You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তির সংগ্রামে বাংলাদেশ
কল্হন

সেদিন সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে গিয়ে দাঁড়াতেই আনন্দ, বেদনা আর রােমাঞ্চে মেশানাে আশ্চর্য এক অনুভূতি আমায় অসাড় করে ফেলল। তাকিয়ে দেখলাম সেই মাঠ, সেই কাস্তের মতাে বাঁকা খেজুরগাছ, সেই বাঁশ ঝাড়, সেই মেঠো পথ, সেই গােয়ালঘর, সেই মানুষ, সেই মাটি। আজও আমার শরীরে লেগে রয়েছে ওখানকার ঘাসমাটির গন্ধ। এই তাে সেদিন এলাম এপার বাংলায়। তবু ওই মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আমার আশৈশবের পরিচিত ছবিটা যেন কেমন নতুন নতুন ঠেকছে। মনে হচ্ছিল, সােনার বাংলার সােনার আলােয় যেন মাখামাখি হয়ে গেছে ওই আকাশ, ওই মাটি, ওই ঘাস। আমার তাে ওরকম অনুভূতি হওয়ার কথা নয়, আমি তাে বেশিদিন এপার বাংলায় আসিনি। কারণটা আমার অন্যখানে। আমি যে আজ পূর্বপাকিস্তানে নয়, স্বাধীন বাংলা দেশের মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছি। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একদিন দেখেছিলাম আমরা-আমি শাহাবউদ্দীন হানিফ, আতােয়ার, আলাে, ফণি, সীতাংশু, কীবরিয়া, বাচ্চু, বােরহান এবং আমাদের মতে পূর্ব বাংলার আরও অনেকে; সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তব মূর্তি ধরে দাড়িয়েছে আজ আমার সামনে। তাই তাে আজ এত আনন্দ, এত বেদনা। আনন্দ এই জন্যে যে, ১৯৫৯-৬০ সালে মুন্সীগঞ্জের চরে রাত্রির অন্ধকারে শ্মশানে, গােরস্তানে, পাটক্ষেতে, ধানক্ষেতে নির্জনে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তা আজ বাস্তবায়িত। বেদনা এই জন্যে যে, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ সাধের বাংলাদেশ পাক-সৈন্যের হামলায় আজ বিপন্ন: বেদনা এই জন্যে যে, আজ রাইফেল হাতে শাহাবউদ্দিন, বাচ্চু, বােরহান, কীবরিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারছি না।
আমার, আমাদের প্রতিটি বাঙালির জীবনের এক অবিস্মরণীয় আনন্দের দিন, সুখের দিন ১৩ চৈত্র, শুক্রবার, ১৩৭৭ সাল। হ্যা, বাংলা তারিখেই বললাম। কেননা এত বাঙালি তার জীবন থেকে মন থেকে বাংলা তারিখ, বাংলা সংস্কৃতি ধীরে ধীরে মুছে ফেলতে চলেছিল, বিশেষ করে এপার বাংলায়। আজ বাঙালির ঘরে ফেরার দিন। ১৩ চৈত্র অক্ষয় হােক অমর হােক। যদিও জানি, ইতিহাসের পাতায় ওই ১৬ মার্চটাই চিহ্নিত হবে লাল কালিতে। তবু প্রার্থনা, তবু বলা, বাঙালির হৃদয় থেকে যেন মুছে না যায় ওই ১৩ চৈত্র। ১৩ চৈত্র ছিল বড় আনন্দের বড় সুখের দিন। ব্রিটিশ যেদিন ভারতের মাটি ছেড়ে গেল, সেদিনটাও আনন্দের ছিল। তবে আমাদের অনেকের কাছেই নয়। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে এইটুকু বুঝলাম। কিন্তু বুঝলাম না কেন দেশটা দু ভাগ হল, বাংলা দু ভাগ হল। কেন ওই সবুজ-সাদার চাঁদতারা খচিত পতাকার বিপুল আয়ােজন যা দু দিন আগেও দেখতে পাইনি, কেন খুড়া-জ্যেঠা এবং বয়স্কদের মুখ বিমর্ষ। তখনও বুঝতে পারিনি যে, এপারে খণ্ডিত বাংলাদেশ পরাধীনই রয়ে গেল, স্বাধীন হল না শুধু হাত বদল হল শাসকের। ইংরেজের হাত থেকে জিন্নাহ-লিয়াকত আলীর হাতে গেল: দিল্লী থেকে করাচিতে গেল। বুঝতে পারেনি আমার বন্ধুরাও-শাহাবউদ্দীন বােরহান, বাচ্চু, কীবরিয়া, হানিফ। ওদের সঙ্গে মিলে দল বেধে ১৪ আগস্ট বিনি পয়সার বায়স্কোপ দেখে এলাম। মিষ্টি খেলাম; বন্ধুদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইলাম ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ। কিছুদিন বাদেই দেখলাম, দক্ষিণের পাড়ার ক্ষ্যান্তপিসীরা চলে গেল বর্ধমান না কোথায়। ক্ষ্যান্তপিসীর বাড়িতে, তুলসীমঞ্চ ঘেষে একটা ভালাে ফুলগাছ ছিল। সকাল নেই, দুপুর নেই, ওই ফুলগাছের নিচে গিয়ে পাড়ার ছেলেরা গুলতি দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ফুল পাড়তাম। ছোঁক ছোঁক করতাম। ক্ষ্যান্তপিসী কতদিন তাড়া করে আসত গালাগাল দিতে দিতে। কিন্তু ওই হেন খিটখিটে মেজাজের ক্ষ্যান্তপিসীও যখন পােটলা-পুটলি নিয়ে চলে গেল গা ছেড়ে, খারাপ হয়ে গেল মনটা। তখন মনে পড়ল ক্ষ্যান্তপিসীর মনটা কত ভালাে ছিল। কত সময় আমাদের ডেকে ডেকে নারকেলের নাড় দিয়েছেন মােয়া দিয়েছেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বলেছেন যে, খা আমার সামনে খাড়াইয়া খা। ক্ষ্যান্তপিসীর মতাে এ পাড়ার ওপাড়ার অনেকে ফুলমামী, সুবলকাকা আমাদের নারায়ণ ভূইমালী আরও অনেকে চলে গেল ওপারে, পশ্চিমবঙ্গে কইলকাত্তায়। আস্তে আস্তে হিন্দু পাড়াগুলি ফাঁকা হয়ে গেল। আমার বাবা কিন্তু তখনও নতুন নতুন জমি কিনে চলেছেন। শরিকরা বাড়ি বিক্রি করছেন, বাবা কিনছেন। বাবার ওই এক কথা, চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। প্রাণ থাকতেও আমি অন্যের হাতে তুলে দিতে পারব না এই ভিটা। যা হয় হবে।
এল পঞ্চাশের দাঙ্গা। হিন্দু মহল্লা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। কত ভিটেমাটি খা খা করতে থাকল। কত আম জাম কাঁঠাল মাটিতে পড়ে পড়ে পচে পচে নষ্ট হয়ে গেল। কত লেবু গাছেই বুড়িয়ে গেল। তবুও কিন্তু আমরা রয়েই গেলাম। স্কুলে তখন আমরা জিন্নাহর জীবনী পড়ছি। উর্দু, ভাষা শিখছি। উর্দু পড়াটা স্কুলের ছেলেদের পক্ষে আবশ্যিক হয়ে গেল। মুসলিম লীগের চেলাচামুণ্ডাদের দাপটে তখন আমরা কোণ ঠাসা। রাস্তাঘাটে ভয়ে ভয়ে কথা বলি। ১৪ আগস্ট এলে দেখতাম মুসলমানপাড়া থেকে হিন্দু পাড়ায়ই পাকিস্তানের পতাকা উড়ত বেশি। হিন্দুদের ভয় ছিল, পাছে পতাকা না ওড়ালে কিছু একটা হয়ে যায়। পতাকা না ওড়ালে মুসলিম লীগের লােকজন এসে দু’একবার যে শাসানি না দিয়ে যেত তা নয়। তবে ছােটবেলা থেকেই আমার অবস্থাটা ছিল অন্য রকম। আমার বন্ধু ছিল রতন (মাজহারুল আজিজ), রশিদ, শাহাবউদ্দিন, বােরহান বাচ্চু, কীবরিয়া–ওরা। ওই সব বন্ধুদের বাড়িতে কত খেয়েছি, ঘুমিয়েছি, আজ্ঞা দিয়েছি। আমার কাছে তাই ওই সব কার্যকলাপ ছিল খানিক অপরিচিত।
এল বাহান্ন সাল। শুরু হল বাংলাভাষায় দাবিতে তুমুল আন্দোলন। ঢাকায় মুসলিম লীগের বুলেটের গুলিতে প্রাণ দিল শফিক-রফিক-জাব্বার-বরকত আরও অনেকে। আমার মতাে আমার বন্ধু—শাহাবউদ্দীন, মফিজ, কীবরিয়া রশিদ ওরাও তখন বুঝেছে, ইংরেজ কূটচালে দেশটাতে ভাগ করেছে। আমাদের মধ্যে খেয়ােখেয়ি লাগিয়ে দেশটাকে দুর্বল করে রাখছে। দেশ যখন স্বাধীন হল, জেনারেল থেকে পুলিস কমিশনার পর্যন্ত পাকিস্তানের সব ক্ষমতা তখনও ব্রিটিশ আমলাদের হাতে। জিন্নাহ-লিয়াকত আলী তাদেরই কথা শুনতেন। করাচির রাষ্ট্রনায়করা বাংলাদেশের আশা আকাঙ্খ তাে পূরণ করতে পারলেনই না, বরং দিন দিন বাংলাকে শােষণ করলেন। বাংলাদেশের পয়সায় করাচিতে নতুন নতুন ইমারত উঠতে থাকল। আর এদিকে বাংলার বিক্ষোভকে দমিয়ে রাখার জন্য নিলেন রাষ্ট্রনায়করা সর্বনাশা সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয়। ১৯৫২ সালে আমরা আমাদের মায়ের ভাষা, ভাইয়ের ভাষা, বুকের ভাষা, মুখের ভাষা, রবীন্দ্র নজরুল-সুকান্তজীবনানন্দ-শরৎচন্দ্রের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য ঝাপিয়ে পড়লাম আন্দোলনে। বন্ধুদের পাশে পাশে এগিয়ে গেলাম টিয়ারগ্যাসের সামনে। সেইদিন থেকেই পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ঘরে ফেরার পালা হল শুরু। ১৩৭৭ সালের ১৩ চৈত্র সেই ঘরে ফেরার পালা শেষ হল। ওইদিনই সকাল ৯টা ৮মিনিটে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রিয় মুজিব ভাই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন। সন্ধ্যে সাতটায় আবার শােনা গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ঘোেষকের কণ্ঠ: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান শুনছেন।
স্বাধীন বাংলার ভাই-বােনেরা আসসালামু ওয়ালেয়কুম। মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। সারা বাংলাদেশে আজ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। চিরাচরিত প্রথায় বাংলার ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবার ঘৃণ্য মানসিকতা বর্জন করতে না পেরে ওরাও এখনও তাদের শােষণ অব্যাহত রাখতে চায়। ওরা তাই সকল ন্যায়নীতি বিসর্জন-দিয়ে পৈশাচিকভাবে শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর।
সমগ্র বাংলাদেশ সহ সমগ্র পৃথিবী আজ স্তম্ভিত। সামরিক শক্তির এহেন জঘন্য প্রয়ােগের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নেই। আজ সারা বাংলাদেশ সামরিক শক্তির দাপটে এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ক্ষতবিক্ষত। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী জনসাধারণ তাদের ওপর আঘাত হেনে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। ক্যানটনমেনট এলাকায় স্বাধীন বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদাররা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় শত্রুবাহিনী শক্তি বাড়াবার উদ্দেশ্যে অনবরত হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। কুমিল্লা থেকে তাদের সৈন্য এনে তাদের শক্তিকে মজবুত করতে চাইছে। ই.পি. আর ও মুক্তিযােদ্ধা বাহিনী তাদের মুকাবিলা করার জন্য প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই আজ মুক্তি-পাগল কৃষক, শ্রমিক-ছাত্র জনতার নিকট আহ্বান জানাই-শত্রু সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ন; হানাদারদের যাতায়াতের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিন। শত্রুসেনা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে সুবিধামত স্থানে অবস্থান করে মরিচের গুড়া সােডা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছুঁড়ে দিন। হাতবােমা নিক্ষেপ করুন। গ্রামের ভাইদের কাছে আমাদের আবেদন, দলে দলে শহর অভিমুখে রওনা হােন এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করার কাজে লিপ্ত মুক্তি সেনাদের সর্বতােভাবে সাহায্য করুন। শহরের ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা দলে দলে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে মুক্তি সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সর্বপ্রকারের সাহায্য চালিয়ে আমাদের এই দুর্বার আন্দোলনকে সফলকাম করে তুলুন।
বন্ধুগণ, আজকে সারা দেশের মানুষ উৎকণ্ঠায় পাগলের মত হয়ে উঠেছে। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর ওরা অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে দেখামাত্র গুলি করছে: হাজার হাজার মানুষ আজকে মৃত্যুবরণ করছে। এর নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। আমরা বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানাই, বিশেষভাবে জানাই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিকট, আপনারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেও চুপ করে বসে থাকবেন না। বাংলাদেশের এই সাড়ে সাত কোটি ভাইদের বাঁচাবার জন্য আমাদের সাহায্য করার জন্য অগ্রসর হােন। | বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন, আপনারা মানবতার খাতিরে, মানুষকে বাঁচাবার তাগিদে, বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য অগ্রসর হােন।
…পরিশেষে আমি জনগণকে অনুরােধ জানাব, এই দেশ—এই দেশের মহামান্য জননেতা, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেবতা, বাংলার নয়নের, মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নির্দেশে পরিচালিত হতে। অন্য কারও নির্দেশ বাঙালিরা বরদাস্ত করবেন না। এবং কোনাে মার্শাল ল বাঙালিরা মানে না। আমি আহ্বান জানাব বাংলার প্রতিটি নরনারীর কাছে, আপনারা মার্শাল ল মানবেন না। মার্শাল ল আমাদের কাছে গ্রহণের নয়, স্বাধীন বাংলার নাগরিক, স্বাধীন বাংলার মহান জননায়ক, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুরের নির্দেশ আমাদের শিরােনাম। জয় বাংলা।
ওই কণ্ঠশ্বর, ওই বাণী শিরায় শিরায় রােমাঞ্চ জাগাল। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে চীৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছিল তখন।
বৃথা যায়নি শেখ মুজিবেরই ওই ডাক। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ জেগে উঠেছে। মুক্তিপাগল মানুষেরা মেসিনগান ব্রেনগানের গুলি আর কামানের গােলা উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হানাদার শত্রুর উপর। প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মেসিনগানের গুলিতে, মর্টারের গােলায় মরছে আজ ওপারের লাখাে লাখাে নিরস্ত্র ভাই বােন মা। বন্দিনী মায়ের মুক্তির লড়াইয়ে ওদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগে আজ আমি, আমরা এপার বাংলার মানুষেরা গর্বিত। ওদের ব্যথায় ব্যথিত। ওদেরকে সাহায্য করতে পারার অক্ষমতায় আমরা লজ্জিত, ধিকৃত।
এপারের আমরা আজ উদ্বেলিত, উৎকণ্ঠিত। কেননা ওদের কান্না যে আমাদের হৃদয়ও স্পর্শ করে। দুইয়ের রক্তে, এক ভাষা, এক গান, এক সুর প্রবাহিত। ওদেরকে কি আমরা ভুলতে পারি? আমরা দুইজনেই যে বাংলামায়ের একই নাড়ি-ঘেঁড়া ধন; বাংলা মায়ের একই উদার আকাশ তলে, একই আলােহাওয়ায়, একই অন্নে লালিত। তাই পৃথিবীর মানুষ চুপ করে বসে থাকলেও আমরা বসে থাকতে পারি না। আমার ভাইয়ের ,বােনের, মায়ের, বন্ধুর এই নৃশংস হত্যার আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না। তাই ততা বাংলা আজ উদ্বেলিত। শাহাবউদ্দীন শােন, মুজিবভাই শুনুন শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, বাংলা বিহার আসাম, ত্রিপুরা থেকে সুদূর কেরলা পর্যন্ত ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষ তােমাদের ডাকে তােমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তােমাদের সাধের স্বাধীন বাংলাদেশকে কেউ স্বীকৃতি দিক না দিক পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসী দিয়েছে। এখানে মানবতার জয় হয়েছে। আজ এত বড়াে দুঃখের দিনে, বিপদের দিনেও এইটুকু যা সান্ত্বনা।
এই কিস্তিটা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ গানটা বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত রূপে নির্বাচিত হয়েছে। খবরটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিছুদিন আগে যখন এখানে খবর বেরােল আজাদ রহমানের সঙ্গীত, পরিচালনায় ঢাকার শিল্পীদের গাওয়া ‘পুবের আকাশে ঘ/ আলােকে আলােকময়/জয় জয় জয় জয় বাংলার জয়’ কোরাস গানটি জাতীয়সঙ্গীত নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের তখন একজন বন্ধুকে আমি বলেছিলাম, হতেই পারে না। কারণ, ‘৫২ সাল থেকে ঢাকার ছাত্র, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের কণ্ঠে কণ্ঠে অনুরণিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের এই গান। আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি/চিরদিন তােমার আকাশ, তােমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা নববর্ষের প্রভাতফেরীতে আমরা এই গান গেয়ে গেয়ে ঢাকা নরায়ণগঞ্জের পথে পথে ঘুরেছি। এই গান ‘৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় ছাত্র, শ্রমিক কৃষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সকলের জপের মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। পােস্টারে পােস্টারে শােভা পায় ওই গান। জীবনানন্দের কবিতা: বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি-তাই আমি পৃথিবীর রূপ দেখিতে যাই না আর। এবং অতুলপ্রসাদের মােদের গরব মােদের আশা আ-মরি বাংলাভাষা। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জাগরণের দিনে জাতির কবি রবীন্দ্রনাথের এই প্রাণ-নিঙড়ানাে ভালবাসায় মথিত গান সুরে স্বদেশী, ভাবে স্বদেশী তা বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত হবে না তাে কি একটি সিনেমার গান জাতীয়সঙ্গীত হবে? পূবের আকাশে সূর্য উঠেছে আলােকে আলােকময়’ গানটি জংয়বাংলা ছায়াছবির গান। মাহবুব তালুকদারের ছয়-দফার প্রতীক ছয়টি ছােট কাহিনী নিয়ে ছবিটি ঢাকার এফ-ডি-সি স্টুডিয়ােতে ভােলা হয়েছে। পরিচালনা করেছেন ফখরুল আলম; প্রযােজনা এম এ তায়েব। মুখ্য ভূমিকায় রূপ দিয়েছেন আনােয়ার হােসেন এবং সাহানা চৌধুরী। জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া ছবিটির ছাড়পত্র দেননি।
সেদিন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে প্রাণ ভরে বাতাস নিতে নিতে বলেছিলাম, আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’। বলেছিলাম, ওমা তাের চরণেতে এই দিলেম মাথা পেতে,/ দেগাে দে তাের পায়ের ধূলা সে-যে আমার মাথার মানিক হবে।’
কিন্তু ওই মুহূর্তে মনে পড়ল, আমার সােনার বাংলা আজ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বর্বর পাকহানাদারদের কামানের গােলায় দাউদাউ জ্বলছে শহর-বন্দর-গ্রাম। শত্রুর গােলায়, শত্রুর বােমায়, শত্রুর গুলিতে আমার আবাল্যের সঙ্গী, আমার ভালােবাসার ঢাকা বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত, মহাশ্মশান। আমার বন্ধুরা কে বেঁচে আছে, কে মরেছে, ও লড়েছ এখনও জানি না। উৎকণ্ঠিত উদ্বেলিত আমি তাই ছুটে গেছি সীমান্তে আমার বন্ধুর আমার ভাইয়ের, আমার বােনের আমার খালাম্মার, আমার রমণীর এক টুকরাে খবরের আশায়। নানান সুত্রে পাওয়া খবর থেকে ঢাকার যে ছবি পেয়েছি তা বড়াে মর্মস্পর্শী, বড় বেদনার। ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের বিশেষ পরিকল্পিত অভিধাবনটি প্রথম শুরু হয় ২৫ মার্চ, মাঝ রাত্তিরে। হঠাৎ-ঘুমভাঙা ঢাকার মানুষ ছাদে দাঁড়িয়ে ভীত ফ্যাকাশে মুখে ভয়-বিহ্বল চাহনি নিয়ে দেখেছে পশ্চিমা সৈন্যদের নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ। যেদিকেই তাকিয়েছে চোখে পড়েছে শুধু আগুন আর আগুন। ধোঁয়া আর ধোয়া।
সেদিন রাত সাড়ে নটা পর্যন্তও ঢাকার অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। জিন্নাহ এভিনিউ এবং নিউ মার্কেটে রােজকার মতােই লােকজন চলাচল করেছে নিশ্চিন্তে। বাস চলেছে, গাড়ি চলেছে রােজকার মতােই বনেটে কালাে পতাকা লাগিয়ে। তখনও চৈতালি হাওয়ায় সেক্রেটারিয়েট ভবনের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। পতাকা উড়ছিল হাইকোর্ট ভবন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে।
রাত সাড়ে নটার পরে পরেই মিলিটারি জীপ চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি ঘরে-ফেরা ঢাকাবাসীদের কাছে। কারণ মার্শাল ল’ তাে রয়েছেই। রাত সাড়ে দশটার টিক্কা খানের নির্দেশে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শুরু হলাে যথার্থ সৈন্যভিযান। ট্রাক ট্রাক সৈন্য শহর অভিমুখে ছুটল । হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-লাইট মেসিনগান, ব্রেনগান, স্টেনগান এবং রাইফেল। জীপে নিতে দেখা গেল রিকয়েরলেসগান এবং মিডিয়াম মেসিন গান। একটি খবরে প্রকাশ, প্রথম দফায় টিক্কা খানের নির্দেশে তিন ব্যাটেলিয়ন সৈন্য নামে। তাদের সঙ্গে ছিল এক স্কোয়াড্রন গােলন্দাজবাহিনী।
সৈন্যরা প্রথমেই অবরােধ করল তেজগা বিমানবন্দর। বিমান বন্দরটি সৈন্যরা ঘিরে রইল। সেখানে ৩৭ এম এম গান লাগানাে আরমারড কারও দেখা গেল। বিমানবন্দরের পর সৈন্যরা একে একে ঢাকার বেতার কেন্দ্র, ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের দখল নিল। ওখানে দুই-চারিদিন কর্মচারী যা ছিল তাদের দিয়ে ভবনের ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলল। সেনাবাহিনী এগিয়ে চলল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে। একদল গেল সেন্ট্রাল লাইব্রেরি পেরিয়ে ফুলার রােড ধরে প্রকৌশল বিশ্ব বিদ্যালয়ের দিকে। আর একদল গেল হাইকোর্টের ধার দিয়ে কার্জনহলের পাশ দিয়ে। কিছুটা গিয়েই বাধা পেল সৈন্যরা। রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। ইকবাল হল থেকে ছাত্ররা প্রথম বাধা দিল। ছাত্ররা বােমা ছুঁড়ল। ৩০৩ রাইফেলের গুলি ছুঁড়ল। ওদিকে সৈন্যদের ব্রেনগান এম-জির গুলি এসে পড়তে লাগল হল গুলােতে। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে মেসিনগানের গুলিতে তছনচ হলাে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ওপর দিয়ে সৈন্য তখন পাশের ছাত্রাবাসে ঢুকে পড়েছে। ছাত্ররা ছাদ থেকে ঘরের জানালা থেকে ৩০৩ রাইফেল আর ১২ বােরের বন্দুক প্রতিরােধ করল সেনাবাহিনীর। প্রতিটি ছাত্রাবাসে চলল ছাত্রে আর সৈন্যে অসম লড়াই। পাক-ফৌজ ট্যাংক নিয়ে এল। ট্যাংক দিয়ে সরালাে ব্যারিকেড। ৭৫ এম এম মর্টার থেকে গােলা বর্ষণ শুরু করল সৈন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে, ছাত্রাবাসে গুলিতে। ওখানকার সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম হল ভেঙে ভেঙে পড়ল। প্রচণ্ড গােলা আর মেসিনগানের মুখে ছাত্ররা আর কতক্ষণ দাঁড়াবে। পিছু হটার পথও বন্ধ। তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রতিরােধের চেষ্টা করলাে পশ্চিমা সৈন্যদের। যারা তখনও গুলিতে মারা যায়নি ছাত্রাবাসের ঘরে ঘরে ঢুকে চৌকির নিচ থেকে চুলের মুঠিধরে টেনে এনে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মেসিনগান দিয়ে গুলি করেছে। ছাত্রাবাসের সব ছাত্রই লড়াই করেছে তা না কিন্তু যারা লড়াই করেনি তারাও রেহাই পায়নি। নির্বিচারে হত্যা করেছে সকলকে। এগিয়ে গেল একদল সৈন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে শহীদ মিনার এবং মেডিকেল কলেজের দিকে। বর্বর সৈন্যের বুলেটের আঘাতে ভেঙে চুর-চুর হল শহীদ মিনারের সুন্দর লালকাচের আর্চগুলি থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জমাট বাঁধা রক্ত ছড়িয়ে পড়ল মিনারের চত্বরে। শহীদ রফিক-শফিক বরকত-সালামের রক্তাক্ত হৃদয় অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হলাে। ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার মর্যাদা আদায়ের জন্য মুসলিম লীগের পুলিসের গুলিতে ওরা প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতির বেদনার এই মিনার। ঢাকার ছাত্ররা ওই মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়েই নতুন সংগ্রামের শপথ নেয়। পূর্ব বাংলার ছেলেমেয়েদের সংগ্রামের প্রেরণা আত্মত্যাগের প্রেরণা ওই মিনার। এপার বাংলা ওপার বাংলার সাড়ে বার কোটি মানুষের পবিত্র তীর্থমঞ্চ এই শহীদ বেদী। এই সেই শহীদ মিনার যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে শােষকের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার দীক্ষা নেওয়া হয়। এই তাে সেই দিন,একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির কাকডাকা ভােরে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর শপথবাণী উচ্চারণ করেছে, বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্যে শক্তি প্রয়ােগ করা হলে তা বরদাসত করা হবে না। প্রয়ােজনে বাঙালি আরও রক্ত দেবে, জীবন দেবে, কিন্তু স্বাধিকারের দাবির প্রশ্নে কোনাে আপস করবে না। শেখ মুজিবুর রহমান যখন কথাগুলাে বলছিলেন, তখনাে ভালাে করে ভােরের আলাে ফোটেনি। পরে আকাশে লালের ছােপ ধরেছে সবে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বুকে কালাে ব্যাজ লাগিয়ে খালি পায়ে সমবেত হয়েছে শহীদ বেদীর সামনে নতুন দিনের নতুন শপথ নিতে।
তিনি বলে চলেছেন, ‘বাংলার মানুষ যাতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে বরকত সালাম-রফিক-শফিরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পথ দেখিয়ে গেছেন। ৫২ সালের সেই রক্তদানের পর ১৯৬২, ১৯৬৬ ,১৯৬৯-এ-বার বার বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবি বানচাল করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাঙলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে–এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে আমরা গাজী হয়ে ফিরতে চাই। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকার এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিন, বাঙালিকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারু নেই। একটু থেমে তিনি আবার বলেছিলেন, ষড়যন্ত্রকারী শােষক গণ-দুশমনের দল বার বার বাঙালির রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত করেছে। যারা নির্মম শােষণে লুণ্ঠনে বাংলার মানুষকে ভিখিরিতে পরিণত করেছে, তারা আজও নিজেদের কুমতলব হাসিল করার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিব হাত তুলে কারু প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা জেনে রাখুন ১৯৫২ সাল আর ১৯৭১ সাল এক নয়ষড়যন্ত্রকারীদের বিষ দাঁত কী করে ভাঙতে হয় এখন আমরা তা জানি। কারু প্রতি আমাদের বিদ্বেষ নেই, আক্রোশ নেই। আমরা চাই স্বাধিকার। আমরা চাই আমাদের মতােই পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বালুচ এবং পাঠানরাও নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কেউ আমাদের ওপর প্রভুত্ব করবে। ভ্রাতৃত্বের অর্থ দাসত্ব নয়। সম্প্রীতি আর সংহতির নামে বাংলাদেশকে আর কলােনি বা বাজার হিসাবে ব্যবহার করতে দেব না। যারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধিকারের দাবি বানচালের জন্য বাঙালিকে ভিখিরি বানিয়ে ক্রীতদাস করে রাখছে তাদের উদ্দেশ্যে যে-কোনাে মূল্যে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে।
একটু থেমে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে শেষ মুজিব ফের বললেন, ‘ভাইরা আমার বােনেরা আমার সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়তাে আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারব। তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাংলার সকল, মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হােন—বাংলার মানুষ যেন শােষিত না হয়, বঞ্চিতও না হয়, লাঞ্ছিত অপমানিত না হয়। দেখবেন, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।
‘যতদিন বাঙলার আকাশ-বাতাস মাঠনদী থাকবে, ততদিন শহীদরা অমর হয়ে থাকবে। বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফরিয়াদ করে ফিরছে : বাঙালি তােমরা কাপুরুষ হইও না। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বাধিকার আদায় করাে। বাংলার মানুষের প্রতি আমার আহ্বান প্রস্তুত হােন। স্বাধিকার আমরা আদায় করবই।’ শেখ মুজিবের আহ্বানে বাঙালি সাড়া দিয়েছে। স্বাধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আজ ঝাপিয়ে পড়েছে মেসিনগানের গুলি আর মর্টারের গােলা অগ্রাহ্য করে। বন্দিনী মাকে মুক্ত করার জন্য শত্রুর আধুনিক গােলাগুলির মুখে অসম সাহসে লড়াই চালিয়ে বীরের মতাে মৃত্যুবরণ করে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। আজিমপুর গােরস্তান থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত যে-রাস্তা একুশে ফেব্রুয়ারির পবিত্র দিনে আলপনায় আলপনায় ভরিয়ে তুলেছিল চারু ও কারু কলেজের ছাত্ররা, আজ তা রক্তে রক্তে লাল। একটি দুটি নয়, শয়ে শয়ে তাজা প্রাণের রক্তে হয়েছে রাঙা ওই পথ। যে পথে শফিক-বরকতজাব্বার প্রাণ দিয়েছে যে-পথে আসাদ-মনিরুজ্জামান প্রাণ দিয়েছে সেই পথ আজ হাজার ছাত্রের রক্তে হয়েছে ছয়লাপ। হায় কত প্রতিভা কত মনীষা ঝরে গেল পাক-সৈন্যের মেসিনগানের গুলি আর কামানের গােলার সামনে কে তার খোঁজ রাখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন বিল্ডিং জ্বলছে দাউদাউ। ধোঁয়া আর আগুনে ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শত্রুর মর্টারের গােলায় ধ্বসে গেছে মেইন বিল্ডিং। উড়ে গেছে মধুর ঐতিহাসিক ক্যান্টিন। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সংগ্রামের জন্ম হয়েছে ওই মধুর ক্যানটিনে। ওই মধুর ক্যানটিনে বসেই শেখমুজিব, আজিজুল হক, অলি আহাদ, তােয়াহারা একদিন ভাষা আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ওইখানেই জন্ম নিয়েছিল ‘৬২, ‘৬৬, এবং ‘৬৯ সালের গণ-আন্দোলন। ওই ক্যানটিনের সঙ্গে মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, তােফায়েল আহম্মদ, সাইফুদ্দিন মাণিক, জামাল হায়দার, নূরে আলম সিদ্দীকী, সাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন আরও অনেক অনেক বাংলা মায়ের বীর ছেলেমেয়েদের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে শেখ মুজিব থেকে শুরু করে অসংখ্য নেতার। আমাদের অনেক সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার স্মৃতি জড়ানাে ওই ক্যানটিন আর নেই। বর্বর দস্যুর গােলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেটি। রকেট ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল সর্বত্র। সৈন্যরা বেশ কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ঢুকে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ঘেষে রাস্তার কাছেই মধুর ক্যানটিন। ওই ক্যানটিন গুড়িয়ে দিয়ে ট্যাঙ্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঢুকে পড়ল। ট্যাঙ্ক থেকে গােলা ছুটছে রাত্রির অন্ধকারে বুক চিরে চিরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আটশ ছেলে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। দিন-কয়েক থেকে তারা ওখানেই থাকত। তাদের সঙ্গে থাকত তাদের কয়েকজন প্রিয় অধ্যাপকও। যারা তখনও বেঁচে ছিল, সৈন্যরা ভিতরে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে তাদের। অধ্যাপকদের আবাস স্থানে ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে ডক্টর জিন্নাত আলী, ডক্টর সারওয়ার মুরশিদ, ডক্টর মনিরুজ্জামান, ডক্টর মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং আরও কয়েকজনকে। এরা সকলেই বিভাগীয় প্রধান। জহিরুল হক ইকবাল হলের একজন সেই রাত্রে কোনাে মতে পাকিস্তানী সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তার মুখে শুনলাম সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী। অধ্যাপকদের সার করে দাঁড় করিয়ে স্টেনগানের গুলিতে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। অধ্যাপকদের পরিবারের লােকেরাও রেহাই পাননি। ঘুমন্ত শিশুদের বিছানায়ই মেরে রেখে চলে গেছে।
এমন অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে আছে বলে মনে হয় না। অধ্যাপক এবং ছাত্র খুনের এমন নজিরও সম্ভবত আর নেই। জনৈকা বিদেশিনী এক পাক অফিসারকে জিজ্ঞেস করছিল তােমরা নিস্পাপ শিশুদের কেন মারছ। ওরাই একদিন তাদের মায়ের, ভাইয়ের বাবার মৃত্যুর প্রতিশােধ নেবে। সৈন্যরা পরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশের সেরা-সেরা অধ্যাপককে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার অভিমত : মুজিবকে মদত দিচ্ছে অধ্যাপক এবং ছাত্ররা, তারাই হলেন পূর্ব বাংলার সমস্ত গণ-আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলে ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলায় আর গণআন্দোলন দেখা দেবে না। শােনা যায়, দর্শন বিভাগের প্রধান ডক্টর গােবিন্দ দেবকেও বর্বরেরা হত্যা করেছে। অপর একটি খবরে বলা হয়েছে, তাকে বেদম প্রহার করা হয়েছে। জানি না, কোন্‌টা সত্যি। তিনি শুধু বেঁচে থাকুন আমাদের একান্ত কামনা এই। তার মতাে অধ্যাপক এ-যুগে বিরল। তার বিভাগ বলে কথা নয়, সকল বিভাগের ছাত্রের কাছেই তিনি ছিলেন খুব প্রিয়। কোনাে দুষ্টু ছাত্রকেও কখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোনাে অসংযত উক্তি করতে শুনিনি। আত্মভােলা দেবতুল্য অমন পণ্ডিত মানুষটির ছবি আজ চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার; ওই সব অধ্যাপকদের জন্য মনটা আজ হুহু করে উঠছে। হায়, বাংলাদেশের কত মনীষা শেষ হয়ে গেল বর্বর দস্যুর বুলেটের গুলিতে।

