কে আছ জাগিয়া পুরবে চাহিয়া
রঞ্জন
আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে। গত সপ্তাহে কাউকে নির্দেশ দিতে হয়নি। বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নে যখন খবর এলাে যে, পূর্ববঙ্গের পশ্চিমী শাসকদের আৱসমর্পণ অত্যাসন্ন তখন সমগ্র কলকাতায় উচ্ছাস প্রায় আতিশয্যের আকারধারণে উদ্যত। কলকাতার আবেগপ্রবণাত আমার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা রকমের শ্রেয় প্রাণচাঞ্চল্য আনে। অন্তহীন অনীহার নির্বিরম প্রবাহ থেকে সে যে কী বিষম নিষ্কৃতি তা আপাতত অপ্রকাশ্য। তবু পূর্ববঙ্গের পুনর্লব্ধ স্বাধীনতার প্রত্যুষে কয়েকটা সন্দেহের নিহিত কন্টক আমি উপেক্ষা করতে পারিনে। একটা ভাষার যুগল ব্যবহারে নেই ঐক্যের অমােঘ সূত্র। স্বাধীন বাঙ্গলার উত্থানে স্বভাবতই আমি উল্লসিত। কিন্তু প্রত্যক প্রতিবেশীর কাছে স্বাধীনতা নয় নিতান্ত সহজগ্রাহ্য পদার্থ। পশ্চিমবংগ আর নবজাত বাংলাদেশের সম্পর্ক আজো আলােচনাসাপেক্ষ। শারীর সান্নিধ্য আর ভাষাগত ঐক্যবােধ হতে পারে হার্ডিঞ্জ ব্রিজেরই মতাে ভঙ্গুর। আমার চাইতে কেউ বেশী খুশী হবে না আমার এই আশঙ্কা অসত্য হলে যে, বর্তমানের উষ্ণ বাঙালি আলিঙ্গনে নিহিত থাকতে পারে কোন এক অবিশ্বাস্য শীতল বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছেদের অপ্রীতিকর সম্ভাবনার স্বাদরিক্ত স্বীকৃতি সত্ত্বেও আমি একে অপরিহার্য বলে মানতে পারিনে। অক্লান্ত আলােচনায় উদগীর্ণ হতে পারে আমাদের অকথ্য বিরােধের উৎস। বিতর্কে মিলায় ঐক্য : বিশ্বাস বিরূপ।
বাঙ্গালিত্ব বলে একটা বস্তু নিশ্চয়ই আছে: পঁচিশ বছরের বিভাগের পরেও। কিন্তু এটাকে নিয়ে পদ্মার এপারে বা ওপারে বাড়াবাড়ি হলে অচিরেই নৈরাশ্য হয়ে উঠবে অবশ্যম্ভাবী। বাঙালিত্বের বিভক্তির উপর গঠিত যে-কোনাে সম্পর্কই দু’পক্ষের অন্তরে এমন পর্বতপ্রমাণ প্রত্যাশার সঞ্চার করবে যার পূরণ হবে অসম্ভব। আমরা চাইব ওদের চিরকালীন কৃতজ্ঞতা, কেননা আমরা ওদের সাহায্য করেছি পাঞ্জাবী নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেতে। ওরা দাবি করবে ওদের সার্বভৌমত্বের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। আমরা চাইব বাহাত্তর বাজারের পূর্ণ সুযােগ নিতে। ক্রমে পূর্ববঙ্গের আসবে তিক্ততা ও প্রতিরােধ। আমরা যত চাইব ওরা তত দিতে রাজী হবে না। ওরা যত আদর প্রত্যাশা করবে তত আমরা দিতে পারবাে না। শীঘ্রই শুরু হবে দরাদরি, পরে মন কষাকষি—যার একমাত্র পরিণতি হতে পারে পুনর্বিরােধ। প্রতি পক্ষই যদি নিজ নিজ প্রত্যাশা সীমায়িত রাখে তা হলে সেই অনুপাতে নৈরাশ্যের পরিমাণ সীমিত হতে পারে।
***
বর্তমান উচ্ছাসের প্রাবল্যে আমার বিনীত পরামর্শ অতিসাবধানী বলে মনে হতে পারে। তবু আমি চাইনে অতীব বিরােধের সূত্রগুলাের পুনরাবির্ভাব। আমাদের দু পক্ষের মধ্যে যে মিলগুলি আছে সেগুলির উৎসাহদান নিশ্চয় একান্তই কাম্য। সেই সঙ্গে স্বীকার করা ভাল যে, অনেকগুলি অমিল আছে দুই বাঙ্গলার মধ্যে। কেবলমাত্র আশা করলেই বৈসাদৃশ্যগুলি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না। এমন কি, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোন পক্ষ অপর পক্ষের ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করবে না। আর্থনীতিক সংযােগ নিশ্চয়ই উভয় পক্ষেরই অসীম দারিদ্র্য লাঘব করতে পারে। কিন্তু কোন পক্ষই সহ্য করবে না অপরের অতিরিক্ত অর্থলােলুপতা। