You dont have javascript enabled! Please enable it! নিহত অধ্যাপকের স্মরণে - সংগ্রামের নোটবুক

নিহত অধ্যাপকের স্মরণে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আত্মভােলা দার্শনিক ড. গােগাবিন্দচন্দ্র দেব আজ আর ইহলােকে নেই। পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারির নিধনযজ্ঞেও তিনি আত্মাহুতি দিয়েছেন। এক বিদেশী দার্শনিক ড. দেবকে “সক্রেটিস” বলে অভিহিত করেছিলেন। দার্শনিক আলােচনায় সক্রেটিস ড. দেবকে প্রেরণা দিয়েছেন। ড. দেব বলতেন, “তিনিই আমার পথিকৃত, দিশারী।” ড. দেবকে আমি খুব কাছে থেকে জানার সুযােগ পেয়েছিলাম। তার মৃত্যুতে সমস্ত পাকিস্তান হারালাে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক এবং একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিককে। আমি একবার তাকে বলেছিলাম, “স্যার আপনি কলকাতায় গেলে তাে অনেক বেশী সুযােগ সুবিধা পেতে পারেন এবং নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারেন।” তিনি আমার ওপর ভীষণ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি অত বড় স্বার্থপর নই। পাকিস্তান ছেড়ে আমি কোথাও যাবাে না। মরতে হয় পাকিস্তানেই মরবাে।” ড. দেব ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। তার সারা ঘরময় ছড়ানাে থাকতাে দর্শনের রাশি রাশি বই। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে বই মাথায় দিয়েই ঘুমিয়ে পড়তেন। তিনি দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ঐ কলেজের অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি বহুদিন। ড. দেবের সুনাম যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তিনি আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এবং জগন্নাথ হলের প্রভােসট। ড. দেব ছিলেন পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেসের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সম্পাদক। বিশিষ্ট দার্শনিক হিসাবে তার খ্যাতি প্রসারিত হয়েছিল প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে। দর্শনশাস্ত্রে তাঁর নিজস্ব দান প্রচুর। তিনি ছিলেন সৃজনশীল লেখক ও দার্শনিক। একদিকে যেমন পাণ্ডিত্য ছিল পাশ্চাত্য ও ভারতীয় দর্শনে, অপরদিকে তেমন পাণ্ডিত্য ও শ্রদ্ধা ছিল ইসলামিক দর্শন ও ইতিহাসে। তার কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম- ‘আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস’, ‘আইডিয়ালিজম: এ নিউ ডিফেনস অ্যান্ড এ নিউ অ্যাপ্লিকেশন’, ‘আমার জীবন দর্শন’। এছাড়াও তার প্রচুর ইংরেজী এবং বাংলায় লেখা দার্শনিক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়ানাে রয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকাতেও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও মানবসমাজের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি চিন্তা করতেন। আজীবন দর্শনের সেবক, দর্শনের পেছনে ছুটতে ছুটতে ড. দেব নিজের ঘরবাড়ির খোঁজখবর রাখতে পারেননি। তাই তিনি ছিলেন অকৃতদার। আজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ড. দেবও নেই। নেই আরও অনেক স্বনামধন্য অধ্যাপক-জয় বাংলার মণি-মুক্তা-মাণিক্য।
—আনন্দ বকসি, গড়িয়া।

ড. হবিবুল্লা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত নজন শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ইয়াহিয়ার জঙ্গীদের হাতে নিহত হয়েছেন কাগজে এই খবর দেখলাম। ড. হাবিবুল্লাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ইতিহাসে তার পারঙ্গমতার কথা সকলেই জানেন, সেই সঙ্গে আর একটি কথা আমি যােগ করতে চাই, এমন স্বচ্ছ দৃষ্টি ও উদার ভাবনার মানুষ কোনও দেশেই খুব বেশী দেখা যায় না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কোনও সংকীর্ণ খন্ড বুদ্ধির কাছে তিনি কখনও মাথা নােয়াননি। মাত্র কয়েক মাস আগে ঢাকার এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ থেকে বই আনবার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা তুলে দিতে হবে না হইলে গবেষণার কাজ ব্যাহত হতে বাধ্য। নিজের প্রাণ দিয়ে সেই দাবির মূল্য তাকে দিতে হল।
-নিরূপম চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা ৯-।

