দৃশ্যপট
শরণার্থী সমস্যা
নবারুণ গুপ্ত
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা ক্রমেই জটিল ও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ইতিমধ্যেই লাখ চল্লিশেক এসে গিয়েছেন। আরও আসছেন। অবিরাম আসছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গােড়ার দিকে কিন্তু এভাবে শরণার্থী আসছিলেন না। প্রথম দিকে খুব অল্প অল্প আসছিলেন। পাক সেনাবাহিনী তখন শুধু শহরাঞ্চলে, অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্ট এবং গ্যারিসনগুলিতে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিল। সাধারণ মানুষ তখন বড় বড় জেলা শহর ছেড়ে ছােট ছােট শহরগুলিতে এবং গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, পাক সেনারা লড়াইয়ে হেরে যাবে এবং তারপর সাধারণ নাগরিকরা যে যার নিজ নিজ বাসভূমে ফিরে যাবেন।
কিন্তু তা হল না। দিন পনেরাের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্য এল বাংলাদেশে। মুক্তিযযাদ্ধারাও প্রথম দিকের কয়েক দিনের লড়াইয়ের পর বিমানে-কামানে-মেসিনগানে বলিয়ান, পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে উঠলেন না। পাক সেনাবাহিনী প্রথমে বড় শহর ছেড়ে ছােট শহরগুলির দিকে এগােলাে। তারপর এগােলাে গ্রামের দিকে। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলের গ্রামগুলির দিকে। সর্বত্র সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে লাগল। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিল। নিরস্ত্র হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করল। মেয়েদের সঙ্গে পশুর মত ব্যবহার করল।
প্রথম প্রথম বাঙ্গালি মাত্রই পাক সেনাবাহিনীর টার্গেট ছিল। বাঙালি পেয়েছে তাে গুলি করে মেরেছে। নির্বিচারে গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়েছে। মেয়েদের যাকে পেয়েছে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সেটা ছিল তাদের অত্যাচারের প্রথম পর্যায়। তখন বাছাই ছিল না।
এখন শুরু হয়েছে অত্যাচারের দ্বিতীয় পর্যায়। এই পর্যায়ে তারা বাছাই শুরু করেছে। তাদের টার্গেট প্রধানত হিন্দুরা এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকরা। মুসলিম লীগ এবং জামায়েত এর লােকেরা এ ব্যাপারে পাক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করছে। তারা সেনাবাহিনীকে হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। লীগ এবং জামায়েতের লােকেরাও আক্রমণে অংশ নিচ্ছে। অংশ নিচ্ছে অ-বাঙালি মুসলমানরাও। সেনাবাহিনী এদের হাতে হাল্কা অস্ত্রশস্ত্রও তুলে দিয়েছে।
আরও একটা কাজ করছে সেনাবাহিনী। তারা গােটা সীমান্ত অঞ্চলের প্রায় পনেরাে মাইল এলাকা থেকে বাঙলিদের বিতাড়িত করছে। উদ্দেশ্য দু’রকমের। (এক) যাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা ওখানে কোনও রকমের সাহায্য বা আশ্রয় না পায়। এবং, (দুই) ওই এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এনে কয়েক লক্ষ অনুগত মারাদাঙ্গাবাজ লােককে বসিয়ে দেওয়া যায়।
গেরিলা যুদ্ধে যত পাক সেনাবাহিনী অসুবিধায় পড়ছে ততই অত্যাচারও বাড়ছে। কোথাও যদি একজন পাক সেনা খুন হয় বা একটা ব্রিজ ধ্বংস হয় তাে তারপরই পাক সেনাবাহিনী গিয়ে আশপাশের সব ক’টা গ্রামকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, যাকে পাচ্ছে খুন করছে।
এই প্রচণ্ড অত্যাচারের ফলে পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে আসছেন। হিন্দুরা এবং আওয়ামী লীগের পরিচিত সমর্থকরা সবাই আতঙ্কিত। সাধারণ বাঙালি মুসলমানরাও ভীত। যেভাবে পারছেন পালিয়ে আসছেন। হিন্দুরা সবাই তাে আসছেনই, হাজার হাজার মুসলমানও আসছেন। প্রথমে শরণার্থী আসছিলেন দৈনিক সাত শত। তারপর সংখ্যাটা বেড়ে হল হাজার হাজার। ২৮।২৯ তারিখ থেকে দৈনিক আগমনের সংখ্যা লক্ষের উপর চলে গিয়েছে। ২৮ তারিখ রাত্রে বনগাঁ এবং নদীয়া থেকে খবর এল, একদিনে শুধু ওই দুই এলাকায়ই তিন লক্ষের মত শরণার্থী এসেছেন। ২৯ তারিখ রাত্রে কোচবিহার থেকে খবর পাওয়া গেল, চার লক্ষ শরণার্থী, এপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন।
গেরিলা যুদ্ধের ভয়াবহতা যত বাড়বে, পাক বাহিনীর অত্যাচারও ততই বাড়বে। আর বাড়বে বাংলাদেশের ভেতরে অর্থনৈতিক সংকট। পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও বিপন্ন। সরকার বলতে কিছুই নেই। বাজারহাট, স্বাভাবিক কাজকর্ম সব বন্ধ। বিভিন্ন এলাকায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। এর ফলে শরণার্থী আগমন আরও বেড়েছে। সংকট যত বাড়বে ততই পূর্ব বাংলায় মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। শরণার্থী আগমনও ততই বাড়বে।
একটা সময় আমার মনে হয়েছিল, শরণার্থীর সংখ্যা হয়ত এক কোটির উর্ধ্বে যাবে না। এখন আশংকা হচ্ছে পূর্ব বাংলায় যদি মাস চারেক বর্তমান অবস্থা চলে তাহলে ভারতের চারটি সীমান্ত রাজ্যে (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং আগরতলায়) অন্তত দেড় কোটি শরণার্থী আসবেন। তার মধ্যে এক কোটিরও বেশি আসবেন পশ্চিমবঙ্গে।
* * *
এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের জন্য দু বেলা দু মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করা অসম্ভব। প্রশ্নটা শুধু টাকার নয়, প্রশ্নটা সংগঠনেরও। টাকা পেলেও প্রতিদিন নতুন এক লক্ষ লােকের জন্য ব্যবস্থা করা অসম্ভব। প্রতিদিন এক লক্ষ নতুন লােকের জন্য ছাউনী করা বিরাট ব্যাপার। প্রতিদিন নতুন এক লক্ষ লােকের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্য। এত বড় সংগঠন কোথায়? কেউ বা গড়ে তুলতে পারে এই বিরাট সংগঠন?
