বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯শে জুন, বৃহস্পতিবার, ৫ই আষাঢ়, ১৩৮১
বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা
বাংলাদেশে পাঁচদিন রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করে ভারতের মাননীয় রাষ্ট্রপতি শ্রী বরাহ গিরি ভেস্কট গিরি গতকাল দেশে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশের অবস্থানকালে তিনি চিটাগাং সফর করেছেন। বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। গত পরশুদিন রাষ্ট্রপতি শ্রী গিরি আমাদের জাতীয় সংসদে ভাষণ দান করেছেন। রাষ্ট্রপতি গিরির এই ভাষণ অত্যন্ত মূল্যবান এবং উপমহাদেশীয় শান্তি ও প্রগতির প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার ভাষণের একপর্যায়ে বলেছেন- ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে রক্তাপ্লুত হয়েছে, সেই বন্ধুত্ব উত্তরোত্তর আরো বাস্তবমুখী এবং গভীর মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠবে। মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি দিকে সুন্দর ভাবে বিকশিত করার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতা যাতে করে জনসাধারণের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারে তার দিকে যত্নবান হতে হবে। একথা উল্লেখ করে শ্রী গিরি বলেন, বর্তমানে দারিদ্র ও অশিক্ষার অন্ধকারে দূর করা কথার কথা হয়ে দাড়িয়েছে। এই লক্ষ্য লাভের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা না হলে দুই দেশের দেশবাসীর মধ্যে যে মহৎ সম্ভাবনা রয়েছে তা থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হবে।
রাষ্ট্রপতি শ্রী বরাহ গিরি ভেস্কট গিরি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন পরম বন্ধুজন। বাঙালিরা যখন মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত তখন ভারতবাসীও ছিল আমাদের সেই স্বপ্নের সাথী। ১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ ভারতের সংসদে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল সে কথা এবার আমাদের জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি শ্রী গিরি উল্লেখ করেছেন। সেদিনের সে প্রস্তাব ছিল এই সংসদ এর গভীর প্রত্যয় লিপিবদ্ধ করেছে যে, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক জয়যাত্রা সাফল্যমন্ডিত হবেই। সংসদ পূর্ববঙ্গের জনসাধারণকে এই আশ্বাস দিয়েছে যে, তাদের সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের পেছনে ভারতীয় জনগণের পরিপূর্ণ সহানুভূতি এবং সহায়তা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের কালে ভারতীয় সংসদের প্রস্তাব স্মরণ করে শ্রী গিরি পুনরায় তার গভীর সহানুভূতি ও সহায়তা কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের প্রগতি ত্বরান্বিত করবে এ আশা তিনি পোষণ করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে উভয়ের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ভিত্তি রচিত হয়েছে তা উল্লেখ করে তিনি বলেন-অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রগতির সন্ধানে ভারত বর্ষ বাংলাদেশ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করছে এবং কতগুলি যৌথ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করছে। বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে যেমন বাণিজ্য, যানবাহন, পরিবহন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিস্তার ক্ষেত্রে আমাদের দু’দেশের যৌথ উদ্যোগের শুভ সূচনা হয়েছে। দুই দেশের মানুষের প্রকৃতি ও তাদের আদর্শগত শামিলের কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন- ভারতবর্ষ বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়। যদিও প্রাচুর্যজাত কোন সমস্যার দ্বারা আমরা জর্জিরত নই। তবু যাতে আমাদের দু’দেশের অধিকাংশ জনসাধারণ মানুষ হিসেবে তাদের পূর্ণতা অর্জন করতে পারে তার জন্য আমরা চাই জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
ভারতের রাষ্ট্রপতির এ সফর পূর্বাহ্নেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছিলাম। বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী বাস্তবমুখী করে গড়ে তোলা দরকার। শুধু কাগজে বা বক্তৃতায় নয় অথবা একে অন্যের কথার মাধ্যমে নয়-সত্য ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ সম্পর্কের উন্নয়ন সাধন করা আবশ্যক। উভয় দেশের একশ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী ও প্রতিক্রিয়াশীল দু’দেশের বন্ধুত্বের নামে নানা সংশয় ও উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করে চলেছে তারা উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ প্রগতিকে বিনষ্ট করে দিতে চায়। এদের মোকাবেলা করে সত্যিকারের প্রগতির পথ ধরে আমাদেরকে এগোতে হবে। উভয় দেশের মাঝে সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে যেটুকু সামিল রয়েছে তাকে সযত্নে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত আমাদের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং তা করছে। সেটাকে সুসংহত করে জাতীয় প্রতীক ত্বরান্বিত করা দরকার। উভয় দেশের মাঝে দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি, খুদা, রোগ-শোক বেকার প্রভৃতি বিরাজ করছে তাকে সহযোগিতার ভিত্তিতে উত্তরণ করতে হবে। আমরা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও বাস্তব মুখী হয়ে উঠুক এটাই সর্বান্তকরণে কামনা করি।
মানবিক স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে
দেশের ব্লাড ব্যাংক গুলোর আশঙ্কাজনকভাবে রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশ, পোস্ট গ্রাজুয়েট সহ দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ব্লাড ব্যাংকের রক্তের দারুন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এবং পরিস্থিতি এতই গুরুতর আকার নিয়েছে যে, বর্তমানে পি, জি, হাসপাতাল সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাংক পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রক্ত ধার করতে শুরু করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, রক্তের অভাবেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাজার হাজার রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। রাজধানীর ঢাকার মেডিকেল কলেজ ও সলিমুল্লাহ কলেজ হাসপাতালে রক্তের অভাবে অপারেশনের ক্ষেত্রে প্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। রক্তস্বল্পতাগ্রস্ত রোগীদেরকে রক্তের অভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিন গুণতে হচ্ছে। এমনকি এই দুটি হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতেও জরুরী প্রয়োজন মোকাবেলা করার মতো রক্ত নেই। অথচ স্বাধীনতা-উত্তরকালে অতি দ্রুত হারে রাজধানীর নাগরিক বাড়তে থাকে। তার ফলে রোগী বেড়েছে। স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেখানে ১২০০ শত, সেখানে গাদাগাদি করে এখন প্রায় ২০০০ রোগীর জায়গা করতে হয়েছে। ফলে একদিকে রক্তের চাহিদা বেড়েছে অপরদিকে ব্লাড ব্যাংকের সঞ্চয় কমেছে। যার ফলে উদ্ভূত হয়েছে বর্তমানে সংকটজনক পরিস্থিতির।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের দেশে বর্তমানে জীবনরক্ষাকারী ঔষধেরও প্রচণ্ড সংকট রয়েছে। ব্লাড ব্যাংক গুলো শূন্য হয়ে পড়ছে। তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কি সত্যই বন্ধ হয়ে যাবে?