আমরাও সহযােদ্ধা
বাংলাদেশ বিপন্ন। এ অবস্থায় আমরা ভারতীয় বাঙ্গালিরা কি হাত-পা গুটিয়ে চুপ করে থাকবাে। জানি, আন্তর্জাতিক আইনের অনেক বিধি নিষেধ আছে। কিন্তু প্রতিবেশীর ঘরে ডাকাত পড়লে কিংবা আগুন লাগলে কি আমরা আইন কানুনের কথা ভেবে অনধিকার প্রবেশের অজুহাতে থাকি, না থাকতে পারি। সমস্ত দ্বিধা সংকোচ দূর করে নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশকে আমাদের চোখের মণির মত করতে হবে এবং সর্বপ্রকার সাহায্য দেবার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আপাতত নিম্নলিখিত চারটি উপায়ে আমরা সাহায্য দিতে পারি-
১. শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আইনসম্মত সরকারকে
অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের জন্য শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলন আরম্ভ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে বিশ্বের
জনমত সংগঠনে সচেষ্ট হতে হবে।
২. আমাদের সকলের একদিনের বেতন বা উপার্জন দান করে সেই অর্থে অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ থেকে শুরু করে ঔষধপত্র এবং চিকিৎসার সর্বপ্রকার সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পাঠাতে হবে। প্রয়ােজনবােধে বারবার এই উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
৩.ভিয়েতনামের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য যেমন আমরা রক্তদান করেছিলাম, তেমনি বাংলাদেশের। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রক্তদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. সীমান্তের খুব নিকটে অস্থায়ী হাসপাতাল এবং সাহায্যদানের কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যুবক বন্ধুদের নিকট আমার বিনীত নিবেদন, আপনারা বাড়িতে খুননাখুনি ও সন্ত্রাস বন্ধ করুন। স্বাধীন বাংলাদেশের ভাইবােনেরা যখন গণতন্ত্ররক্ষার জন্য হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, আর আমরা তখন গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য হিংসার আশ্রয় নিয়ে উন্মত্ত হত্যালীলায় লিপ্ত হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন অকারণে মানুষ খুন হচ্ছে। সদ্যনির্বাচিত বিধান সভার সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, কেরাণী, দোকানদার কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। ওপার বাংলার যুবকেরা যখন মানবতার আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরে মাতৃহীন প্রাণের পরিচয় দিচ্ছেন, এপার বাংলার কিছু বিভ্রান্ত যুবক তখন সমস্ত মানবিক আদর্শ আর মূল্যবোেধ বিসর্জন দিয়ে গােপন হিংসার পথে অন্ধ আক্রোশ মেটাচ্ছেন। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার যুব মানুষের মধ্যে এত বৈষম্য এত ব্যবধান বােধ হয় আর কখনও দেখা যায়নি।
-মিছির মুখখাপাধ্যায়
অধ্যাপক, শ্রীচৈতন্য বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়, চব্বিশপরগণা।

ক-দিন ধরে জোর হাওয়া দক্ষিণ থেকে, বাইরে ওড়ে ধুলা আর শুকনাে পাতা, টেবিলের কাগজপত্র ছত্রখানজোর হাওয়া যেমন বইতাে মস্ত ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে পুরানা পল্টনে, চৈত্রমাসের সবুজ কোনাে সকালবেলায়। সবুজ হয়ে ছড়িয়ে আছে রমনা , আমার উনিশ বছরের বয়সের মতাে সবুজ। শান্ত নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছি, আমার ডানে-বায়ে বাগান আর ছবির মতাে একাট দুটি বাড়ি। চুপচাপ শুধু সাইকেলের ঘন্টি মাঝে মাঝে, আর গাছপালায় ঝিরঝির শিরশির। আমার চোখ জুড়ে রােদুর মাখা আকাশ, আমার মনের মধ্যে বাতাস বয়ে যায় ভবিষ্যৎ। আর আজ আমি শুনছি সে সব রাস্তায় সাঁজোয়াবাহিনী। আর বন্দুক আর ধ্বংস আর উন্মত্ততা। গুড়িয়ে যায় হাজার হাজার ভবিষ্যত, আগুন জ্বলে রক্ত রঙ্গা প্রচন্ড ।

প্রতিশােধের একদিক
আমার বাড়ি থেকে ঢাকা বিমানবন্দর-আগাগােড়া পথটাই মানুষের কবর। রাস্তার দূরের গলিগুলাে মৃতদেহে বােঝাই-অধিকাংশ নারী আর শিশু। শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে ১০১ জন বিদেশী বিমানে সিঙ্গাপুরে এসে পৌছেন। তাদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ মহিলা সাংবাদিকদের একথা জানিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩ লক্ষ লােকের মৃত্যুর খবর কোনাে অতিরঞ্জন নয়। অপরপক্ষে বিমান বহরের একজন অফিসারকে বলেছিলাম, শিশুদের মরতে হলাে কেন? অনাথ শিশুদের রাখলে তারাও বড় হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী বিরােধী হবে। অধিকাংশ উদ্বাস্তু সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চাননি। যারা বলেছেন, নাম বলেননি। বন্দুকের নল উঁচিয়ে আমাদের বলা হয়েছে-পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বাইরে বলবেন না। বললে আর পাকিস্তানে আসতে দেওয়া হবে না।
-এ পি

সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