথমে কংগ্রেসের অনুমােদন না পেলেও ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল। তিনি ভুলে গেছেন আবুল কালাম আজাদের নাম যিনি তাঁর সমস্ত জীবন ধরে কংগ্রেসের সেবা করে গেছেন। এ কথা সত্য যে, সৈয়দ আহমেদ মুসলমানদের কংগ্রেসে যােগদানে বিরােধী ছিলেন। তবুও এক শ্রেণির মুসলমান কংগ্রেসে যােগদান করেছিলেন এই সংগঠনের জন্মলগ্ন হতেই, এই প্রসঙ্গ স্মরণ করা যেতে পারে যে, কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে মাত্র ২ জন, দ্বিতীয় অধিবেশনে ৩৩ জন এবং তৃতীয় অধিবেশনে মােট ৭০২ জন প্রতিনিধির মধ্যে মুসলমান প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ১৫৬ জন। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও কিছু সুবিধাবাদী মুসলমান নেতার চক্রান্তে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এর প্রথম অধিবেশনে হাসান ইমাম এবং মাজহারুল হকের ন্যায় জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতাদের দেখা গিয়েছে। খিলাফৎ আন্দোলন এবং ওয়াহাবী আন্দোলন মূলত ধর্মভিত্তিক হলেও শেষ বিশ্লেষণে এগুলাে যে ব্যাপক ব্রিটিশ বিরােধী চরিত্র ধারণ করেছিল এ কথা বলাই বাহুল্য। ব্রিটেন ও তুরস্কের যুদ্ধে ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্র আকার ধারণ করে এবং কংগ্রেস ও লীগে লক্ষৌ প্যাক্টের মাধ্যমে সহযােগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং দেশব্যাপী ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের এক তীব্র জোয়ার দেখা যায়। অসহযােগ আন্দোলনের সাথে খিলাফত ধর্ম-আন্দোলন যুক্ত হয়ে মুক্তি আন্দোলনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছিলেন। দেশে এবং বিদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় যারা আত্মনিয়ােগ করেছিলেন তাদের প্রথম সারিতে অনেক মুসলিম নেতাকে দেখা গেছে। এই প্রসঙ্গে মুজাফফর আহমেদ ও আব্দুল হালিম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
প্রবন্ধ লেখক অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন যে, “ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় আন্দোলন- স্বদেশী আন্দোলন-বাংলদেশেই হয়েছিল… এসব আন্দোলন থেকে মুসলিম সমাজ দূরে থেকেছে। প্রথমত ইতিহাসের দিক থেকে এরকম মন্তব্য একেবারে ভুল। স্বদেশী আন্দোলন কি প্রথম জাতীয় আন্দোলন? ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে তিনি কি নামে অভিহিত করবেন।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম সমাজ এই বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নাই বলে তিনি যে অভিযােগ করেছেন তা সর্বাংশে সত্য নয়। বিপ্লবী আন্দোলনে হিন্দু পুনরুত্থানে যে বাহ্যিক অনুষ্ঠানের ঘটা ছিল তার সুযােগ বিদেশী শাসক েশ্রনী এই আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করলেও স্বদেশী আন্দোলনে মুসলমানদের একটা ভূমিকা ছিল। আবদুর রসুলের নাম কি কেউ কখনও ভুলতে পারে? ভ্যালেন্টাইন চিরল বলেছেন-“নবযুগের নব মুসলমান গণ নব জাগ্রত জাতীয়তাবােধের চরম পন্থাতেও হিন্দুদের ভাগীদার হতে তখন প্রস্তুত।
” তবে এ কথা সত্য যে সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম সমাজের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। এর কারণ কি কেবলমাত্র মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক মনোেভাব এবং ধর্মীয় গােড়ামী লেখক সেই কথা বলতে চেয়েছেন। এই ঘটনার পশ্চাতে সমাজ ও অর্থনৈতিক কারণগুলাে একটু সহানুভূতির সাথে বিচার করে দেখতে পারতেন তিনি। নানা কারণে মুসলমানদের বুজোয়া শ্রেণি গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। মুয়াফিজ ভূমিগুলি ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদীয়মান মুসলমান বুর্জোয়াশ্রেণির অধিকাংশ আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেছে।
আবার আধুনিক বুদ্ধিজীবী মুসলমান সম্প্রদায় গড়ে উঠতেও অনেক দেরি হয়েছে। রেনেসাস আন্দোলন মূলত হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারমূলক হওয়ার ফলে সাধারণভাবে মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচারে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করে নাই।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল উদীয়মান বুজোয়াশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায়। এই বুর্জোয়া শ্ৰেণীর মধ্যে মুসলমানদের অবস্থান মােটেই সংহত ছিল না বলে তাদের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম, এই রকম সিদ্ধান্ত অধিকতর বৈজ্ঞানিক হবে বলে মনে হয়।
