নয়া দিল্লি : নয়া ছদ্মবেশী
রক্তন
আজও মাঝে মাঝে আধাে সভয়ে ও আধাে সানন্দে স্মরণ করি আমাদের সেই আধা শহরের বহুরূপীকে। সে আসততা সন্ধ্যার পরে, গাঢ়বর্ণ শাড়ি পরিধান সত্ত্বেও বােঝা যেতাে যে, আচ্ছাদিত আগন্তুক আর যাই হােন রমণী নন। তবু বাড়ির দরজা খুলতেই দেখতাম সেই ব্যক্তিটি প্রস্তুত তার প্রদর্শনী নিয়ে। নাকের উপর ঝােলানাে একটা অবৃহৎ কিন্তু গতিশীল পর্দা। সেটাকে এক দিকে সরালে দেখা যেতাে এক অপরূপ সুন্দরীর মুখাবয়ব : অপর দিকে ছিল ভীষণ এক ভয়ংকর মূর্তি। উল্লাস ও আতঙ্কের এই যুগল পরিবেশের পরে লােকটি চাইতাে মাত্র এক পয়সা। তখন এক পয়সার ক্রয়-ক্ষমতা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি। এই দুমুখখা বহুরূপীর কথা আমার বারবার মনে হয়েছে দেশবিভাগের পর থেকে। কখনাে মনে হয়েছে সেই পরাস্ত পূর্ববঙ্গই আজো আমার চোখে বহুরূপীর মুখের সেই অবিস্মরণীয় আধখানা আর পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে তার কদর্য অপরাধ। পচিশে মার্চের পাকিস্তানী আক্রমণের পরে মনে হয়েছে বহুরূপী আবার তার নাসিকাসীন পর্দা সরিয়েছে এধার থেকে ওধারে। আমাদের বহুরূপীর কদর্যতা আর সৌন্দর্য দুই-ই ছিল মােটামুটি বিশ্বাসযােগ্য। অঙ্গসজ্জার যমজ সন্তান। দ্বিবিধ বিস্ময় আজ ভস্মীভূত বিষাদশ্মশানে।।
পূর্ববঙ্গের দুর্ভাগ্যের তবু অন্য রূপ আছে তার দুর্জয় প্রতিবাদে। তুলনীয় বজ্রকণ্ঠ শুনতে পাইনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। তারও আছে ইসলামাবাদ, বিনীতির নামে। নয়া দিল্লির সােহাগী স্বরূপ, আমার বহুরূপীর মুখের একার্ধ, ভাষাভাষিভাবে সন্দেহ করেছি বহুদিন। বাঙালির সাম্প্রতিক সর্ব খর্বতার জন্য নয়া দিল্লিকে দোষ দিতে আমার বাধে যেমন আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব জাতীয় সামান্যতার জন্য ইংরেজ শাসকদের আমি অবাধে পুর্ণদোষী সাব্যস্ত করতে পারিনি। সহসা হাতে এলাে এক সাংবাদিকের প্রবন্ধসংগ্রহ। রণজিৎ রায়ের The Agony of West Bengal পূর্ববঙ্গের নির্মম শশাষণ ও অপশাসনের জন্য অবর্ষণ সমস্ত ভারতীয়য়ের পক্ষে একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুরূপ অন্যায়, সামান্য পর্যায়ভেদে, অন্যত্র ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হলে সার্বিক নীরবতার সঙ্গতি আমার বুদ্ধির অগম্য। দীর্ঘ দিল্লিপ্রবাস সত্ত্বেও রণজিৎ রায় অপরিশােধ্য বঙ্গসন্তান। তার বক্তব্য শুধু তজ্জন্যই অশ্রদ্ধেয় হতে পারে না। প্রমাণ সমৃদ্ধ প্রবন্ধদশকে রণটি রায় নয়া দিল্লির বিরুদ্ধে যে অভিযােগ এনেছেন এ মিল জোলার অনুসরণে তার নাম অনায়াসেই হতে পারতাে J’Accuse, নয়া দিল্লি, তুমি অপরাধী। তােমার পূর্বসুরী ইংরেজরাও এত অপরাধ করেনি ভাগ্যহীনা বাঙলার বিরুদ্ধে।
বাঙালির অন্তর্জাত রাজনীতিক বিরূপতা তাে ইতিহাসের অংশ। তার সাহেবিয়ানার পর্ব শেষ হলে সে মােসাহেবি করতে রাজী হয়নি। অবিলম্বেই অবশ্যম্ভাবী ফসল ফলল ইংরেজদের সােচ্চার বাঙালিবিতৃষ্ণায় । হায় রে হায় ১৯৫৭ সালে ভারতদর্শনের পরে ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি নাকি লিখেছিলেন, বঙ্গভঙ্গের পর বাঙালির আর পাখা নাহি উড়িবার। সে মেনে নিক যে, ভাগ্য তার রাহুগ্রস্ত।” অবমাননার উপর শারীর আঘাত। টয়েনবি লিখেছেন, “মােগল রাজত্বের অবসানে যেমন হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত ঘটলে ঠিক তাই হলাে : ক্ষীণতেজ ক্ষমতার অন্তহীন প্রতিবন্ধকতা…বিংশ শতাব্দীর জয়ী গুজরাটের ধূর্ত ..বিংশ শতাব্দীর জয়ী গুজরাটের ধূর্ত সৈনিক।…গুজরাটী মহাত্মা তখন মৃত। টয়েনবি কার কথা ভাবছিলেন? রণজিৎ রায় অন্যতর গুর্জরসন্তান মােরারজি দেশাই-এর অকুণ্ঠ অনুরাগী নন। বস্তুত তার বস্তুসিদ্ধ সিদ্ধান্ত এই যে, এই ভদ্রলােকের কুপরিকল্পিত নীতির কল্যাণেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিক অকল্যাণের প্রধান প্রসূতি রচিত হয়। আমি লেখককে অনুতভাষণের অপবাদ দিতে পারিনে।