সূত্র: দেশ : ৩ বৈশাখ ১৩৭৮

১ মার্চ দুপুরের খবরের পরেই অবস্থাটা গেল পাল্টে। প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রেখেছেন—খবরটা পেতেই পূর্ববাংলার মানুষ ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়ল। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় নেমে এল বিক্ষুব্ধ মানুষের খণ্ড খণ্ড মিছিল। দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেল ঝপাঝপ। একদল লােক গিয়ে নাজ’ সিনেমাহলে আগুন লাগিয়ে দিল। স্টেডিয়ামে বিশ্ব একাদশ এবং বি সি সি পি-র মধ্যে ক্রিকেট খেলা চলছিল। দর্শকরা খবর পেতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে গ্যালারি ছেড়ে বেরিয়ে এল। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল ক্লাস, চলছিল পরীক্ষা। সব বাতিল হয়ে গেল। স্কুল-কলেজ কল-কারখানা অফিস-আদালত থেকে বেরিয়ে এল অগণিত ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-কেরানী। টেলিগ্রাম, টেলিফোন, ডাকবিভাগ এবং বিমানবন্দরের কর্মীরাও সেই বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হলাে। যােগাযােগ বন্ধ হয়ে গেল বাইরের জগতের সঙ্গে। তেজগা বিমানবন্দরের কাছে মিলিটারি আর জনতায় সংঘর্ষ হলাে। ১ জন মারা গেল। কম করেও ৭ জন আহত হলাে। রাত ৮টা থেকে ভাের ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি হলাে।
ওইদিনই ইকবাল হলের একটা ঘরে বসে কেন্দ্রীয় ছাত্র লীগের নেতারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। ওইদিনের সভায়ই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে বাঙালির জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ সংগীতটি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে, পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয় পতাকা ব্যবহার করার। এসবকিছু সিদ্ধান্তের পিছনে যার মাথা, নাম তার সিরাজুল আলম খান। ঢাকার ছাত্রদের সকলের শ্রদ্ধার, ভালােবাসার ‘সিরাজভাই’ তিনি। (আমি জানি, তিনি তাঁর প্রচার একেবারেই পছন্দ করেন না।) সবার অলক্ষ্যে থেকে তিনি কাজ করে যেতেই ভালােবাসেন। কিন্তু ইতিহাসের দাবি উপেক্ষা করি কী করে? তাই বাধ্য হয়েই তাকে পাদপ্রদীপের আলােয় হাজির করছি। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঠকদের সামনে হাজির করানাের জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে রাখছি। আর-একটি কথা। সিরাজুল আলম খানকে তুলে ধরার পিছনে কোনাে নেতা বা কর্মীকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। অন্য সকলের ত্যাগ এবং নিষ্ঠা সম্পর্কেও আমার সমান শ্রদ্ধাবােধ আছে। আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার অবকাশ আছে বলেই কথাটা আগে-ভাগে বলে রাখলাম।) মঞ্চে আমরা তাকে দেখিনি, কিন্তু ‘৬৬, ৬৯ এবং ৭১-এর ছাত্র এবং গণ-আন্দোলনের নেপথ্যনায়ক এই সিরাজুল আলম খান। ছাত্ররা কেউ-বা তাকে ডাকেন ‘মাও সে তুং, কেউ-বা চে-গুয়েভারা। আওয়ামী লীগের প্রবীণেরা তাকে বলেন, কমিউনিস্ট’। সাম্প্রতিককালে পূর্ববাঙলার ছাত্র এবং গণআন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা মূলত শেখ মুজিব (তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সহ) এবং তাঁর। ১৯৬২ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এখন কেউ নন, আওয়ামী লীগেরও নন। ঢাকার ছেলেরা বলেন, চার আনার সদস্যও নন। কিন্তু তিনি অনেক কিছুই। ছাত্রলীগের একজন প্রভাবশালী সদস্যের কাছে শােনা একটা ঘটনার উল্লেখ করছি এখানে। ঢাকায় যখন শেখ মুজিবের ডাকে অসহযােগ আন্দোলন চলছিল, তখন একজন ইতালীর সাংবাদিক শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার উপদেষ্টা কে? উত্তর মুজিবুর রহমান তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ফোন করেন, ‘সিরাজ, তুমি এক্ষুনি আমার বাড়ি চলে এস।’ মােটসাইকেল চড়ে সিরাজুল আলম খান শেখ সাহেবের বাড়ি পৌছুতেই শেখ সাহেব হেসে সিরাজুল আলম খানকে দেখিয়ে ইতালীর সাংবাদিকটিকে বললেন, এই যে আমার উপদেষ্টা।’ আশ্চর্য চরিত্রের লােক এই সিরাজুল আলম খান। দিনের পর দিন একনাগাড়ে ঘুমুতেও পারেন, আবার না ঘুমিয়ে একনাগাড়ে কাজও করে যেতে পারেন। দিনের বেলা ছাত্রনেতারা তাঁর নাগাল বড়াে-একটা পেতেন না। আয়ুব-ইয়াহিয়ার চর হন্যে হয়ে তার খোঁজ করেছে। ছাত্রনেতারা তার সঙ্গে গভীর রাত্রে—রাত দুটো-তিনটেয় কয়েকটা নির্দিষ্ট রেস্তোরায় মিলতেন। ঢাকার ছাত্রদের কাছে,বিশেষ করে ছাত্রলীগের ছেলেদের কাছে তিনি ‘ফ্রেন্ড, ফিলজফার এন্ড গাইড’। ১৯৬৯ সালে জনমতের চাপে আয়ুব যখন শেখ মুজিবুরের ওপর থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিলেন, শেখ সাহেব এবং অন্যান্যরা জেল থেকে ছাড়া পেলেন,তখন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় শেখসাহেব এবং অন্যান্যদের সংবর্ধনা জানানাে হয়। তখন এই সিরাজুল আলম খানের নির্দেশেই তারই হাতে গড়া ছেলে, ৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমদ ওই জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তােফায়েল শেখ মুজিবকে এই খেতাব দেওয়ার সার্থকতা সম্পর্কেও ভাষণ দেন। জনতা লক্ষ হাতের করতালিতে তােফায়েল আহমদের প্রস্তাব সমর্থন করে। সেদিন থেকে মুজিব হলেন, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান।
জয়বাংলা ধ্বনি আজ এপার বাঙলা ওপার বাঙলার হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে রণিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের বীজমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ‘জয় বাংলা’। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব জয়ের পিছনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি একটি ফ্যাক্টর। পরবর্তী কোনাে এক কিস্তিতে নির্বাচন প্রসঙ্গে আমি তার বিস্তারিত আলােচনা করব। এখানে আমি তার উল্লেখমাত্র করলাম। পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনের সময়ে ঢাকায় দেখা গেছে, একজন রিকশাওয়ালা আর একজন রিকশাওয়ালাকে দেখলে ‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময় করছে। ক্রমশ সর্বস্ত রের মানুষের মধ্যে এটা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়। এই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির উদগাতাও সিরাজুল আলম খান। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নির্মিত মঞ্চের দেবদারু পাতার পশ্চাৎপটের ওপর ফুল দিয়ে প্রথম ‘জয় বাংলা’শব্দ দুটি লেখা হয়। তারপর ‘জয় বাংলা’ লেখাটি নিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেদের মিছিলও বের হয়। কিন্তু সাধারণের মধ্যে ধ্বনিটির প্রচার ঘটে ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে। ১৯৬৯ সালে গণ-বিক্ষোভের সুযােগ নিয়ে আয়ুবকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলেন। ২৫ মার্চ আবার সামরিক শাসন জারি হলাে। ইয়াহিয়া বা আয়ুবের পক্ষে কাজটা ছিল বে-আইনী। কেননা, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে মার্শাল ল জারির বিধান ছিল। সেই বিধান অনুযায়ী ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করে ছিলেন। এবং ওই সামরিক আইনের সাহায্যেই আয়ুব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে আয়ুব যে-সংবিধান রচনা করেন, তাতে কোনাে অবস্থায়ই মার্শাল ল জারির কোনাে বিধানই ছিল না। কিন্তু ইয়াহিয়া-এস এম আহসান এবং টিক্কা খানের পিস্তলের নলের কাছে আয়ুবকে নিজের সংবিধান বিরােধী কাজটিই করতে হলাে। আয়ুব বেআইনীভাবে মার্শাল ল জারি করলেন। সেই মার্শাল ল-র সাহায্যেই ইয়াহিয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। যেহেতু মার্শাল ল জারিটাই আইনবিরােধী, মার্শাল ল’র সাহায্যে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকাটাও বেআইনী। ইয়াহিয়া যে প্রেসিডেন্ট পদে এখনাে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, এটা নেহাতই গায়ের জোরে, তার পিছনে আইনের কোন সমর্থন নেই। যাক বলছিলাম ১৯৭০ সালের জানুয়ারির গােড়ায় রাজনৈতিক দলগুলাের ওপর থেকে ইয়াহিয়া-আরােপিত বাধানিষেধ তুলে নেওয়া হলাে। রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠানের ওপর থেকে বাধানিষেধ তুলে নেওয়ার পর ১১ জানুয়ারি শেখ সাহেব পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা করলেন। ওইদিনই প্রথম, প্রকাশ্যে সভামঞ্চের সামনে হার্ডবাের্ডে বড়াে বড়াে হরফে ছাত্ররা লিখে দিলেন ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি। আমি শব্দ না বলে বলি মন্ত্র। মন্ত্র বলতে আমি এই বুঝি, যে নাম উচ্চারণে মানুষ তার দেহে এবং মনে একটি আশ্চর্য পরিবর্তন অনুভব করে তাই মন্ত্র। পরিবর্তনটা বাহ্যিক নয়, ভিতরকার, অনুভূতির। সে অনুভূতি চেতনা বা জ্ঞানের, তেজ এবং শক্তির। ওই শব্দ দুটি উচ্চারণে বাঙলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে একটি নতুন তেজ এবং শক্তি অনুভব করে। শব্দ দুটি এখন আশ্চর্য সঞ্জীবনী শক্তির আধার। ওইদিন পল্টনের জনসভায় ব্যবহারের পর থেকেই জয়বাংলা’ স্লোগানটি দ্রুত সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গােড়ায়, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একাংশ ওই ধ্বনি ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁদের আশংকা ছিল, এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নির্বাচনে তাদের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, তাঁদের ধারণায় শব্দদুটির সঙ্গে যুক্তবাঙলার গন্ধ জড়িত। কিন্তু বাস্তবে ফল হয়েছে উল্টো। এই স্লোগানটিই পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করে তােলার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাঙলাদেশ ঘােষণা নিয়েও ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরােধ ছিল। ১২ আগস্ট, ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটীর এক বর্ধিত সভা হয় ইকবাল হলে। সভায় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এবং নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আলােচনা এবং বিতর্ক হয়। ছাত্রনেতাদের গরিষ্ঠ দলের বক্তব্য ছিল, পূর্ববাঙলা পাকিস্তান-সরকারের একটি উপনিবেশ। তাই জাতীয় মুক্তি-আন্দোলন তীব্র করতে হবে। তাদের লক্ষ্য হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা। নির্বাচনে জয়ী হলেই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে জঙ্গীশাসক ইয়াহিয়া খান গণপ্রতিনিধিদের হাতে আপসে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এ তারা বিশ্বাস করেন না। নির্বাচনে যােগ দেওয়ার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য জনমত গঠন সত্য। নির্বাচনে যােগ না দিলে আওয়ামীলীগ জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন তাে হয়ে পড়বেই তদুপরি, আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করলে মুসলিম লীগ, জামাত, জমিয়তে ওলামা প্রভৃতি দলের একটা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ক্ষমতায় চলে আসবে অনায়াসেই। তার ফলে শশাষণমুক্তির বাস্তবায়নের স্বপ্ন হবে সুদূরপরাহত। তাদের মতে, নির্বাচন জনমত গঠনের একটি মাধ্যম মাত্র। সেই ঐক্যবদ্ধ জনতার আন্দোলনকে একদিন সশস্ত্র রূপ ধারণ করতেই হবে।
ছাত্রদের ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘােষণার প্রস্তাব অনুমােদন করেন। কিন্তু ছাত্রদের একাংশ প্রস্তাবটির বিরােধিতা করেন। তাঁরা যে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ গঠনের বিরােধী ছিলেন তা নয়, তবে ওই মুহূর্তে তারা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘােষণার বিরােধী ছিলেন। অর্থাৎ মতিবিরােধটা ছিল, সময় নিয়ে।
সমস্যা সমাধানের জন্য ছাত্র নেতারা গেলেন শেখ মুজিবের কাছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই প্রয়ােজনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমােদনে দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নীতি নির্ধারিত হয়। শেখ মুজিব কিন্তু কখনােই চাইতেন না, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগে এমন কোনাে প্রস্তাব পাশ হােক যার প্রতি একাংশের অনুমােদন নেই। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে প্রস্তাব পাশ করা যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে দলে ভাঙন দেখা দেয়। তিনি ছাত্র নেতাদের বললেন, তােমরা যা খুশি প্রস্তাব পাশ করতে পার। সে অধিকার তােমাদের আছে। তবে শুধু প্রস্তাব পাশ করেই বিপ্লব হয় না। বাস্তব দিকটাও বিচার করতে হবে। সরকার ভালােই জানেন, আমরা কী করছি বা করতে যাচ্ছি। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের কিছু করতে পারছেন না। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ গঠনের প্রস্তাবটা এই মুহূর্তে লিখিতভাবে পাশ হলেই জঙ্গী সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই সব কিছু বানচাল হয়ে যাবে। প্রস্তাবটা লিখিত না থাকলেও ইতরবিশেষ কিছু হবে না। ছাত্র নেতারা শেখ সাহেবের কথা মেনে নিল।
শেখ সাহেবের একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আছে। সেই সঙ্গে তাঁর কথায় আছে জাদু, আছে গণতন্ত্রের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। দলের সহকর্মী বা ছাত্রদের কোনাে প্রস্তাব তার মনঃপুত না হলে তিনি সরাসরি তা নাকচ করে দেন না। তিনি শুধু তার নিজস্ব অভিমতটা ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের এবং যুক্তির এমনই প্রভাব যে, প্রস্তাবক সানন্দেই শেখ সাহেবের কথায় সায় দিয়ে দেন। শেখ সাহেব থিয়ােরী’র পােকা নন। তিনি অত্যন্ত বাস্তববাদী। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি দলের সব নীতি নির্ধারণ করেন।
জনসাধারণের ওপর তার ব্যক্তিত্বে যে কী প্রভাব, তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৭০ সনের ৭ জুন ৬-দফা দাবি-দিবস উপলক্ষে রেসকোর্স ময়দানে জনসভার আয়োেজন করা হয়। সকাল থেকেই সেদিন অঝােরে বৃষ্টি পড়ছিল, ঝড়াে হাওয়া বইছিল। অনেকেই ভাবলেন, শেখ মুজিবের জনসভায় আজ বেশি লােক হবে না। কিন্তু দুপুরের পরেই তাদের সেই ভুল ভাঙল। ছাতা মাথায়, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বর্ষাতি গায় বস্তা মাথায়, টোকা মাথায়, কাতারে কাতারে লােক এসে জমায়েত হলাে রেসকোর্স ময়দানে। ঝড়াে হাওয়ার এমনই দাপট যে, সভামঞ্চ পর্যন্ত হেলতে হেলতে এই পড়ে তাে এই পড়ে অবস্থা। লােকেরা বৃষ্টির ছাটে এবং কনকনানি হাওয়ায় কুঁকড়ে বসে গেল ময়দান জুড়ে। লক্ষ লক্ষ জনতা। শেখ মুজিব এসে উঠলেন মঞ্চে। উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়ল জনতা। শেখ মুজিব নির্দেশের স্বরে বললেন, আপনারা চুপ করুন। মুহূর্তেই জনতার সমুদ্র একেবারে নীরব। বাতাসের শাে-শাে শব্দ ছাড়া আর কিছুই শােনা যাচ্ছিল না । শেখ সাহেব আবার আদেশ দিলেন, ‘আপনারা উঠে দাঁড়ান। জনতা উঠে দাঁড়াল। এলােমেলােভাবে নয়, ঢেউয়ের মতাে। শেখ সাহেব আবার বললেন, আপনারা হাততালি দিন। জনতা হাততালি দিল । বলুন, জয় বাংলা,’ শেখ বললেন। জনতাও তাই বলল। আপনারা এখন বসে পড়ন। শেখ মুজিবের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে জনতাও নিঃশব্দে একটা পড়ন্ত তরঙ্গের মতাে বসে পড়ল।
বিদেশী সাংবাদিকদের মন্তব্য, এ যে দেখছি ম্যাজিক।
শেখ সাহেবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার পিছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে তার চরিত্রের ছােটোখাটো কয়েকটা বৈশিষ্ট্যরও প্রভাব আছে। যেমন, শেখ সাহেবের বাড়ি কোনাে অপরিচিত লােক দেখা করতে গেলে শেখ সাহেব লােকটিকে না চিনেই বলে ওঠেন “আরে আরে কী খবর? কেমন আছেন? কী যেন আপনার নাম—ওই যে কী যেন নামটা –-আঃ-।’
শুধু এই মুহূর্তে হয়তাে মনে পড়ছে না, কিন্তু শেখ সাহেব তার নাম জানেন না। লােকটা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘আজ্ঞে আমি মানিকগঞ্জের সােবহান আলী।
শেখ সাহেব সােল্লাসে চিৎকার করে ওঠেন, “আরে হ্যা, হ্যা, এখন মনে পড়েছে এতক্ষণ পেটে ছিল, মুখে আসছিল না।
লােকটা খুশি হয়ে ফিরে যায়। সে তার গায়ে ফিরে গিয়ে সবাইকে নিশ্চয়ই ফলাও করে কাহিনীটা বলবে। হয়ত বলবে, একদিন কবে মানিকগঞ্জে এসেছিলেন, ভিড়ের মধ্যে কবে দেখেছেন, ঠিক মনে রেখেছেন। এর একটা প্রভাব আছে নিশ্চয়ই। শেখ সাহেবের অভিমত, সামান্য কথায়ই যদি কাউকে খুশি করা যায়, কেন করব না। ছাত্রদের মধ্যে শেখ সাহেবের, জনপ্রিয়তার পিছনেও এমনি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকখানি কাজ করেছে। আশ্চর্য তাঁর স্মরণশক্তি। যে ছাত্রের সঙ্গে একবার তিনি পরিচিত হন, ভােলেন না তিনি তার নাম, তার পরিচয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ছেলেরা যখন তার বাড়ি যায় তিনি তাদের নিয়ে অনেক সময় হৈহুল্লোড় করেন। কার, পিঠে একটা দুম করে শব্দ করে কিল মাবরেন, স্নেহের পরশে কারু কানটা মুলে দিলেন, নাকটা টানলেন, চুলটা টানলেন। শেখ সাহেব হ্যত আবদুর রব বা তােফায়েল বা সাহাজান সিরাজের সঙ্গে কথা বলছেন, একই সঙ্গে রফিককে হয়তাে একটা চোখ টিপে দিলেন, নজরুলকে হয়তাে ভেংচি কাটলেন, আফতাবকে হয়তাে জিব দেখালেন। কথাবলার সময় শেখ সাহেবের কাধ দুটো নাচতে থাকে। ছাত্রদের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গভাবে আর কোনাে নেতা কখনাে মিশতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়ােজন যে, দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার রাজনীতিতে একটা মূল পার্থক্য গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে প্রাধান্য রাজনৈতিক নেতাদের। পূর্ববাঙলার প্রাধান্য ছাত্রদের। এখানকার মতােই ওখানে প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই একটি করে ছাত্র-সংগঠন আছে। কিন্তু এ বাঙলার ছাত্র এবং গণআন্দোলনের নির্দেশ আসে রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে। কিন্তু ওখানে নির্দেশ আসে ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে। অর্থাৎ পূর্ব বাঙলার রাজনীতিতে গণ-আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সব থেকে বেশি। এই মূল বিষয়টা সামনে না রাখলে ও বাঙলার রাজনীতি এবং গণ-আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তি জন্মাতে পার। কী করে পূর্ববাঙলায় রাজনীতি এবং গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাত্রসমাজের হাতে গেল, সে সম্পর্কে আমি পরবর্তী কোনাে কিস্তিতে আলােচনা করব। আপাতত প্রয়ােজনে শুধু মােদ্দা বিষয়টা বলে রাখলাম এখানে।
১মার্চ সিরাজুল আলম খান এবং তাঁর সহযােগী ছাত্রনেতারা পরবর্তী গণআন্দোলনের রূপ এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করে একটি ইস্তাহারের খসড়া করেন। এটা প্রকাশ করা হয় ৩ মার্চ, পল্টনে ছাত্রলীগের সভায়। শেখ মুজিব সেই সভায় ভাষণ দেন। ইস্তাহারটি আজ একটি ঐতিহাসিক দলিল। মার্চের সমস্ত গণআন্দোলন পরিচালনা, স্বাধীনতা ঘােষণা, শেখ-মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘােষণা—সব কিছুই ওই ইস্তাহারের নির্দেশ মতােই হয়েছে। আমি এখানে ইস্তাহারটি হুবহু তুলে ধরছি :
১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ নির্ভেজাল
গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
ক. বাঙলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে।
খ. সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযােগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। গ. শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় ‘মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে।
ঘ. হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
ঙ. স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে পারস্পরিক যােগাযােগ রক্ষা করতে হবে।
স্বাধীনতা-আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে।
অ, বর্তমান সরকারকে বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকার গণ্য করে এ বিদেশী সরকারের | ঘােষিত সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।
আ. তথাকথিত পাকিস্তানের তল্পীবাহী পশ্চিমা অবাঙালি মিলিটারিদের বিদেশী ও হামলাকারী সৈন্য হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং হামলকারী শত্রুসৈন্যকে খতম করতে হবে।
ই, বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শােষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স খাজনা দেওয়া বন্ধ করতে
হবে।
ঈ. স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণগত যে-কোনাে প্রতিরােধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ এবং খতম করার জন্যে সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
উ. বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
ঊ . স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে আমার সােনার বাঙলা আমি তােমায়
ভালােবাসি’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।
ঋ .শােষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন করতে হবে। এবং সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এ. উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়ে বাঙলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে। ঐ. স্বাধীন সংগ্রামের বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদান করে বাঙলার
স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে—
* স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’ দীর্ঘজীবী হউক।
* স্বাধীন কর স্বাধীন কর বাঙলাদেশ স্বাধীন কর ।
* স্বাধীন বাঙলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
* গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড় মুক্তিবাহিনী গঠন কর।
* বীর বাঙালি অস্ত্র ধর– বাঙলাদেশ স্বাধীন কর।
* মুক্তি যদি পেতে চাও-বাঙালিরা এক হও।
বাঙলা ও বাঙালির জয় হােক
জয় বাঙলা
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
কেন এই বাংলাদেশ গঠন কী তার লক্ষ্য, স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, কী হবে আন্দোলনের ধারা আন্দোলনের স্লোগানই বা কী কী হবে- সব কিছুর স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে ইস্তাহারে।
বাংলাদেশ গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি গঠন, অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করা, গণতন্ত্র মূল্যবােধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলন জাতীয়তাবাদী এবং সেই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের আন্দোলন। দেখা যাচ্ছে, এই স্বাধীনতা-আন্দোলন পশ্চিমা শশাষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নয়। পশ্চিমা শশাষক-শ্রেণীকেই ছাত্ৰ-সংগ্রাম পরিষদ ‘বিদেশী এবং উপনিবেশবাদী’ আখ্যা দিয়েছেন। পশ্চিমা এই শােষকশ্রেণীর মধ্যে আছে ইয়াহিয়া সরকার এবং পুঁজিপতিরা। স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে তারা জনসাধারণের সহযােগিতা এবং ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন শ্রমিকদের এবং কৃষকদের সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকসৈন্য খতম করা এবং সশস্ত্র প্রস্তুতির ডাকও দেওয়া হয়েছে। এই আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল যে হিন্দু-মুসলমান এবং বাঙালিঅবাঙালিতে দাঙ্গা লাগাতে পারেন সে সম্পর্কেও জনসাধারণকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। অসহযােগ আন্দোলনের নির্দেশিকা এই ইস্তাহারেই রয়েছে। পরবর্তী, সমস্ত আন্দোলন এই ইস্তাহারের নির্দেশ মতােই পরিচালিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের যে-একাংশ এতদিন স্বাধীন ও সার্বভৌম স্বাধীন বাঙলাদেশ’ ঘােষণা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, ইয়াহিয়ার অগণতান্ত্রিক মনােভাবের দরুণ তাঁদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার পর পূর্ববঙ্গে নির্বিচার গণহত্যা চালানাের পর তাঁদের পক্ষে ইস্তাহারের নির্দেশ সমর্থন না করে আর কোনাে উপায়ই রইল না। তাই বলছিলাম, ২৮ ফেব্রুয়ারি আর ১ মার্চের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান ঘটে গেছে। পুর্ববঙ্গের রাজনীতিতে, গণআন্দোলনে এক নতুন অধ্যায় সূচনা হয়ে গেছে ১ মার্চ দুপুরের পর।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং-এর প্রাঙ্গণে ছাত্রসংগ্রাম-পরিষদের আয়ােজনে ছাত্রদের একটি বিরাট সভা হলাে। ছাত্রদের সভা সাধারণত বেলতলাতেই হয়। কিন্তু ওই দিন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীতে সারা অঙ্গন ছয়লাপ। ছাত্রনেতারা তখন ছাদের ওপর উঠে ভাষণ দিলেন। ওই দিনের সভাপতি ছিলেন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী! ছাত্রনেতা আ.স.ম আবদুর রব জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে ‘উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাঙলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করার ডাক দিলেন।
পােড়ানাে হলাে পাকিস্তানী পতাকা। যে দিয়াশলাই দিয়ে প্রথম পাকিস্তানী পতাকা পােড়ানাে হয়, ঢাকার একজন ছাত্রনেতা আজও পরমযত্নে সেই দিয়াশলাইটা রেখে দিয়েছেন। স্বাধীন বাঙলাদেশের মিউজিয়ামে তা সংরক্ষিত হবে ভাবীকালের ছেলেমেয়েদের জন্য।
পাকিস্তানী পতাকা তাে পােড়ানাে হলাে। কিন্তু জাতীয় পতাকা কোথায়? ছাত্র লীগের জঙ্গীবাহিনীর (রেজিমেন্টাল) পতাকাটাই এগিয়ে দিল একজন। ছাত্রনেতা আব্দুর রব সেই পতাকা হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করলেন, এই আমাদের স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা। পতাকার জমিন সবুজ। মাঝে সিঁদুর-রঙা গােলাকার সূর্য। তারই মাঝে সােনালিতে আঁকা পূর্ববাঙলার মানচিত্র। ছাত্র-ছাত্রীরা বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে বরণ করে নিল সেই পতাকা। তারপর সেই পতাকা সামনে নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করলেন। রমনা এলাকায় ঘুরল সেই মিছিল। বাঙলাদেশের মানুষ সেই প্রথম দেখল তাদের জাতীয় পতাকা, সকলে সশ্রদ্ধ চিত্তে সম্মান জানাল সেই পতাকাকে। পরের দিন ছাত্রলীগ আয়ােজিত প্রকাশ্য জনসভায় ১নং ইস্তাহার বিলি করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা দেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে সেই পতাকাও তােলা হলাে।
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছাত্র লীগের জঙ্গীবাহিনীর পতাকারূপে এই পতাকার পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনাও সিরাজুল আলম খানের। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের স্মৃতি-স্মরণে ছাত্রলীগের জঙ্গীবাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। তাতে ওই পতাকার প্রথম বাস্তবরূপ দেখা যায়। কিন্তু প্রকাশ্যে পতাকা ব্যবহৃত হয় ৭ জুন সকাল সাড়ে আটটায়। ৬-দফা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ছাত্রলীগের স্বেচ্ছা-বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয় পল্টন ময়দানে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। তার মধ্যেই শেষসাহেব ছাত্রলীগ স্বেচ্ছা সেবকবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন। গােল করে মােড়ানাে ছাত্র লীগের পতাকাটা। একজন শেখ সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। শেখ-সাহেব তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ওই পতাকা খুলে ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রবরে হাতে তুলে দিলেন বিশেষ কুচকাওয়াজ শুরু হওয়া ঠিক আছে।

