মনে রাখবেন, ওদিকে জীবন মরণের যুদ্ধ
আমরা আজ সীমান্তে গিয়ে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের মুখ থেকেই শােনা যে,তারা কি সাহায্য প্রত্যাশা করেন আমাদের কাছ থেকে। তারা দুটি কথার উপর জোর দিলেন। প্রথমত প্রতিদিন পশ্চিম বাংলা থেকে কৌতূহলী এবং সহানুভূতিসম্পন্ন হাজার হাজার স্ত্রী-পুরুষ-কিশাের-বালক দলে দলে “বাংলাদেশে গিয়ে প্রবেশ করেছেন, আর স্বচক্ষে সব দেখবার আশায় ঘুরে বেড়িয়ে আসছেন। একজন প্রতিনিধি যন্ত্রনায় তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “আমরা এখন যে জীবনমরণ যুদ্ধে জড়িয়ে আছি, তার গুরুত্ব যেন এরা বুঝতে পারছেন না। এটা প্রায় প্রহসন মনে হচ্ছে। আপনারা এটাকে ঠেকান।” আমাদের কথা জনসাধারণ শুনবেন এত বড় প্রত্যাশা নেই। তবু আমরা আনন্দবাজার পাঠকদের কাছে আবেদন জানাই, তাঁরা সবাই মিলে চেষ্টা করুন যেন অযথা ভীড় বাড়িয়ে আমরা “বাংলাদেশের যুদ্ধরত মানুষদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে না তুলি। দ্বিতীয়ত ওঁরা যে সাহায্য এখন চান, তাহলে লড়াই করবার হাতিয়ার। যদি আমরা তা সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দিতে পারি, তবেই আমরা তাদের দুঃসময়ের বন্ধু বলে প্রমাণ দিতে পারব। তারা বললেন, “আপনারা বােমা পেটো এসব দেবেন না। একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে হয়রান করবার কাজ বােমা পেটোয় চলে ও দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয় না, এটা আপনাদের বােঝা দরকার। বুলেট, ডিনামাইট এসব পারবেন কি দিতে ?” সেগুলিও কিন্তু যার তার হাতে পড়লে বিপদ। East Pakistan Rifles-এর Camp এ সে সব পৌছে দিতে পারলে তবেই যথার্থ যুদ্ধের সাহায্য হবে। নয়ত অবাঞ্ছিত হাতে পড়ে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। আমরা যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে পারি, যদি উপযুক্ত হাতিয়ার না দিতে পারি, তবে যেন অন্তত কালাে ব্যাজ ঝুলিয়ে “জয় বাংলা” হাঁক ছেড়ে ভীড় না বাড়াই। জঙ্গী-বাহিনীর সঙ্গে শ্লোগান দিয়ে লড়া যায় না, একথা এই বাংলায় আমরা কবে বুঝব? আপনারা দয়া করে কথাগুলি পশ্চিম বাংলার মানুষদের কাছে পৌছে দেবেন কি?
– মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ূব, কলকাতা-১৭
আকাশবাণী থেকে মাঝে মাঝে এখনাে স্বাধীন বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এখনি স্বাধীন বাংলা’ বলতে যদি নীতিগত বাধাও থাকে, তাহলেও পূর্ব বাংলা বা “বাংলাদেশ” বলতে তাে বাধা থাকা উচিত নয়। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীও পূর্ব পাকিস্তান না বলে পূর্ব বাংলা বলেছেন। তাহলে আকাশবাণীর দ্বিধা কেন? বাংলায় ঘন ঘন সংবাদ প্রচার ছাড়াও আকাশবাণী থেকে এখন উর্দুতেও দু-একবার সংবাদ প্রচার করলে ভালাে হয়। একথা ভুললে চলবে না, পূর্ব বাংলায় যে সামরিক বাহিনী অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত, তারাও আসলে মুস্টিমের শােষকগােষ্ঠীর আজ্ঞাবাহী বেতনভূক্ত সৈনিকমাত্র। তারাও প্রকৃত ঘটনার কিছু খবর জানে না, জানতে দেওয়া হয় না। পূর্ব বাংলার মুক্তি সেনানীর সংগ্রামের বীরত্ব ও ন্যায্য দাবির কথা যদি ঐ বেতনভুক্ত সৈনিকরা জানতে পারে, তবে তারাও হয়তাে এই অন্যায় লড়াইতে আর অংশগ্রহণ করতে চাইবে না তাতে অনর্থক রক্তপাত বন্ধ হতে পারে।
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা
২.৪.১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