You dont have javascript enabled! Please enable it!

নরমেধযজ্ঞ : ওঁদের চোখে, ওঁদের মুখে

ঢাকা শহরের দুইজন বিশিষ্ট লেখক তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন এই দুটি লেখায়।
ওপার থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হলাে।
আশ্চর্য! হঠাৎ যেন পৃথিবী যেন দ্রুত গতিতে পিছিয়ে গেল এক লােমহর্ষক বর্বরতম যুগে। শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই, সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই, নেই কোন বিদ্যার চর্চা। আছে শুধু হত্যা আর ধ্বংস। বর্বরতার চরম প্রকাশ। যে চেঙ্গিস খা আর নাদির শাহের হত্যালীলা আর বর্বরতার কাহিনী বহন করে আজও ইতিহাস লজ্জায় ঘৃণায় শিউরে ওঠে, সভ্যতার মধ্যাহ্ন লগ্নে পাকিস্তান জঙ্গীশাহীর বর্বরতা তার তুলনায় খুবই নগন্য। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ জঙ্গীশাহীর দুর্বিষহ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যখন একজোট হয়ে একটা সুন্দর উজ্জল দিনের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়েছিল, ঠিক তখনই ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী ফৌজ অতর্কিত ন্দ্রিার কোলে সুপ্ত ঢাকাবাসীর উপর চালালাে বিশ্বের জঘন্যতম আক্রমণ। নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে হত্যা করতে লাগলাে পাইকারী হারে। জ্বালিয়ে দিল বস্তির পর বস্তি নিরীহ মানুষের শান্তির নীড়। ধ্বংস করে দিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, হাসপাতাল আর মন্দির। ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করতে লাগল জ্ঞানী পণ্ডিত অধ্যাপক আর সাহিত্য সেবীদের। হত্যা করতে লাগল ছাত্র, যুবক আর শ্রমিকদের। এমন কি মসজিদ মিনারে দাঁড়িয়ে আযানরত মােয়াজ্জিন বাদ পড়ল না। লক্ষ লক্ষ আতঙ্কিত মানুষ ছুটলাে গ্রামের পথে। মরতে লাগল পথে বিপথে। না খেয়ে,পথ আগলে রাখা জঙ্গী ফৌজের হাতে। গত তেইশ বছর ধরে শুনে আসছি, আমরা উভয় পাকিস্তানের অধিবাসী পরস্পর ভাই ভাই। যেহেতু তারা মুসলমান। ভাইকে হত্যা করছে পথে ঘাটে শিয়াল কুকুরের মত! হায়রে পাকিস্তান! হায়রে মুসলমান! ইয়াহিয়া খান সাহেব ঘােষণা করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশদ্রোহী। আওয়ামী লীগ বেআইনী। অর্থাৎ এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ বেআইনী আর দেশদ্রোহী। তাই হয়তাে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যার এই চেষ্টা। বাংলাদেশের মানুষ আজ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বিশ্বাসী। সমগ্র দেশের অর্ধেক মানুষও যদি হত্যা করা হয় বাকী অর্ধেককে জঙ্গী ফৌজ মেসিনগান আর ট্যাংক এর ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে পারবে না। এ দেশের মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করা কোনদিনই সম্ভব হবে না। জয় আমাদের হতেই হবে। আমরা হতে চাই না বেইমান কুচক্রী মুসলমান, আমরা হতে চাই সত্যিকার মানুষ। বাঁচতে চাই স্বাধীন মানুষের মত। আমার মা বােনদের চোখের জল, ভাইয়ের রক্তস্রোত কোনদিনই বৃথা যাবে না। সংগ্রাম চলছে এবং চলবে। আজ এ সময় আমার সামনে রয়েছে তিনটি কিশাের বালক। দশম শ্রেণির ছাত্র। কাল ঢাকার বাড্ডা এলাকায় বর্বর ফৌজ হামলা করে ওখানকার প্রতি ঘরে। ঘর থেকে বের করে নেয় হিন্দু হাজার পুরুষদের। তারপর আগুনে পুড়িয়ে দেয় ওদের বাড়িঘর । এ তিনটি কিশাের পালিয়ে আসে কোন রকমে। ওদের মা বাপই ওদের বলে, যা তােরা পালিয়ে যা, তােরা পালিয়ে যা, এ দস্যুদের আওতা ছেড়ে চলে যা। আমরা বুড়ােবুড়ি না বাঁচলে কোন দুঃখ নেই। কিন্তু তােদের বেঁচে থাকতে হবে। পাঞ্জাবীদের রক্ত নেওয়ার জন্য। তাই আজ এ কিশােরদের চোখে মুখে আগুনের হলকা। তারা প্রতিশােধ চায়। দেখতে চায় মুক্ত স্বদেশ। স্বাধীন বাংলা। কত আর লিখব! এ দুঃখ, এ হৃদয় যন্ত্রণা আর জমাননা ক্রোধ-সে তাে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। রক্ত স্রোতের প্লাবন তাে শুধু মাত্র আক্ষরিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মা বােনদের চোখের জলকে শুধুমাত্র সাগর-মহাসাগরের লােনা জলের সাথে তুলনা করা চলবে না। এর একমাত্র প্রকাশ- লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পরেও আমরা সগ্রাম চাই। চাই স্বাধীনতা। সারা পৃথিবীর সংবাদপত্র আজ পাকিস্তানী ফৌজের বর্বরতার নিন্দা করছে। ভারত যে ভূমিকা নিয়েছে, তার তুলনা, নেই। ভারত তথা পশ্চিম বাংলার জনগণের সহানুভূতি আর মর্মবেদনা আমাদের পরম পাথেয় আজ। গােটা বাংলাদেশ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