সূত্র: দেশ : ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮

এই ক্রমবর্ধমান বিক্ষুব্ধ গণ-মানসের চাপ এবং জঙ্গীশাসক চক্রের নির্বিচার গণহত্যা ও উস্কানির মুখেও শেখ সাহেব ধৈর্য এবং ধৈর্য না হারিয়ে সাফল্যের সঙ্গে তার সুপরিকল্পিত অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পিছনে তাঁর চারটি উদ্দেশ্য ছিল। এক পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর শােষণ নিপীড়ন এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিটি বাঙালির মনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিয়ে এক ইস্পাত কঠিন জনমত গঠন করা। দুই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের হুমকির মুখে সেই জাগ্রত জনতার সাহায্যে স্বাভাবিক প্রশাসন স্তব্ধ করে দিয়ে ইয়াহিয়া-টিক্কাখান-পীরজাদা চক্রের চৈতন্যোদয় করা, যাতে তারা পাকিস্তানের স্বার্থেই, পূর্ব বাঙলার দাবি মেনে নেয়। তিন, অধিক রক্তপাত না ঘটিয়ে পশ্চিমা শাসক এবং ধনিক গােষ্ঠীর শােষণ থেকে বাঙালিকে মুক্ত করে শােষণমুক্ত একটি নয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে পৌছানাে। শেখ সাহেব প্রায়ই একটা কথা বলছেন, মনে রাখবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন,তিনিই সেরা সিপাহশালার। চার অসহযােগ আন্দোলন চলার ফাঁকে জনসাধারণকে পাকসৈন্যের সাধারণ গােছের হামলা রােধ করবার মতাে শক্তি সঞ্চয় এবং প্রস্তুতি নেওয়ার সুযােগ দেওয়া।
শেখসাহেব ধাপে ধাপে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাঁর লক্ষ্যে পৌছুতে চেয়েছিলেন। নির্বাচন ছিল একটি ধাপ, একটি শান্তিপূর্ণ ধাপ। পূর্ব বাঙলার শােষিত-বঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্খ বাস্তবায়িত করার জন্যে তিনি ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, বাঙালির ভাগ্য বাঙালিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে পূর্ব বাঙলার মানুষের কখনাে সার্বিক কল্যাণ এবং বিকাশ হতে পারে না। তাই তিনি পূর্ব বাঙলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিলেন। সেই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পৌছানাের জন্যে নির্বাচনকে একটা উপায় বলে ধরেছিলেন তিনি। তার মানে এই নয় যে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকেই তিনি একমাত্র উপায় বলে গণ্য করতেন। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা সফর করে এসে, নির্বাচনের আগে, ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই হােক আর নির্বাচন বানচাল হলে জাগ্রত জনগণের শক্তির মাধ্যমেই তােক জনগণকে ক্ষমতা দখল করতেই হবে। নির্বাচনের পরও শেখ সাহেব বলেন, “শাসনতন্ত্র প্রত্যাখ্যাত হলে বাঙলার সাত কোটি মানুষকে সংগ্রামের পথই বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা বানচাল হলে জাগ্রত জনগণের শক্তি এবং সংগ্রামের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে—এই বিশ্বাস এবং পরিকল্পনা তার মনে এবং মাথায় ছিল।
পূর্ব বাঙলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলন ছিল তার লক্ষ্যে পৌছানাের একটি অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন। তৃতীয় অধ্যায় ছিল শােষণমুক্ত অর্থনৈতিক এবং সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। (এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলােচনা করব।)
সন্দেহ নেই, নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে তিনি তাঁর প্রথম অধ্যায়ের লক্ষ্যে পৌঁছানাে সম্পর্ক বেশ আশাবাদী হয়ে পড়েছিলেন। পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সম্পর্কে ইয়াহিয়ার সহানুভূতিশীল মনােভাব শেখ মুজিবের আশা আরও প্রবল করেছে। ইয়াহিয়া ডিসেম্বরে (১৯৭০) ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আমি নিজেও তথাকথিত, স্ট্রং সেন্টারে বিশ্বাসী নই। দেশের অপর খণ্ড থেকে পূর্ববাঙলার হাজার মাইলের ভৌগােলিক অবস্থান সম্পর্কে আমি সচেতন। পরিকল্পনা, নিজস্ব সম্পদ ভােগ, ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলা যাতে করে নিজেই তার ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ হতে পারে, তজ্জন্য পূর্ব বাঙলাকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া আবশ্যক।
আন্দোলনের এই অধ্যায়েই পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ ঘােষণার পক্ষপাতী ছিলেন না শেখ মুজিব। নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা জনতার দরবারে যে-শপথনামা পাঠ করেন তা শেষ করেন জয় বাংলা জয় পাকিস্তান’ দিয়ে। অর্থাৎ তিনি বাঙলাদেশ ও পাকিস্তান—দুইয়েরই কল্যাণ এবং উন্নতি চান। আর তা চান ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্র সমবায়টিতে যুক্ত থেকেই। অনেকের অবশ্য এ-কথা মনে হতে পারে, ইয়াহিয়া চক্রকে ধোকা দেওয়ার জন্যেই শেখ সাহেব শপথনামার শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটি জুড়ে ছিলেন। যদি তাই হবে, তাহলে শেখ সাহেব তার অন্যান্য ভাষণের শেষে কেন শুধু ‘জয় বাংলাই বলেন? সেখানে ও তাে ‘জয় পাকিস্তান জুড়তে পারতেন। ধোকা দিতে গেলে বরং সেইসব ক্ষেত্রেই ‘জয় পাকিস্তান’ উল্লেখ করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল বেশি। সাধারণ ভাষণের শেষে কে কী বললেন, তাতে তেমন কিছু-একটা এসে যায় না। সেখানে ভাষণটাই আসল। কিন্তু সাধারণ ভাষণ করে শপথনামা এক নয়। শপথনামার একটা আলাদা গাম্ভীর্য, পবিত্রতা এবং গুরুত্ব রয়েছে। যিনি শপথ পাঠ করেন,তিনি যে শপথনামার প্রতিটি শব্দই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন—এটাই সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়। যদিও বাস্তবে হয়তাে অনেকেই শপথের মর্যাদা রাখেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্তত শেখ মুজিব যে শপথনামার প্রতিটি শব্দ বিশ্বাস করতেন ওটা নিশ্চিতই ধরা যায়। কারণ দলের নেতা হিসাবে শপথনামার খসড়া নিশ্চয়ই পূর্বাহ্নেই তার অনুমােদন লাভ করেছিল।
২৬ নভেম্বর ঢাকার হােটেল শাহাবাগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি শুধু স্বায়ত্তশাসন চাইছেন, বিচ্ছেদ বা স্বাধীনতা চাইছেন না? উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, এখনও ।
কিন্তু নির্বাচনের পরে গােড়ায় ছয়দফা আদায় সম্পর্কে কিছুটা আশায় সঞ্চার হলেও ক্রমশ তা বিলীন হয়ে গেল। শেখ সাহেব ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন ইয়াহিয়াকে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর দাবি মেনে নিয়ে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন। আবার ভুট্টোই শেষে নানান অজুহাতে ৩ তারিখের অধিবেশন বানচাল করতে উঠে পড়ে লাগলেন। ষড়যন্ত্রের আঁচ পেলেন মুজিব। পূর্ব বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের দাবি বানচালের আশঙ্কায় বেড়ে চলল। ১ মার্চ পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার পর প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ল তারা। আর ছয়-দফা এগারাে দফা নয় সরাসরি স্বাধীন ও সার্বভৌম, বাঙলাদেশ কায়েমের দাবি জানাল তারা। জনসাধারণের সেই দুর্বার দাবিকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা কারু হাতেই রইল না। শেখ মুজিব জনগণের নেতা। জনমতই তার মত। বাস্তবে দেখি নেতার মতই জনতার মত। কিন্তু এক্ষেত্রে জনতার মতই তার মত হয়ে দাঁড়াল। তিনি এই আন্দোলনকে ‘মুক্তিসংগ্রাম’ বলে আখ্যা দিলেন। তখনাে কিন্তু শেষ রক্ষার আশায় পূর্ব-পশ্চিমের বন্ধনের শেষ সুতাে ধরে রাখবার চেষ্টায় তিনি অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। ওই সময় এয়ার মার্শাল আসগর খানও মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের দুই অঞ্চল মনের দিক থেকে ইতিমধ্যেই ভাগ হয়ে গেছে।
শেখ মুজিবই দুই অঞ্চলের ছিড়ে-যাওয়া বন্ধনের শেষসুতাে। স্বাধীন বাঙলার দাবির মুখে তিনি চরম ধৈর্য দেখাচ্ছেন।
১ মার্চ ইয়াহিয়ার অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর শেখ মুজিব বুঝলেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভের আশা খুব কম।
এখানে কথা উঠতে পারে, তাহলে নির্বাচন করে কী লাভ হলাে? বরং ওই সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়াই উচিত ছিল। ছাত্রলীগের কয়েকজন তাত্ত্বিক নেতার সঙ্গে আলােচনা করে যা জবাব পেয়েছি তা এই :
এক নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা থাকলেও সেই জনপ্রিয়তার সীমানার মাপ জানার উপায় ছিল না। সকল রাজনৈতিক দলই নিজেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে দাবি করতাে সেই সময়। ফলে জনসাধারণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে যাচাই হয়ে যায়, জনগণ আওয়ামী লীগের ছয়দফা সমর্থন করে কিনা। জনসাধারণ যে ছয়-দফা সমর্থন করে তা আগেও জানা ছিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির একটা বড়াে প্রয়ােজন ছিল। ছয়দফা যে জনগণের দাবি নয়, সেটা যে কেবলই আওয়ামী লীগের মুষ্টিমেয় নেতার দাবি—ওই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ফলে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর পক্ষে এই অজুহাত তােলার সুযােগ আর রইল না। দুই, এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ফলে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা দ্রুত সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব নেতা নির্বাচনের আগে শেখ সাহেবের বিরােধিতা করেছিলেন, তাঁরাই নির্বাচনের পর শেখ সাহেবকে সমর্থন জানালেন। তাদের মধ্যে ন্যাপনেতা মৌলানা ভাসানী, জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান, পি ডি পি নেতা নুরুল আমিনের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। নির্বাচনে মুজাফফর আহম্মদ পন্থী ন্যাপও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তারা একটি আসন পাননি। কিন্তু তাই বলে তাদের জনপ্রিয়তা নেই একথা মনে করা ভুল। (নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের কারণ আমি পরবর্তী কোনাে কিস্তিতে উল্লেখ করব।) খণ্ডিত ন্যাপের এই দলটি বেশ শক্তিশালী। তাদের সমর্থনের একটা মূল্য আছে। নির্বাচনের পর গণ রায় মেনে নিয়ে মুজাফফর আহম্মদের দলও আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানায়। নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি নতুন, পুরনাে সংবাদপত্র আওয়ামী লীগের মুখপত্রে পরিণত হয়ে যায়। তাছাড়া নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয়লাভ করায় জনসাধারণের একটা অংশ যারা আওয়ামী লীগের শক্তি সম্পর্কে সংশয়ের মধ্যে ছিল, তারাও নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে ভিড়ে পড়ল। এবং সকলে তখন ছয়দফা দাবিতে এককাট্টা হবার অনুপ্রেরণা পায়। এই নির্বাচনে এক-একটি ব্যক্তিগত মতকে একটি সংঘবদ্ধ জনমতে পরিণত করার সুযােগ দিল। যে জনমত পরিণত করার সুযােগ দিল। যে জনমত শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মানসিক শক্তিকে করেছে অনেক গুণে দৃঢ়তর। সেই সঙ্গে দৃঢ়তর করেছে এবং বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগের সংগঠনের শক্তি। সেই শক্তি পরবর্তী পর্যায়ে অসহযােগ আন্দোলন এবং তা থেকে সাধারণ মানুষকে সশস্ত্র আন্দোলনে উত্তরণে প্রভূত সাহায্য করেছে।
তিন, নির্বাচনে নজিরবিহীন সাফল্য লাভ করে বিশ্বেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শেখ মুজিব। এবং তিনি যে পূর্ব-বাঙলার অবিসংবাদী জননেতা—এই নিশ্চিত ধারণা সৃষ্টি করতে পেরেছেন দেশে বিদেশে, তারই ফলে আজকের বিশ্বের নানান দেশে বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের অনুকূল যে জনমত গড়ে উঠেছে, বা উঠছে তার মূলে আছে বিদেশী সাংবাদিকদের অনেক অবদান। নির্বাচনে জয়লাভের সূত্র ধরেই বিদেশী সাংবাদিকদের সংস্পর্শে আসার সুযােগ পান শেখ মুজিব এবং তার সহকর্মীরা। এবং স্বভাবতই শেখ মুজিবের চমৎকার ব্যবহার ও যুক্তির প্রভাব পড়েছে তাদের ওপর। কয়েকমাস ঢাকা থাকার ফলে শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, পূর্ব বাঙলার জনতা এবং নেতার সংস্পর্শে আসতে পেরেছেন। তাদের অভাব, অভিযােগ এবং সমস্যা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক তাদের ওপর যে শশাষণ এবং কুশাসন চলেছে তা প্রত্যক্ষ করার সুযােগ পেয়েছেন। ফলে তাদের রিপাের্টে ও পূর্ব বাঙলার দাবির অনুকূলেই মত প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, জনমত গড়ে উঠেছে, তবে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না কেন? স্বীকৃতি দিচ্ছে না, রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বার্থের প্রশ্নে। কিন্তু ওই জনমত গড়ে ওঠার ফলে আপাতত অন্তত এইটুকু লাভ হয়েছে, পৃথিবীর কয়েকটি বড়াে দেশ ইয়াহিয়া সরকারকে সব রকম সাহায্য এবং সহযােগিতা দেওয়া বন্ধ রেখেছেন। এটাও কম লাভ নয়।
চার, নির্বাচনে জয়লাভ করার ক্ষমতা লাভের একটা আইনগত ও ন্যায্য অধিকার জন্মেছে শেখ মুজিবের। সেই অধিকার পৃথিবীর সকল দেশ স্বীকারও করে নিয়েছে। এটা একটা মস্ত লাভ। ভবিষ্যতে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে যদি ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বসতেই হয় এক বা একাধিক বড়াে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তখন এই নির্বাচনে জয় লাভের প্রশ্নেই আলােচনার গতি আওয়ামী লীগের অনুকুলে যাবে।
পাঁচ, নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত গঠনের ফলেই ১ মার্চ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই সবদ্ধ জনতা নিজে থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে দাবি আদায়ের আন্দোলনে অকুতােভয়ে এগিয়ে গেছে বন্দুকের নলের সামনে।
অসহযােগ আন্দোলন শেখ মুজিবের পরিকল্পিত সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্যায়। কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক, ব্যবসায়ী কেরানী—প্রতিটি বাঙালি শেখ সাহেবের অসহযােগ করার ডাকে সাড়া দেন। ঠিক ছিল শেখ সাহেবের ৭ তারিখের ভাষণ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করা হবে। বেলা দুটো দশ মিনিট থেকে তিনটে কুড়ি মিনিট পর্যন্ত ঢাকার বেতারে চলল একটার পর একটা দেশাত্মবােধক গান আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দুম করে তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘােষণা করা হলাে। বেতারের কর্মচারীরা প্রতিবাদে কাজ করতে অস্বীকার করেন। ফলে সেদিন কেন্দ্রটি বন্ধ রইল। শেষে কর্মচারীদের দাবি মেনে নিয়ে শেখ মুজিবের ভাষণ হুবহু প্রচারের অনুমতি দেওয়ায় কর্মচারীরা পরদিন সকাল ছটায় কাজে যােগ দিলেন। এর আগেই রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ঢাকা বেতার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন শেখ মুজিবের বাড়িতে প্রচুর মিছিল এসে তার কাছে সংগ্রামের শপথ নিয়ে গেল। অসহযােগ আন্দোলনের ফলে স্কুলকলেজ, অফিস-আদালত, কলকারখানা বন্ধ হয়ে রইল। কিন্তু এ এক অভিনব অসহযােগ আন্দোলন। ট্রেন চলবে বাস চলবে, রিকশা চলবে, জাহাজ চলবে—এককথায় আভ্যন্তরীণ যােগাযােগ ব্যবস্থা ঠিকই থাকবে, পুলিস আগের মতােই শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে, রুজি-রােজগারের পথও খােলা থাকবে; শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যােগযােগ থাকবে না, পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাচার চলবে না, পশ্চিমা সৈন্যের যানবাহন চলবে না, তাদের জন্য খাদ্য পানীয় দেওয়া হবে না নেওয়া যাবে না।
পশ্চিমের সঙ্গে সামান্য যােগাযােগ রক্ষার জন্য শুধু মাত্র শেখ সাহেবের নির্দেশিত সময়ে ব্যাংক ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খােলা থাকল। শেখ সাহেব যেদিন রেসকোর্স ময়দানে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন, সেইদিন বিকেলেই টিক্কা খান ঢাকায় এলেন পূর্ব বাংলার গভর্নর হয়ে। কিন্তু অসহযােগ আন্দোলনের প্রভাব এতদূর পৌছেছিল যে, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী থেকে শুরু করে কোনাে বিচারপতিই টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে রাজী হলেন না। ফলে টিক্কা খান সামরিক প্রশাসকই হয়ে রইলেন, ২৫ মার্চ পর্যন্ত। সিভিল সার্ভিসের সদস্যরাও এই আন্দোলন সমর্থন করার প্রস্তাব নিল। অফিস, আদালত, ঘরবাড়ি, গাড়ির বনেট রিকশায় সর্বত্র উড়তে থাকল কালাে পতাকা।
১৫ মার্চ সকাল পৌনে নয়টার খবরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষক আবদুস সাত্তার ঘােষণা করলেন শেখ মুজিবের ৩৫টি নির্দেশ। ওই নির্দেশনামায় বলা হয়েছিল: শেখ মুজিবুর রহমানের দল প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। তাই বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থে তিনি বাঙলাদেশের শাসনভার হাতে তুলে নিলেন। তাঁর নির্দেশনামায় বলা হয়েছিল, ডেপুটি জেলা কমিশনায় এবং মহকুমার অফিসাররা তাদের অফিস না খুলে যতটুকু কাজ করা সম্ভব, তা যেন করেন। পুলিস শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন। প্রয়ােজনবােধে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনীর সাহায্য তারা নেবেন। বন্দর-কর্তৃপক্ষ জাহাজ চালু রাখবেন। তবে যেসব জাহাজ বাঙলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য সৈন্য এবং সমর সরঞ্জাম বয়ে আনবে তাদের সঙ্গে যেন কোনােরকম সহযােগিতা না করেন। বাঙলাদেশের ভিতরে ডাক চলবে। বিদেশে টেলিগ্রাম ও মানি অর্ডার পাঠানাে চলবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু পাঠানাে চলবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাঙ্কগুলি বার্তা বিনিময়ের জন্য সােম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি-এই চারদিন বেলা, আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত টেলিপ্রিন্টারে সংযােগ স্থাপন করতে পারবেন। রেডিও সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনকে গণ-আন্দোলন সম্পর্কীয় সমস্ত সংবাদ পুরাে ছাপতে বলা হয়েছে। যেসব সংবাদপত্রের মালিক পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্তশাসনের বিরােধী, সেখানকার কর্মচারীদের তাদের মালিকের সঙ্গে সহযােগিতা করতে নিষেধ করা হয়েছে। খাদ্য আনা-নেওয়া চলবে। সংশ্লিষ্ট অফিসাররা প্রাদেশিক ও স্থানীয় কর আদায় করে ইস্টার্ন মার্কেনটাইল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন–এই দুইটি ব্যাংকে বাংলাদেশের তহবিলে, জমা দেবেন। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আয়কর সংগ্রহ করা চলবে না। ব্যাংকগুলি প্রত্যহ তিন ঘন্টার জন্য খােলা থাকবে। লবণ কর আদায় করা চলবে না। বেসরকারী বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে যথারীতি খােলা রাখতে বলা হয়েছে। তবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। শ্রমিকরা কাজে যােগ দেবেন না। কিন্তু ৩০ তারিখে গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।
এই নির্দেশকে ৭ মার্চের নির্দেশেরই ব্যাখ্যা এবং সংযােজন বলা চলে।
প্রকৃতপক্ষে শেখ সাহেবের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়ি হয়ে গেল বাঙলাদেশ প্রশাসনের কেন্দ্র। শেখ মুজিব হলেন সেই প্রশাসনের প্রধান নিয়ন্তা। থানা, কোর্ট, আদালত, সেক্রেটারিয়েট, টেলিফোন, এক্সচেঞ্জ, জেলা, শাসক, পুলিসের বড়াে কর্তা, সেক্রেটারিয়েটর কর্মচারীবৃন্দ শ্রমিক, সকলেই তাঁর নির্দেশ মতাে কাজ করে যেতে থাকলেন। শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী বাঙলাদেশ সরকারের একাউন্টে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং করপােরেশনের বিভিন্ন শাখার আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, প্রমােদর, বিক্রয়-কর, আবগরি শুল্ক ইত্যাদি জমা পড়তে থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় কয়েকটি বিখ্যাত সিগারেট, প্রস্তুতকারক কোম্পানী, তৈল কোম্পানী, চিনি-কল, কাপড়ের মিল, আমদানি-রপ্তানী প্রতিষ্ঠান এবং সিনেমা হল কর দেয়। এর মধ্যে একটি সিগারেট কোম্পানীই ১১ লক্ষ টাকা শুল্ক জমা দেয়। এই অসহযােগ আন্দোলনের সাড়া সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে কী ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তখনকার পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে। রাতারাতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ভাষাও পরিবর্তিত হয়ে গেল।
ইস্টার্ন মার্কেনটাইল ব্যাঙ্ক তাদের ১ মার্চের বিজ্ঞাপনে ধনধান্যেপুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা দ্বিজেন্দ্রলালের এই গানটি এবং ২২ মার্চের বিজ্ঞাপনে সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি পুরাে তুলে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ২২ মার্চ লাঠিধারী জনতার ছবি দিয়ে নিচে লেখে : গােলাভরা ধান পুকুরভরা মাছ আজ কল্পকথা মাত্র। দারিদ্র্য ও ক্ষুধার গ্লানি ও কালিমার বাংলা আজ বিবর্ণ মালিন্য দূর করার জন্য, শূন্য মাঠ সােনালী ফসলে ভরে দেবার জন্য, শুষ্ক মুখে হাসি ফোটাবার জন্য প্রতিটি বাঙালি আজ ব্রতী, অঙ্গীকারবদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তান পরিবার-পরিকল্পনা বাের্ডের বিজ্ঞাপন: আসিতেছে শুভদিন। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, সুধিতে, হইবে ঋণ’ নজরুলের কবিতাটি। গ্রামােফোন কোম্পানীর বিজ্ঞাপন: গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধৃত তবু মাথা হাতে হাতে ফেরে দেনাপাওনার খাতা/ শােননা হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের। জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন: সােনার বাংলা। সবুজ ক্ষেত। কিষাণের হাসি।—সব যেন হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। কিন্তু আজ বাংলাদেশের জনতার জাগরণ দেখলে মনে হয় আমরা ফিরে পেয়েছি আমাদের অস্তিত্ব আমাদের সত্তা। ইউনিয়ন ব্যাংক : বাংলাদেশ আজ এক নতুন চেতনায় উদ্বেলিত। এ চেতনা নিজেকে নতুন করে জানার চেতনা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা। এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক বাঙলার মাটি, বাঙলার জল বাঙলার বায়ু, বাঙলার ফল, পূণ্য হউক পূণ্য হউক…’ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে। এই সব বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে সরকারী বেসরকারী আধা-সরকারী সকল প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলাে যেমন রুচিসম্মত, তেমনি দেশাত্মবােধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ।
এমন সার্থক অসহযােগ আন্দোলন আর কখনও কোথায়ও দেখা গিয়েছে বলে জানা নেই। এই অসহযােগ আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সরকারী প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাও যােগ দিয়েছিলেন এতে এবং শেখ মুজিবের নির্দেশে কাজ করে গেছেন তারা। আর তারা এটা করেছেন সামরিক শাসন চলাকালে, এবং টিক্কাখান-ইয়াহিয়া খানের উপস্থিতিতেই।
শেখ মুজিব তখনাে কিন্তু চাইছিলেন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। সকলের মুখে যখন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা, তখনও শেখ মুজিব নিজে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা ঘােষণা করেননি। তার অর্থ এই যে, তিনি দুই অঞ্চলের বন্ধন রক্ষার শেষ পথটি তখনও ভােলা রেখেছিলেন। তিনি তখনও সকল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য, এবং পশ্চিমের সঙ্গে বন্ধনের শেষ সূত্রটি আঁকড়ে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে ১৬ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনা চালিয়ে যান।
১৭ মার্চ শেখ মুজিবের দাবি অনুযায়ী ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় কী পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনী তলব করা হয়েছিল সে সম্পর্কে ৪ সদস্যের এক তদন্ত কমিশন গঠন করা হল, কমিটির সকল সদস্যই সামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষ নিয়ােগ করবেন বলা হল। এবং জানানাে হলাে, কমিশনের রিপোের্ট দাখিল করতে হবে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসন-কর্তার কাছে। শেখ মুজিব এই লোেক-দেখানাে তদন্ত-কমিশন গঠনের প্রতিবাদ করে বললেন, এ হেন তদন্ত কমিশন আমরা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্যে তদন্ত কমিশন। এই কমিশনের বিবেচ্যসূচিই মূল ইস্যুর পটভূমি বিচার এবং আসল ইস্যুর তদন্ত না করার মতলব ফাঁস করে দিয়েছে। কমিশনের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কোন্ পরিস্থিতিতে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী তলব করেছিল তা নির্ধারণ করা।
কাজেই পূর্ব বাংলার মানুষ এই তদন্ত কমিশন মেনে নিল না।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করেছিলেন, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ১৯ তারিখ শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলােচনা চলাকালেই জয়দেবপুরে সৈন্যরা জনতার ওপর গুলি চালায়। যাতে অন্তত ২০ জনের মতাে লােক নিহত হয়। এই কি সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার নমুনা!
তার পরের দিনও শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনা করতে গিয়েছিলেন। সেই দিনের আলােচনাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর শেষ আলােচনা।
অতিরিক্ত-সংবাদ
শ্রীবসুধা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ডক্টর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তী দেবী এবং তাঁদের কন্যা বেঁচে আছেন। ঢাকা থেকে সদ্য আগত কয়েকজন ছাত্রের কাছেও খোজ নিয়েছিলাম, তারাও তাই জানালেন। শ্রীগুহঠাকুরতার কলকাতার আত্মীয়-স্বজনের কাছেও সেই রকমই খবর এসেছে। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
নারায়ণগঞ্জে সৈন্যরা ২৬মার্চ সাড়ে দশটা নাগাদ আক্রমণ করে। জনসাধারণ পঞ্চবটীর কাছে রাইফেল ছুঁড়ে বাধা দেয়। সৈন্যরা শহরে ঢুকতে পারে ২৭ তারিখ একটা নাগাদ। ততক্ষণে নারায়ণগঞ্জের প্রায় সব অধিবাসীই শহর ছেড়ে দূর-গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়েছিল। সৈন্যরা রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘরে নির্বিচার গুলিগােলা চালিয়েছে। মাসডাইল (ঈদগাহ মাঠের পিছনে) দেওভােগ এবং বাবুরাইলে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে অসংখ্য। তাতে শ’দেড়েক লােক নিহত হয়েছে। বাড়ি পাহারা দেবার জন্য যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন প্রধানত তারাই নিহত হয়েছেন। খানপুর এম সারকিস কোয়াটার জ্বালিয়ে দিয়েছে সৈন্যরা। কেউ সেখানে নিহত হননি। লক্ষ্মীনারায়ণ-চিত্তরঞ্জন-ঢাকেশ্বরী মিল এলাকায় এবং বন্দরে একশ-দেড়শ লােক অবাঙালিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরে স্মিথ রােডের বাসিন্দা শ্রীসন্তোষ রায়চৌধুরী এবং নােটন রায়চৌধুরীকে বাড়ি গিয়ে সৈন্যরা হত্যা করেছে। শ্রীসন্তোষ রায়চৌধুরী জয়গােবিন্দ হাইস্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন। মেট্রো সিনেমার সংলগ্ন একটা বাড়িতে দুজনকে (হিন্দু) হত্যা করেছে পাক-সৈন্য। এ ছাড়া আর কেউ, সাধারণ পরিচিত কেউ, নিহত হয়েছেন বলে শােনা যায়নি। চাষাড়া, আমলাপাড়া, নগর খানপুর, নিতাইগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা টানবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কালিবাজারের কালিমূর্তি নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। এ ছাড়া অনেক জায়গায় লুঠতরাজ হয়েছে।
নরসিংদি বাজারে (চাউল পট্টিতে) সৈন্যরা ; বােমা বর্ষণ করেছে। একটি বােমা পড়েছে কলেজের সংলগ্ন পুকুরে এবং একটা ফায়ার বিগ্রেডের কাছে। কয়েকজন লােক নিহত হয়েছে বাজারে।