প্রবন্ধ লেখক পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য সামগ্রিকভাবে মুসলিম লীগকে দায়ী করেছেন। মূল দায়িত্ব মুসলিম লীগের হলেও এই অপকর্মে কংগ্রেসের কি কোন ভূমিকাই ছিল না? পাকিস্তানের মূল্যে কংগ্রেসের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া কি ঠিক হয়েছে ? এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও অনুধাবনযােগ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ Divide and rule এই নীতির সাহায্যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুসলমানদের নিজেদের বিশেষ প্রিয়পাত্র করে তােলে এবং তাদের বিশেষ বিশেষ সুবিধাদি দেয়। শাসক এবং শােষক শ্রেণির এটি একটি অতি পরিচিত ও পুরাতন কৌশল।
প্রবন্ধের এক স্থানে তিনি বলেছেন যে, পাকিস্তানের ছাত্র ও যুব সম্প্রদায় ছাড়া যারা আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছিলেন সেই সব অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত’ সাধারণ চাষী-মজুররা সকলেই মুসলিম লীগের সমর্থক। এইরকম উক্তি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যমণ্ডিত চাষী-মজুরদের প্রতি কতটা সুবিচার করেছে তা প্রবন্ধ লেখককে ভেবে দেখতে অনুরােধ করি।
পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই। সাম্প্রদায়িকতার কোন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের একচেটে অধিকার নয়। প্রতিটি দেশের শাসক ও শােষক শ্রেণি নিজেদের প্রয়ােজনে একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যতদিন ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা থাকবে ততদিন সাম্প্রদায়িক মনােভাব থাকবে এবং শাসক ও শােষক শ্রেণি তার সুযােগ নেবে।
নজরুল ইসলাম কলকাতা-১৮
শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ’ নামক বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধটিতে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা সুধীজন মাত্রই গ্রহণ করবেন সন্দেহ নেই। বস্তুত ধর্মান্ধ ও বিদ্বেষপরায়ণ নেতৃবৃন্দের শাসকগােষ্ঠী ‘oriented’ রাজনীতির ফলে যে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়েছিল, এ কথা মর্মান্তিকভাবে সত্য, আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যে এই পাকিস্তান আন্দোলনের গােটা ভিত্তিটারই সবল ও সুদৃঢ় প্রত্যাখান, এটিও একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য মাত্র। মুসলমান বলেই পূর্ব বাংলা চিরদিনের মতাে পশ্চিম পাকিস্তানের লেজুড় হয়ে বিদ্যমান থাকবে, এই প্রতারণা ও মিথ্যাচারকে সবলে পরিহার করে মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুগামী আওয়ামী লীগ আজ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করেছেন। শ্রী-দত্ত প্রবন্ধটিতে যে ঋজু ও সত্যনিষ্ঠ মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি লিখেছেন পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ যে এখনও সক্রিয়, তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গ থেকে যারা পালিয়ে আসছে তাদের শতকরা আশিভাগ হিন্দু….. তাদের বাড়িঘর, জমিজমা জবর দখল করে, লুঠপাটে সর্বশান্ত করে যারা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে তারা পাক সৈন্য নয়, স্থানীয় মুসলমান।” সত্যিই এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে গভীরভাবে প্রণিধান করতে হবে। মাত্র দুটি বিষয়ে লেখকের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত নই। তিনি লিখেছেন, “সারা দুনিয়ায় আজ পাকিস্ত নের কোন প্রেসটিজ নেই।” কিন্তু বহু সংখ্যক ভারতবাসী ও মুক্তিকামী পূর্ববঙ্গবাসী ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ পৃথিবীর সুসভ্যতম দেশ। আমরা স্বাধীনতাকামী জনগণ তথা আওয়ামী লীগকে যে সাহায়্য ও সমর্থন জানাচ্ছি, তার ফলস্বরূপ হয়তাে একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু তারপর? বলাবাহুল্য আবার যা তাই হবে। তার প্রথম