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চাতে থাকবে নয়াদিল্লীর বিশাল ক্ষমতা। অন্তত আপাতত বাঙ্গলাদেশকে ছাড়া হবে প্রায় নির্বান্ধব। তাই বলে ঢাকা মেনে নেবে না কলকাতার প্রায়শ অতিকৃত আত্মম্ভরিতা। হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে প্রাচীন বিরােধের অবসান হবে না ধর্মানিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নামাবলী পরিধান করলেই বাঙলাদেশের নতু রূপ পরিগ্রহ করবে তাও বর্তমানে অজ্ঞাত। মুজিবনগরের ঐক্য ঢাকায় অক্ষুন্ন না থাকতে পারে। এ নীতিতে সাম্যবাদ উল্লিখিত হয়েছে এবং শুনতে পাই কোন কোন অঞ্চলে শেখ মুজিবর রহমান ইতিমধ্যেই বুর্জোয়া বলে বর্ণিত এবং বর্জিত। গণতন্ত্রে এই প্রকার বিরােধ গুলি তর্ক দ্বারা মীমাংসিত হতে পারে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য আর সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সুযােগ পায়নি পাচ্ছি সন্তানের জন্মলাভের পর থেকে। পশ্চিমবঙ্গের তাে অতি সাম্প্রতিক কালে দেখা গেলাে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলির বিবাদ হিংস্র ও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আর উল্লাস তাই সঞ্চিত থাকবে ভবিষ্যতের জন্যে।
পশ্চিমী নির্যাতন সত্তেও পূর্ববঙ্গে চিন্তাধারায় বেশ কিছু নতুন উদ্যমের উদ্ভব হয়েছে গত কয়েক বৎসরে। পূর্ববঙ্গে ছােটখাট একটি চলচ্চিত্রশিল্প জন্মগ্রহণ করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য অঞ্চলে সাহিত্যপ্রচেষ্টা আর একেবারে কলকাতার মুখাপেক্ষী নয়। এই আঞ্চলিক উদ্দেশ্য যেন উৎসাদিত না হয় বিশাল কলকাতার চাপে। এমন আরও অসংখ্য সমস্যার উদ্ভব অপরিহার্য। কলকাতার বাণিজ্যিক সাংস্কৃতিক মহলে যেন এমন অপধারণ অপজন্ম না হয় যে, বাঙ্গলাদেশের সৃষ্টির অর্থই যে ওদের বাজার আরও ব্যাপক হল। আমাদের যেমন দিতে হবে তেমনি নিতে হবে। মনােভাব দ্রুত পুষ্টি না পেলে পুনর্বিবেচনা ঠেকান যাবে না।
* * *
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয়কে অগ্রসর হতে হবে ধীরে, অতি ধীরে পঁচিশ বছরের পাঞ্জাবী শাসনের মধ্যে পূর্ববঙ্গে কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি এমন ধারণা একেবারেই অলীক। উর্দু সাহিত্য কি কিছু মাত্র প্রভাব বিস্তার করেনি পূর্ববঙ্গ সাহিত্যচিন্তার উপর? এই প্রভাব যে একবারেই অশুভ এবং পুরােপুরি নির্বাসন যােগ্য, এমন কথাই বা ধরে নেব কেন। বহু বাঙ্গালি বাংলা না ভুলেও উর্দু শিখেছে, এটাকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করার কারণ দেখি না। মােদ্দা কথা এই জন্য পুর্ববঙ্গ ফিরে পাবে না পঁচিশ বছর আগেকার পূর্ববঙ্গকে। বাঙ্গলা ভাষা সত্ত্বেও দুজন দুজনকে নতুন করে চিনতে হবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। পুরােনাে সম্পর্কে পুনর্জন্ম অভাবনীয় এবং বােধ হয় পুরােপুরি বাঞ্ছনীয়ও নয়।
সূত্র: দেশ ॥ ৯ পৌষ ১৩৭৮