সূত্র: দেশ : ৫ জুন ১৯৭১

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সত্তর মিনিট আলােচনা শেষে বাইশ তারিখে শেখ মুজিব বললেন, আলােচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। ২৩ মার্চের ইত্তেফাকে’ সংকট নিরসনের পথে?’—এই শিরােনামায় স্টাফ রিপােটার বললেন, ‘তেসরা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘােষণা এবং তৎপরবর্তী ঘটনাবলীর অপরিহার্য পরিণতি হিসাবে যে চরম রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হইয়াছে, বাংলার জনগণের পক্ষ হইতে শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত চার-দফা দাবি পূরণের মধ্য দিয়া উহা অবসানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। অর্থাৎ এই সাংবাদিক শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীদের হাবভাব দেখে, তাদের সঙ্গে আলাপ করে এমন কিছু আভাস পেয়েছেন যা থেকে তার এই ধারণা হয়েছে। পত্রিকার সাব এডিটরের কিন্তু এ সম্পর্কে খানিক খটকা ছিল। এই শিরােনামার শেষে তিনি একটা প্রশ্ন বােধক চিহ্ন জুড়ে দিয়েছেন। যাই হােক ইত্তেফাক’ আওয়ামী লীগের মুখপত্র বলে খবরটার ওপর পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ গুরুত্ব দিয়েছিল এবং তাদের দাবি পূরণ সম্পর্কে আশান্বিতও হয়ে উঠেছিল তেইশ চব্বিশ তারিখে শেখ সাহেবের সহকর্মীরা প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ করায় জনসাধারণের মনে সাফল্যের আশা আরও উজ্জীবিত হয়েছে। সােজা কথায় জনসাধারণ ধোকায় পড়েছে।
তাহলে কি এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও থােকায় পড়েছিলেন এবং ২৫ তারিখের ব্যাপক আক্রমণের কথা তারা আগে থেকে আঁচ করতে পারেন নি। এই সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে আরও কয়েকটি কারণ ঘটেছে। সম্প্রতি শেখ সাহেবের প্রেস সেক্রেটারি আমাকে বলেছেন ২৭ তারিখে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। তিনি রাত ন’টা পর্যন্ত সেই খবর সাংবাদিকদের দিয়ে গেছেন। দুই, ছাত্রলীগ জঙ্গীবাহিনীর একজন প্রভাবশালী সদ্য আমাকে বলেছেন, অন্য দিন তাঁর কাছে স্টেনগান থাকে। সেদিনই ছিল না। সৈন্যদের ব্যাপক আক্রমণ আশংকা তারা করেননি।
তিন, আওয়ামী লীগ থেকে এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়নি। শুধু ২৫ তারিখ সন্ধ্যের পর কিছু কর্মীকে শেখ সাহেব সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এবং তারই ফলে সেই রাত্রে কিছু ব্যারিকেড রচিত হয়েছিল ঢাকা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে এবং চট্টগ্রামে। অবশ্য, চট্টগ্রামে বন্দরের পথে আগেই ব্যারিকেড পড়েছিল। জাহাজ থেকে সৈন্য নামতে দিচ্ছিল না সেখানকার ছাত্র এবং শ্রমিকরা।
কিন্তু পঁচিশ তারিখের আক্রমণের পরিকল্পনা নিশ্চয়ই পঁচিশ তারিখেই হয় নি। বিভিন্ন স্থানের ই.পি আর, পুলিস ব্যারাক আক্রমণ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিরস্ত্র এবং বন্দী করে রাখার চেষ্টা, তালিকা মিলিয়ে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা, বেছে বেছে আওয়ামী লীগের দুটি শক্তিশালী মুখপত্র পিপল এবং ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, আগের দিন চট্টগ্রাম থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় আনিয়ে গ্রেপ্তার করে রাখার ঘটনাই প্রমাণ করে এই আক্রমণের পরিকল্পনা হয়েছে কয়েক দিন আগেই। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ঢাকা আসার পথেই ইয়াহিয়া এই আক্রমণের সমস্ত আয়ােজন সেরে এসেছেন। আলােচনা ফলপ্রসু না হলে,অর্থাৎ তার চাপের কাছে নতি স্বীকার না করলে যাতে করে ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণে উল্লেখিত পর্যাপ্ত শক্তির প্রয়ােগে পূর্ব বাঙলার গণ-বিক্ষোভ ঠাণ্ডা করে দিতে পারেন তারই আয়ােজন সেরে আসেন তিনি পিন্ডি থেকে ঢাকা আসার পথে, করাচিতে নেমে । ইয়াহিয়া আরও জানতেন, ই.পি.আর পুলিস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বিদ্রোহ করতে পারে। তাই তিনি পাঞ্জাবী এবং পাঠান ‘ক্ল্যাক্লটুপ’ নিয়ে গিয়েছেন ঢাকায়। করাচিতে তার গতিবিধি সম্পূর্ণ গােপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু টিক্কা খান, হামিদ আলী, পীরজাদা পরিকল্পনাটির চুড়াত রূপ দেন, ২১ তারিখ রা এবং ২২ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনা শেষে প্রথমে মুজিব এবং তার এক ঘন্টা বাদে ভুট্টো চলে যাওয়ার পরই ইয়াহিয়া খান, জেনারেলদের সঙ্গে আলােচনা করে ওই পরিকল্পনায় তার অনুমােদন দেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের কথা ঘােষণা করেন। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খানের এই সামরিক অভিযান পরিকল্পনার যে-রূপরেখা পাওয়া যায়, তা এই :
এক, হঠাৎ করে পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে এক দু’দিনের মধ্যে গণআন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে
হবে।
দুই. যেখান থেকেই সামান্য বাধা আসবে, সে জায়গা নির্মূল করে দিতে হবে।
তিন, রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে হবে যাতে করে শেখ মুজিবের লােক গেরিলা কায়দায় অতর্কিতে ওইসব বাড়িঘর বা তার আশপাশ থেকে পাক-সেনাদের উপর আক্রমণ চালাতে না পারে।
চার, এবারের নির্বাচনে শেখ মুজিবের সমর্থনের একটা বড় অংশ ছিল, হিন্দু সম্প্রদায়। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ববাঙলার হিন্দুর সংখ্যা ছিল নব্বই লক্ষের মতাে। এবারকার নির্বাচনে শেখমুজিবের এই বিস্ময়কর জয়ের পিছনে তাদের দান অনেকখানি। তাদের হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে আতঙ্কিত করতে হবে যাতে করে তারা ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। ফলে লাভ হবে দুটো, মুজিবের সমর্থক সংখ্যা উল্লেখযোেগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং সেই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাঙলাকে সংখ্যালঘিষ্ঠতার পথে কয়েক পা ঠেলে দেওয়া হবে।
পাচ, পূর্ববাংলার গণ-আন্দোলনের পিছনে যারা মাথা, সেই সব বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে কয়েকজনকে হত্যা করতে হবে। তাহলে পূর্ববাঙলায় অদূর ভবিষ্যতে আর কোনাে গণ-আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
ছয়, বালুচ এবং পাঠান সৈন্যরা নিরীহ মুসলমান নাগরিকদের ওপর নির্বিচার গুলি বর্ষণে রাজী নাও হতে পারে। তাদের অপারেশনে নেওয়ার আগে বােঝাতে হবে, ভারতীয় হিন্দু কমান্ডাে সৈন্য ঢাকা, কুমিল্লা চট্টগ্রাম, ছেয়ে ফেলেছে। এই অভিযান সেইসব হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। হিন্দু অনুপ্রবেশকারীরা শহরের হিন্দু-মহল্লা এবং জগন্নাথ হলে (হিন্দু ছাত্রাবাস) আত্মগােপন করে রয়েছে।
সাত, ই. পি আর, পুলিস এবং বাঙালি রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করতে পারে তাদের প্রথমেই হয় হত্যা, না। হয় আটক এবং নিরস্ত্র করতে হবে।
আট, প্রদেশের স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টগুলাে দখল করতে হবে অনতিবিলম্বে ।
নয়, পাকিস্তানের বাইরে যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে, তার জন্য সাংবাদিকদের আটক করে পাকিস্তানের বাইরে দিয়ে আসতে হবে। খবর পাচারের সব রকম রাস্তা বন্ধ করতে হবে।
লড়াই শুরু হওয়ার চার-পাঁচ দিন বাদে এই সবের সঙ্গে আরও দুটি বিষয় যােগ হলাে।
প্রথম উদ্দেশ্য, মুসলমানদের রেহাই দিয়ে, মুসলমানদেরই সামনে হিন্দুদের হত্যা করলে হিন্দুমুসলমানদের বিভেদ সৃষ্টি হবে। একদল মুসলমান তখন ভয়ে এবং বিভ্রান্তিতে নিজেদের মনে যুক্তি খাড়া করবে, হিন্দুরা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে করতে চায়, তাই সৈন্যরা তাদের হত্যা করছে, আমাদের কিছু বলবে না। আর হিন্দুরা রেগে যাবে এই ভেবে,তােমাদের জন্য অত করলাম, ভােট দিলাম আর তােমরাই কি না আমাদের পিছনে লাগছ। তার ফলে এরা ভারতে গিয়ে পূর্ব-বাংলার বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ভারতকে এই সংঘর্ষে নিষ্ক্রিয় করে রাখার ব্যাপারে প্রভাব খাটাবে। শুধু সৈন্যদের দিয়েই হত্যা করানাে নয়, বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলমানদের দিয়েও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালানাে হয়েছে। একটা কথা প্রায়ই শােনা যাচ্ছে, মুসলিম লীগের লােকেরা মুক্তিফৌজদের ধরিয়ে দিচ্ছে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করছে। মুসলিম লীগের সকলেই বিশ্বাস ঘাতক, সাম্প্রদায়িক, সকলেই খুনে, এবং হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে—এ আমি মনে করি না। আমি এমন অনেক মুসলিম লীগ নেতা এবং কর্মীর কথা জানি—যারা ৬৪-র দাঙ্গার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের অনেক হিন্দু-মহল্লা পাহারা দিয়েছে, দাঙ্গাবাজদের হাত থকে রক্ষা করেছে অনেক হিন্দুকে। আসলে বিষয়টা নির্ভর করে ব্যক্তি এবং পরিবারের শিক্ষা-সংস্কৃতির ওপর। সুযােগ-সন্ধানী এবং নিচুমনা লােকেরা সর্বদাই এইসব ব্যাপারে এগিয়ে যায়। ইয়াহিয়ার এই পরিকল্পনার প্রধান হাতিয়ার হয়েছে তারাই। অবশ্য তাদের সকলেই ইয়াহিয়ার পরিকল্পনার হাতিয়ার নয় কেউ-কেউ আবার ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং লাভের জন্যও বিচ্ছিন্নভাবে নানা দুষ্কার্য করে চলেছে। এদের মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগ, জামাতে ইসলামী মার্কা দেওয়া ভুল। হতে পারে মুসলিম লীগ কিংবা জামাতে ইসলামীর একটা অংশ (ছােট বা বড়ড়া) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সমর্থক নয়। আবার এও হতে পারে, তাদেরই একটা অংশ এই মুক্তি সংগ্রামের সমর্থক। কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলেমা ততা শেখ মুজিবকে সমর্থনও করেছিল। বর্তমানে সমর্থনের পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী এবং বিভ্রান্ত লােক বাদে অধিকাংশ লােকই (মত পথ এবং আদর্শের প্রশ্নে ভিন্ন মত পােষণ করা সত্ত্বেও) এই মুক্তি-সংগ্রামের সমর্থক। তাদের অনেকেই হয়তাে এখন ভয়ে বাড়িতে পাকিস্তানী পতাকা তুলছে, ইয়াহিয়ার সমর্থকদের ভান করছে।
যাক যা বলছিলাম। ইয়াহিয়ার এই পরিকল্পনা আশানুরূপ সফল হয়নি। দুই বাংলার মানুষেরই ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য বুঝতে দেরী হয় নি। তবে ইয়াহিয়ার হিন্দু তাড়ানাের এবং পূর্ববঙ্গকে সংখ্যালঘু বানাবার উদ্দেশ্য অনেকটা সফল হয়েছে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হলাে অবাঙালিদের দিয়ে স্থানে স্থানে দাঙ্গা বাধিয়ে আসল ঘটনা চাপা দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাক-ফৌজ ২৫ মার্চ রাত ১১টার পর ঢাকায় সামরিক অভিযান চালায়।
এখানে একটা কথা উঠতে পারে, ছ-ছয়টা বৈঠকে সব সুদ্ধ নয় ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে আলােচনা করেও কি শেখ মুজিব বুঝলেন না যে, ইয়াহিয়া ব্যাপক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন! শেখ মুজিবের সঙ্গে ছয়-ছয়দিন আলােচনা করার সময়েও কি কোনাে অসতর্ক মুহূর্তে ইয়াহিয়ার চোখ, ভাবভঙ্গি, শব্দ-প্রয়ােগ, বাচনভঙ্গি এবং পরিবেশ তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সামান্যতম আভাস দেয় নি? যদি তাই ধরে নিই তাহলে বলতে হয় শেখ সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব আছে (?)।
এ ছাড়া চোখে পড়ার মতাে এমন কতক ঘটনা ঘটেছে যা থেকেই ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য আঁচ করা কঠিন ছিল না।
প্রথম বিষয় লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলায় গভর্নর করে পাঠানাে। পূর্ব বাংলার সামরিক প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান নির্বিচার গুলি চালিয়েও অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারেননি, বিক্ষোভ দমাতে পারেননি। এই ব্যর্থতা দূর করা, শেখ সাহেবের ডাকে অচল প্রশাসনকে সচল করার জন্যই কি পাক-সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নৃশংস এবং শক্ত মানুষ বলে পরিচিত টিক্কা খানকে আনা হয়নি পূর্ব বাংলায়? পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়ােগের ক্ষমতা ছাড়া টিক্কা খানের আর কোন গুণ আছে যা দিয়ে টিক্কা খান গণবিক্ষোভ দমাতে পারেন। পূর্ব বাংলার মানুষকে কঠোর হাতে দমন করার জন্যই যে টিক্কা খানের আগমন-এ ব্যাপারে সন্দেহ করার মতাে কারণ ঘটেনি?
দ্বিতীয়ত ইঙ্গিত নিহিত, পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গার পাক-সেনাবাহিনীর অফিসারদের পরিবার এবং বিদেশী নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ঘটনায়। ৯মার্চ থেকে তাদের ঢাকা-ত্যাগ শুরু হয়। ১৩ মার্চ ২৬৫ জন বিদেশী নাগরিক বিমানে ঢাকা থেকে ব্যাংকক গিয়ে পৌছান। তাদের ৬০ জুন ছিলেন জার্মান, ৪৫ জন জাতিসংঘের কর্মচারী এবং ইতালী, মার্কিন এবং ব্রিটিশ, কানাডা ও ফ্রান্সের নাগরিক ছিলেন ৪০ জন। এর আগে জার্মান দূতাবাসের ১৫০ জন নাগরিক ঢাকা ছেড়ে যান। মনে হতে পারে, ঢাকায় ১ মার্চের থেকে যে গােলযােগ শুরু হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঢাকা ছেড়েছিলেন। তাই কি? তারা যখন ঢাকা ছাড়েন তখন ঢাকার অবস্থা শান্ত ছিল। অসহযােগ আন্দোলন চলছিল বটে, কিন্তু বিশৃঙ্খলা ছিল না। বিদেশীদের তাে ধর পাকড়েরও ভয় ছিল না। তবু কেন তারা ঢাকা ছাড়লেন? নিশ্চয়ই তারা বড় রকমের কোনাে গােলযােগের আশঙ্কা করছিলেন কিংবা তাদের দেশের গুপ্তচর মারফৎ তার আভাস পেয়েছিলেন। তৃতীয় উল্লেখযােগ্য ঘটনা, করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র এবং সৈন্য বােঝাই জাহাজের আগমন। ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছেই খবর আসে, অস্ত্র এবং সৈন্য বােঝাই বিমান এবং জাহাজ রওনা দিয়েছে পূর্ব বাংলার দিকে। ১০ মার্চ শেখ মুজিব বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর লােকজন ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হচ্ছে।
কাজেই শেখ সাহেব এবং তার সহকর্মীরা যে ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছুই আঁচ করতে পারেননি তা মেনে নেওয়া যায় না।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে শেখ সাহেব বলেন, যদি আঘাত আসে, যদি আমি নির্দেশ নাও দিতে পারি, যদি আমার কর্মীদের পক্ষেও পথ-নির্দেশ দেওয়া সম্ভব না হয়, বাংলার মানুষ, তােমরা নিজেরাই নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিও। হাতের কাছে যা পাও তাই দিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করাে। রাস্তাঘাট বন্ধকরে দিও, ঢাকা বন্ধ করে দিও। বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে মুক্তি-সৈনিক হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িও।’
১৯ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলােচনা সেরে তিনি বললেন, বাংলার মানুষ তােমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ করে তোেল, প্রতিহত করাে, পাল্টা আঘাত হাননা। সাত কোটি শােষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌছবই।
আরও বললেন, দাবি আদায় করতেই হবে, শান্তিপূর্ণভাবে হয় ভালাে—নয় সংগ্রামের পথ ধরেই আমরা লক্ষ্যে গিয়ে পৌছব।’
২২ মার্চ বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা বের করে। তাতে শেখ মুজিবের স্বাক্ষরকরা একটি বাণী ছিল। বাণীটি সই করেছেন ১৯ মার্চ। তাতে তিনি বলেছেন : লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরােধের দুর্গ।
২৩ মার্চ প্রতিরােধ-দিবসে এক ভাষণে বলেন, সংগ্রাম আমাদের চলতেই থাকবে। এই সংগ্রামের পন্থা কী হবে তা আমিই ঠিক করে দেব, সে ভার আমার ওপরই ছেড়ে দিন। বাংলার মানুষ কারু করুণার পাত্র নয়, আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা মুক্তি ছিনিয়ে আনবে। জয় বাংলা-বাংলার জয় অনিবার্য।’-এই উক্তিগুলিই কি প্রমাণ করে না যে, ইয়াহিয়া-টিক্কা খান-ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন।
২৫ তারিখ সন্ধের পর আওয়ামী লীগ বা ছাত্র লীগের যে-ই শেখ সাহেবের বাড়ি গেছেন, তাকেই তিনি পাক-সৈন্যের হামলা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে এবং প্রস্তুত হতে বলেছেন। কথা উঠতে পারে, শেখ সাহেব যদি আগেই আঁচ পেলেন সব কিছুর তাহলে সেই হামলা প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন না কেন এবং কেন-ই বা তিনি কেবল অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে গেলেন?
প্রথম কারণ, শেখ মুজিব জানতেনই ইয়াহিয়ার হামলার রূপটা কী হবে। শেখ সাহেব ভেবেছিলেন, বড়াে জোর আটক এবং শয়ে শয়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের ধরে নিয়ে যাবে, হাজতে নিয়ে পুরবে। কিছু গুলিও ছুঁড়তে পারে। আগেও দু’দুবার সামরিক শাসন হয়েছে পাকিস্তানে, নতুন কিছু নয়। নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া ট্যাংক, মর্টার, রকেট, এবং বােমা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে, এটা শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কল্পনায়ও ছিল না। তাই পাকসৈন্যের হামলার মুখে প্রথম দফায় সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ কৃষকশ্রমিক এবং কিছু ছাত্র তাদের অন্তরের জ্বালায়, ক্ষোভে দা, কাঁচি, কুড়ােল, বর্শা নিয়ে হাজারে হাজারে, এগিয়ে গেছে চীন মার্কিন রুশ ব্রিটেন ফ্রান্সের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হাজার হাজার সুশিক্ষিত সৈন্যের বিরুদ্ধে। ফলে মেরেছে কম, মারছে বেশি, খুব বেশি।
এত ব্যাপক লােক ক্ষয় হতাে না, যদি শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার আক্রমণের স্বরূপটা জানতে পারতেন। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লােকের জীবনের ঝুঁকির প্রশ্ন যেখানে সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এই খবরটা জানা উচিত ছিল। উচিত ছিল সেনাব্যারাকে তাদের নিজস্ব ইনটেলিজেনস’ খােলা।
তাছাড়া শেখ মুজিব ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার যে-আহ্বান জানিয়েছিলেন, আহ্বান জানিয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে থানায় থানায় সংগ্রাম-পরিষদ গড়ে তােলার, সে-ব্যাপারে কাজ এগিয়েছে সামান্যই। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তখন শুধু জনমত গঠন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। (অথবা জনতার অভূতপূর্ব সমর্থন নিয়ে আত্মতুষ্ট ছিলেন) শক্তিশালী সংগঠনের দিকে নজর দেননি তেমন। জানি, সবচেয়ে বড়াে শক্তি জনতা। কিন্তু সেই শক্তিকে সুষ্ঠুভাবে, সার্থকভাবে পরিচালনা করার জন্য শক্তিশালী সংগঠন এবং দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়ােজন। ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য চরম হামলার মুখে দৃঢ় প্রতিরােধ গড়ে তােলা, যােগাযােগ ও সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখা এবং পাল্টা আক্রমণ চালাবার জন্য আগে থেকেই সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে গ্রামে গ্রামে থানায় থানায় মহকুমায় মহকুমায় শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তােলা দরকার ছিল। যদি তা থাকত, তাহলে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের হামলার মুখে প্রথমটায় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র লীগের কর্মীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত না। সেই তুলনায় মহম্মদ তােয়াহার সংগঠনের বয়স অল্প এবং আকার ছােটো হলেও তার দলের সদস্যরা অনেক বেশি সুসংগঠিত এবং দৃঢ়। প্রথম হামলার মুখে তার দল বিপর্যস্ত বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। যতটুকু খবর পেয়েছি, তাঁর দল চট্টগ্রাম, খুলনা এবং যশােরে দক্ষ গেরিলা সৈনিকের মতাে পাক-বাহিনীর দৃঢ় মুকাবিলা করেছে। ভাসানী এবং মুজাফফর আহমদ পন্থী ন্যাপের কর্মীরাও অনেক জায়গায় খানিক লড়াই করেছে।
অবশ্য এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, আওয়ামী লীগ বা ছাত্র লীগের কর্মীরা একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিলেন। এমপি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ছাত্র লীগের এক জঙ্গবাহিনী গড়ে উঠেছিল। শােনা যায় তার সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ। তার মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার ছেলে সাধারণ গােছের রাইফেল চালানাে শিখে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে কিছু ছেলে আছে যাদের আধুনিক সমরাস্ত্রে প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ আছে। পরে তারা খুবই কাজে আসে। উত্তেজনার মুখে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রস্তুতি এবং শিক্ষা ছাড়াই রাইফেল হাতে ছেলেরা লড়াইয়ে যায়। তারা শুধু গুলি ভরা এবং ট্রিগার টেপা ছাড়া কিছু শেখবার সুযােগ পায়নি। ফলে তাদের গুলির অপচয় হয়েছে প্রচুর। এবং লড়াইটাও হয়েছে অনেকাংশে অকাজের।
পুরাে অকাজের বলছি না এই জন্য যে বহু জায়গায় আনাড়ি হলেও এই প্রাথমিক প্রতিরােধের ফলে লােকালয়ে ঢুকতে সেনাবাহিনীর সময় লেগেছে। ইত্যবসরে সাধারণ মানুষ নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পেরেছে। তাছাড়া আর একটি লাভ হয়েছে এই যে, যারা প্রাথমিক যুদ্ধে যােগ দিয়েছিল, প্রধানত তাদের অভিজ্ঞতা মনােবল এবং দৃঢ়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। তারাই আজ প্রধানত পরবর্তী পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে তারাই। তাদের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, আওয়ামী কর্মী, ন্যাপকর্মী, ব্যবসায়ী, চাকুরে শিল্পী—কম বেশি সমাজের সব স্তরের লােকই রয়েছে। প্রথম দফায় যে-সব চাষী মজদুর এবং সাধারণ মানুষে অসম লড়াইয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের আত্মত্যাগও বৃথা যায়নি। কেননা তাদের আত্মত্যাগই বাংলাদেশ গঠনের এবং আজকের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা। তাদের আত্মতিই কোনাে কোনাে নেতার পিছু ফেরার প্রবণতা রুদ্ধ করে দিয়েছে।
তবে প্রায় সর্বত্রই পাক-সৈন্যের প্রথম লক্ষ্য ছিল ই. পি. আর, পুলিশ, বাঙালি সৈন্য (বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের নিরস্ত্র এবং গ্রেপ্তার করা। এবং তা করতে গিয়েই লড়াইটা বেধেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আর আজকের এই মুক্তিযুদ্ধে প্রধানত লড়ছেন তারাই। তাদের সহযােগিতায় আছেন পদস্থ অনেক তরুণ সি এস পি এবং ই সি সি এস বাঙালি অফিসার এবং দলমত ধর্ম নির্বিশেষে জনতার একটা অংশ। পুলিশ, ই, পি আর এবং বাঙালি অফিসাররা এত দিন গণআন্দোলন দমানাের কাজে নিয়ােজিত ছিল, আজ তারাই প্রাণপণে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইয়াহিয়া সরকারের প্রশাসন অচল করে রেখেছেন। কী এমন ঘটল যা তাদের মনে এনে দিয়েছে এই আশ্চর্য পরিবর্তন? তারা বুঝতে শিখেছেন, ধর্মে তারা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যা-ই হােন কেন, জাতে তারা বাঙালি। পশ্চিমা শাসক এবং বেনের দল পূর্ব বাংলার ওপর দীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ শােষণ এবং কু-শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই তঁারা আজ মুক্তি পাগল। অবশ্য আমি এ কথা বলতে চাই না যে পূর্ববঙ্গ এখনই সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেছে। বরং বলা উচিত হতে চলেছে। এবং ইতিমধ্যে অনেকটা হয়েও গেছে। প্রধানত শিক্ষিত-সংস্কৃত ও রাজনীতির ঘাের-প্যাচে নেই এমন সােজা-সরল গায়ের মানুষদের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ। যেহেতু গোঁড়ামি-মুক্তির সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রশ্নটা জড়িত, তাই সম্পূর্ণ ধর্মীয়-গোঁড়ামি মুক্ত হতে, ধর্মটাকে রাজনীতির দাবার খুঁটি হিসাবে ব্যবহার না করতে সময় নেবে আরও। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দেওয়ার পরই এ ব্যাপারে দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা তাছাড়া লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হলেও (এবং হবেও) এ-ব্যাপারে অনেকটা অগ্রগতি হবে। সমাজের সর্বস্তরে এই যে স্বজাত্যবােধ এবং শােষণমুক্তির প্রেরণা তা কিন্তু অসহযােগ আন্দোলন চলাকালেই হয়েছে। বিশেষ করে ই পি আর, পুলিস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের পরিবর্তনটা ওই সময়েই হয়েছিল। তাদের মধ্যে পরিবর্তনটা আসতে শুরু করেছিল আগে থেকেই, নির্বাচনের পরেই। তবে মার্চের ১ তারিখ থেকে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর পাক সৈন্যের নির্বিচারে এবং ব্যাপক গুলি বর্ষণের পর এবং কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী অসহযােগ আন্দোলন চলার, সময় তাদের ভিতরে পরিবর্তনটা ঘটেছে দ্রুত। তারা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আর নয়, বাঙালি হিসাবেই আমাদের বাঁচতে হবে। এটাই হয়েছে অসহযােগ আন্দোলনের বড়াে লাভ।
দ্বিতীয় লাভ হয়েছে, প্রশাসনের বাঙালি অফিসাররা লড়াইয়ের প্রাথমিক সাহসটা পেয়েছে অসহযােগ আন্দোলন চলাকালেই। তারা দেখেছেন, অসহযােগের মাধ্যমে সার্থকভাবে সামরিক প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া যায়।
তৃতীয় লাভটা হলাে, এই অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে বেসামরিক প্রশাসন (ইনটেলিজেন্স সহ) সহায়তা করার ফলে প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র লীগের কর্মীদের পক্ষে রাইফেল ট্রেনিং নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এবং পাক সৈন্যের সঙ্গে মুকাবিলার অস্ত্রও তারা পেয়েছে পুলিস এবং ই পি আরের অস্ত্রাগার থেকে।
অসহযােগ আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ যে-লাভবান হয়েছে, আর কোনাে উপায়ে (সমর প্রস্তুতিসহ) কি এর চেয়ে বেশি লাভবান হতাে? গঠন করতে পারত কি ই. পি. আর পুলিস, আনসার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমম্বয়ে গড়া এক উল্লেখযােগ্য মুক্তিফৌজ? প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাধীনতাকামী মুক্তিকামী যেকোনাে দেশের পক্ষেই এটা আশাতীত রকমের বিরাট শক্তি।
অতিরিক্ত সংবাদ
গত সংখ্যায় নারায়ণগঞ্জের কিছু সংবাদ দিয়েছি। আরও কিছু খবর পাওয়া গেছে ওই সংবাদ প্রেসে যাওয়ার পর। নগর খানপুরে জনাকুড়ি লােককে (সকলেই হিন্দু বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুলি করে মেরেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। নারায়ণগঞ্জে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে সকলের পরিচিত একজন হিন্দু কম্পাউন্ডারের নামও শােনা যাচ্ছে।

