You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব কোথায়?
পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিরাও সূত্র খুঁজছেন
পাক রাজনীতির ভাষ্যকার

পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে যে-সব বাঙালিরা ছড়িয়ে আছেন, তাঁরা নানাভাবে খোজ করে যাচ্ছেনসত্যিই শেখ মুজিব লাহাের, করাচি, মূলতান বা অন্য কোন শহরে বন্দী হয়ে আছেন কিনা। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন সূত্র থেকে কোনও ইঙ্গিতই তাঁরা পাননি, যাতে ধরে নেওয়া যায় যে, শেখ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে কোথাও কারারুদ্ধ।
পশ্চিমের বাঙালিদের এই প্রচেষ্টার পিছনে গােপনে যারা সহায়তা করছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে কর্মরত বাঙালি সরকারী কর্মচারীরা ও শুভবুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন কিছু পশ্চিম পাকিস্তানীও। এবং সাংবাদিকরাও।
এঁরা বলছেন যে, করাচি বা লাহাের যেখানেই হােক শেখ মুজিবের মত ‘সর্বজন-পরিচিত ও সাড়াজাগানাে ব্যক্তিত্বকে বন্দী হিসেবে নিয়ে গেলে অন্তত বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড ও অন্যান্য স্টাফ, শহরের পুলিশ বা গােয়েন্দা বিভাগে এবং জেলখানার কর্মচারীদের কাছে তা কিছুতেই অদৃশ্য বা অজ্ঞাত থাকতে পারে না। আর মূলতানের মত ছােট শহর বা বিমানঘাটিতে তাে নয়ই। শেখ মুজিবকে বন্দী অবস্থায় যেখানেই নেওয়া হােক, সেখানে ব্যাপক নিরাপত্তা এবং সেই সঙ্গে নানা গােপনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হতই। নতুবা আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি এড়ানাে যেত না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙ্গালিরা নানা সূত্রে বিভিন্ন শহরে, বিমানবন্দরের এবং পুলিশ ও কারা বিভাগের কর্মচারীদের মাধ্যমে অনুসন্ধান করেও এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন ব্যবস্থা কোন বিশেষ দিনে বা মুহুর্তে নেওয়া হয়েছিল বলে খবর পাননি। তবুও তারা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া, যে বিমানই ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে থাক, তা কলমবাে বিমানবন্দরে আমার কথা, যদি না অবশ্য সেটি চীনের উপর দিয়ে উড়ে থাকে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী যখনই কলমবাে বিমানঘাঁটিতে কোন বিদেশী বিমান যাত্রাবিরতি করে, তখন শুল্ক বিভাগের অফিসাররা বিমানটির ভিতরে যান এবং যাত্রীদের নামের একটি তালিকাও সিংহল সরকারকে দিতে হয়। এমন কি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন করাচি থেকে ঢাকা যাতায়াত করেছিলেন, তখন তাঁর নামও সিংহলী কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়েছিল। কিন্তু কলমবােতে বাংলাদেশের নাগরিক যারা আছেন, তারা অনেক অনুসন্ধান করেও সিংহলের শুল্ক বা বিমান পরিবহণ বিভাগের এমন কাউকে এখনও পর্যন্ত পাননি, যাঁরা শেখ মুজিবের মত কাউকে দেখেছিলেন যা কোন যাত্রী তালিকায় দেখতে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নাম। অবশ্য পিনডি মিথ্যা নাম দিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠিত সরকারের তরফে এ ধরনের অসাধুতা ধরা পড়লে ভবিষ্যতে তার আন্তর্জাতিক জটিলতা হবে অত্যন্ত বেশি।
এছাড়া, ঢাকা থেকে আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, শেখ মুজিবের একনিষ্ঠ ভক্ত পূর্ব বাংলার আই জি আহমদ সাহেব ২৫ মার্চ তারিখে শুধু মিলিটারির সন্দেহজনক গতিবিধি ও ইয়াহিয়ার পালিয়ে যাবার খবরই শেখ সাহেবকে আগেভাগে জানিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি, তিনি সশস্ত্র পুলিশের একটি বাহিনী দিয়ে মুজিবের বাড়ির প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু ২৬ তারিখে ধানমন্ডীর কেউ শেখের বাড়ির সামনে প্রাদেশিক পুলিশের কারও আহত বা নিহত দেহ দেখতে পাননি। এঁরা বলছেন যে, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, সব সতর্কবাণী সত্ত্বেও মুজিব সেই রাত্র বাড়িতেই ছিলেন, তবুও আর্মির সঙ্গে লড়াই করে এবং জীবন না দিয়ে অন্তত বিশ্বস্ত প্রাদেশিক পুলিশ জঙ্গী বাহিনীকে তাদের প্রিয় নেতা মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে দেয়নি। তবে সে লড়াইয়ের চিহ্ন কই?
উপরন্তু কোন আওয়ামী নেতার গ্রেফতার বা মৃত্যু বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী বা জঙ্গী-সূত্র যে-সব খবর ছড়াচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ তা আর একেবারেই বিশ্বাস করছে না, বিশেষ করে ডা. কামাল হােসেন বিষয়ে তাদের রটনার পরে। প্রথমে তাদের প্রচার : কামাল হােসেন নিহত। দুদিন পরেই তাদের ঘােষণা : কামাল হােসেনের আত্মসমর্পণ। কিন্তু মৃত ব্যক্তি কি করে আত্মসমর্পণ করে? অবশ্য ইয়াহিয়াশাহীর ভূতের রাজ্যেই এ ধরনের ভৌতিক কাণ্ডকারখানা হয়তাে সম্ভব?
বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন, নয়াদিল্লি থেকে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ঢাকা হাইকোরটের একজন অ্যাডভােকেটের মতে সামরিক কর্তৃপক্ষের অভিযান শুরু হওয়ার অন্তত তিন ঘণ্টা আগেই শেখ মুজিব তাঁর বাড়ির থেকে অন্যত্র চলে যেতে পেরেছিলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষের কামান-গর্জন শুরু হয় ২৫ মার্চ মধ্য রাত্রি থেকে। এই অ্যাডভােকেট দ্রলােক আওয়ামী লীগেরও একজন নেতা।
অ্যাডভােকেট ভদ্রলােক বহু কষ্ট করে একটানা ছয় দিন পথ চলার পর ঢাকা থেকে এখানে এসে পৌছেছেন। নিজের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়েছেন।
তিনি জানান, ১ মারচ হরতালের শুরু। ওইদিন থেকেই তিনি মুজিবের বাড়িতে আওয়ামী লীগের কনট্রোল রুমে ছিলেন। ২৫ মারচ রাত নয়টার সময় তিনি শেখ মুজিবকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেন। শেখ মুজিব কোন এক অজ্ঞাতস্থানে যাচ্ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদেরও আনডার-গ্রাউন্ডে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, আমার পরিবারের লােকেরা এখনও জানে না, আমি বেঁচে আছি কি না।’
শেখ মুজিবের পরিবারের অন্যান্যদের খবর কী?-এর উত্তরে ওই অ্যাডভােকেট ভদ্রলােক জানান, ‘আমরা জানি না। ২৭ মার্চ পর্যন্ত আমি মুজিবের বাড়িতে ছিলাম। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মত ক্ষণিকের জন্য কারফিউ তুলে নিলে- সেই সুযােগে ওই বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। তারপর থেকে সেখানে কেউ ছিল না। তিনি প্রসঙ্গত একথাও জানান, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, বাড়িটা দিব্যি আছে। কিন্তু ভেতরে সর্বত্র পাক-ফৌজের অত্যাচারের দগদগে চিহ্ন ছড়ানাে।