-মেসবাহুল হক
* * *
হত্যা আর হত্যা। হত্যার চরমতম লীলাক্ষেত্র ঢাকানগরী। নগরীতে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে পশ্চিমা হিংস্র পশুগুলাে, যাদের উল্লাসে ঢাকানগরী মহাশশ্মান হতে চলেছে। নির্বিবাদে চলেছে ওদের পাশবিকতা-বর্ণনা করতে গিয়ে শরীর শিউরে ওঠে-ইতিহাস লজ্জায় মুখ লুকোয় সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে আজ একই শপথ নিতে বাধ্য করেছে যে, যেমন করেই হােক, যত রক্তের বিনিময়েই হােক আমরা স্বাধীনতা আনবই এবং সেই শপথে কোন আপস নেই। ২৫ মার্চ রাতে কোনরকম উসকানি ছাড়াই পাঞ্জাবী হানাদাররা কোনরূপ সংকেত ছাড়াই চালায় অতর্কিত আক্রমণ। যে আক্রমণের শিকার হল হাজার হাজার পুলিশ, ই.পি.আর, ছাত্র, শিক্ষক আর শ্রমিক। রােমের আগুন কদিন জ্বলেছিল আমার জানা নেই। কিন্তু ঢাকায় ২৫ মার্চ থেকে জ্বলছে পথে প্রান্তরে আগুনের লেলিহান শিখা এবং তার সাথে চলছে যুদ্ধাস্ত্র, বুলেট-আত্মবলী দিচ্ছে অগণিত বঙ্গ সন্তান। কী অপরাধ এদের ছিল! মা বােনেরা আজ আর কাঁদছে না। ছেলেদের জীবনের মায়া ছেড়ে তারা এই বলে পাঠিয়ে দিচ্ছেঃ শত্রু খতম করে যদি আসতে পারাে তবে আবার দেখা হবে। পাঞ্জাবী হানাদাররা পাইকারী হারে যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে। পালিয়ে পালিয়ে ঘুরছে ছাত্র, যুবকরা, চোখেমুখে তাদের দুর্জয় শপথ-প্রতিশােধ আমরা নেবই নেব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমরা আনবই। পশ্চিমা ঐ বর্বর পশুদের সাথে আপস নেই। এ সংগ্রাম আমাদের আপসহীন সংগ্রাম। মরতে হয় সবাই আমরা মরব তবু আপস করতে যাব না। দিনের পর দিন ওরা ব্যপক হত্যা আর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহায়তায় পশ্চিমা অবাঙ্গালিরা করছে লুটতরাজ আর অত্যাচার। তাদের সে লােমহর্ষক অত্যাচারের কথা বর্ণনার বাইরে চলে গিয়েছে। সেনাবাহিনী ছাত্রী হলে হানা দিয়ে করেছে ধর্ষণ, হত্যা আর কিছু সংখ্যক ছাত্রী ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। সান্ধ্য আইন জারি করা হয় বটে, তবে বিরতি সময় চলে ওদের হত্যাযজ্ঞ আর অগ্নিসংযোেগ। সান্ধ্য আইনের সময়ে চলে মৃতদেহ পাচার। শুধু তাই নয়, সংলগ্ন এলাকাগুলাে থেকে গরু, বাছুর, ছাগল মুরগি ওরা নিয়ে যায়। দোকানে দোকানে গিয়ে চালায় লুঠতরাজ। মানুষ নিধন করে ওরা হাসে আর তামাসা দেখে। বাঙ্গালির রক্তস্রোতে ঢাকা রাজধানীর জনপথ যাচ্ছে, যারা বেঁচে আছে তারাও মৃত্যুর দিন গুনছে। আওয়ামী লীগ কর্মী, শ্রমিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক আর হিন্দুই ওদের আক্রমণের লক্ষ্য। ওরা বলে অফিসে আসতে, নিজের বাসস্থান ফিরে আসতে আর রাত দিন চলে ওদের হত্যালীলা। আজ ছাত্র ও যুবকরা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে ঘুরছে। মা বােনেরা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন। যুদ্ধের ইতিহাস আমরা পড়েছি, কিন্তু এমনি নিরীহ জনসাধারণকে হত্যার কোন ইতিহাস আমরা জানি না। রাতে দেখেছি যেন ঝকের পর ঝক অগ্নিবাণ আকাশের বুক বয়ে উড়ে আসছে আর নিধন করছে অগণিত নারী পুরুষকে। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আবেদন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির এই ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন দিয়ে তারা যেন সর্বপ্রকার সাহায্য পাঠান। নইলে বাঙ্গালির কাছে, মানবতার কাছে, গণতন্ত্রের কাছে তথা ইতিহাসের কাছে তারা অপরাধী থেকে যাবেন।
-আবু জাফর আকরাম
১০.৪.১৯৭১

সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!