সূত্র: দেশ : ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮

সমগ্র আন্দোলন পরিচালনায় শেখ মুজিবের বড় রকমের ভুল হয়েছে দুটোই—একটির কথা, আগেই উল্লেখ করেছি; অপরটি হলাে তাঁর আত্মগােপন করতে অস্বীকার করা। শেখ সাহেবের আত্মগােপন না করার পিছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথমত তিনি ভেবেছিলেন, তিনি আত্মগােপন করলে তার খোজে পাক সৈন্যরা আওয়ামী লীগকর্মী এবং নিরীহ জনসাধারণের ওপর অত্যাচার করবে। দ্বিতীয়ত, তিনি ধরা পড়লে, তার মুক্তির দাবিতে এই গণ-আন্দোলন আরও তীব্র, আরও দুর্বার হয়ে উঠবে। শেখ সাহেব যদি বুঝতে পারতেন, ইয়াহিয়া খান নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘােষণা করে বসবেন, তাহলে এই ভুল তিনি করতেন না। যদি আজ তিনি বাইরে থাকতেন, তাহলে মুক্তিযোেদ্ধাদের মনােবল থাকত খুবই দৃঢ় এবং সেই সঙ্গে আজ যুদ্ধের সামগ্রিক চেহারাটাই থাকত আলাদা। যদিও গােড়া থেকেই পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন গণআন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, কমরুদ্দীন আহম্মদ প্রমুখদের প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে, যদিও শেখ মুজিবের কাজকর্ম এবং চিন্তার সঙ্গে তারা দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত , তবু একথা বলতেই হয় যে, মুজিব ছাড়া আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই ভাবা যায় না। আওয়ামী লীগ কর্মী এবং জনসাধারণের ওপর শেখ মুজিবের এমন একটা জাদুকরী প্রভাব আছে, যা আর কোনাে আওয়ামী লীগ নতার নেই। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা দেশের সামনে আজ একটাই লক্ষ্য—মুক্তি। কিন্তু পশ্চিমা সৈন্যদের হটিয়ে বাঙলাদেশকে মুক্ত করার পথে রয়েছে অনেক বাধা, অনেক সমস্যা। শেখ মুজিবের অভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ প্রমুখরা এই দুঃসময়ে বাঙলাদেশের হাল ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সত্যি কিন্তু শেখ মুজিবের অসাধারণ সংগঠন ক্ষমতা এবং জনসাধারণের ওপর তাঁর জাদুকরী প্রভাব বিস্তারের দুর্লভ গুণ তারা পাবেন কোত্থেকে? শেখ মুজিবের উপস্থিতি, তাঁর ভাষণ হাজার হাজার ছেলেকে মরণযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিতে পারত। সেই অনুপ্রেরণা সেই ‘মাভৈ:মন্ত্র ,সেই
অসাধারণ সংগঠন শক্তিরই আজ বড়াে অভাব। তাই তাে প্রতিটি আওয়ামী লীগ কর্মী, বাঙলাদেশের প্রতিটি মানুষ শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিটা প্রতি মুহূর্তে তীব্রভাবে অনুভব করছে। তাইতাে সকলের মনেই একটা প্রশ্ন শেখ সাহেব কোথায়? তিনি সুস্থ তাে? তিনি কি বন্দী? এ পর্যন্ত এ সম্পর্কে অনেক পরম্পবিরােধী খবর বেরিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য সূত্রগুলির পর্যালােচনা প্রয়ােজন। তা থেকে হয়ত-বা কোনাে আলাের সন্ধান পাওয়া যেতেও পারে।
শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রথম খবর পাকবেতারের। করাচি থেকে ২৭ মার্চ, শনিবার সকাল সাতটা পনেরাে মিনিটে খবর দেয়: শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ৩২নং ধানমণ্ডীর বাড়ি থেকে ২৫ মার্চ রাত্রি বারােটা দশ মিনিটে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা বেতারের ৮টা ৪৫ মিনিটের খবরে কিন্তু শেখ মুজিবুরের গ্রেপ্তার সম্পর্কিত কোনাে খবর প্রচারিত হয়নি। পরবর্তী সংবাদে অবশ্য তা প্রচার করেছে।
দুই, ১১টা ২০ মিনিটে ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবর শুনলাম। কিন্তু পাক-বেতারের খবর আমি বিশ্বাস করি না।
তিন, দুপুরের বাঙলাদেশ বেতার খবর দিল : মুজিবুর না ধৃত না মৃত। তিনি মুক্ত এবং অ-মৃত।
চার, ২৮ মার্চ ইউএন আই খবর দিল, বিদেশী একাধিক সাংবাদিক ঢাকা থেকে লনডনে ফিরে বলেছেন, মুজিবুর রহমান আত্মগােপন করতে অস্বীকার করেছেন এবং সম্ভবত তিনি জেলে। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকেরও ধারণ্য, মুজিবুর রহমান জেলে। তার ধারণার সূত্র, শেখ সাহেবের আত্মগােপন করতে অস্বীকার করা।
পাঁচ, ২৯ মার্চ দিল্লির সরকারী সূত্রে প্রকাশ ভারত সরকার মনে করেন, মুজিবুর গ্রেপ্তার হননি। তিনি এখনও মুক্ত।
ছয়, কুষ্টিয়া থেকে সেখানকার মুক্তি ফৌজের প্রধান উপদেষ্টা আসাবুল হক জানান, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিফৌজের সামরিক সদর দপ্তরে নিরাপদেই আছেন।
সাত, ২ এপ্রিল যুগান্তর পত্রিকায় সব জল্পনা-কল্পনার অবসান’ শীর্ষক শিরােনামায় খবর বেরােয় নয়াদিল্লির সরকারী মহলের খবর শেখ মুজিবুর রহমান এখনও মুক্ত আছেন। গতকাল অর্থাৎ ১ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত নয়াদিল্লির কাছে শেখ মুজিবুরের তাই খোজ আছে।
আট, আগরতলা থেকে ইউ এন আইয়ের খবর, বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যদের অভিযান আশঙ্কা করে ২৫ মার্চ সকালে ঢাকায় তাঁর ধানমন্ডীর বাড়ি থেকে চলে যান। ঢাকার এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক একথা জানিয়েছেন।
নয়, রয়টারের খবর : লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে লাহােরে, নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে দেশদ্রোহিতার অভিযােগে তার বিচার হবে।
দশ, চুয়াডাঙ্গার এম এল এ আবু আমেদ বজলুর রশিদ পি টি আইকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিরাপদেই আছেন। লন্ডন থেকে যে খবর বেরিয়েছে তা ভুয়া বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
এগারাে, আর একটি খবর, ২৬ মার্চ (?) রাত একটায় ই.পি আরের দুজন বাঙালি অফিসার তাঁদের সঙ্গে যেতে শেখ মুজিবুরকে বাধ্য করেন। আগরতলা থেকে এই খবরটিরই একটু রকমফের খবর পাওয়া যায়। খবরটি এই সৈন্যদের মতাে দেখতে একদল লােক জিপ থেকে শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে নেমেই এলােপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে এবং দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢােকে। গুলি চলার সময় শেখ সাহেব তার স্ত্রী, তিন পুত্র-কামাল জামাল, রাসেল, দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা এবং জামাতা ডাক্তার ওয়াজেদকে নিয়ে পিছনের ড্রয়িংরুমে যান। পরক্ষণে শেখ সাহেব চিৎকার করে বলেন, ‘গুলি বন্ধ করাে।’ এরপর তিনি হানাদারদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন ‘গুলি করার কী মানে হয়, আমাকে ফোন করলেই পারতেন। কিন্তু চলে যাওয়ার সময় অপহরণকারীদের কণ্ঠে নাকি ‘জয় বাংলা ধ্বনি শােনা যায়।
ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ড্রিংকের খবর, শেখ মুজিবের একজন প্রতিবেশী তাকে জানিয়েছেন, একজন পুলিস অফিসার এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একটা ভ্যানে তার বাড়ি থেকে সমস্ত কাগজপত্র তুলে নেয় এবং বাড়িটা নষ্ট করে দেয়।
বারাে, ১০ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে রয়টার খবর দিল, শেখ মুজিবের বন্দিদশার একটি ছবি পাকিস্তান সরকার প্রচার করেছেন। ছবিতে দেখানাে হয়েছে, শেখ মুজিব দুজন পুলিস-অফিসার পরিবৃত হয়ে একটি ঘরে সােফায় বসে রয়েছেন। ঘরটি করাচি বিমানঘাটির ভি আই পি লাউঞ্জের মতাে বলে সংবাদদাতার অনুমান।
তের, স্বাধীন বাঙলা বেতারের ঘােষণা : মুজিব জীবিত। বিশেষ কারণে তিনি আত্মগােপন করে আছেন। যথাসময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন।
চৌদ, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য (রংপুর) আসাম সীমান্তের কাছে একজন সাংবাদিককে জানান ২৫ মার্চ গভীর রাত্রিতে তাজউদ্দীন সাহেব কয়েকজন ই পি আর -এর লােককে নিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ি যান। বারবার অনুরােধের পরও শেখ সাহেব নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে অস্বীকার করায় তাজউদ্দীন সাহেব রিভলভার উঁচিয়ে বলেন, আমি আপনাকে পাঞ্জাবীদের হাতে মরতে দেব না। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে আসতে না চান তাহলে একজন বাঙালিই আপনাকে হত্যা করার সুযােগ লাভ করুক। তখন শেখ সাহেব মত বদলালেন এবং তাদের সঙ্গে গেলেন।
১৩৫
পনেরাে, জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী একজন সাংবাদিককে জানান, আসাম-বাঙলা সীমান্তের কোনাে এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমি দেখা করি। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং জীবিত আছেন।
ষোল , ১৬ এপ্রিল পশ্চিম পাকিস্তানের ‘জং’ পত্রিকা খবর দিল, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবরের বিচার হবে।
সতেরাে, ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগরে যখন প্রজাতন্ত্র বাঙলাদেশের জন্ম হলাে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘােষণাপত্রে সই দেন। রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে ছিলেন না। সেই অনুষ্ঠানে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, বঙ্গবন্ধু এখনও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা তারই নির্দেশ পালন করছি। সময় মতাে আমাদের জনপ্রিয় নেতা আত্মপ্রকাশ করবেন—সরকারের দায়িত্ব নেবেন।
আর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি শেষবার কখন তাঁকে দেখেছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ বললেন, ২৫ মার্চ রাত্রে। আমরা যখন ঢাকা ত্যাগ করি, শেখ সাহেব তখন সেখানে নিরাপদেই ছিলেন।
আঠারাে, এর কয়েক দিন বাদেই কলকাতার বাঙলাদেশ মিশনের প্রধান হােসেন আলী বলেন, শেখ সাহেব কোথায় আছেন আমি জানি না, তবে তিনি ঢাকায় নেই। আমি আর কিছু বলব না।’
উনিশ, পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল মহম্মদ আকবর খান ৫ মে জানান শেখ মুজিব জীবিত এবং সুস্থ আছেন।
কুড়ি, ১৬ মে উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে এসে কলকাতায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীমতী ইন্দিরাগান্ধী বললেন, গােড়ায় আমাদের কাছে যে-খবর ছিল, সেই অনুযায়ীই আমরা বলেছি শেখ মুজিবুর মুক্ত এবং নিরাপদে আছেন। পাকসরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রকে জানিয়েছে শেখ মুজিব ধৃত। সরকারীভাবে আমাদের কাছে কোনাে খবর নেই।
বর্তমানে সাধারণভাবে সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন শেখ মুজিব ধৃত এবং তিনি অনশনরত রয়েছেন। আওয়ামী লীগকর্মীদেরও অনেকে এই খবর বিশ্বাস করেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ছাত্রলীগের কয়েকজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা আমাকে বললেন, মুজিবভাই অ্যারেস্ট হয়ে গেছেন। ঢাকা থেকে সদ্য আগত অনেক ছাত্রও এই কথাই বলেন। কিন্তু যারা বলেছেন শেখ মুজিব মুক্ত আছেন তাদের বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কথা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? মনে রাখতে হবে তারা দায়িত্বহীনতার মতাে কোনাে উক্তি করতে পারেন না। কথার মারপ্যাচ তারা রাখতে পারেন, কিন্তু সরাসরি মিথ্যা সংবাদ অন্তত জেনেশুনে পরিবেশন করতে পারেন না। এটা ঠিক যে, তাজউদ্দীন আহমদ শেখ সাহেবের সঙ্গে ২৫ মার্চ রাত এগারােটা পর্যন্ত ছিলেন। খবরটা অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য সূত্রের। তারপরেও তাজউদ্দীন সাহেবের পক্ষে শেখ সাহেবের বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকা স্বাভাবিক। সেই সময় শেখ সাহেবের বাড়িতে আরও অন্তত একজন ছিলেন। তিনি শেখ সাহেবের বডি গার্ড। নাম মহিউদ্দিন (মুন্সীগঞ্জ)। এগারােটা দশ মিনিটের সময় সামরিক অভিযান প্রথম শুরু হয়। ফার্মগেটের কাছে একটা ব্যারিকেড সরানাে নিয়ে শেখ মুজিবের বাহিনীর সঙ্গে পাকসৈন্যের প্রথম কিছু গুলি বিনিময় হয়। ইকবাল হল আক্রান্ত হয় এগারােটা কুড়ি মিনিট নাগাদ। শেখ মুজিবের ধানমন্ডীর বাড়ি আক্রান্ত হয় বারােটা পাঁচ-সাত মিনিটে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শেখ সাহেব ঢাকার বাইরে যাবার সময় পাননি। শেখ সাহেব গ্রেপ্তার হয়েছেন—এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় যখন শুনি যে হলিডে পত্রিকার সম্পাদক এনায়েতউল্লা খানকে ধরে নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দেরই খোঁজ করতে। শেখ মুজিবের খোজ তারা করেননি। তাহলে কি ধরে নিতে হয় শেখ সাহেব সত্যি গ্রেপ্তার হয়েছেন? সরাসরি হা’ বলা যাচ্ছে না। কেননা, তাজউদ্দীন আহমদ এবং মহীউদ্দীন যদি ঢাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে থাকেন, তাহলে শেখ সাহেবই-বা পারবেন না কেন? কারণটা কি তার আত্মগােপনে অস্বীকৃতি? বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকে এবং ‘গারডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকের ধারণা কিন্তু তাই। দ্বিতীয় বিষয়, শেখ মুজিব যদি পঁচিশ তারিখ রাত্রিতেই গ্রেপ্তার হবেন, তাহলে পরদিন সকালের খবরে পাকিস্তান রেডিও সেই সংবাদ জানাল না কেন? শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের সংবাদ গণ-বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে উঠবে বলে কি? তাই যদি হবে তবে ২৭ মার্চ সকালে কেন তাঁর গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রচার করা হলাে? ধরে নেওয়া যাক, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ যখন দেখলেন, পঁচিশ-ছাব্বিশ দু’দিন পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়ােগ করেও জনসাধারণকে দমানাে গেল না,বরং সমস্ত বাঙালি এককাট্টা হয়ে অসম সাহসে পাক সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে, যখন দেখলেন মুজিবের গ্রেফতারের খবর চেপে রেখেও প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ দমিয়ে রাখা গেল না এবং যখন দেখলেন, মুজিবের নামে গােপন বেতার থেকে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়েছে, তখন গােপন বেতারকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবার জন্য এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য শেখ সাহেবের গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করা উচিত বিবেচনা করলেন পাক-কর্তৃপক্ষ। ২৭ মার্চ শেখ সাহেবের খবর প্রথম প্রচারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তাই যদি হবে, পাক-কর্তৃপক্ষ যদি মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ভাঙার জন্যই শেখ সাহেবের গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করে থাকবেন, তাহলে শেখ মুজিব মুক্ত বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের এই বারংবার প্রচারের মুখেও পাক-কর্তৃপক্ষ নিজেদের উক্তির সত্যতা প্রমাণের ব্যবস্থা করলেন না কেন? সত্যতা প্রমাণের পথ ছিল দুটো, এক, শেখ সাহেবের বন্দী অবস্থার ফটো প্রকাশ করা; দুই দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে বন্দী শেখ সাহেবকে দেখানাে। পাক-কর্তৃপক্ষ প্রথম ব্যবস্থাটি নিলেন, কিন্তু অনেক বিলম্বে। ১৬ দিন বাদে শেখ মুজিবের বন্দীদশার একটি আলোক চিত্র প্রকাশ করলেন পাক-কর্তৃপক্ষ। ফটোটি এই : একটি ঘরে সােফায় উপবিষ্ট বিমর্ষ শেখ সাহেবের ছবি। শেখ সাহেবের দু’পাশে দুজন প্রহরী। ঘরটি দেখতে করাচি বিমানবন্দরের ভি আই পি রুমের মতাে। শেখ সাহেবের পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি এবং হাফ মুজিব কোট। শীত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলের মতাে শেখ সাহেবও যে তাঁর কোট ছেড়ে দিয়ে ছিলেন এটা সকলেরই জানা। শেখ সাহেব মার্চ মাসে পাজামা এবং সাদা পাঞ্জাবিই পরতেন। তাহলে ওই কোটটি এল কোত্থেকে? তাছাড়া পাক-কর্তৃপক্ষের ছবির সঙ্গে শেখ মুজিবের সাম্প্রতিক কালের চেহারার পার্থক্যটাও চোখে পড়ার মতাে। তাহলে কি এই সিদ্ধান্তই আসতে হয় যে, ছবিটা মুজিবের সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের পর তােলা নয়। পাককর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ছবি প্রকাশ করাটা ছিল খুবই জরুরী তা তারা করতে পারলেন না কেন? যদি ধরেও নিই ছবিটা সত্যি, তাহলে ও প্রশ্ন থেকে যায়, যখন পাক-কর্তৃপক্ষ বুঝলেন, ছবিটা প্রকাশ করা খুবই প্রয়ােজন, এবং তা ২৬-২৭ মার্চেই প্রকাশ করা সম্ভব থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করতে ১৬ দিন সময় নিলেন কেন? তাছাড়া এই ছবিটা সম্পর্কে যখন অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সেক্ষেত্রে নিজেদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য পাক-কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল না কি বন্দী মুজিবের আরও ছবি প্রকাশ করা?
মে মাসে ঢাকার বিভিন্ন দালানকোঠা মেরামত করে টিক্কা খান যখন ছয়জন বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা পরিদর্শনে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন, ঢাকা ঘুরিয়ে দেখালেন, তখনও সে নিজেদের উক্তির সত্যতা প্রমাণের জন্য বিদেশী সাংবাদিকদের বন্দী শেখ মুজিবকে দেখাতে পারতেন? কথা বলতে না দিন, কিছুটা ব্যবধানে থেকে শেখ মুজিবকে তাঁদের দেখতে দিতে কোনাে আপত্তি থাকার কারণ নেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী এবং ভারতের কিছু পার্লামেন্ট সদস্যের বারংবার দাবির মুখে তাজউদ্দীন আহমদ এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বড়াে বড়াে রাষ্ট্রগুলাের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন না কেন? আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ দেখছি এব্যাপারে নির্বিকার। অবশ্য ৬ জুন সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক সমাধানের শর্ত হিসাবে বাঙলাদেশসরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চেয়েছেন। শেখ সাহেব যদি সত্যিই অনশনরত থাকেন তাহলে উক্তিতে যথেষ্ট উদ্বেগ থাকতাে। কারণ, ওইদিন শেখ মুজিবের অনশনের ৭৩ দিন অতিবাহিত হয়। কবে রাজনৈতিক সমাধানের আলােচনার কথা উঠবে তার নেই ঠিক, শেখ সাহেব অনশনরত থাকলে তার মুক্তির প্রশ্নই কখনাে উঠবে না। কারণ, তত দিন কোনাে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
তাহলে কি এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয়, শেখ মুজিব মুক্ত? এ প্রশ্নের জবাবেও হ্যা বলা যাচ্ছে না। কারণ, শেখ মুজিব যদি মুক্তই থাকবেন তাহলে এই বিপদের দিনে যখন, তার উপস্থিতির একান্তই প্রয়ােজন, তখন তিনি কোথায়? তিনি যদি মুক্ত থেকে আত্মগােপন করেই থাকেন, তাহলে তিনি অন্তত তাঁর সই-করা তারিখ-দেওয়া বাণী এবং টেপরেকর্ড-করা ভাষণও তাে প্রচার করতে পারেন অনায়াসেই, তা তিনি পৃথিবীর যে-কোনাে প্রান্তেই থাকুন না কেন? বিশেষ করে আজ যখন তাঁকে নিয়ে পরস্পর বিরােধী মন্তব্যে সারা বিশ্ব সরগরম বিশেষ করে তার একটি হলেও বাণী, একটি হলেও ভাষণ প্রচারের যখন খুবই প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছে, তখনও তার কাছ থেকে তা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তিনি মুক্ত থাকলে নিশ্চয়ই তা পাওয়া যেত। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে যখন প্রজাতন্ত্র বাঙলাদেশের জন্ম হলাে, রাষ্ট্রপতি হয়েও তখনও তিনি অনুপস্থিত কেন? পাক-চর বা গুপ্ত ঘাতকের ভয়ে? সে ভয়টা তাে তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখদের ক্ষেত্রেও থাকার কথা। তারা সাংবাদিকদের সামনে আসতে পারলে, তিনিই বা আসলেন না কেন? তবে তিনি কোথায়? অপ্রিয় হলেও একটি প্রশ্ন আসে, তিনি কি তবে মৃত? এ মতের স্বপক্ষের কারণগুলাে প্রথমে আলােচনা করা যাক। এ ব্যাপারে প্রথম সন্দেহের সৃষ্টি করে, মুজিবের নামে বৈদ্যনাথতলার ‘মুজিবনগর’ নামকরণ। শেখ সাহেব মুক্ত থাকলে এ নামকরণে তিনি নিশ্চয়ই রাজী হতেন না । এই নামকরণ এবং সেই সঙ্গে শেখ সাহেবের সহকর্মিগণ কর্তৃক ওই অনুষ্ঠানে বার বার তাঁর অবদান উল্লেখ করাটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন নিশ্চয়ই। মানুষের মৃত্যুর পরই সাধারণত এই ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শন হয়ে থাকে। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে এই ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শন অন্য ক্ষেত্রেও হতে পারে না। পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্রের উক্তিটিও এ প্রসঙ্গে পর্যালােচনা করা প্রয়ােজন। তিনি বলেছেন, শেখ মুজিব জীবিত এবং সুস্থ। পাকিস্তান সরকারের ঘােষণা মতাে শেখ মুজিব যখন অনশন করে চলেছেন, যখন তার মৃত্যুর প্রশ্নই ওঠে না , যখন তার স্বাস্থ্যের অবনতির প্রশ্নই মাত্র ওঠে, তখন তার সুস্থ’ শব্দটি প্রয়ােগ সঙ্গতই হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ তিনি জীবিত’ শব্দটি প্রয়ােগ করতে গেলেন কেন? তাহলে কি পাকিস্তান সরকারের মাথায় বিপরীত ধারণাই কাজ করছে?
সেক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে প্রথমেই কেন তারা ‘শেখ মৃত—কথাটা ঘােষণা করলেন না? প্রশ্নটির জবাব এই : সম্ভবত তারা ভেবেছিলেন, শেখ সাহবেকে হত্যা করার ঘােষণায় মুক্তি পাগল প্রতিটি বাঙালি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র তাকে ধিক্কার দেবে। তাই ইয়াহিয়া শেখকে ‘ধূত’ বলে ঘােষণা করেছিলেন। কিংবা এও হতে পারে, পাক-কর্তৃপক্ষ শেখ সাহেবকে না পেয়ে ধরে নিয়েছেন, শেখ সাহেব ‘মৃত। তাই তারা মুক্তিফৌজের মনােবল ভাঙার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব ‘ধৃত’ ঘােষণা করতে সাহসী হয়েছেন। তখন হয়ত মাথায় ঢােকে নি, যে-ধূত’ তাকে মুক্ত করার প্রশ্ন ও আসবে। বিপদে পড়ে এখন তাই অনশনের নাম দিয়ে সম্ভাব্য সময়ের পর শেখকে মৃত ঘােষণার প্রতীক্ষায় আছেন পাক-কর্তৃপক্ষ এবং প্রতিপক্ষ অর্থাৎ বাঙলাদেশও হয়তাে ইয়াহিয়ার শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের সংবাদটা কাজে লাগানাের চেষ্টায় আছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন হয়ত ভালাে করেই জানেন যে শেখ মুজিব ধৃত নন। তাই বর্তমানে নীরব থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অদূর ভবিষ্যতে ইয়াহিয়াকে তাঁরই মিথ্যার জালে আটকানাের পরিকল্পনা করছেন—এমনটাও হতে পারে। হয়তাে সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিটা তাঁরই একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের পর আজ (১৬ জুন) ৮৫ দিন অতিবাহিত হলাে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যদি ঘােষণা না করে থাকেন যে, শেখ মুজিব মৃত কিংবা অনশন ভঙ্গ করেছেন এবং অনশন ভাঙার কারণ স্বরূপ বলেন, তার সঙ্গে ইয়াহিয়ার একটা সমঝােতা হয়েছে তাহলে দু’চারদিনের মধ্যেই তাকে ওই রকম একটা ঘােষণা করতেই হবে। অনশনরত একজন লােককে (যত সবলই হােন) নব্বই দিনের বেশি ইয়াহিয়া বাঁচিয়ে রাখতে পারেন না। বাঙলাদেশ সরকার চান, ইয়াহিয়া প্রথম সম্ভাব্য ঘােষণাটি করুক। তখন তারা বিশ্বজনমত গঠনে সেই ঘােষণাটাকে কাজে লাগাতে পারবেন। সেই জন্যেই সম্ভবত তারা নীরবতা অবলম্বন করছেন। মুজিবকে এখন ‘মৃত’ ঘােষণার ফলটা সারা বিশ্বে যে কী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা যে ইয়াহিয়া বুঝতে না পারছেন তা নয়, সেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া সম্ভবত দ্বিতীয় সম্ভাব্য ঘােষণাটিই করবেন। সেক্ষেত্রেও প্রমাণিত হবে মুজিব গ্রেপ্তার হননি। কারণ শেখ মুজিব কোনাে আপস করতে পারেন না। বাঙলাদেশ সরকার বিশ্বের সামনে তখন শেখ মুজিবকে হাজির করার চেষ্টা করে প্রমাণ করতে চাইবেন ইয়াহিয়ার জালিয়াতি। তার অর্থ দাঁড়ায় শেখ গ্রেপ্তার হননি। অথবা চ্যালেঞ্জ জানাবেন সেই উক্তির এবং বলবেন, মুজিবকে সামনে আনতে। এবং তােলপাড় শুরু করবেন এই বলে যে মুজিবকে পাক সরকার হত্যা করে ফেলেছে। তখন মুজিবকে সামনে না আনুন, মুজিবকে দিয়ে টেলিভিশনে একটা বক্তৃতা তাে পাকসরকারকে দেওয়াতেই হবে। সেক্ষেত্রেও বাঙলাদেশ সরকার লাভবান হবেন।
আর যদি নব্বই দিন পরেও পাক-সরকার নীরব থাকেন তাহলেও প্রমাণ হবে, শেখ গ্রেপ্তার হননি।
শেখ মুজিব জীবিত—এই মতের বড়াে সমর্থন হলাে তাঁকে বাঙলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে।
এই পর্যালােচনা এবং পরস্পর-বিরােধী মন্তব্য থেকে নির্যাস বের করা গেলেও এইটুকু (১) সাধারণ বিশ্বাস, তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অনশনরত আছেন, (যুক্তির বিচারে তা মেনে নিতে অসুবিধা হয়) (২) তিনি মুক্ত (এ-ও যুক্তির ধােপে টেকে না।) (৩) তিনি মৃত। (এও নিঃসংশয়ে বলা যায় না)।
শেখ মুজিব মুক্ত গ্রেপ্তার বা মৃত কোনােটাই যদি না হন, তাহলে আর কী হতে পারে? এমনও তাে হতে পারে যে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কথাই ঠিক। তিনি গ্রেপ্তার হন নি। গ্রেপ্তার হন নি অথচ মুক্তও নন—এমন কী হতে পারে? সম্ভাব্য উত্তর তিনি ঢাকার কোনাে এক জায়গায় আছেন, যেখান থেকে তাঁর পক্ষে বেরুনাে সম্ভব হচ্ছে না। পাক-সৈন্যর সদা সতর্ক প্রহরা চলছে তার চার পাশে। আমার কাছে এ রকম একটা খবরও আছে যে শেখ সাহেবের বডি গার্ড মহিউদ্দীন জোর করে শেখ সাহেবকে কোনাে একটি বাড়িতে পৌছে দিয়ে এসেছেন। আমার সংবাদের সূত্রটি মােটামুটি নির্ভরযােগ্য। তিনি আমাকে বাড়ির নির্দিষ্ট ঠিকানাও বলেছেন। এই সংবাদ মিথ্যা বা সত্যি যাই হােক না কেন, এর বেশি কিছু বলা এখন আমার উচিত হবে না।
শেখ সাহেবের কী হাল হয়েছে তা সঠিক করে বলা না গেলেও এ কথা ঠিক যে, বাঙলাদেশের মানুষ এমন প্রয়ােজনের দিনেও তাদের বন্ধু শেখ মুজিবকে কাছে পাচ্ছেন না। বাঙলাদেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তুলতে গেলে শেখ সাহেবের মতাে এমন একজন নেতার প্রয়ােজন জনসাধারণের ওপর যার বেশ প্রভাব আছে। মুজিবের অবর্তমানে সারা বাঙলাদেশে এমন আর-একজন নেতাই আছেন। তিনি মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বাঙলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এমন একজন নেতার আজ খুবই প্রয়ােজন। নির্বাচনের পূর্বে ভাসানীর ভূমিকা যাই থাক না কেন, নির্বাচনের পরে পরেই তিনি প্রথম স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তানের দাবি তােলেন। তিনি বাঙলাদেশ’ নাম রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। কেননা, তিনি মনে করতেন, বাঙলাদেশ কথাটির সঙ্গে যুক্ত বাঙলার গন্ধ আছে। যাই হােক সম্প্রতি তিনি ওই মত পাল্টেছেন। বাঙলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের তিনি একজন বড়াে সমর্থক। বর্তমান পর্যায়েও তাঁর মতাে নেতাকে দূরে সরিয়ে রাখাটা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষে কি ভুল হচ্ছে না?

