You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.17 | বাংলাদেশ পরিস্থিতি - সংগ্রামের নোটবুক

দৃশ্যপট
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
নবারুণ গুপ্ত

বাংলাদেশ সমস্যার কী হবে সাধারণ মানুষের কাছে এখনও তা খুব পরিষ্কার নয়।
পাকিস্তান সরকার চাইছে, অত্যাচার করে, খুন করে, হাজার হাজার মানুষকে খতম করে, লক্ষ লক্ষ নরনারীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে।
মুক্তি ফৌজ ও বাংলাদেশ সরকার চাইছেন, লড়াই করে পাক হানাদারদের তাড়িয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে।
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি চাইছে, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান” হােক।
আর, ভারত সরকার যে বাংলাদেশ সম্পর্কে কী করবেন এখনও তা পরিষ্কার নয়। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই কতকগুলি ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত কী করবেন, অর্থাৎ চূড়ান্ত কোনও ব্যবস্থা নেবেন কিনা এখনও তা স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে না।
সবাই যখন নানাভাবে চেষ্টা তদ্বির করছেন ইয়াহিয়া খা এবং তার অনুগামীরা কিন্তু তখন বসে নেই। তারা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারেই এগিয়ে চলেছে। তারা পূর্ব বাংলায় সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপর্যস্ত করার জন্য সর্বতােভাবে সচেষ্ট। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের খুন করছে। এবং, হিন্দুদের উপর ধর্মান্তরকরণসহ সবরকমের অত্যাচার চালাচ্ছে।
গােড়ায় পূর্ববাংলায় এক বা দেড় ডিভিসন পাক সৈন্য ছিল। ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত সংঘর্ষের সময়ও পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলায় সৈন্য সংখ্যা তেমন একটা বাড়ায় নি। এবার বাংলাদেশে তাণ্ডবলীলা শুরু করার সময় থেকেই কিন্তু পাকিস্তান পূর্ববাংলায় সৈন্য সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে চলেছে। দেড় ডিভিসন দেখতে দেখতে তিন ডিভিসনে দাঁড়াল। এখন পূর্ববাংলায় পাঁচ ডিভিসনের মত পাক সৈন্য হাজির। প্রতিদিনই এর কিছু না কিছু মুক্তি ফৌজের হাতে শেষ হচ্ছে। কিন্তু যাতে মােট সংখ্যাটা না কমে সেইজন্যও প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী হচ্ছে। এবং যাতে মূল ভাণ্ডারে অভাব না পড়ে তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে নতুন লােকও নেওয়া হচ্ছে।
ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববাংলায় সব রকমের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনই আনছে। চীনা, মারকিনী, রুশ, বৃটিশ, জারমান, ফরাসী ইত্যাদি যা পাচ্ছে সব। বােমারু বিমানও এসেছে। নানা এলাকায় শক্ত বাঙ্কার তৈরি করেছে।
এই প্রস্তুতির একটা অংশ হল শুধু মুক্তি সেনাদের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ভেতরে দমননীতি ও অত্যাচার চালাবার জন্য। আর একটা উদ্দেশ্য, ভারত-পাক সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি গড়ে তােলা।
ও পাক সৈন্যরা প্রতিদিনই শত শত নিরীহ বাঙালিকে মারছে। গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। এগুলি তারা রেখে ঢেকেও করছে না। বিদেশী যেসব সাংবাদিক পূর্ববাংলায় গিয়েছেন যাদের এতদিন পরে পাক কর্তৃপক্ষ পূর্ববাংলায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তাদের সামনেই এসব করছে।
আর চলছে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের উপর অত্যাচার। পাক সরকারের ধারণা হিন্দুরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাদের আরও ধারণা, পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলেও হিন্দুরাই। তাই, ২৫ মার্চ থেকেই পাক সেনাবাহিনী হিন্দুদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। সেই অত্যাচার এখনও অব্যাহত। এখন তারা এই কাজে মুসলিম লীগ এবং জামায়েতেরও সাহায্য নিচ্ছে। বাছাই করে হিন্দুদের উপরেই অত্যাচার চলছে।
পূর্ববাংলার সাধারণ মুসলমানরা নানাভাবে বিপন্ন হিন্দুদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। পূর্ববাংলার সাধারণ মুসলমান এখন আগে বাঙালি তারপর মুসলমান। কিন্তু তারা সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ ও জামায়েতের থাবা থেকে কতটা আর হিন্দুদের রক্ষা করতে পারেন। তাঁদেরও যে জীবন বিপন্ন! সত্যিকারের বাঙালি মাত্রই পাক কর্তৃপক্ষের শিকার।
আরও একটা জিনিস এবার শুরু করেছেন পাক কর্তৃপক্ষ। সেটা হল ব্যাপক ধর্মান্তরকরণ। শান্তি কমিটি নামে যে বস্তু পাক কর্তৃপক্ষ থানায় থানায় দাঁড় করিয়েছে সেগুলিই এই ধর্মান্তরকরণে নেতৃত্ব নিয়েছে। হিন্দুদের ব্যাপক হারে মুসলমান করা হচ্ছে। এবং শান্তি কমিটিগুলি সারটিফিকেট দিচ্ছে : আজ হইতে অমুকচন্দ্র মণ্ডল অমুক আলী হইল। যারা পারছেন পালিয়ে আসছেন। যারা পালাতে পারছেন না তারা মুসলমান হয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করছেন। পূর্ববাংলায় পাক কর্তৃপক্ষ সব রকমের বর্বরতা অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে।
