রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য
পূজ্যপাদ্ কমরেড ভাসানী!
চাচা, আমরা পশ্চিম বাংলার সাচ্চা কমিউনিসটরা আপনার কোন্ পাকা ধানে মই দিয়েছি যে আপনি আমাদের এভাবে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আপনি শুরু করেছেন কি?
আমাদের সময়টা এখন বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। চাদ্দিকে যা ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে তাল রাখতে রাখতেই আমাদের প্রাণান্ত। আমরা দাদাদের কাছ থেকে আজ যা লাইন পাচ্ছি সেটা আগামীকাল যখন কাজে লাগাতে যাচ্ছি, দেখি কি, তার আগেই হাওয়া ঘুরে গিয়েছে। আবার নতুন লাইন ধরছি। আবার ছাড়ছি। এ রকম ধরতে ধরতে আর ছাড়তে ছাড়তে এক সময় কোনটা লাইন আর কোনটা বেলাইন সেটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার গােদের উপর বিষফোড়া অর্থাৎ আপনার যন্ত্রণা। বুরজোয়া প্রেসের সঙ্গে এখন কি ঢলাঢলি না করলেই নয়।
বড় চাচা! দোহাই, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না। আপনাকে ইনসালট করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এটাকে আপনি কমিউনিস্ট আত্ম-সমালােচনা বলেই ধরে নেবেন।
আপনি ৩১ মে বুরজোয়া প্রেসের রিপােটারদের কাছে যা বলেছেন, যা তারা পয়লা জুনের কাগজ ফলাও করে ছেপেছে, তা অতি মারাত্মক। আপনার মনে আছে, কি বলেছেন? শুনুন!
১. আপনি বলেছেন : ‘চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, আলবেনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের ব্যবহার দেখে আমি
দুঃখিত। ওঁরা বলেন, আমরা, দুনিয়ার মুক্তিকামীদের পক্ষে, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে। কই বাংলাদেশের ব্যাপারে তাে একটা কথাও বলছেন না। ভিয়েতনাম নিয়ে আমরা বাংলাদেশের মানুষ কত আন্দোলন করেছি। সেই ভিয়েতনামও আমাদের ব্যাপারে কোনও কথা বলছে না। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ জুন, ১৯৭১ পৃঃ ২)
২. রুশিয়া ও চীন সম্পর্কে আপনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন : ‘এত শুনে, এত দেখেও যদি ওদের বিবেক জাগ্রত না হয়, তাহলে কি আমি গিয়ে বলে ওদের বিবেক জাগ্রত করতে পারব? (ঐ)।
৩. বাংলাদেশে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার সম্পর্কে আপনি মন্তব্য করেছেন : ‘পাকিস্তানে এবং হিন্দুস্থানে নানান সর্বদলীয় সরকার দেখে আমি ভীত। তার চেয়ে একটা সরকার যখন হয়েছে (অর্থাৎ আওয়ামি লীগের সরকার!) সেই সরকারই এখন চলুক না। এখন মূল প্রশ্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম। এখন সর্বদলীয় সরকারের কথা তুললে সেটাই না বাধা পায়, তাতেই না গণ্ডগােল হয়।
– (ঐ)।
৪. এবং আপনি বলেছেন : ‘ভারত সরকার ও জনসাধারণের সাহায্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করছেন।’-(ঐ)
কমডের বড় চাচা! এই হচ্ছে আপনার মােদ্দা কথা। এইবার ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে দেখুন তাে, এগুলাে কি কোনও নকশালপন্থীর উপযুক্ত কথা! আরে আমাদের ওই নয়া শশাধনবাদী যে সি পি এম, সেও দুবেলা অবজেকটিভ কনডিশন অনুসারে আওয়াজ দেয়, ‘ইন্দিরা ইয়াহিয়া: এক হ্যায়, ভুলাে মৎ ভুলাে মৎ। আর সেখানে আপনি, নিতান্ত কচি খােকাটি তাে নন, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছেন, সেই আপনি কি না ভারত সরকার এবং জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বসলেন। জনগণের কথা ছেড়েই দিলাম, কৃতজ্ঞতা একেবারে খােদ ‘ভারত সরকারের কাছে!! আমাদের পজিশনটা কী দাঁড়াচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন!