সূত্র: দেশ : ৪ আষাঢ় ১৩৭৮

পূর্ববাঙলার মানুষের এই যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবােধ থেকে ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ উত্তরণ এই যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক সচেতনতা, সাত কোটি মানুষের স্বাধিকার আদায়ের জন্য পশ্চিমা শাসক ও শােষক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই যে মুক্তির সংগ্রাম-এ তাে দু-চার মাসের প্রস্তুতিতে হয় নি দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তার জমি তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে ধাপে ধাপে দলমত নির্বিশেষে শত-সহস্র মানুষের আত্মত্যাগে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। স্থানাভাবে বর্তমান পর্যায়ে তার বিস্তারিত উল্লেখ সম্ভব নয়। পুস্তকাকারে এ সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করার ইচ্ছে রইল। এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে আমি একটা রেখাচিত্র মাত্র দেবার চেষ্টা করব।
ভারতবর্ষে আধুনিক যুগের শুরু হয় ইংরেজদের আসার পর। ইংরেজরা যে নতুন সমাজ, নতুন জীবনের আয়ােজন করল মুসলমানরা তা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখল। দূরে সরিয়ে রাখল এই জন্যে যে, ইংরেজরা প্রধানত মুসলমানদের হাত থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করেছে আর সাধারণ মুসলমানরা মুসলমান শাসকদের পরাজয়কে নিজেদের পরাজয় বলে ভেবে নিয়েছিলেন। অপর দিকে হিন্দুরা ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন গােড়া থেকেই সুনজরে দেখেন নি। দেখেন নি প্রধানত এই জন্যে যে, এদেশে ধর্মান্ত করণের কাজটা প্রধানত জোরজার করেই হয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য কারণও অবশ্য এর পিছনে রয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ-ছশ বছর মুসলমানদের অধীনে থাকার ফলে হিন্দুদের কাছে ইংরেজরা সাধারণভাবে গ্রহণযােগ্য হলেন। ইংরেজদের সহযােগিতায় এগিয়ে গেলেন তারা সহজেই; আর অভিমান ক্ষুব্ধ মুসলমানরা রইলেন পিছিয়ে। এইভাবে অসমান ভাবে ভারতবর্ষের দুটি প্রধান ধর্ম-সম্প্রদায়ের লােকের জীবনধারা চলল সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত। এই একশ বছরে হিন্দুরা নিজেদের মােটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। এখন ধীরে ধীরে হিন্দু ইংরেজ সহযােগিতাটা প্রতিযােগিতায় গিয়ে দাঁড়াল। সিপাহী যুদ্ধের পরে-পরেই মুসলমানরা ইংরেজের চালে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক প্রয়ােজনের তাগিদে ইংরেজদের সহযােগিতায় হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় নামলেন। ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তিক্ততা দেখা দিতে থাকল।
নিজের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা থাকার নাম সাম্প্রদায়িকতা নয়। এক ধর্মের লােক যদি ধনী-দরিদ্র, মন্দভালাে নির্বিশেষে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পােষণ করেন এবং তাদের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেন তখনই তা হয় সাম্প্রদায়িক। এবং এই সাম্প্রদায়িকতার পৈশাচিক অভিব্যক্তিই হলাে দাঙ্গা। দাঙ্গার সঙ্গে ধর্ম-নিষ্ঠার কোনাে সম্পর্ক নেই। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ। ব্যক্তির মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তিই তার লক্ষ্য। কিন্তু সেই ধর্ম যখন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখনই তার ফল হয় বিষময়। ভারতবর্ষে ইংরেজ নিজেদের স্বার্থে ধর্মের ভেদবুদ্ধির বিষ ছড়িয়ে দিল হিন্দু মুসলমানের মধ্যে। আর হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মসম্প্রদায়েরই ধনিকগােষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে সেই ভেদুবুদ্ধিকে চাঙ্গা করে তুলল।
ইংরেজ যখন দেখল, স্বদেশী আন্দোলন ভারতবর্ষে দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। তখন সেই আন্দোলনকে দুর্বল করে রাখার জন্যে মুসলমানদের দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করা। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করলেন ১৯০৬ সালে। গােড়ায় ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজটি করেছিলেন আলিগড় কলেজের তদানীন্তন ব্রিটিশ অধ্যক্ষ আর্কবােল্ড। আর্কবােল্ড নিজে আলীগড়ের ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতেন। তিনি ভাইসরয়ের সেক্রেটারি কর্নেল স্মিথের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মূল দাবি নাম দিয়ে নিজেই একটা দরখাস্ত লিখলেন। তারপর আলিগড় কলেজের সেক্রেটারি নবাব মুহসিন-উল-মুলকের সহায়তায় দরখাস্তটা দিয়ে ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৭০ জনের এক প্রতিনিধিদলকে সিমলায় লর্ড মিন্টোর কাছ পাঠালেন। এই প্রতিনিধি দলে কিন্তু মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের কেউ ছিল না। দরখাস্তটায় সই করেছিলেন মুসলমান সমাজের কিছু ধনী আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন রাজ্যের কয়েকজন মন্ত্রী এবং জমিদার। ইংরেজরা তাদেরকে দিয়ে এই কাজটা করাতে পেরেছিলেন, কেননা প্রতিনিধি দলের বেশিরভাগ লােকেরই ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বা কোননা-না-কোনাে ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিল। বাকিরা গিয়েছিলেন ইংরেজের কাছ থেকে সুযােগ লাভের আশায় অথবা যারা সুযােগ ভােগ করছেন তাঁদের কাছ থেকে কিছু সুবিধা লাভের আশায়। লেডি মিন্টো কিন্তু তাঁর ডায়েরীতে এই ঘটনাটিকে ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন বলে উল্লেখ করে রেখেছেন। লেডি মিন্টো ওই দিন বিকেলে একজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারির কাছ থেকে একটা চিঠি পান। তাঁর ডায়েরীতে চিঠিটির উল্লেখ আছে। চিঠিটি এই :
I must send your Excellency a line to say that a very very big thing has happened 10-day. A work of statesmanship that will effect India and Indian History for many a long year. It is nothing less than the pulling back of 62 millions of people from joining the ranks of the
seditious opposition.” সত্যি ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঘটনাটির ফল হয়েছিল সুদুরপ্রসারী। ইংরেজের এমন ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতির তুলনা নেই।
সেই ডেপুটেশনের পর মুসলিম লীগের জন্ম হলাে। ১৯০৭ সালের ২১ ডিসেম্বর করাচিতে আদমজী পীরভাই নামে বােম্বের একজন খােজা বণিকের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলন হয়। মুসলিম লীগ যে সাধারণ মুসলমানের স্বার্থে গড়ে ওঠেনি তার প্রমাণ আমরা মুসলিম লীগের তখনকার নীতির প্রতি তাকালেই পাব। তখন মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য ছিল :
_____________
১. ‘The carried with them a petition signed by nobles, ministers of varlous states, great landowners, lawyers, merchants and many others of His Majesty’s Mohammedan subjects’—Pakistan–Milltary rule or People’s wary by Tariq Ali
“to project among the Muslims of India. feelings of loyalty to the British Government and to remove any misconception that may arise as to the Interntion of the Government with regard to any of its members”[২]
আগা খান মুসলিম লীগের ঢাকা শাখার সভাপতিকে লিখেছিলেন :
‘The League recognises British rule essential for India.”[৩]
স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় কিছু লােকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে রইল মুসলিম লীগ দীর্ঘদিন। তারপর ফজলুল হক, আবুল হাশিম প্রমুখেরা মুসলিম লীগে এলেন। তাদের চেষ্টায় মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের যুবকরা মুসলিম লীগে এল। এবং ১৯৪০ সালের ২২, ২৩, ২৪ তারিখে লাহাের অধিবেশনের পরই ঘটল মুসলিম লীগের যথার্থ উত্থান। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর ইংরেজ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির যে বিষ ছড়িয়ে ছিলেন তারই বলি হলাে হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ হিন্দু-মুসলমান ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায়। ওই ডাইরেকট অ্যাকশনের জন্য বাঙলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী কিনা এ সম্পর্কে মন্তব্য করার মতাে পর্যাপ্ত তথ্য এখনাে পাইনি। তবে কয়েক জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে সুহরাওয়ার্দীর চরিত্রের যে ছবি পেয়েছি, তা প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত জীবন তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার যাই হােক, পূর্ববাংলার হিন্দুদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল কলকাতার দাঙ্গার জন্য সুহরাওয়ার্দী দায়ী। কথাটি উল্লেখ করলাম এই জন্যে যে, পাকিস্তানের রাজনীতি বুঝতে গেলে এ তথ্যটি প্রয়ােজন হবে। মহম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কেও সাধারণের কাছে এমন একটা ধারণা প্রচলিত। জিন্নাহ যে ব্যক্তিগত জীবনে সম্প্রদায়িক ছিলেন না সে সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশভাগের পরও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার বিষয় যারা ছড়িয়ে গেছেন তাদের প্রধান ছিলেন লিয়াকত আলী খান, মামদোতের নবাব, দৌলতানা প্রমুখরা। অথচ আশ্চর্য এই যে, লিয়াকত আলীর স্ত্রী উত্তরপ্রদেশের পন্থ উপাধিধারী ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা। ব্যক্তিগত জীবনে ওরা কেউ ইসলামের রীতিনীতি মানে না। তবু ইসলাম বিপন্ন’ বলে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে গেছেন লিয়াকত আলী নিজের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য : মামদোত এবং দৌলতানা করেছেন নিজেদের স্বার্থে।
যে জিন্নাহকে পাকিস্তানে জাতির পিতা বলা হতাে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এখনাে বলা হয়, অনেকেই হয়তাে জানেন না, তিনি যখন মারা যান, তখন লিয়াকত আলী সুদ্ধ তার ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা করাচির ফ্রেনচ অ্যাম্বেসিতে ককটেল পার্টিতে মশগুল ছিলেন। পাকিস্তানের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের প্রথম শিকার হয়েছিলেন জিন্নাহ। তারপর প্রায় কেউই বাদ যাননি। লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে মারা যান। নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেলের পদ ছেড়ে নেমে এলেন লিয়াকত আলীর জায়গায়। গভর্নর জেনারেল হলেন গােলাম মােহম্মদ। নাজিমউদ্দীন, গােলাম মহম্মদ, চৌধুরী মহম্মদ আলী (বগুড়া), ইস্কান্দার মির্জা সকলেই প্রাসাদষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং ক্ষমতাচ্যুতও হন প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের ফলেই।
পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাস যেখানে শুরু খেয়ােখেয়ি এবং প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের লড়াই দিয়ে, সেখানে পূর্ববাঙলার ইতিহাস শুরু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দিয়ে, অর্থনৈতিক মুক্তি প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার রােয়েদাদ ঘােষণা করেন। মুসলিম লীগের কিছু বামপন্থী কর্মী বুঝতে পারছিলেন দেশ স্বাধীন হলেই জনগণের স্বাধীনতা আসছে না। তারা বুঝলেন, মুসলিম লীগ জোতদার, জমিদার, নবাব এবং কিছু উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের লােক কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে যে-কোনাে প্রগতিশীল কাজকেই বাধা দেবে। ওই চক্র প্রাদেশিক পরিষদ হতভাগা বিলকে বানচাল করে দিয়েছে। তাই গণস্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীরা একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলেন। জুলাই মাসে ঢাকায় গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ছােট প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলাে। কমরুদ্দীন আহমদ হলেন তার আহ্বায়ক। প্রতিষ্ঠানটি গড়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের আশা দাবি কর্মসূচি আদর্শ শীর্ষক পুস্তিকায় বলেন:
____________________
২. Political conspiracies in Pakistan by Jamnadas Akhtar.

দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের স্বাধীনতা—দুইটি পৃথক জিনিস। বিদেশী শাসন হইতে একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে; কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, সেই দেশবাসীরা স্বাধীনতা পাইল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনাে মুল্যই নাই যদি সেই স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে; কারণ রাজনৈতিক মুক্তি ব্যতীত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মুক্তি সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্ত নের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালাইয়া যাইব। তারা আরও বলেন, “লাঙ্গল যার জমি তার ভিত্তিতে জমির বিলিব্যবস্থা করিতে হইবে। তেভাগা বিল পাশ করিতে হইবে। এবং বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করিতে হইবে এবং জমির উপর হইতে সর্বপ্রকার মধ্যস্বত্ব লােপ করিতে হই শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ঘােষণাটিতে বলা হয় : মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথােপযােগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” “[৪] ৪৭ সালে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হতে চলেছে, যখন মুসলিম লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপ, (সম্ভবত সে সূময় ছয় থেকে সাত লক্ষ ছিল তার সদস্য সংখ্যা) তখন কিছু মুসলিম লীগের কর্মীর পক্ষে এই মর্মে চিন্তা করা নিঃসন্দেহে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও এরা বুঝেছিলেন মুসলিম লীগের প্রয়ােজন ফুরিয়েছে। তারা তাই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠনে সচেষ্ট হন। গণ-আজাদী লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কমরুদ্দীন আহমদ। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটির নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায়, সিভিল লিবার্টিস লীগ’। আসলে প্রতিষ্ঠানটি পুরাে রাজনৈতিক দলের রূপ নেয়নি কখনােই। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্টের পর মুসলিম লীগের কিছু প্রগতিশীল কর্মী, এবং ছাত্র কলকাতার সিরাজউদৌল্লা হােটেলে মিলিত হয়ে ঠিক করলেন স্বাধীনতা-উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার উপযুক্ত সংগঠন করা প্রয়ােজন। এদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী) কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ । তঁারা ঢাকায় গিয়ে কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, তসদুক আহমদ প্রমুখদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। এবং নেতৃস্থানীয় কর্মীরা পূর্ববাঙলাকে কতগুলাে এলাকাতে ভাগ করে কর্মীদের সঙ্গে যােগাযােগের উদ্দেশ্যে ব্যাপক সফর শুরু করেন। ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় খানসাহেব আবুল হাসনাতের বাড়িতে তসন্দুক আহমদের সভাপতিত্বে যুবকর্মীদের এক সভায় জন্ম নেয় গণতান্ত্রিক যুব লীগ।’ এই প্রতিষ্ঠানের ইস্তাহারের একটি উল্লেখযােগ্য অংশ : ‘রাষ্ট্রের অধীনস্থ বিভিন্ন এলাকায় পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন এবং সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এই সব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে।
এই সময় নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ছাত্রের চেষ্টায় প্রধানত মুসলমান ছাত্রদের নিয়ে ঢাকায় প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলাে। গােড়ায় ঠিক হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে মুসলিম ছাত্র লীগ। পরে মুসলিম শব্দটি পরিত্যক্ত হয়।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র অধ্যাপক মিলে তমদুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ওই প্রতিষ্ঠানই প্রথম ভাষার প্রশ্নে জোরদার জনমত এবং আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। তমদুন মজলিস ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? এই নামে একটা পুস্তিকা বের করেন। পুস্তিকাটিতে অধ্যাপক কাজী মােতাহের হােসেন, দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখরা লেখেন। ওই পুস্তিকায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ভাষার ব্যাপারে কতগুলি সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়। তার মােদ্দা কথা হচ্ছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি—উর্দু ও বাংলা। ইংরেজী থাকবে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে।
___________________
৪. ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বদরুদ্দীন উমর।

ভাষার প্রশ্নে এর আগেই বিতর্কের সূপ্রপাত হয়। ওই বছরেরই জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দীকে ভারতের এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সুপারিশ করেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদ-এ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি বলেন, পাকিস্তান ডােমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন যেমন-পুষতু, বেলুচী পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা: কিন্তু বেলুচী পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা: কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলেরই মাতৃভাষারূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিতাক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোনাে যুক্তি নাই। বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।’
তখন এক শ্রেণীর লােকের ধারণা ছিল, বাংলা হিন্দুদের ভাষা, কাজেই পরিত্যজ্য। এবং উর্দু ইসলামের ভাষা, কাজেই গ্রহণীয়। মাতৃভাষার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং তীব্র হিন্দু বিদ্বেষের ফলে ধর্মীয় ভাষা মনে করে ওই সব লােকদের উর্দুর প্রতি একটা অহেতুক মােহ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ সম্পর্কে তমদুন মজলিসের পুস্তিকায় কাজী মােতাহের হােসেন বলেন, “আমি উর্দু ভাষাকে নিন্দা বা অশ্রদ্ধা করি না, বাঙালি মুসলমানের উর্দুর মােহকে সত্য সতাই মারাত্মক মনে করি। যখন দেখি উর্দু ভাষায় একটা অশ্লীল প্রেমের গান শুনেও বাঙালি সাধারণ দ্রলােক আল্লাহর মহিমা বর্ণিত হচ্ছে মনে করে ভাবে মাতােয়ারা অথবা বাংলা ভাষায় রচিত উৎকৃষ্ট ব্রহ্মসংগীতও হারাম বলে নিন্দিত, তখনই বুঝি এই সব অবােধভক্তি বা অবােধ নিন্দার প্রকৃত মূল্য কিছুই নেই।
ডক্টর কাজী মােতাহের হােসেনের ওই প্রবন্ধের অপর-একটি উল্লেখযােগ্য অংশ : দারিদ্র্য দূর করতে হলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা, বৈদেশিক শােষণ থেকে আত্মরক্ষা করা এবং জাতীয় সম্পদ যাই থাক, শিল্পবাণিজ্যের সাহায্যে তার সুবিনিময়ের ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। শুধু প্রভাব কিছুটা খর্ব হলেই হবে না -ইংরেজের স্থান যেন বৈদেশিক বা অন্য কোনাে প্রদেশীয় লােক দখল করে না বসে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা নিতান্ত প্রয়ােজন। কুচক্রী ললাকেরা যাতে শিক্ষাব্যবস্থার ভিতর দিয়ে, ভাষার সৃষ্টি করে নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক বিকাশে বাধা না জন্মাতে পারে সে বিষয়ে জনসাধারণকে সজাগ থাকতে হবে। পরবর্তীকালে কী ঘটবে কাজীসাহেব পাকিস্তান সৃষ্টির উষালগ্নেই তা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন। তাই এই সতর্কীকরণ, এই উপদেশ।
ওই পুস্তিকায় আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারি চাকুরির ‘অযােগ্য বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসীর জায়গায় ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারি কাজের ‘অযোেগ্য করিয়াছিল।’
সেই সময় বাংলা বিরােধী মনােভাব এত উগ্র ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলিতেও ভাষার প্রশ্নে ছােটোখাটো ঘরােয়া অনুষ্ঠান করা পর্যন্ত ছিল দুঃসাধ্য। ৪৭-এর অক্টোবরে ভাষার প্রশ্ন আলােচনা ও বিবেচনার জন্য তমদুন মজলিস ফজলুল হক হলে একটি সাহিত্য সভার আয়ােজন করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ববাংলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার। কবি জসিমউদ্দিন এবং কাজী মােতাহের হােসেনও সভায় আলােচনা করেন।
‘৪৭-এর ৫ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে না। তমদুন মজলিসের পক্ষ থেকে আবুল কাসেম আবু জাফর প্রমুখরা মৌলানা আকরাম খানের সঙ্গে দেখা করেন। মৌলানা সাহেব তাদের আশ্বাস দেন: পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষাকে চাপানাের চেষ্টা করলে পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘােষণা করবে এবং তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন।
কিন্তু পরে করাচির শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইনটারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং অন্যান্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিরাট সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এটাই প্রথম প্রকাশ্যে ছাত্রসভা। সভায় বক্তৃতা দেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান প্রমুখ। সেখান থেকে ছাত্ররা মিছিল করে সেক্রেটারিয়েট এবং নুরুল আমিন, নাজিমউদ্দীন এবং হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে যান। প্রাদেশিক মন্ত্রী নুরুল আমিন এবং মহম্মদ আফজাল বাংলাভাষার দাবিকে সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দেন। হামিদুল হক এবং নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য ছিল নেতিবাচক।
১২ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের কিছু গুণ্ডা ছাত্র ও সরকারি কর্মচারীদের উপর অত্যাচার চালায়। তারই প্রতিবাদে ঢাকাতে ছাত্র-কর্মচারীর প্রথম সম্মিলন ঘটে। এবং তারই ফলে ছাত্রদের সঙ্গে কর্মচারীরা ও বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করে।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পুরনাে কমিটিগুলােকে ভেঙে দেওয়া হয়। মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের জন্য মৌলানা আকরাম খানকে সভাপতি মনােনীত করে একটি কমিটি হয়। কমিটির অপর কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন নুরুল আমীন, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিঞা) মাতালেব মালেক প্রমুখ। মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে এদের নানান কারণে মতবিরােধ দেখা দেয়। আকরাম খান বামপন্থী কর্মীদের হাতে মুসলিমলীগ চলে যাওয়া এবং নিজের গদিচ্যুত হবার ভয়ে সদস্য করার রসিদ বই বামপন্থী কর্মীদের হাতে দিলেন না। ফলে ১৯৪৮ এর জানুয়ারিতে ১৫০ মােগলটুলি অফিসে বামপন্থী কর্মীরা। (প্রধানত সুহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের দল) (ওয়ারকার্স ক্যাম্প ও আবুল হাশিমের দল) ‘ওয়ারকার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সম্মিলিত হ’লাে। ওইসব কর্মীরা তক্ষুনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল না বটে, তবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে শামসুল হককে মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানােই হলাে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ। শামসুল হক নির্বাচনে জয়ী হন। পাকিস্তানের পরবর্তী ইতিহাসে এই নির্বাচনের ফল হয়েছিল সুদুরপ্রসারী। এতদিন লােকের ধারণা ছিল মুসলিম লীগ অপরাজেয়। এই নির্বাচন প্রমাণ করল, মুসলিম লীগ অপরাজেয় নয়। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রথম সাহস পেলাে পূর্ববাংলার মানুষ এই নির্বাচন থেকেই। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে এই নির্বাচনটির তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
৮ কেন্দ্র করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবধারায় যে কম পরবর্তীকালে তাঁরাই রােজ গার্ডেনে সমবেত হয়ে ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন। আড়াই-তিনশাে কর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই নতুন রাজনৈতিক দলটির নাম হলাে, আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ জনের এক কমিটি হয়। শামসুল হক সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুস্তাক আহমদ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২৪ তারিখ বিকেলে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আরমানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মৌলানা ভাসানী আগে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। কৃষক এবং সাধারণ মানুষের ওপর মৌলানা সাহেবের বরাবরই খুব প্রভাব। তারই চেষ্টায় সিলেট পূর্ব পাকিস্তান ভুক্ত হয়। সাম্প্রদায়িক মনােভাব বিস্তারের অভিযােগে মৌলনা সাহেবকে আসামে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তখন তিনি আসাম থেকে পূর্ববঙ্গে এসে ময়মনসিংহের কাগমারিতে বসবাস শুরু করেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই ভাসানী জিন্নাহর বিরােধিতা করছিলেন। তাই বামপন্থী কর্মীরা মৌলানাকে লুফে নিল। নাজিমউদ্দীন মৌলানা সাহেবকে তাঁর রাজস্ব এবং কৃষিমন্ত্রী করতে পর্যন্ত চেয়েছিলেন, কিন্তু মৌলানা সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আবার আমি ভাষার প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি। তমদুন মজলিস এবং ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর কিছু পরেই কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ঢাকায় আসেন। তখন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তাঁর তুমুল তর্ক হয়। তার পরেই সগ্রাম পরিষদ ভাষার প্রশ্নে গণস্বাক্ষর অভিযানে নামে। এবং যথাসময়ে তা সরকারের কাছে পাঠায়ও। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা নাজিম-উদ্দীনের কাছে এক স্মারকলিপি পাঠিয়ে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে কংগ্রেসের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৫ তারিখ ওই প্রস্তাব নিয়ে পরিষদে আলােচনা হয়। আলােচনকালে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। রেগে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন, এখানে এ প্রশ্নটা তােলাই ভুল হয়েছে। এটা আমাদের জন্যে একটি জীবনমরণ সমস্যা। আমি তীব্রভাবে এই সংশােধনী প্রস্তাবের বিরােধিতা করি এবং আশা করি যে, এ ধরনের একটি সংশােধনী প্রস্তাবকে পরিষদ অগ্রাহ্য করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, প্রথমে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।
পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনােভাব যে, একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’
দৈনিক আজাদ’ ২৭ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয়তে খাজাসাহেবের সমালােচনা করে বলেন : খাজাসাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভােট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না। আমার মতে, তাহার উক্তি মােটেই সত্য নয়। আমরা বিশ্বাস করি, গণভােট গ্রহণ করিলে বাংলাভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯টি ভােটের বড় কম হইবে না।’
গণ-পরিষদে বাংলাভাষার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় ছাত্র, রাজনীতিক এবং শিক্ষিত মহলে অসন্তোষ দেখা দিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্ররা প্রথম ধর্মঘট করে। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা হয়। ২ মার্চ ফজলুল হক হলে ছাত্র, যুবকর্মী অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা হয়। ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার জন্য ছাত্র এবং বিভিন্ন দলের দুজন দুজন প্রতিনিধি নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ পুর্ববাঙলায় প্রথম সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। সেই ডাকে সব স্তরের মানুষই সাড়া দেয়। সাধারণ মানুষ ভাষার সমস্যা নিয়ে এই প্রথম ভাবতে শুরু করেন, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটে সাধারণভাবে ওই দিন। আজকের এই মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতির সূত্রপাত ঘটে ওই দিনই। পিকেটিং করা কালে সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখদের এবং দ্বিতীয় গেট থেকে কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী বরকতকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। পুলিসী নির্যাতনে এবং ছাত্র গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা পূর্ব বাঙলায় চারদিন ধরে তুমুল আন্দোলন চলল। শেষটায় বাধ্য হয় নাজিউদ্দীন ছাত্রদের মুক্তি দিয়ে সংগ্রাম-পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক চুক্তি করলেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, নঈমুদিন আহমদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
সংগ্রাম-পরিষদের সঙ্গে নাজিমউদ্দীন একটি আট-দফা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির একটি দফা ছিল, এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা যে, প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজী উঠে যাওয়ার পর বাংলা সে জায়গায় সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হবে। এ ছাড়া শিক্ষক মাধ্যমও হবে বাংলায়।
এই আট দফা চুক্তি কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে ছাত্র এবং পূর্ব বাঙলার মানুষের প্রথম জয়। এই চুক্তি পূর্ব বাঙলার মানুষের মনে সংগ্রামের সাফল্য সম্পর্কে একটা বিশ্বাস এনে দেয়। যদিও সরকার পরে এই চুক্তির মর্যাদা পুরােপুরি দেননি। তাহলেও উপরােক্ত কারণে তার একটা বিশেষভাবে তাৎপর্য রয়েছে।
১৯ মার্চ মহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। ২২ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের এক সভায় ভাষণ দিলেন তিনি। জিন্নাহ্ তাঁর ভাষণে বললেন, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্যই ভাষার প্রশ্ন তােলা হয়েছে। বাংলা এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হবে কিনা সেটা এই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই স্থির করবেন। কিন্তু আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদের পরিষ্কার জানাতে চাই যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়।’
২৪ মার্চ সমাবর্তন উৎসব উপলক্ষে সকালে কার্জন হলেও জিন্নাহ তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। সেখানে আবদুল মতিন এবং এস এম আহসান নামক দু’জন ছাত্র-যুবক জিন্নাহর উক্তির প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর ইচ্ছায় বিকেলে মহম্মদ তােয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখদের এক প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলাে না কিছুই।
৬ এপ্রিল অবশ্য নাজিমউদ্দিন পরিষদে ভাষার প্রশ্নে একটি প্রস্তাব আনলেন এবং সামান্য সংশােধনের পর প্রস্তাবটি গৃহীত হলাে। গৃহীত প্রস্তাবটি এই : (ক) পূর্ব বাঙলার প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং যত শীঘ্র বাস্তব অবস্থাগুলাে দূর করা যায়, ততই তাহা কার্যকর করা হইবে। (খ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যমে হইবে বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশ ছাত্রদের ভাষা।