হিমালয়সদৃশ অপচয়,,—বা পুকুরচুরি—সত্ত্বেও ভারতের নানা খণ্ডে আপেক্ষিক আর্থনীতিক উন্নতি অনস্বীকার্য। পাঞ্জাব দিল্লি-গুজরাট-মারাঠায় তার সাক্ষ্য প্রায় অশ্লীলভাবে প্রত্যক্ষ। খণ্ডিত বাঙলার ভাগ্যে কেন্দ্রীয় দাক্ষিণ্যের কণামাত্র পড়েনি বলে অভিযোেগ একেবারে অসঙ্গত নয়। রণজিৎ রায় বাঙালির মজ্জাগত কর্মবিমুখ তার নালিশ পুরােপুরি অস্বীকার করেন কিনা জানিনে, কিন্তু দেশবিভাগের পরে পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু স্বীয় বাহুবলে স্বাবলম্বী হয়েছে আর বিতাড়িত বাঙালি উদ্বাস্তু শিবিরে অকর্মণ্য ভিক্ষুক মাত্র, কৃপার পাত্র, এমন চিত্র তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নানা অপাঠ্য সরকারী রিপাের্ট অনন্ত অধ্যবসায় দিয়ে অনুধাবন করে তিনি দেখিয়েছেন যে, গত সিকি শতাব্দী ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের সকল অনুগ্রহ বর্ধিত হয়েছে পশ্চিমী উদ্বাস্তুদের উপর পাঞ্জাব থেকে দিল্লি দূর অস্ত নয়। ………. পশ্চিমাগত শরণার্থীদের জন্য কেন্দ্রের সহনুভূতি ছিল তাৎক্ষণিক ও উত্তর পূর্ব থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ক্রন্দন কেন্দ্রের কানে পৌঁছােতে সময় লাগে, এমন কি তিন চার বছরও যথেষ্ট নয়। পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু …………… পলাতক মুসলমানদের ভারতীয় সম্পত্তি পেয়েছে অবিলম্বে, ক্ষতিপূরণ পেয়েছে আপন হৃত সম্পত্তির জন্য। ভিটেছাড়া বাঙালির ভাগ্যে জোটেনি কোনাে জমি ব্যবসা নব ব্যবসায়ের উপযুক্ত মূলধন। সরকারী ঋণ বা দিনমজুরি, যাকে ভিক্ষার অপর নাম দেওয়াই সঙ্গত, তা প্রত্যহ ব্যয়িত হয়েছে দৈনন্দিন, উপবাস-এড়ানাে ও জীবন ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে।
এই সীমাহীন অবহেলা নিষ্ঠুরতা দেশ বিভাগের পূর্বে প্রদত্ত সমস্ত প্রতিশ্রুতি নির্লজ্জ প্রত্যাখ্যান। কিন্তু রণজিৎ রায়ের প্রতিপাদ্য এই যে, স্বাধীনতার পর বাঙালির অর্থনীতিক নিষ্পেষণ অব্যাহত আছে। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সােনার বাঙলাকে ভালােবেসে কেউ এদিকে আসেননি। কলকাতা কয়েকটি অমূল্য স্বাভাবিক সম্পদ ছিল তার বন্দর, হাতের কাছে কয়লা লৌহ ইস্পাত। ব্রিটিশ বাণিজ্য এখানে ঘর করেছিল একান্তই টাকা-আনা-পয়সার হিসাবে স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই এই সমস্ত সুযােগ নস্যাৎ করে দেওয়া হলাে দিল্লি ফরমানে। সর্বভারতীয় উন্নয়নের নামে কয়লা আর ইস্পাতের দাম হলাে সারাদেশে সমান। কলকাতা আর হাওড়ার বুভুক্ষা তাে অবহেলনীয় আঞ্চলিক সমস্যা মাত্র। দক্ষিণ ভারতের কয়লা তথা আর পশ্চিম ভারতের ইস্পাতক্ষুধা মেটাতে হবে বাঙলাকে, জাতীয় স্বার্থের নামে।
রণজিৎ রায়ের মতাে আমিও আপাতত আত্মােৎসর্গে কিঞ্চিৎ অনুৎসাহী। ভারতীয়ত্বের পাঠ আমি নেব কৃষ্ণমাচারী বা মােরারজি দেশাই বা আর কারাে কাছ থেকে। আমি বাঙালিয়ানা কখনাে করিনি ভারতও আমার প্রধান মূলধন। তবু সর্বভারতীয়তার নামে আঞ্চলিক অবিচার আমি অপ্রতিবাদে মেনে নিতে পারিনি। পূর্ব ভারত কেন ব্যবহৃত হবে দেশের অন্যাংশের উপনিবেশ হিসেবে? বাংলাদেশে বর্তমান বীভৎসতার মৌল উৎস যদি হয়ে থাকে ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য, তবে অন্যান্য রাজধানীও সতর্ক হবার কারণ থাকতে পারে। যথা নয়া দিল্লি। পশ্চিমবঙ্গের দ্রুত অবক্ষয়ের দায়িত্ব একা পশ্চিমবঙ্গের নয়, যদিও বাঙালির পরিপূর্ণ নির্দোষিতা আমি মেনে নিতে পারিনে। আমি নিজে যে অংশত দোষী। কিন্তু কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি।
সূত্র: দেশ | ২৫ অগ্রহায়ন ১৩৭৮