You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুই বাংলা
বিশেষ প্রতিনিধি

সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে যখন তৃণমূল মুক্তিযুদ্ধ চলেছে এপারে, কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে তখন নতুন ধরনের কিছু বক্তব্য উকি দিচ্ছে। যথা : দুই বাংলার লড়াই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াই! দুই বাংলা এক হােক- এই ধ্বনিও সম্পূর্ণ অক্ষত নয়। দুই-ই, বলা নিপ্রয়ােজন, পরিস্থিতির অতি-সরলীকরণ …… এইসব হিজিবিজি এড়িয়ে যাওয়া বােধহয় ঠিক নয় কেননা, দুই-ই তাৎপর্যপূর্ণ।
তাৎপর্যপূর্ণ এ-কারণে যে, দুটি ধ্বনিরই পিছনে রয়েছে কিঞ্চিৎ পটভূমি সকলেই জানেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনে এই প্রান্তে অন্তত একটি রাজনৈতিক দলের শ্লোগান ছিল বাংলাকে কেন্দ্রের উপনিবেশ হতে দেব না ।… লােকসভায়ও শােনা যাচ্ছে তার প্রতিধ্বনি। মাঠে ময়দানে এখনও তার রেশ। ইয়াহিয়া খা আর ইন্দিরা গান্ধী নাকি এক।
কিন্তু সত্যই কি তা-ই? পশ্চিম বাংলাকে উপলক্ষ করে লােকসভায় সপ্রতি যে বিতর্ক হয়ে গেল সেখানে অনেকেরই মুখে শােনা গেছে কেন্দ্রের সমালােচনা। বস্তুত ইন্দিরা গান্ধীর নিজের দল নব-কংগ্রেসও বাদ নেই। কিন্তু কেন্দ্রের সমালােচনা আর বিচ্ছিন্নতাবােধ নিশ্চয়ই এক বস্তু নয়। সমালােচক কে নয়? বাংলার কমপন্থী নেতারা জানেন এ ব্যাপারে তাদের সহযােগী অনেকেই। ওড়িশা, বিহার, তামিলনাড়, মহীশুর- কে নয়? এমন কি বােধহয় একদা “ইন্ডিয়া দ্যট ইজ ভারত, দ্যাট ইজ উত্তর প্রদেশ” নামে বর্ণিত সেই ভাগ্যবান রাজ্যটিও। সুতরাং কেন্দ্রের সমালােচনা নতুন কোনও লক্ষণ, বা বাংলার একান্ত কোনও কাণ্ড নয়। সমালােচক কখনও স্বৰ্গত বিধানচন্দ্র রায়।…
কেন্দ্র কীভাবে অবিচার করেছে বা করছে- সে আলােচনার সুযােগ এখানে নেই। আমরা জানি, উন্নয়নশীল দেশে এ জাতীয় বৈষম্যের অভিযােগ অন্যত্রও শােনা যায়। এমনকি খোজ নিলে দেখা যাবে, লালদিঘি পাড়ের সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযােগ আছে কোনও কোনও জেলারও। তবু ধরে নেওয়া গেল, এবং যুক্তিসহই যে, বাংলার প্রতি ন্যায় বিচার করেনি, বাংলা অবহেলিত। কিন্তু তার মানে কি এই যে, বাংলা কলােনি? কাকে বলে উপনিবেশ, কী তার চরিত্র- দীর্ঘ দুশ বছর ধরে তার পরিচয় লাভের পর আমাদের তা অজানা থাকার কথা নয়। তাছাড়া, দিল্লির শাসকদের হয়তাে একটা শ্রেণী চরিত্র আছে, কিন্তু সে-গােষ্ঠীতে নিশ্চয় সর্ব-ভারতই সদস্য! তবুও একটা কথা আমরা সবাই জানি- পূর্ব বাংলার বাঙালি পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠ ভারতে নিশ্চয় তা-নয়। তার চেয়েও বড় কথা, বামপন্থী রাজনীতি যে শ্রেণী সংগ্রামের হক দেয়, সেই শ্রেণী বিন্যাস পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে কোনও শ্রেণীতেই বাঙালি একমাত্র সম্প্রদায় নয়। যতদূর মনে পড়ে, এই রাজ্যে কর্মনিযুক্ত শ্রমিকদের বৃহত্তর অংশই অবাঙালি। চটকলে তাদের পরিমাণ শতকরা ৭৯ জন।
এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিকতার আবেদন অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু আঞ্চলিকতা আর বিপ্লব নিশ্চয়ই এক কথা নয়। আঞ্চলিকতাবােধ ভারতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এ-কথা বলা যায় না। নানা সময়, নানা উপলক্ষে আমরা তা দেখেছি। কখনও ভাষ্য, কখনও ইস্পাত কল কখনও নদীর জল- ক্ষোভের কারণ নানবিধ। কিন্তু নাগা এবং মিজো এলাকা বাদ দিলে বিচ্ছিন্নতাবােধ কোথায়ও দেখা যায়নি। ডি-এম-কে নিজের প্রথম দিককার আচরণ ভুলতে পারলে নিশ্চয় খুশী হবে আজ। পানজাবি সুবার আন্দোলনও নিশ্চয় অঙ্গচ্ছদের বাসনা থেকে উপ্ত নয়। তেলেঙ্গানা রাজ্যের মর্যাদা চায় মাত্র, তার চেয়ে বেশী কিছু নয়। একমাত্র বাংলাই কি তবে বিচ্ছিন্নতাকামী হবে?
বােধহয় নয়। এমনকি কাশ্মীর, নাগালান্ড এবং মিজো পাহাড়ে যখন ভারতের প্রধান প্রবাহে মিলিত হবার জন্য ইচ্ছা ………. স্পষ্টতর, তখন ভারতের প্রথম সারির রাজ্য বাংলা-আলাদা হতে চায় এটা কল্পনা করা দুঃসাধ্য। বাঙ্গালি জাতীয়তার অভীপ্স কিন্তু বরাবরই ভারতীয় জাতীয়তার মহাসাগরের দিকে। স্বাধীনতার পরের বছরগুলােতে যেখানে নানা কারণে নৈরাশ্য দেখা দিয়েছে হয়তাে, কিন্তু বাঙালি আত্মঘাতী হতে চায় এটা অবশ্যই অসত্য।
সেদিক থেকে বিচার করলে বরং মনে হয় কেরলের নায়ক শ্রীনামরুদরিপাদ বােধহয় কলকাতার দেওয়াল লিখনের চেয়ে সত্যের অনেক কাছাকাছি। মাদরাজে তিনি নাকি বলেছেন- বাংলাদেশের ঘটনা ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য। কাশ্মীরে তাে বটেই, তামিল নাড়তে, অনর্থে- সর্বত্র এক কথায়, শ্রীনামরুদরিপাদ বােধহয় বলতে চান কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্পর্ক অতঃপর নতুন করে যাচাই করা হবে। রাজ্যগুলাে আরও ক্ষমতা হাতে পেতে চাইবে।
তার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা গেছে। হয়তাে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীর আলােতে তা আরও তীব্র হবে। কিন্তু তার অর্থ নিশ্চয় এই নয় যে, দিকে দিকে বিচ্ছিন্নতার দাবি উঠবে। গত তেইশ বছরের গণতান্ত্রিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পর সেটা এখন বােধহয় অবান্তর চিন্তা। কোনও এক সাহেব বলেছিলেন- ইন্ডিয়া ইজ নাইদার এ কানট্রি নর এ নেশান! ইন্ডিয়া তথা ভারত আজ নিশ্চয়ই একটি জাতি। এবং বহুবর্ণ বলেই আজ সে-জাতি অনেকখানি নিরাপদ।
উপসংহারে ‘দুই বাংলা এক হােক’ এই ধ্বনি সম্পর্কে দুএকটি কথা। গঙ্গাতীরে এই বাক্যের প্রতিধ্বনি শােনা গেছে সুদূর টেমস-তীরেও। লন্ডন “টাইমস” নাকি লিখেছে- অতঃপর দুই বাংলা এক করার জন্যেও উদ্যোগ শুরু হতে পারে। সেটাও কল্পনা-বিলাস মাত্র। সত্য, দেশ বিভাগের আগের মুহূর্তে কেউ, কেউ যুক্ত বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এবং বিভক্ত দেশের মানসিকতায় পুনর্মিলনের জন্য আকুলতাও অবশ্যই থাকে। কিন্তু আজ যা হচ্ছে তাতে সে-ই সুপ্ত এবং হয়তাে বা নানা কারণে প্রায় লুপ্ত ইচ্ছা পূরণের কোনও সুযােগ নেই। পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধা, রক্তের মূল্যে যারা স্বাধীনতা অর্জন করতে চাইছেন তারা কি এতই নির্বোধ যে করাচি-পিন্ডির বদলে কলকাতাকে করবেন সােনার-বাংলার আর্থিক রাজধানী? আর এপারের বাঙালিই বা আবার কেন পরিণত হতে চাইবেন সংখ্যালঘু গােষ্ঠীতে? ওপারের বাঙালি স্বাধীন হােক, হােক সুপ্রতিষ্ঠিত এপারের বাঙালি সম্ভবত তা-ই চান। তার বাইরে আর যা চান সেটা স্বাভাবিক সম্পর্ক।

সূত্র: আনন্দবাজার : ১০.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!