কারণ আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে যা স্বাধীনতা লাভের পর আরও প্রকট হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু নির্যাতন সমানে চলবে। লেখকের বক্তব্য অনুসারে এখন শুধু হিন্দুরা ভারতে আসছে। সবচেয়ে বড় কথা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর হাতিয়াররূপে হিন্দুরা ব্যবহৃত হবে এবং যাকে হিন্দুরা সমর্থন করব না, সেই হিন্দু নিধনযজ্ঞে মেতে উঠবে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত মন্তব্য- ১. প্রতিবেশী রাষ্ট্র সর্বদা শত্রুভাবাপন্ন হয়। ২. প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রের পরের রাষ্ট্রের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক থাকবে। কৌটিল্য তিব্বত, নেপাল প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক উল্লেখ করে তার বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রু সম্পর্ক যে কোনও ভাবে বজায় থাকে। বর্তমান শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিস্ময় চীনআমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন। আর এটা যে কোন Supra-rational, Supra-national, Supra-idealism নিয়ে নয় পাক ভারত সন্ত্রাসের মওকা ধরে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
জ্ঞানপ্রকাশ মন্ডল
আগরতলা, ত্রিপুরা
সূত্র: দেশ, ১০ শ্রাবণ ১৩৭৮
বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধ সম্বন্ধে আমার নিজের চোখে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা জানাতে চাই। আশা করি এ সত্য ঘটনা প্রকাশ করে অনুগৃহীত করবেন। লেখক ১১৮৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মনে মুজিবের প্রভাব শিক্ষিত যুবক মহলে প্রধানত ছাত্রসমাজেই আবদ্ধ, দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগণ আওয়ামী লীগকে নিয়ে থাকলেও কার্যকলাপে তারা মুসলিম লীগ পন্থী’। এ যে কতদুর সত্য তার প্রমাণ লেখকের লিখিত তার ঠিক পরের লাইনগুলােই এবং এটা অনেক সংবাদপত্রের মাধ্যমে স্বীকৃত সত্য যে, পূর্ববঙ্গ থেকে যতজন এসেছেন তার শতকরা আশি ভাগই হিন্দু। লেখক লিখেছেন, পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ যে এখনও সক্রিয়, তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গ থেকে যারা পালিয়ে আসছে তাদের শতকরা আশিভাগ হিন্দু। এখন শুধু হিন্দুরাই আসছেন। তাদের বাড়িঘর, জমিজমা জবর দখল করে, লুঠপাটে সর্বস্বান্ত করে যারা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে তারা পাক সৈন্য নয়, স্থানীয় মুসলমান।” আমি যে গ্রাম থেকে বিশেষ কারণবশত তার নাম উল্লেখ করছি না, সে গ্রাম ও তার আশেপাশের সব গ্রামের চিত্রও একই রকম। এই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রামের মুসলমান সমাজের পাণ্ডারা যারা নির্বাচনের সময় প্রচারকার্য করেছিলেন, তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার নােটিশ দেন। আমরা আসার সময় আমাদের বাড়িতে যে মুসলমান মাহিন্দার কাজ করত তাকে সব দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই পাণ্ডারা তাতেও রাজী হননি। নিজেরাই হিন্দুদের জমিজমা, সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন। ওই গরীব মুসলমান কর্মচারীও আমাদের সঙ্গে তার পরিবার নিয়ে ভারতে চলে এসেছে। আমার তাে মনে হয়, যে কজন ভারতে চলে এসেছেন তাদের, বেশীরভাগের অবস্থাই ওই রকম অর্থাৎ জমিজমা কিছু নেই। দিন মজুরী, কল কারখানা বন্ধ, তাই নেহাত বেঁচে থাকার জন্যই ভারত চলে এসেছেন। আসার সময় অনেক হিন্দুদের কাছ থেকে জোর করে উপরােক্ত পাণ্ডারা দানপত্র করে নিচ্ছেন। যে শরণার্থী ভাবছেন পরে ফিরে যাবেন তাদের সে আশা সুদূরপরাহত। যারা জবর দখল করে বসেছে তারা ছাড়বে না। লেখককে তাঁর প্রবন্ধে একাংশে এই সত্য ভাষণের জন্য ধন্যবাদ।
সমীর মজুমদার
হুগলী
বিশ্ব রাজনৈতিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মুহূর্তে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখিত ‘বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ প্রবন্ধটি সময়ােপযােগী ও গুরুত্বপূর্ণ। তার কয়েকটি মন্তব্য বর্তমান বাংলাদেশ সমস্যার পটভূমিকায় ভারতবাসী হিসেবে আমাদের মনে রাখা প্রয়ােজন।
১. ধর্মীয় রাষ্ট্রের ন্যায় অধার্মিক রাষ্ট্র আর হতে পারে না।