সূত্র: দেশ : ১১ আষাঢ় ১৩৭৮

ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের শেষ হয় ওইখানেই। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ৪৯-৫০ সালে। তৃতীয় বা। চূড়ান্ত পর্যায় ছিল ১৯৫২ সালের আন্দোলন। ৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে এলেও পূর্ববাঙলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে তার একটা প্রভাব পড়ল। ছাত্র এবং সরকারী কর্মচারীরা এই সময় নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন, হয়ে উঠতে থাকে। ৮ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারিরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন। ১৮ এপ্রিল থেকে | মেডিকেল কলেজের ৩৬ জন ছাত্র অনশন শুরু করেন। কর্তৃপক্ষ শেষটায় তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হন। ২৭ এপ্রিল ছাত্ররা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। বিক্রয়কর, ধার্যের প্রতিবাদে দোকানদাররা ২৬ এপ্রিল ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালন করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের প্রতিবাদে ৩০ এপ্রিল সিলেটের সাংবাদিকরা প্রতিবাদ সভা করেন। নানা অব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানানাের জন্য ৩০ জুন ঢাকা | বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক বিক্ষোভ-সভা করেন। ১৫ নভেম্বর থেকে ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেছা গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা এই দুই প্রতিষ্ঠানের একত্রীকরণের প্রতিবাদে ধর্মঘট শুরু করে। ১৪ নভেম্বর থেকে ঢাকা ইনটারমিডিয়েট কলেজের ৫০০ ছাত্র ও তাদের কতকগুলি দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই কিছু-না কিছু দাবি আদায় হয়। ছাত্র-ছাত্রী এবং কর্মচারিরা নিজেদের ঐক্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হন এই সময়ে। তারা বুঝলেন, ঐক্যবদ্ধ এবং ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনাে বৃথা যায় না।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই সময় একটি উল্লেখযোেগ্য অনুষ্ঠান হয়। প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে ৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ৪৯-এর ১ জানুয়ারি-দু’দিন ধরে পূর্বপাকিস্তানে প্রথম সাহিত্য সম্মেলন হয়। সম্মেলনে বিভিন্ন শাখার সভাপতি ছিলেন, অভ্যর্থনা—হাবিবুল্লাহ বাহার, সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতি—ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাব্য—জসিমউদ্দীন, শিশু সাহিত্য—বেগম শামসুন্নাহার, ভাষাবিজ্ঞান—আবুল হাসনাৎ, ইতিহাস– অধ্যক্ষ শরফুদ্দীন পুঁথি-সাহিত্য লােকসঙ্গীত—ত্রিপুরাশঙ্কর সেনাশাস্ত্রী, বিজ্ঞান—ডক্টর এস আর খাস্তগীর, চিকিৎসা বিজ্ঞান –ডক্টর আবদুল ওয়াহেদ, শিক্ষা—অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি একটি ‘তাহজীব’ অনুষ্ঠান হয়।
ঢাকার প্রগতিলেখক ও শিল্পী-সংঘ কিন্তু এই সম্মেলনের সঙ্গে কোনাে সহযােগিতা করেননি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রগতি-বিরােধী এবং প্রকৃত গণতন্ত্র গণসাহিত্যের পরিপন্থী। লেখক সংঘের এই সম্মেলন বর্জনের পিছনে অবশ্য অন্য ইতিহাস ছিল। সেই সময় ভবানী সেন রবীন্দ্র গুপ্তনামে কলকাতার মার্কস বাদীতে রবীন্দ্রনাথকে প্রগতি-বিরােধী সাহিত্যিক বলে আখ্যায়িত করেন। সুশােভন সরকার, গােপাল হালদার প্রমুখরা ভবানী সেনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ভবানী সেনের ডাকে লেখক সংঘের বেশির ভাগ সদস্য রবীন্দ্রবিরােধী হয়ে উঠলেন। তাদের প্রধান ছিলেন মুনীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী তখন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রথম শ্রেণীর সদস্য। অজিত গুহের সঙ্গে এই নিয়ে মুনীর চৌধুরী আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আলমুতী প্রমুখদের বিরােধ সৃষ্টি হয়। অজিত গুহ লেখক সংঘেও ছিলেন আবার সাহিত্য সম্মেলনেরও অন্যতম সম্পাদক হয়েছিলেন। অজিত গুহকে নাজেহাল করার জন্যই প্রধানত লেখক সংঘ ওই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, পরবর্তীকালে এই মুনীর চৌধুরীই চরম রবীন্দ্রভক্ত হয়ে ওঠেন। আয়ুব-সরকারের রবীন্দ্রবিরােধিতার প্রতিবাদে যারা সােচ্চার হয়ে ওঠেন, তাঁদের অন্যতম, মুনীর চৌধুরী।
যাই হােক নির্দিষ্ট দিনেই কার্জনহলে সাহিত্য সম্মেলনটি হয়। সেই সম্মেলনে ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেন, স্বাধীন পূর্ব বাঙলার স্বাধীন নাগরিকরূপে আজ আমাদের প্রয়ােজন হয়েছে সর্বশাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য।…..এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষায়— বাংলায়।
হরফের প্রশ্নে তিনি বলেন, স্বাধীন পূর্ব বাঙলায় কেউ আরবী হরফে,কেউ-বা রােমান হরফে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাঙলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের জন্য কি চেষ্টা হচ্ছে? যদি পূর্ববাঙলার বাইরে বাঙলাদেশ না থাকত, আর যদি গােটা বাঙলাদেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকত, তবে এই অক্ষরের প্রশ্ন ততটা সঙ্গীন হতাে না। আমাদের বাঙলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না।… আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদের বঞ্চিত, থাকতে হবে। অধিকন্তু আরবীতে এতগুলি নতুন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যােগ করতে হবে যে, বাংলার বাইরে তা যে কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে, তা বােধ হয় না। ফলে যেমন উর্দু ভাষা না জানলে কেউ উর্দু পড়তে পারে না, তেমন হবে বাংলা।’ ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন, যা নিয়ে সে সময় ঢাকায় গুরুতর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমনসত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনাে আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিদের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপিলুঙি-দাড়িতে ঢাকবার জো নেই। নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক উক্তি। ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেই তা পেরেছিলেন।
ওই সম্মেলনেই সভাপতির অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম জোর করে দাঁড়িয়েই পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা-দফতরের তদানীন্তন সেক্রেটারি ফজলে আহমদ করিম ফজলী বলেন, আজ এখানে যে-সমস্ত প্রবন্ধ পড়া হলাে, সেগুলি শােনার পর আমি ভাবছি আমি কি ঢাকাতে আছি না কলকাতায়! ফলে ফজলীর সঙ্গে তার মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের জোর তর্ক বেধে যায়। ছাত্রদের মারের ভয়ে শেষটায় ফজলী মাইক ছেড়ে চলে যান।
এই অনুষ্ঠান ছিল পূর্ববাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে প্রগতিমুখী ও বলিষ্ঠ করে তােলার প্রথম পদক্ষেপ।
যাক যা বলছিলাম, পূর্ব বাঙলার আজ সে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে, তার প্রথম প্রবক্তা ছিলেন ডক্টর শহীদুল্লাহ্ এবং কাজী মােতাহের হােসেন। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ডক্টর শহীদুল্লাহ এবং কাজী মােতাহের হােসেনের দান অসামান্য। পরবর্তীকালের প্রগতিশীল এবং জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে শিল্পী সাহিত্যিকের দান কোনাে রাজনীতিকের চেয়ে ন্যূন নয়, তারা শহীদুল্লাহ মােতাহের হােসেনেরই উত্তরসুরী।
পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে আর একটি উল্লেখযােগ্য দিন ১৯৪৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বেতনের কর্মচারিরা কতকগুলি দাবি আদায়ের জন্য ৩ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করে। ছাত্ররাও তাদের সমর্থনে এগিয়ে এল। ২৫ এপ্রিল ছিল সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত দিন। কর্মচারীদের দাবিতে ছাত্রের এগিয়ে আসা, ছাত্র-শ্রমিকের ঐক্যের সেই সূত্রপাত। পূর্ব বাঙলার পরবর্তী প্রায় সকল গণআন্দোলনে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য ছিল সুদৃঢ়। একের আন্দোলনে অপরে এগিয়ে গেছে। কোনাে শক্তি তাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। শ্রমিকদের দাবি-আদায়ের সংগ্রামে যেসব ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অলি আহাদ, মতিন, এনায়েত করিম, নিতাই গাঙ্গুলি খালেক নওয়াজের নাম উল্লেখযােগ্য। এই কাছেই ৫৪ সালের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন পরাজিত হয়েছিলেন, নিজেরই এলাকায়।
৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পেশােয়ারে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা-উপদেষ্টা বাের্ডের এক সভায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বাংলাভাষা আরবী হরফে লেখার সপক্ষে সুপরিশ করেন। তিনি শিক্ষা উপদেষ্টা মামুদ হাসানের মাধ্যমে ডক্টর শহীদুল্লাহকে একটি চিঠি দেন। মামুদ হাসান চিঠিতে বলেন যে সরকার পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা আরবী হরফে বাংলাভাষা লিখতে চান। ওই ব্যাপারে ডক্টর শহীদুল্লাহর সাহায্য পেলে তারা উপকৃত হবেন। শহীদুল্লাহ সাহেব এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, চিঠির জবাব পর্যন্ত দেননি।
বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর এই নয়া চক্রান্তের বিরুদ্ধে আবার পূর্ব বাঙলায় অসন্তোষ দেখা দিল। পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা কমিটির পক্ষ থেকে নঈমউদ্দিন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিলেন: পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত গত বছরের প্রস্তাবটি উর্দু চাপানাের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। উর্দুর জন্য সামনের দুয়ার যখন রুদ্ধ তখন আরবী বর্ণমালার জিগীর তুলে পশ্চাৎ দুয়ার দিয়ে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে এবং পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ও বাংলা ভাষাকে খতম করবার ষড়যন্ত্র চলছে।’
১০ ডিসেম্বর (১৯৪৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের এক সভায় বাংলাভাষা আরবী হরফে লেখার, প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। শেষটায় বেগতিক দেখে ১৪ ডিসেম্বর এক প্রেসনােট পূর্ব বাঙলা সরকার বলেন: বাংলাভাষা বাংলা হরফে লেখা হবে না। আরবী হরফে লেখা হবে সেটা পূর্ব বাংলার জনসাধারণই তাদের স্বাধীন মতামতের দ্বারা নির্ধারণ করবে। পাকিস্তান উপদেষ্টা বাের্ডের সভায় এ সম্পর্কে কোনাে আলােচনা করা হবে
কিন্তু কার্যত। আরবী হরফে-বাংলাভাষা লেখার হরফে বাংলা চেষ্টা সরকার চালিয়ে ভাষা শিক্ষা গেলেন। ১৯৫০ সালের দেওয়ার ১৮ এপ্রিল থেকে কাজ চালু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন কাজ চালু পূর্ব বাংলার বিভিন্ন হয়। জেলায় ২০টি কেন্দ্রে হরফে সরকারি উদ্যোগে বয়স্কদের আরবী বাংলা ভাষা লেখার সপক্ষে সুপারিশ আদায় করার জন্য কয়েকজন শিক্ষাবিদকে নিয়ে একটি ভাষা কমিটি গঠন করেন সরকার। কিন্তু কমিটি বিপরীত সুপারিশই করলেন। ভাষা কমিটি তাদের রিপাের্ট শেষ করেন ৭ ডিসেম্বর। সরকার রিপাের্টটি চেপে রাখলেন। ১৯৫২ সালের ২০ জানুয়ারী পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে সরকারী তরফে বিশেষ উচ্চবাচ্য শােনা গেল না। ২৬ জানুয়ারী নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশনে গভর্নর জেনারেল নাজিমউদ্দীন পূর্বের প্রতিশ্রুতি খেলাপ করে ঘােষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা আবার সংগ্রামে নামল। শুরু হলাে ভাষা-আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়।
৩০ জানুয়ারি এবং ৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট করল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ ও ১৩ পতাকা দিবস ঘােষণা করে অর্থ সংগ্রহ করল। ভাষা আন্দোলনের সমর্থন করায় ১৩ ফেব্রুয়ারী লীগ সরকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকাটির প্রকাশন বন্ধ করে দেন; গ্রেপ্তার করেন পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালামকে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা পরিষদ অভিযানে যাওয়া ঠিক করল। ব্যাপক গণ্ডগােলের আশঙ্কায় সরকার আগের দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলেন। কিন্তু ছাত্ররা চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিল। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গাজিউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রদের এক সভা হলাে। সভাশেষে তারা একশাে চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করে দশজন দশজন করে বেরিয়ে এল বাইরে। পুলিস লাঠিচার্জ করল, টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ল। ছাত্রপুলিসে একটানা, ঘন্টা দুই লড়াই চলল। পরিষদ অধিবেশন বসার কথা ছিল তিনটের দিকে। প্রায় ওই সময়েই ছাত্রদের ওপর পুলিস প্রথম গুলি ছোঁড়ে। নিহত হয় জাব্বার। তারপর শহীদ হলাে রফিক, বরকত। বরকতকে গুলি করে মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের শেডের নিচে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ ক্লাসের ছাত্র ছিল বরকত। পরের দিন মারা গেল ল’ক্লাশের ছাত্র শফিকুর।
দাবাগ্নির মতাে গুলির খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পরিষদে এ নিয়ে তুমুল হৈ-চৈ হলাে। ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে সরকারী দলের সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ ‘আজাদ-সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন এ খয়রাত হােসেন পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। শামসুদ্দিন সাহেব পরে সদস্যপদেও ইস্তফা দেন। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আন্দোলনকে ভারতীয় এজেন্ট এবং কমিউনিস্টদের কারসাজি আখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা পূর্ব বাঙলা তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলাে। মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ সহ আন্দোলনের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই গ্রেপ্তার হলেন। ঢাকায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ল। কিন্তু ব্যর্থ হলাে না এই আন্দোলন। ৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলাে। ৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেল।
এই আন্দোলন যে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনই আনল তা নয়, সমাজ এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন চেতনা সৃষ্টি করল, ৫২ সালের আগে হিন্দুদের সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে লিয়াকত আলী এবং তার দলবল তীব্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে যান। হিন্দুদের তারা ভারতের দালাল এবং কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করে রাখেন। অবশ্য একথা সত্যি দেশ ভাগের সময় পূর্ব বাঙলার কম্যুনিস্ট সদস্যের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদের যে কোনাে সংস্কৃতিক কার্যকলাপ তারা বিষ নজরে দেখতেন। ফলে ৫২ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ববাঙলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ‘৫২ সালের পর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশাের, কুমিল্লা প্রধানত শহর অঞ্চলে দ্রুত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলে। ‘৫২ সালের আন্দোলনের সময় মুসলমান ছাত্রদের পাশে পাশে হিন্দু ছাত্ররাও এগিয়ে যায়, যােগ দেয় মিছিলে। পূর্ব বাঙলার হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির ব্যাপক সূত্রপাত ঘটে তখন থেকেই। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র প্রমুখকে পূর্ব বাঙলার সাধারণ মুসলমানরা আপনার ভাবতে শিখলেন ‘৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পর থেকেই। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে ভাষাআন্দোলন একটি নীরব বিপ্লব। পরবর্তীকালে ঐ আন্দোলনের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। পূর্ব বাংলার ভাষার প্রশ্নে যদি বিতর্ক সৃষ্টি না হতাে, না হতাে ‘৪৮ এর মার্চ এবং ‘৫২ এর ফেব্রুয়ারি আন্দোলন তাহলে পূর্ব বাঙলার এই মুক্তিযুদ্ধ আজকে শুরু হতাে কিনা সন্দেহ। হ’লেও অন্তত কয়েকটা যুগ পরে হতাে নিঃসন্দেহে।
‘৫২ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। ফজলুল হক হলেন তার মুখ্যমন্ত্রী।
পূর্ব পশ্চিম—দুই অঞ্চলেই এর পরের চার বছরের ইতিহাস খেয়ােখেয়ির ইতিহাস, ক্ষমতা দখল এবং ষড়যন্ত্রের ইতিহাস।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে লিয়াকত আলী নিহত হবার পর নাজিমউদ্দীন গভর্নর জেনারেলের পদ ছেড়ে নেমে এলেন প্রধানমন্ত্রীর পদে। গভর্নর জেনারেল হলেন পাঞ্জাবের গােলাম মহম্মদ। কেন্দ্রে তখন থেকেই পাঞ্জাবীদের ব্যাপক আধিপত্য শুরু হলাে।
‘৫২ সালের ১৭ এপ্রিল গােলাম মহম্মদ প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনকে বরখাস্ত করে বসলেন অকস্মাৎ। পাকিস্তান তখনাে ব্রিটিশ ডােমিনিয়ন। নাজিমউদ্দিন তাই মরিয়া হয়ে একবার রানীর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফোন করতে গিয়ে দেখলেন লাইন কাটা। নাজিমউদ্দিন যেদিন বরখাস্ত হন তার আগের দিন ওয়াশিংটন থেকে হঠাৎ বগুড়ার মহম্মদ আলী এসে পৌঁছলেন করাচি। গােলাম মহম্মদ কোনাে অদৃশ্য প্রভাবে নাজিমউদ্দীনকে সরিয়ে মহম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন বাদেই চৌধুরী মহম্মদ আলী কমান্ডার-ইন-চীফ জেনারেল আয়ুব খানকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকাতে। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন আসেন-করাচিতে। শুরু হলাে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার মিতালি। ‘৫২ সালের মে মাসে সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে চুক্তি হলাে। সেপ্টেম্বরে ‘সিয়াটো’ এবং ‘৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাগদাদ’ এবং ‘৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাগদাদ প্যাক্ট (পরে সেন্টো নাম হয়) যােগ দিল পাকিস্তান। পরিবর্তে মহম্মদ আলী আমেরিকাকে গিলগিট এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সামরিক এবং গুপ্তচর ঘাঁটি খােলার অনুমতি দিলেন।
এদিকে পূর্ব বাঙলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভাঙার জন্য গােলাম মহম্মদ এবং মহম্মদ আলী সুযােগের অপেক্ষা করছিলেন। ‘৫৪ সালের জুন মাসে নয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতার কাছে হকসাহেব বললেন, মন্ত্রিসভার প্রথম কাজ হবে স্বাধীনতা আদায় করা। হক সাহেবের এই কথা কেন্দ্রীয় সরকারকে মন্ত্রিসভা ভাঙার ব্যাপারে অজুহাত দেখানাের সুযােগ এনে দিল। হক মন্ত্রিসভা বাতিল করে গভর্নরের শাসন চালু করা হলাে ৩০ শে। অবশ্য কার্যত গভর্নরের শাসন চালু হয়ে গিয়েছিল ১৭ মে। গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং চীফ সেক্রেটারী হাফিজ ইসহাক ৯২-ক ধারা জারির বিরােধী ছিলেন বলে গােলাম মহম্মদ তাদের সরিয়ে যথাক্রমে প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারী মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের সেক্রেটারী এন এম খানকে বহাল করেন। গভর্নর হয়েই মির্জা হপ্তখানেকের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করলেন। হক সাহেবকে তার কে এম দাস লেনের বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখলেন। অত্যাচার এবং নির্যাতনের চূড়ান্ত করে ছাড়লেন মির্জা। এক সময় কমুনিস্টপার্টির সঙ্গে যাঁদের কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিল তাদের স্বল্পসংখ্যকই মির্জার নির্যাতন থেকে রেহাই পেলেন।
গােলাম মহম্মদ নিজের গদি কায়েমী করে রাখার জন্য বহু চক্রান্ত করে ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিকে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি ইউনিটকে একটা ইউনিটে পরিণত করার বিল পাশ করালেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে এই এক ইউনিট ভাঙার জন্য তুমুল আন্দোলন হয়। আয়ুবও তা ভাঙেননি। শেষটায় ইয়াহিয়া এক ইউনিট ভেঙে পশ্চিম পাকিস্তানকে পাঁচটি ইউনিটে বিভক্ত করেন। ‘৫৫ সালের আগস্ট মাসে গােলাম মহম্মদ বগুড়ার মহম্মদ আলীকে সরিয়ে পাঞ্জাবী-তনয় চৌধুরী মহম্মদ আলীকে এনে বসালেন প্রধানমন্ত্রীর পদে। মির্জা পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এলেন। যােগ দিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। এই মির্জাই গােলাম মহম্মদকে চক্রান্ত করে সরিয়ে দিয়ে নিজে গভর্নর হয়ে বসলেন শেষটায়। ১৯৫৬ সালের মার্চে নতুন শাসনতন্ত্র চালু হলাে। মির্জা কৌশলে নিজেকে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে নিলেন। মির্জা ‘৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাবের চৌধুরী মহম্মদ আলীকে সরিয়ে সুহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করলেন। সুহরাওয়াদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই পূর্ববঙ্গে কৃষক-প্রজা পার্টির আবুহােসেন মন্ত্রিসভা সরিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা কায়েম করলেন। ৯২ ক ধারা তুলে নেওয়ার পর পূর্ব বাঙলার আগেকার যুক্তফ্রন্ট আর ক্ষমতায় ফিরে আসেনি। এই যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন শরিক দলে ততদিনে জোর রেষারেষি শুরু হয়ে গেছে।
সুহরাওয়ার্দী আগে এক ইউনিট এবং সিয়াটো যুদ্ধ-চুক্তিজোটের বিরােধী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই ভুলে গেলেন সব। আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে এই নিয়ে মতভেদ দেখা দিল। সদস্যরা ভাসানী এবং সুহরাওয়ার্দী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কাগমারী (সন্তোষ) সম্মেলনে তার প্রথম প্রকাশ ঘটল। ‘৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল মিটিং এ সুহরাওয়ার্দীর সমর্থকরা কালাে শেরােয়ানি এবং চুড়িদার পায়জামা পরে আলাদাভাবে বসে ছিলেন। ভাসানী সেখানে সুহরাওয়ার্দীকে পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। সেখানে তিনি আরও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শশাষণ চলছে। শশাষণ চলতে চলতে এমন একটা দিন আসবে যখন পূর্ব পাকিস্তানের লােক পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইবে।’ তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন দাবি করেন।
ভাসানী আরও অভিযােগ করলেন, সুহরাওয়ার্দী পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে দলের নির্দেশ মেনে চলছেন না এবং কাশ্মীর প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তােলার চেষ্টা করছেন।
৩ এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদে মৌলানা ভাসানীর সমর্থক অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একটি বেসরকারী প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। প্রস্তাবে প্রাদেশিক সরকারকে মুদ্রা, বৈদেশিক নীতি এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাদবাকি বিষয়ে প্রদেশগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাতে বলা হয়। সুহরাওয়ার্দীর সমর্থক শেখ মুজিব, বিরােধী দলের নেতা আবু হােসেন সরকার প্রস্তাবটি সমর্থন করলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বসে রইলেন গিয়ে নিজের ঘরে।
পশ্চিম পাকিস্তানে সুহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার গােলাম আলী খান তালপুর এই প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে বললেন, পূর্ব বাঙলাকে বিচ্ছিন্ন করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার সর্বরকম প্রচেষ্টা সরকার শক্ত হাতে দমন করবে। সুহরাওয়ার্দী নিজেও প্রস্তাবটিকে ‘স্টান্ট’ আখ্যা দিয়ে বললেন, “আমি মনে করি না প্রস্তাবটির প্রতি জনগণের সমর্থন আছে।’
সুহরাওয়াদী এক ইউনিট পর্যন্ত ভাঙার বিরােধিতা করেছিলেন। অথচ আশ্চর্য, সেই সুহরাওয়ার্দীর গােড়া সমর্থক শেখ মুজিবই সুহরাওয়ার্দীর নিন্দিত এই প্রস্তাবই ছয়-দফার আকারে পেশ করে গণআন্দোলনে নামেন; এক ইউনিট ভাঙার দাবি জানান। এই ছয় দফার প্রশ্নেই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেন এবং ওই ছয়-দফার, প্রশ্নেই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার জন্যই আওয়ামী লীগ, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ গঠন করেন। মৌলানা ভাসানী কাগমারি সম্মেলনের ভাষণই সত্যি হলাে শেষ পর্যন্ত। সেই জন্য আমি বলি, শেখ মুজিবের মানসিকতার সঙ্গে যত না সুহরাওয়ার্দীর মিল, তার চেয়ে বেশি মিল মৌলানা ভাসানীর।
যাক। আগেকার প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাচ্ছি। ১৩ জুন শেখ মুজিব ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মীটিং ডাকলেন। নানান কায়দা-কানুন করে সুহরাওয়ার্দীর দল নিজেদের পছন্দমাফিক প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিলেন। ভাসানীর দল তখন নতুন দল গড়লেন। দলটির নাম হলাে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পশ্চিম পাকিস্তানে এর আগেই সীমান্ত গান্ধীর ‘খুদায়-ই-খিদমতগার, মিয়া ইফতিখার উদ্দীনের আজাদ পাকিস্তান পাটি, সিন্ধুর জি এম সৈয়দের আওয়াম-ই-মাহাজ এবং আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা মাহমুদুল হক ওসমানির দল মিলে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি গঠন করে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা ভাসানীর সমর্থকরা ওই ন্যাপের সঙ্গে যােগ দিলেন। মৌলানা ভাসানী হলেন নিখিল পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি। এই দলটির মধ্যে অবিভক্ত ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির বহু সদস্যও ছিলেন। দেশভাগের পর কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষে প্রকাশ্যে কাজকর্ম চালানাের ব্যাপারে কতগুলি অসুবিধা দেখা দেয়। তাই তারা যুব লীগ এবং আওয়ামী লীগে ঢুকে গিয়েছিলেন। ওই সব ক্যুনিস্ট পার্টির অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন হিন্দু। তাই পূর্ব বাঙলায় ন্যাপের প্রধান সমর্থক হয়ে দাঁড়াল হিন্দুরা। ন্যাপের অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল ভূমিকার জন্যই প্রধানত হিন্দুরা ন্যাপের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সুহরাওয়ার্দী পরিচালিত আওয়ামী লীগকে হিন্দুদের সমর্থন না করার আর একটি প্রধান কারণ, সাধারণভাবে পূর্ব বাঙলা হিন্দুদের মনে আজও বিশ্বাস, ‘৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গার জন্য দায়ী ছিলেন সুহরাওয়ার্দী। কিন্তু পরবর্তীকালে সুহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর নতুন কর্মসূচী নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হলাে। তখন আর আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে হিন্দুদের পক্ষে বাধা রইল না।
‘৫৭ সালের অক্টোবরে মির্জা সুহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে চুন্দ্রীগড়কে এনে প্রধানমন্ত্রীর তখুতে বসালেন। বেশিদিন থাকতে পারলেন না চুন্দ্রীগড়। বিদায় নিতে হলাে তাকেও। এবার এলেন ফিরােজ খান নূন। | কেন্দ্রের মন্ত্রিসভার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মন্ত্রিসভারও অদল-বদল হয়ে চলছিল ক্রমাগত। ফিরােজ খান নূন ফজলুল হককে পূর্ব বাংলার গভর্নর করলেন। গভর্নর হয়ে হকসাহেব আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে নিজের দলের আবু হােসেন সরকারকে নিয়ে এলেন ক্ষমতায়। নূন-মন্ত্রিসভা থেকে সুহরাওয়ার্দী নিজ দলের সমর্থন তুলে নেওয়ার হুমকি দিলেন। ফিরােজ খান নৃন বাধ্য হয়ে ফজলুল হককে গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে হামিদ আলীকে গভর্নর করে পাঠালেন। হামিদ আলী এসেই আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে আতাউর রহমানকে স্বস্থানে ফিরিয়ে আনলেন। ১৮ জুন পরিষদে সরকারপক্ষের একটি প্রস্তাবে ভােটে পরাজিত হলাে। পরদিন আতাউর রহমান পদত্যাগ করলেন। মন্ত্রিসভা গঠন করতে আবার আবু হােসেন সরকারের ডাক পড়ল। তিনদিন বাদেই শেখমুজিবুর রহমান আবু হােসেন সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। প্রস্তাবটি পাশও হয়ে গেল। ২৩ জুন পদত্যাগ করলেন আবু হােসেন সরকার। ২৫ জুন কিছু সময়ের জন্য প্রেসিডেন্টের শাসন চালু হলাে। প্রেসিডেন্ট শাসন তুলে নেওয়ার পর আওয়ামী লীগকে আবার মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য ডাকা হলাে। স্পীকার আবদুল হামিদ ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির। আওয়ামী লীগ আবদুল হামিদকে সরাতে চাইলেন, কৃষক-শ্রমিক পার্টি বাধা দিল পরিষদে দুই-দলের সংঘর্ষের পরিণতি ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মৃত্যু। ঘটনাটি হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হলাে। ২৭ তারিখে আয়ুব মির্জাকে হটিয়ে পুরােপুরি নিজের হাতে ক্ষমতা দখল করে নিলেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম অধ্যায় শেষ হয়ে শুরু হলাে দ্বিতীয় অধ্যায়। একটানা দশ বছর রাজত্ব চালিয়ে গেলেন আয়ুব।
সামরিক শাসন কারু পক্ষে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আয়ুবের ক্ষমতায় আসাটা পাকিস্তানের পক্ষে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছিল পরম আর্শীবাদ স্বরূপ। আর্থিক দিক দিয়ে পাকিস্তানের যা কিছু উন্নতি তার প্রায় বেশিটাই হয়েছে আয়ুবের আমলে, পূর্ব বাঙলার দূর গ্রামাঞ্চলে ও তার আমলে প্রচুর রাস্তাঘাট তৈরি হয়। যােগাযােগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটে তার আমলে। অবশ্য সন্দেহ নেই নিজের স্বার্থ কায়েমী করার জন্যই আয়ুব বুনিয়াদী গণতন্ত্রী সদস্যদের মাধ্যমে এই সব উন্নয়নমূলক কাজ করান।
আর্থিক উন্নতি থেকে বড়াে কথা আয়ুব দুর্নীতিপরায়ণ কিছু রাজনীতিককে হটিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিকে অনেকটা কলুষমুক্ত করেছিলেন। যদিও আয়ুব তা নিজেরই প্রয়ােজনে করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ফল হয়েছিল কল্যাণকর।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাে এতদিন নিজেদের মধ্যে খেয়ােখেয়ি করে যাচ্ছিলেন। আয়ুবকে তখতে কায়েমী হয়ে বসতে দেখে নিজেদের স্বার্থেই তারা আবার একত্রিত হলেন। তাদের এই সম্মিলনের ফলেই আয়ুবী আমলে বিভিন্ন গণআন্দোলন এত তীব্র, এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল।
একটা প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে, আয়ুবের আমলে কি বৈষম্য ছিল না? ছিল। বৈষম্য তাে সুহরাওয়ার্দী মহম্মদ আলীর সময়ও ছিল। তখন তাে বিক্ষোভ হয় নি। আমার বক্তব্য, আয়ুবী আমলে বিক্ষোভের জন্যে যতটা না পূর্ব-পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য দায়ী তার চেয়েও বেশি দায়ী আয়ুবের কায়েমী হয়ে গদীতে আসীন থাকাটা। এবং দায়ী তার পুত্র গওহর আয়ুব ও অন্যান্য আৰীয়-পরিজনের অত্যাচার এবং স্বেচ্ছাচারিতা।
আয়ুবী আমলে কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে, ‘৬২ সালের সেপ্টেম্বরের ছাত্র-আন্দোলন, ‘৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ ‘৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলন আয়ুবের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবউদ্দীনের রবীন্দ্রবিরােধিতা, ভুট্টোর রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ ও প্রস্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ‘৬৯ সালের প্রচন্ড গণ-বিক্ষোভ।
‘৬২ সালের সেপ্টেম্বরের ছাত্র-আন্দোলন হয়েছিল প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিলের দাবিতে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরী। ছাত্রদের দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করায় আয়ুব আজম খানকে পূর্ব বাঙলার গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে নেন ‘৬২ সালে। তার জায়গায় এলেন মােনেম খান। ‘৬৬ সালে শুরু হলাে ছয়-দফা আন্দোলন। ৭ জুন ছয়-দফার সমর্থনে জনমত যাচাই এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা পুর্ব বাঙলায় ধর্মঘট পালিত হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে ১৩ জন প্রাণ দেয়। ওই দিন প্রথম শহীদ হন তেজগার মনু মিয়া। শেখ মুজিব তখন জেলে।
এর আগেই পাকিস্তানে আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে। ‘৬৪ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং অন্যান্য চীনা নেতা পাকিস্তান পরিদর্শনে যান। তারপর থেকেই চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়।
তারপর ‘৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকভারত যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যুদ্ধের প্রভাব পড়ে। চীনের সঙ্গে মিতালি, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হওয়া, গণ-বিক্ষোভ দমাতে ক্রমাগত সৈন্য তলব করা এবং দুর্নীতির প্রশ্রয় দেবার জন্য সেনাবাহিনীর একাংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তারা আয়ুবকে হটানাের ষড়যন্ত্র করছিল। খবর পেয়ে আয়ুব ১১ জন জেনারেল এবং ২৯ জন কর্নেলকে বরখাস্ত করেন।
‘৬৮ সালের ১ জানুয়ারি সরকারিভাবে দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিব এবং আরও ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অভিযােগ, শেখ মুজিব কয়েকটি দূতাবাসের সাহায্যে, বিশেষ করে ভারতীয় দূতাবাসের যােগসাজসে কিছু সামরিক অফিসার এবং কয়েকজন সি-এস-পি অফিসারের সাহায্যে পূর্ব, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কমান্ডাে স্টাইলে আক্রমণ করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন। শেখ মুজিবের কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকর্মী অস্ত্রলাভের আশায় আগরতলায় গিয়ে ভারতের কয়েকজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করে এসেছেন। সেজন্য সাধারণভাবে এই মামলার নাম দেওয়া হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা মামলা দায়ের করে আয়ুব শেখ মুজিবকে তাঁর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। এই মামলা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এনে দিল। সত্যি-মিথ্যা যাই হােক, এই মামলার বিষয় বস্তু আংশিক সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তাই তার সম্পর্কে লােকের শ্রদ্ধা রাতারাতি বেড়ে যায়।
তা ছাড়া শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি প্রাপ্তবয়স্কের ভিত্তিতে নির্বাচন স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি এগারাে-দফার দাবিতে ব্যাপক গণ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। পশ্চিমে আটষট্টির গণ-বিক্ষোভের সূচনা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ঢাকার ছাত্ররা পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের আন্দোলনের সুযােগটা পুরােপুরি গ্রহণ করলেন। ক্রমে পূর্ব বাঙলার আন্দোলন দূর্বার হয়ে উঠল। ছাত্ররা শুধু শেখ মুজিব নয়, সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করলেন। কিন্তু মুজিবের মুক্তির দাবিটাই সব থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়ে গেল। সে সময় ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ছিল। সংবাদ-ই ছিল গণ-আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার। শেখ মুজিবরের পিছনে সংবাদেরও অনেকখানি দান আছে।
আগেই বলেছি, ঢাকার ছাত্ররা লড়াই করছিল এগারাে দফার দাবিতে। এগারাে দফা প্রকৃতপক্ষে ছয়দফারই ব্যাখ্যা। সেখানে দাবিগুলি সুনির্দিষ্ট। এগার দফার রচয়িতা উনসত্তরের ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ। এতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র লীগের সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মহম্মদ আলী; পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা: পুর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার, সহ-সাধারণ সম্পাদিকা দীপা দত্ত; জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি (দোলন গ্রুপ) মাহবুবুল হক দোলন এবং তার সাধারণ সম্পাদক; ডাকসুর সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী।
প্রথা অনুযায়ী, ডাকসুর সহ-সভাপতি ছাত্রদের সকল সভায় সভাপতিত্ব করেন। সেই হিসেবে ছাত্র লীগের তােফায়েল আহমদও বিভিন্ন সভায় সভাপতিত্ব করেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তােফায়েল আহমদ এবং সেই সঙ্গে ছাত্রলীগ প্রাধান্য পেয়ে যায়। কিছুটা সে কারণে রাজবন্দীদের মুক্তি দাবির তালিকায় শেখ মুজিবের নাম সকলের আগে স্থান পায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসাবেও তার মুক্তির দাবি প্রাধান্য পায়। এই সময় সমস্ত বিরােধী দলগুলি একত্রিত হয়ে আয়ুবের বিরুদ্ধে লড়ছিল বলে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সকলেরই মুক্তির দাবি হয়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনে গােড়ায় ন্যাপের দুই গ্রুপের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ন্যাপ ‘৬৮ সালে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ন্যাপ ভাসানীপন্থী এবং মুজাফ্ফর আহমদপন্থী—এই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। মুজাফফর আহমদ রুশপন্থী এবং ভাসানী চীনপন্থী বলে পরিচিত হন। আসলে ভাসানী কিন্তু চীনপন্থী ছিলেন না। তিনি শুধু চীনপন্থী বলে পরিচিত হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযােগটা নেন। প্রধানত ছাত্র লীগের তােফায়েল আহমদ এবং আবদুর রউফের প্রচেষ্টায় আন্দোলনের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ প্রাধান্য পেতে থাকে। তােফায়েল আহমদ তাে অ্যাকটিং গভর্নরই আখ্যা পেয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখা এবং জনপ্রিয় করার পিছনে আরএকজনের অশেষ দান রয়েছে। তার নাম আমেনা বেগম। তিনি ঝড়ের বেগে একটার পর একটা সভা করে গেছেন সেই সময়। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন।
উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর সামসুজ্জোহা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক (ক্যান্টনমেন্টের ভিতর তাঁকে গুলি করে মারা হয়) আসাদ,মনির, মতিয়ুর, রুস্তম প্রমুখের নাম পরবর্তী সময়ে বেশি উল্লেখিত হতে থাকে।
‘৬৯ সালের ২৫ মার্চ আয়ুব গিয়ে ইয়াহিয়া এলেন। শুরু হলাে পাকিস্তান ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায়। ইয়াহিয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর প্রাপ্তবয়স্কের ভিত্তিতে নির্বাচন করেন। শেখ মুজিবের দল জাতীয় পরিষদে ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি আসন পেলেন। এই জয়ের পিছনে শেখ মুজিবের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই মূল কারণ। সােহুরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও পুনর্জন্ম ঘটেছে। দীর্ঘদিন জেলে থেকে থেকে, ছাত্র এবং জনতার দুর্বার আন্দোলনের ফলে মুক্তি পেয়ে জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর আত্মশুদ্ধি ঘটেছে। তিনি বাঙলাকে ভালােবাসলেন নিবিড় করে। তাই ‘৭০এর নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শেখ সাহেবকে ভােট দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে ৬ জুন শেখ সাহেব দলের বিস্তারিত কর্মসূচি প্রকাশ করেন। তাতে কী কী প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিল, উল্লেখ ছিল শিল্পের মালিকানা শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হবে। এই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও তাদের সাফল্যের আর-একটি কারণ। অবশ্য সেই সব কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা আওয়ামী লীগের বর্তমান সংগঠন দিয়ে সম্ভব হতাে কি না—এ প্রশ্নে সন্দেহের অবকাশ আছে।
এই সময় ন্যাপ থেকে হিন্দুদের সরে আসার একটি প্রধান কারণ ভাসানীর ভারত-বিরােধী এবং খানিক সাম্প্রদায়িক জিগির। ভাসানীর আজ এক কথা কাল এক কথা বলার জন্যে ন্যাপে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। মুজাফফর ন্যাপ নির্বাচনের জন্য নিজেদের সংগঠিত করতে পারেনি। নির্বাচনে যােগ দেওয়ার প্রশ্নে এবং ভাসানীর আবােল তাবােল বকার জন্য ভাসানী ন্যাপ থেকে হক-তােয়াহা মেনন-জাফর, মতিন শিকদারের দল বেরিয়ে গিয়ে মার্কসবাদ-লেলিনবাদী দল গঠন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলাে হক-তােয়াহার দল। প্রত্যেকটি দলেরই বক্তব্য, এখানকার নকশাল পন্থী দলেরই মতাে। সি পি আই এম(এলের) চেয়ারম্যান শ্রীচারু মজুমদার তাদেরকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। হক-ততায়াহার ছাত্র প্রতিষ্ঠানে আছেন দীপা দত্ত ও চট্টগ্রামের দীলিপ বড়য়া। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, নির্বাচনের পূর্বে যে ভাসানী বলেছিলেন, কেয়ামত পর্যন্ত পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে, সেই ভাসানীই নির্বাচনের ফল দেখে বললেন, আমাদের এখন একটাই দাবি—স্বাধীনতা। ভাসানী কী, কোপন্থী—এ নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক তিনি যে কৃষক শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের বন্ধু তাতে সন্দেহ নেই।
দেখা যাচ্ছে, আজকের এই মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি একদিনে বা কোনাে রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংস্থার একক প্রচেষ্টায় হয়নি। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অবদান রয়েছে এতে।
আয়ুবী আমলে খাজা শাহাবউদ্দিনের এবং মােনেম খানের রবীন্দ্র-বিরােধিতার ফলে পূর্ব বাঙলায় রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বেশি। বাঙালি জাতীয়তাবাদীর চেতনা বিকাশে সে সময়কার আন্দোলন একটি বিশিষ্ট পর্যায়। পূর্ব বাঙলার গণ-চেতনা জাগরণে শিল্পী-সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সাংবাদিকদের অবদান বিশেষ উল্লেখযােগ্য। ডক্টর শহীদুল্লাহ, ডক্টর কাজী মােতাহের হােসেন, ডক্টর কুদ্রত-ই-খুদা এবং তাঁদের উত্তরসুরী সিকান্দর আবু জাফর, শামসুর রাহমান, বেগম সুফিয়া কামাল, বদরুদ্দীন উমর, সৈয়দ আলী আহসান, জসিমউদ্দীন, শহীদুল্লাহ কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, খন্দকার ইলিয়াস, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজাবশীর, হামিদুর রহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডল, ওয়াহিয়ুল হক, সনজিদা খাতুন, আতিকুল, ইসলাম, কামাল লােহানী, আনােয়ার জাহিদ কে জি মােস্তফা আরও অনেকের পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। স্থানাভাবে আমি কয়েকজনের নাম মাত্র উল্লেখ করলাম, যাদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
আমার বিশ্বাস, এত মানুষের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম বৃথা যেতে পারে না, মুক্তির সংগ্রামে বাঙলাদেশ জয়ী হবেই।

দেশ : ১৮ আষাঢ় ১৩৭৮
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!