* * *
মুক্তি সেনারাও সক্রিয়। তাদের অভিযান ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। কয়েক হাজার পাক সেনাকে তারা ইতিমধ্যেই খতম করেছেন। তথাকথিত শান্তি কমিটির লােকেরাও মুক্তি ফৌজের দৃষ্টি এড়াতে পারে নি। তাদেরও কয়েকজনকে মুক্তি ফৌজ খতম করেছে।
মুক্তি ফৌজের লােকজন এবার ঢাকা শহরেও ঢুকেছে। খােদ ঢাকা শহরেও গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়েছে। পাক সেনাবাহিনী এখন পূর্ববাংলার কোথাও নিরাপদ মনে করতে পারছে না। সীমান্ত এলাকার বহু পয়েন্ট থেকে তারা ক্যান্টনমেন্ট বা গ্যারিসনে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখন তারা একশ দেড়শ একত্র না হয়ে চলাফেরাও করে না। রাতে ছাউনির বাইরে যায় না।
মুক্তি ফৌজের আক্রমণ কিছুদিনের মধ্যেই আরও জোরদার হবে। পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে গাড়ি ঘােড়া ছাড়া চলা কঠিন। বর্ষায় আবার পূর্ববাংলার বহু এলাকায় গাড়ি ঘােড়া চলতেও পারে না। বর্ষার জল পূর্ববাংলার বহু এলাকায় অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে। অকটোবর নভেম্বর অবধি তাই মুক্তি সেনার বিরাট সুযোেগ।
মুক্তি ফৌজের অধিনায়করা এই সুযােগ নিতে প্রস্তুত। তারা সেজন্য নানা পরিকল্পনাও তৈরি করে ফেলেছেন। সেই পরিকল্পনা অনুসারে বড় বড় আক্রমণ শুরু হতেও আর খুব দেরি নেই।
কিন্তু মুক্তি ফৌজের অধিনায়করা এটা মানেন যে বাইরের কিছু কিছু অস্ত্র সাহায্য এবং নিজেদের মনােবলের উপর নির্ভর করে পাচ ডিভিসানের একটা নিয়মিত বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলা গেলেও বড় রকমের সম্মুখ সমর ছাড়া তাদের ঘাঁটিছাড়া করা সম্ভব নয়। এবং দু চার মাসের মধ্যেই সেই রকম কোনও সমরে নামতে হলে তাদের বাইরের ব্যাপক সাহায্য চাই-ই।
এই সাহায্য তারা পাবেন কিনা সেই প্রশ্নই এখন তাদের কাছে বড়। যদি না পান তাহলে বহু দিন ধরে তাদের গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এবং ইতিমধ্যে নানাভাবে বিদেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
এইভাবে খুব বেশি দিন পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চললে তার রাজনৈতিক চেহারাটা শেষ পন্ত কী দাঁড়াবে বলা কঠিন। কোন আন্তর্জাতিক শক্তির কাছাকাছি তারা চলে যাবেন তাও এখনই অনুমান করা সম্ভব নয়।
***
তবে, এটা বােধ হয় অনেকেই বােঝেন যে বর্তমান বিশ্বের তিনটি বৃহৎ শক্তিরই পূর্ববাংলার উপর লােভ আছে। পূর্ববাংলা সামরিকভাবে পূর্ব এশিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বজায় রাখতে হলে পূর্ববাংলায় প্রভাব থাকলে নানা সুবিধা। মারকিন যুক্তরাষ্ট্র চীন এবং রাশিয়া তিনজনই ভারত মহাসাগরে আধিপত্য চায়। বৃটেনের এখন সে ক্ষমতাই নেই।
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া তিনজনই এখন পাকিস্তানের অবলুপ্তি চায় না। তাঁরা এও জানেন যে পূর্ববাংলা যদি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে বেশি দিন পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হবে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানও টুকরাে টুকরাে হয়ে যাবে।
ফলে, গােটা পূর্ব এশিয়ারই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। কোনও বৃহৎ শক্তিই এখন পূর্ব এশিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় না।
তাই, তারা সবাই পূর্ববাংলায় একটা রাজনৈতিক সমাধান চান। এমন একটা ব্যবস্থা যাতে পাকিস্তান টিকে থাকে, পূর্ববাংলায় বাইরের কেউই না একাধিপত্য বিস্তার করতে পারে এবং সেখানে ভারতের তেমন বিশেষ কোনও প্রভাব না থাকে।
তাই, তারা ভারতের উপর চাপ দিচ্ছেন, কোনও চূড়ান্ত ব্যবস্থা যেন না নেওয়া হয় এবং তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে সবদিক রক্ষা কর সমস্যার একটা কোনও সমাধানের পথ বের করা যায়।
***
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তাই, ভারত সরকার এই অবস্থায় কী করবেন। বৃহৎ শক্তিগুলির চাপ রয়েছে। রয়েছে বড় রকমের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার আশংকা। আবার, কিছু একটা না হলেও দেশের ভেতরে অন্তহীন কতকগুলি মারাত্মক সংকটে জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে।
ভারত সরকার এখনও বােধ হয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। তারা এখনও ভাবছেন।
এদিকে বাংলাদেশ সমস্যাটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। হাজার হাজার মানুষ মরছে। লক্ষ লক্ষ লােক পালিয়ে আসছে।

১৭ জুলাই ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