২. দেশ ও জতির চাইতে সম্প্রদায়ের দাবিকে বড় করে দেখেন বলে তাঁদের মধ্যে (মুসলিম সমাজে) যথার্থ জাতীয়তাবােধ অদ্যাবধি জন্মায়নি।
৩. পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ যে এখনও সক্রিয়, তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গ থেকে যারা পালিয়ে আসছে।
তাদের শতকরা আশিভাগ হিন্দু। এখন তাে শুনছি শুধু হিন্দুরাই আসছেন।
৪. পাকিস্তানী শাসক কর্তৃপক্ষ যেমন পূর্ববঙ্গের জনগণের কাছে সম্পূর্ণরূপে exposed এ সব (আমেরিকা, চীন, রাশিয়া) বড় বড় রাষ্ট্রও তেমনি সভ্য জগতের কাছে exposed। বিশ্ব শান্তির একমাত্র অভিভাবক রাষ্ট্রসংঘ যে কী হাস্যকরভাবে অক্ষম এবং অসহায় তাও পৃথিবীর মানুষ দেখে নিল।
… ভারতবর্ষ এ ব্যাপারে যে বীরােচিত ধৈর্য এবং উদারতার পরিচয় দিয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছেন যে, আর কেউ কি এটা মেনে নেবে? পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্রের একটিও পাকিস্তানের দানবীয় রক্তপিপাসুতার সমালােচনা করে নি। ভারতবর্ষের প্রতিবেশী অমুসলিম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সকলেই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব। আর পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটিও সরকারীভাবে ইয়াহিয়ার পৈশাচিক রণতাণ্ডবের নিন্দাবাদ তাে করেই নি, বরং পৃথিবীর দুটি বৃহত্তম রাষ্ট্র যেভাবে পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতার পৃষ্ঠপােষকতা করছে, তাতে মনে হয় যে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামকে ধুলিসাৎ করতে বদ্ধপরিকর। বাস্তবিক পাকিস্তানের বন্ধুবাহুল্য এবং ভারতবর্ষের বন্ধুহীন অবস্থা আমাদের কাছে খুবই উদ্বেগজনক।
শ্রীদত্ত আরও লিখেছেন যে, “ভারতবর্ষ তার বীরােচিত ধৈর্য ও উদারতার দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আন্ত র্জাতিক ক্ষেত্রে সে পৃথিবীর সুসভ্যতম দেশ।” পূর্ববঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে ভারত নিশ্চয়ই যথেষ্ট ধৈর্য ও উদারতা দেখিয়েছে, কিন্তু বীরােচিত বিশ্লেষণটি কি একটু কানে ঠেকছে না?
চন্ডিকাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
বারাসত
সূত্র: দেশ : ১৫ শ্রাবণ ১৩৭৮
‘বাংলাদেশ ও মুসলিম সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধ সম্বন্ধে আমার নিজের চোখে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা জানাতে চাই । আশা করি এই সত্য ঘটনা প্রকাশ করে অনুগৃহীত করবেন।
লেখক ১১৮৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মনে হয় মুজিবুরের প্রভাব শিক্ষিত যুবক মহলে, প্রধানত ছাত্রসমাজেই আবদ্ধ, দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত জনগণ ভােট আওয়ামী লীগকে দিয়ে থাকলেও কার্যকলাপে তারা মুসলিম লীগ পন্থী।” এ যে কতদূর সত্য তার প্রমাণ লেখকের লিখিত তার ঠিক পরের লাইনগুলােই এবং এটা অনেক সংবাদপত্রের মাধ্যমেই স্বীকৃত সত্য যে, পূর্ববঙ্গ থেকে যতজন এসেছেন তার শতকরা আশি ভাগই হিন্দু। লেখক লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গে ধর্মান্ধতার বিষ এখনও কতখানি সক্রিয় তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গ থেকে যারা পালিয়ে আসছেন তার শতকরা আশিজন হিন্দু।” এখন শুধু হিন্দুরাই আসছেন। তাদের বাড়িঘর জমিজমা জবর দখল করে লুঠপাটে সর্বস্বান্ত করে যারা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে তারা পাক-সৈন্য নয়, স্থানীয় মুসলমান।” আমি যে গ্রাম থেকে এসেছি বিশেষ কারণবশত তার নাম উল্লেখ করছি না, সে গ্রাম ও তার আশেপাশের সব গ্রামের চিত্রও একই রকম। এই “মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রামের মুসলমান বাড়বে। (২) শুধু পূর্ব ভারত নয়, পশ্চিম এবং উত্তর ভারতও সেই যুদ্ধে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আংশকা থাকবে। (৩) বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশ ইসু থেকে সরে গিয়ে ভারত-পাক সংঘর্ষের ওপর পড়বে। এবং (৪) শেষ পর্যন্ত যখন বিশ্বের বড় শক্তিগুলি চাপ দিয়ে লড়াইটা থামাবে, তখন হয়ত দেখা যাবে বাংলাদেশ সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।
