You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী ও মহামারী

আমাদের স্বাধীনতার চব্বিশটি বছর পূর্ণ হয়ে গেল। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই চব্বিশ-পঁচিশটি বছর তার প্রারম্ভিক পর্ব। পর্বটির দিকে তাকালে এমন কথা বলা যাবে না যে, এতগুলি বছর একেবারে বিফলে কেটেছে। আবার এমনও বলা মুশকিল যে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই যে ক’টি রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছে ভারতের সঙ্গে তাদের পার্থক্য অনেক। সমস্যাও স্বতন্ত্র। বিশেষ করে এই বৃহৎ রাষ্ট্রটির আয়তন, লােকসংখ্যা, তার অবর্ণনীয় দারিদ্র্য, শিল্প ও কলকারখানার স্বল্পতা, কৃষি সমস্যা ইত্যাদি এক বিরাট বােঝা হয়ে চেপে আছে। উপরন্ত আন্তর্জাতিক একটি চাপ তার চারপাশে প্রথমাবধি থেকেই গেছে। দেশের মধ্যেও রাজনৈতিক টানাপােড়েনেরও বিরাম ছিল না। এমন অবস্থায়, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের সবল বুনিয়াদ গড়ে তােলা সহজসাধ্য নয়। তবু এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, দেশ এবং জাতিকে সমৃদ্ধ উন্নত, সুদৃঢ় করে গড়ে তােলার জন্যে যে উদ্দীপনা, বিচক্ষণতা, উদ্যম এবং সততার প্রয়ােজন ছিল আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং জনগণের কর্মের মধ্যে তার অভাব ছিল মাত্রাতিরিক্ত। জাতীয় স্বার্থকে আমরা কখনােই প্রধান বলে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারি নি। তার পরিণামে এই হয়েছে যে, অনেক বিরাট যজ্ঞশালা প্রতিষ্ঠাই হয়েছে, কাজ হয় নি। অনেক উচ্চাশা নিতান্তই সরকারী কাগজের মধ্যে চাপা পড়ে থেকেছে। আর সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি না ঘটলেও স্বার্থান্বেষীদের দুর্নীতিতে সারা দেশ কেমন অক্ষম, পঙ্গু হয়ে গেছে।
স্বাধীনতা দিবসে এই সব কথা চিন্তা করলে হতাশাই আসে ভবিষ্যতের কোনাে স্বপ্ন আমাদের চোখে ভাসে না। কিন্তু একটি এত বড় দেশ তত ভূতের যজ্ঞশালা হয়ে থাকতে পারে না; তার কিছু পাথেয় চাই, আশা ও উদ্যম চাই। সেই আশার দিকে তাকালে বলতে হবে, ভারতের ভবিষ্যৎ রয়েছে তার উদ্যোগী নেতৃবৃন্দের হাতে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতৃবৃন্দ এ দায়িত্ব অনেকটাই পালন করতে পারেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় যদি সুবিচার, বিচক্ষণতা, সাহস ও সততা থাকে, যদি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয় , ক্ষমতা ব্যবহারের লােভই যদি না একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, এবং সামাজিক-ভাবে যদি ভারতীয় জনসমাজকে সহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, নিতান্ত আত্মস্বার্থের ঊর্ধ্বে তােলা সম্ভব হয়, তবে এই ভারতের যথার্থ প্রগতি, সমৃদ্ধি বৈষয়িক উন্নতি আমরা আশা করতে পারি। গণতান্ত্রিক এবং জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে শাসকই সব নয়, দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষই তার অংশীদার। দায় দায়িত্ব তাদেরও। স্বাধীনতা দিবসেরএই পঞ্চবিংশতি বর্ষে আমরা একেবারে নিরুদ্যম হব না। আশা করব, অতি মন্থরভাবে হলেও আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধি গড়ে উঠুক, সমবেত চেষ্টায়।

সুরেশচন্দ্র
গত বারই আগস্ট স্বৰ্গত সুরেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সুরেশচন্দ্র প্রধানত আমাদের লােক, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার ছিলেন। এই পত্রিকার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সুরেশচন্দ্রের ভূমিকাটি কোনােভাবেই গৌণ নয়। যে জাতীয় কর্মে ও সেবায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকায় আবির্ভাব সুরেশচন্দ্র সেই কর্ম ও সেবায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী কর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও পরামর্শদাতা, স্বজাতির মঙ্গলসাধনের অনলস কর্মী। জাতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে তার দানও সামান্য নয়। বাংলা ছাপাখানার আধুনিক পর্বেও তাঁর কৃতিত্ব সর্বজন-স্বীকৃত। মানুষ হিসেবে সুরেশচন্দ্র ছিলেন সেই পুরােনাে বাঙলার অন্যতম সুসন্তান। আদর্শবাদী, কর্মী সাহসী স্বজন-বৎসল, ব্যক্তিত্বময়। আমরা তাঁর পরলােকগমনের স্মৃতি মনে এলে বেদনা পাই। তবু যে-সত্য অস্বীকারের উপায় মানুষের হাতে নেই সেটা স্বীকার করে নিয়ে, সুরেশচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

সূত্র: দেশ ॥ ৪ ভাদ্র ১৩৭৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!