টাকারও প্রয়ােজন অজস্র। মাথাপিছু সব মিলিয়ে তিন টাকা খরচা ধরলেও দৈনিক তিন কোটি টাকা প্রয়ােজন। মাসে নব্বই কোটি। বছরে ১০৮০ কোটি। এক বছর যদি এক কোটি শরণার্থীর জন্য ব্যবস্থা করতে হয় তাহলে ভারত সরকার দেউলে হয়ে যেতে বাধ্য। বিদেশ থেকে যে সাহায্য আসছে বা আসতে পারে তা সমুদ্রে বারিবিন্দু। ওতে এই শরণার্থীদের জন্য শুধু পানীয় জলের ব্যবস্থাও হতে পারে না।
তার উপর তাে আছে স্থান সংকুলানের প্রশ্ন। সীমান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন থানা এলাকায় স্বাভাবিক লােকবসতি যা ছিল শরণার্থী আগমনের ফলে তা রাতারাতি চার-পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছে। ফলে, ওই সব এলাকায় নানা রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিরাশ্রয় হাজার হাজার মানুষ যেখানে পারছেন ঢুকে পড়ছেন। দিনের পর দিন এই জিনিস চলতে থাকায় স্থানীয় অধিবাসীদেরও অসুবিধা হচ্ছে। নিঃসম্বল মানুষ যা পাচেছন সেই মজুরিতেই কাজ খুঁজছেন। ফলে স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষের সংকট বাড়ছে। এইভাবে নানা তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে।
শরণার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। তা ছাড়া উপায়ও নেই। সীমান্ত জেলাগুলি একা কতদিনই বা এই বিরাট চাপ সহ্য করবে। কিন্তু সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও সহজ নয়। প্রতিদিন এক লক্ষ লােককে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে অন্তত একশ খানা ট্রেন চাই। সীমান্ত থেকে দৈনিক এই একশ’ খানা ট্রেন চালাতে হলে অন্যান্য সব ট্রেনের চলাচল বন্ধ করতে হয়। তাও অসম্ভব।
তার উপর তাে আছে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্ন। এত লােক হঠাৎ কোথাও এসে পড়লে নানা রকমের আইন ও শৃঙ্খলার প্রশ্ন দেখা দেবেই। একেই তাে সীমান্ত রাজ্যগুলিতে নানা গণ্ডগােল। তার উপর এই সমস্যা।
সামগ্রিকভাবে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এভাবে চলতে থাকলে শরণার্থীদের চাপে কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব ভারতের চারটি রাজ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়বে।
* * *
শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
কিন্তু আপাতত তারও কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যতক্ষণ পাক সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় রয়েছে, যতক্ষণ বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী কর্তৃত্ব থাকছে ততক্ষণ এঁরা ফিরে যাবেন না।
পাক সেনাবাহিনী নিজে থেকে সরেও যাবে না। গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে তাদের সরাতেও কয়েক বছর লাগবে।
বড় রাষ্ট্রগুলি পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিয়ে একটা কিছু করবে সে আশাও কম। কারণ, তাদের নানা অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে তারা কেউই পাকিস্তান সরকারকে তেমন চটাতে চান না।
তারা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকেও স্বাগত জানাতে রাজী নন। তারা চান, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানেরই তবে থাক। কারণ, তারা জানেন, পূর্ব বাংলা পুরােপুরি স্বাধীন হয়ে গেলে পাকিস্তানই ভেঙ্গে যাবে। এবং তাহলে, এশিয়ার এই অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং সামরিক ভারসাম্য তাদের স্বার্থমত বজায় থাকবে না। সুতরাং, স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁরা চান না। তাই, তারা পাকিস্তানের উপর বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনও চাপ দেবেন না।
তাহলে এখন হবে কি? ভারত সরকার করবেন কি? বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য তঁারা এগােবেন কোন্ পথে?
সূত্র: দেশ : ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