আমরা যদি জাতিগতভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাম তাহলে অবশ্য বলতে পারতাম যে বাংলাদেশের জন্য প্রয়ােজন হলে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের জন্য ভারতের সব মানুষ তাদের শেষ বিন্দু পর্যন্ত রক্ত দেবে। কিন্তু আমরা সেভাবে প্রস্তুত কি? এ ব্যাপারে দেশের নানা লােকের নানা মত। যারা এখন মুখে বলছেন শেষ বিন্দু পর্যন্ত রক্ত দিতে প্রস্তুত তাঁদের ক’জন যুদ্ধ শুরু হলে শেষ পর্যন্ত অবিচল থাকবেন তাও বােধহয় এখনই বলা কঠিন। সেই জন্যই মানসিকতায়, অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিক বিচারে আমরা এখনই কোনও কিছু নিয়েই দীর্ঘ মেয়াদী লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত নই। এই বারের বাংলাদেশ সংকটের প্রশ্নে দেখা গিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা কত নিঃসঙ্গ। মারকিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে। চীন আমাদের বিরুদ্ধে। এমন যে রাশিয়া, যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ভরসাস্থল, সেও বিরুদ্ধে না হলেও বাংলাদেশের প্রশ্নে খুব ভােলাখুলিভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চায় না। তাই, রাশিয়াও নানাভাবে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করছে যেন ভারত এমন কোনও ব্যবস্থা না নেয় যার ফলে পাক-ভারত সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
***
কিন্তু যুদ্ধ হতে পারে এমন কোনও ব্যবস্থা না হয় ভারত সরকার না-ই নিলেন, অন্য কোনও ভাবে কি বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব?
রাজনৈতিক সমাধান, রাজনৈতিক মীমাংসা- এরকম একটা কথা বহুদিন থেকেই শােনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে কি?
এতদিনে যা ঘটে গিয়েছে তারপর বর্তমান অবস্থায় কোনও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতার পক্ষেই পূর্ব বাংলাকে আপসে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া সম্ভব নয়। দিলে তাকেই তার স্বাধীনতা হারাতে হবে! পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষই তাকে ক্ষমা করবে না। আবার; এত মানুষ খুন হওয়ার পর, এত পাশবিকতা, এত অত্যাচারের পর পূর্ব বাংলার কোনও নেতার পক্ষেও পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটা এসপার ওসপারের অবস্থা। এখানে মাঝামাঝি কোনও ব্যবস্থা হতে পারে না ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার যারা এই রাজনৈতিক সমাধানের কথা সবচেয়ে বেশি করে বলছে তারাই রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব করে তােলার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি। মার্কিন যুক্তরাস্ট্র গােপনে এবং প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে। সােজাসুজি দিচ্ছে। ঘুরিয়েও দিচ্ছে। নিজেরা দিচ্ছে। মধ্যগ্রাচ্যের বিভিন্ন ঐশ্লামিক রাষ্ট্র থেকেও যাতে মূলত মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র এবং জঙ্গী বিমান পাকিস্তানে যায় তার ব্যবস্থা করছে। পাকিস্তানের অস্ত্রশক্তি বাড়াবার সর্বতােমুখী প্রয়াস চালাচ্ছে মারকিন যুক্তরাষ্ট্র।
পাকিস্তানের হাতে যত বেশি অস্ত্রশস্ত্র গিয়ে পড়বে ততই পাক সামরিক শাসকদের অস্ত্রবলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খতম করার জিদ বাড়বে। ততই বেশিদিন বাংলাদেশে সামরিক অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারবে। ততই বাংলাদেশের লড়াইটা দীর্ঘ মেয়াদী হবে।
এদিকে দেখুন, আবার বাঙলাদেশের মানুষের জন্যও গােপনে এবং প্রকাশ্যে মার্কিন শিল্পপতিদের সাহায্যপুষ্ট এবং সরকারী সমর্থনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলির কত দরদ! কত ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করতে তারা আগ্রহী। গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া যায় কিনা তা নিয়েও বহু মার্কিনী নেপথ্যে আলাপআলােচনা চালাচ্ছেন।
এসবের লক্ষ্য কী? একটিই মাত্র লক্ষ্য হতে পারে। মারকিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব বাংলায় বর্তমান পরিস্থিতি জিয়িয়ে রাখতে চায়।
এটা কি কোনও বৃহৎ মার্কিন পরিকল্পনারই অঙ্গ? সেই পরিকল্পনা কি গােটা উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে?
নবারুণ গুপ্ত
সূত্র: দেশ : ২২ শ্রাবণ ১৩৭৮
০৭.০৮.৭১