ইপিআর-এর হাতে বন্দী
আগরতলা থেকে পি টি আই-এর খবর : শেখ মুজিবর কি গ্রেফতার হয়েছেন? এ নিয়ে নানা পরস্পরবিরােধী সংবাদ। সম্প্রতি সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, শেখ মুজিবর রহমান ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর ২ জন অফিসারের হাতে বন্দী হয়েছেন। অফিসার দুজনই শেখ মুজিবকে ঢাকা শহরের বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়েছেন।
সূত্রের খবরে আরও প্রকাশ, শেখ মুজিব বন্দী হয়েছেন ২৬ মার্চ বেলা একটায় ধানমন্ডীতে তার নিজের বাড়িতেই। শেখ মুজিবরকে আত্মগােপন করতে বলা হলে, তিনি তা অস্বীকার করেন তখন ই পি আর-এর ২ জন বাঙালি অফিসার এসে শেখ মুজিবরকে বলেন আপনাকে বন্দী করা হল। আমাদের সঙ্গে আসুন।
ইতিমধ্যে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করেছেন যে কেউ মৃত্যু অথবা জীবিত অবস্থায় শেখ মুজিবের খবর দিতে পারলে তাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। উল্লেখ্য এর অনেক আগেই ঢাকা রেডিও শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর প্রচার করেছে।

সূত্র: আনন্দ বাজার : ৯.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!