ব্লাড ব্যাংকের এহেন অবস্থায় কারণস্বরূপ যা জানা যায় তাও হতাশাব্যঞ্জক। রক্তদান কারীরা ন্যায্যমূল্যের অভাবে রক্ত আর দিতে চাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ হলো এক বোতল রক্তের সেই সাবেকি ৪০ টাকা দামে আর রক্ত দেওয়া যায়না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি শহর খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্ব মূল্যের বাজারে এক বোতল রক্তের ৪০ টাকা দাম আনুপাতিক হারে খুবই কম। একথা সত্য যে, এক বোতল রক্ত দিলে একমাস ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করতে হয় বর্তমানে বাজারে ৪০ টাকাকে ভালো খাওয়া-দাওয়া করার সাহায্যকারী অর্থ বলে ভাবা যায় না। অতএব প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রক্ত দিতে কেউ এগিয়ে আসছে না।
আমাদের মতে ওদের অভিযোগ সর্বাংশে সত্য। এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশান সার্ভিস পরিচালক সভায় রক্তদানকারীদের প্রতি এক বোতল রক্তের মূল্য ৪০ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকা প্রদানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ জানান। প্রতিবেদনের তথ্য হচ্ছে- কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
অর্থের বিনিময় রক্তদান করা ছাড়াও স্বেচ্ছামূলক ভাবে রক্তদান করা হয়। অনেকেই সানন্দে এগিয়ে আসেন রক্তদান করতে। তবে সে ব্যাপারে ব্যাপক রক্ত সংগ্রহ অভিযান চালানোর প্রয়োজন। রক্তদান করলে স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয়না উপরোক্ত মানসিকতার বিরাট উপকার হয় এমন ধরনের প্রচারণা চালানো আবশ্যক। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ব্লাড ব্যাংক গুলো আজ কাঙ্গাল হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই অবস্থা তোর চলতে পারে না। অতএব এখন রক্ত সংগ্রহের জন্য সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতি বছর রক্তের দাম বাড়িয়ে রক্ত দান কারীদের রক্তদানে আগ্রহী করে তুলতে হবে। অপরদিকে সার্বিক অভিযান চালিয়ে মানবতার আবেদনের ভিত্তিতে জনসাধারণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্তদানের প্রবণতাকে জাগ্রত করতে হবে। কারণ শুধু রক্ত কিনে রক্তের চাহিদা পূরণ হবে না বা ব্লাডব্যাংক পূর্ণ হতে পারেনা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বসাধারণ রক্তদানের মহৎ কাজে এগিয়ে না আসলে ব্লাডব্যাংক সমৃদ্ধ হতে পারে না।
এ ব্যাপারে দেশের সকল সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানেরও গুরুদায়িত্ব আছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাদের যোগাযোগ থাকে। সে ক্ষেত্রে সহজেই তাদের সঙ্গে সাধারণ লোকের যোগাযোগ ঘটে এবং সেবামূলক কাজে তাদের প্রতি আবেদন রাখারও অবকাশ পাওয়া যায়। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে চূড়ান্তভাবে এবং গুরুত্বের ভিত্তিতে। মহিলা সমাজকর্মীদের এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। তাদের পরিধিতেই মহিলা সমাজকর্মীদেরকে সক্রিয় হতে হবে। ব্লাড ব্যাংকের এই বিপদজনক শূন্য অবস্থার বিপদগুলোকে সামনে রেখে নিজেদের জীবন অন্যের জীবনের ভয়াবহ বিপদকে প্রত্যক্ষ করে মানবতার স্বার্থে আজ ব্যাপক রক্ত সংগ্রহ অভিযান চালাতে হবে। এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে ব্লাড ব্যাংক গুলোতে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা রাখতেই হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক