রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য
আজ হােক আর কাল হােক, পশ্চিম পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমাধানে আসতেই হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাকে ক্ষমতা ভাগ করে নিতেই হবে। না হলে পশ্চিম পাকিস্তানের নিজের অস্তিত্বই অবলুপ্ত হয়ে যাবে।
পাকিস্তানের সমরনায়করা, মুখে যতই সিংহ গর্জন করুন না কেন, এবার বুঝতে শুরু করেছেন, তাদের একতরফা নির্বিবেক অত্যাচার আর গণহত্যার ক্ষমতাও কত সীমাবদ্ধ! মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাপক হত্যা আর অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে ষড়যন্ত্র তারা এঁটেছিলেন, আজ আট সপ্তাহ পরে তারা উপলব্ধি করছেন যে, সেটা একটা প্রকাণ্ড মূঢ়তামাত্র। তাঁদের প্রত্যেকটি হিসাব ভুল।
আজও বাংলাদেশে তাদের অধিকৃত শহরগুলাে ফাঁকা। আজও সারা বাংলায় প্রশাসন বলে কিছু নেই। কলকারখানা ব্যবসাবাণিজ্য স্তব্ধ। যােগাযােগ ব্যবস্থা আজও বিচ্ছিন্ন। সামরিক বাহিনীর লােকেরা এবং তাঁদের সহযােগী ‘মিত্রগণ অতর্কিতে কখন প্রাণ যায়, এই আতঙ্কে সর্বদা সন্ত্রস্ত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সদা জাগ্রত জনমতের আক্রমণে পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ ক্রমাগত নাজেহাল হচ্ছেন। অনেক চেষ্টা করেও তারা বিদেশ থেকে সাহায্য আদায় করতে পারছেন না। চিত্রটা যে এমন অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে, পাকিস্তানের সমরনায়কেরা বা তাদের হাতের পুতুল প্রেসিডেন্টের পােশাকপরা জেনারেল ইয়াহিয়া খান তা আগে বুঝতে পারেন নি। বিলম্বে হলেও, তাঁরা এখন তা বুঝতে শুরু করেছেন।
পাকিস্তানের সামরিক শক্তি যে মারাত্মক হিসেবের ভুলটা করেছেন তা এই : এই আন্দোলনের চরিত্র তারা ধরতে পারেন নি। তারা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিটা আওয়ামী লীগেরই দাবি। কিন্তু এ দাবি যে কোনও বিশেষ এক রাজনৈতিক পারটির নির্বাচনে জেতার ধ্বনি মাত্র নয়, এটা যে গােটা জাতির অন্তরের কামনা, সেটা তাঁরা হয় বুঝতে পারেন নি, অথবা বুঝেও বুঝতে চান নি।
আত্মম্ভরী সমরনায়কদের এই বােকামি বা ন্যাকামিই আজ পাকিস্তান নামক জরাসন্ধ রাষ্ট্রটিকে নিশ্চিত অবলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পরিত্রাণের একটিমাত্র পথই আছে এবং তা হচ্ছে (শুনতে আজগুবী শশানালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ছয় দফা দাবি ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান। তাদের হাতে বন্দী মুজিবই যে তাদের ত্রাতা এই তিক্ত বটিকা তাঁদের না গিলে উপায় থাকবে না।)।
পশ্চিম পাকিস্তানেও আজ এ কথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সমরনায়কেরা এখন আর হালে পানি পাচ্ছেন না। এবং ইয়াহিয়ার সামরিক পরামর্শদাতাদের কাছেও এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, তাদের সামরিক যন্ত্র পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-গড়াই-এর পলিমাটিতে একেবারে ফেঁসে গিয়েছে।
কিন্তু কোনও জিনিস বােঝা এক কথা আর মেনে নেওয়া আরেক কথা। আবার যত সহজে বােঝা যায়, তত সহজে মানা যায় না। তবে সহজ হােক আর কঠিন হােক, আজ হােক আর কাল হােক, রাজনৈতিক সমাধানের পথে পাকিস্তানকে আসতেই হবে।
কারণ :
(এক) বাংলাদেশ (বা পূর্ব পাকিস্তান) শুধু যে গােটা পাকিস্তানের শতকরা ৬৮ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা কামাই করত তাই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প কারখানায় উৎপন্ন ভােগ্যপণ্যের সব থেকে বড় এবং সব থেকে লাভজনক বাজারও ছিল। আজ সে বাজার বন্ধ।
(দুই) পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের একার পক্ষে সামরিক বাহিনী পােষার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই আট সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনীতির ভরাডুবি হতে বসেছে।
(তিন) চীন এখন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিকগােষ্ঠীর মতই দিলজানের দোস্ত, হােক শুধুমাত্র চীনের অর্থ সাহায্যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বা ডলার মারক পাউন্ড অর্জন সম্ভব নয়।
(চার) আমেরিকার বেসরকারী জনমত ক্রমশ পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে। এওয়ার্ড কেনেডি, ফুস্প্রাইট প্রভৃতির মত প্রভাবশালী সেনেটররা মারকিন সরকার পাকিস্তানকে যাতে সাহায্য না দেন, তার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
(পাঁচ) ব্রিটেনের জনমত ও পাকিস্তানের গণতন্ত্রবিরােধী কাজ এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে উঠছে। পারলামেন্টে লেবার এম পি ডগলাস মান ও তার সমর্থকরা পাকিস্তানকে দেয় সাহায্য বন্ধ অথবা স্থগিত রাখতে প্রস্তাব এনেছেন। দুশজন ব্রিটিশ এম পি. শিক্ষাব্রতী, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী ১৩ মে লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মারফত যে আবেদন প্রচার করেছেন, তাতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামাবাদকে কোনও সাহায্য দিও না।
(ছয়) যে বিপুল শরণার্থীর স্রোত অব্যাহত গতিতে ভারতে আসছে, তা বন্ধ করার ব্যবস্থা এবং যারা এসেছেন তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা ভারতকে করতেই হবে। এবং প্রধানমন্ত্রীর কথায় এদের ঘরে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যও ভারতকে চেষ্টা করতে হবে। রাজনৈতিক সমাধানই সেই পরিবেশকে ত্বরান্বিত করবে।
(সাত) সােভিয়েত রাশিয়াও রাজনৈতিক সমাধানে বিশেষ আগ্রহী।
সরকারীভাবেও পাকিস্তানের বিদেশী বন্ধু বা মুরুব্বীদের চাপ তার উপর ক্রমশ তীব্র হবে। এবং ইয়াহিয়া আর তার, সামরিক উপদেষ্টাগণের উপর স্বদেশী মুরুব্বীদের চাপও বাড়বে। এবং এত চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পাকিস্তানের সামরিকগােষ্ঠীর নেই।
এই আট সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর অবিক্রীত মালে করাচী, লাহাের লায়ালপুরের গুদামগুলি ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আর মাস দুই এইভাবে চললে এবং মুক্তি ফৌজের সুসংগঠিত কাজ এবং জনগণের পূর্ণ অসহযােগ দেখলে মনে হয় বাংলাদেশে অচলাবস্থা আরও অনেক দিন নিশ্চয় চলবে, পশ্চিম অংশে শিল্প সঙ্কট অনিবার্যভাবে দেখা দেবে।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এই সব ঘটনাগুলিই পাকিস্তানকে বাধ্য করবে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সমঝােতায় আসতে। ঘটনা তাকে এই দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। মুখরক্ষার জন্য একটা কিছু অজুহাত এখন চাই। এমন একটা অজুহাত যাতে বন্দী মুজিবকে দেখে ইয়াহিয়ার ‘বন্দী আমার প্রাণেশ্বর” বলে ডুকরে উঠতে মাথা কাটা না যায়!
সূত্র: দেশ : ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