আর আপনার সাক্ষাৎকারটাও আপনি দিয়েছেন। একেবারে গেঁয়াে লােকের মত সােজাসুজি গত ‘দু’সপ্তাহ ধরে শত চেষ্টা করেও আমাদের এপারট কমরেডরা ওর মধ্য থেকে এমন কোনও ফঁাড়া বের করতে পারেনি, যাকে ব্যাখ্যা করে ড্যামেজটা কমিয়ে দেওয়া যায়।
চাচা, চিরকাল আমরা আপনাকে মাথায় করে রেখেছি। এই সাইডে আমাদের যেমন ভাইস চেয়ারম্যান চারুদা, ওই সাইডে তেমন কমরেড তােহার গুরু আপনাকে আমরা এই সাইডে ওইভাবে তােল্লা দিয়ে এসেছি। আর সেই আপনি আমাদের লাইন না বুঝেসুঝে একের পর এক এমন সব কাণ্ড করে চলেছেন যে আমাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রামটাই ওল্লা হয়ে যাবার দাখিল! ছাঃ!
যাক, যা হবার তা হয়েছে। আমাদের কমরেড এবং তরুণ ক্যাডারদের মধ্যে আপনার এই সব আলটু ফালটু কথাবার্তায় কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, সেটা মেরামত করার জন্য তাদের বলতে বাধা হয়েছি যে, বুড়াের ভীমরতি ধরেছে। প্লিজ, কিছু মাইনড় করবেন না। অ্য। আবার এটাও জানিয়ে রাখি, আপনার ভাবমূর্তিটা আমাদের কমরেড এবং ক্যাডারদের মধ্যে এতই উচ্চ ছিল যে আপনার যে ভীমরতি ধরেছে (প্লিজ চাচা, ডােন্ট মাইনড়। আঁ।) সেটা বােঝাতে আমাদের অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতে হয়েছে। কী প্রমাণ? ওই যে, যেখানে চীন এবং রাশিয়া সম্পর্কে আপনি সখেদে বলেছেন, ‘এত শুনে, এত দেখেও যদি ওদের বিবেক জাগ্রত না হয়…..’ ব্যাস ওইটেই মােক্ষম প্রমাণ। কমিউনিসট কানট্রির বিবেক বলে কিছু আছে, ভীমরতি না ধরলে কেউ কি তা প্রত্যাশা করে? ওই এক প্রমাণেই চাচা আপনি ফিনিস্।
এবারে চাচা আমাদের লাইনটা শুনুন।
১. বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সেটা মুক্তিযুদ্ধ নয়। কেননা শেখ মুজিব এই সংগ্রামের নেতা এবং মুজিবকে ইয়াহিয়া লাইক করেন না এবং চীন ইয়াহিয়াকে লাইক করে। এবং চীনের পথ আমাদের পথ। ক্লিয়ার?
২. ইয়াহিয়া সিয়াটোর সমর্থন পাচ্ছে এবং সিয়াটো আমেরিকার সমর্থন পাচ্ছে এবং ইয়াহিয়া চীনের সমর্থন পাচ্ছে এবং চীন আমেরিকার সঙ্গে পিংপং খেলছে। এবার আমরাও আমেরিকার সঙ্গে পিংপং খেলব। কারণ চীনের পথ আমাদের পথ। ক্লিয়ার?
৩. ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধকে চীন সমর্থন করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দমন করতে চীন ইয়াহিয়াকে মদত দেয় এবং চীন সিংহলের বিদ্রোহ দমনের জন্য মাদাম বন্দরনায়ককে অভিনন্দন জানায় এবং যত খুশি সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কারণ? চীনের খুশি। এতে কার বাপের কী! ক্লিয়ার?
৪. ইন্দিরা ইয়াহিয়া এক হ্যায়’ (এবং ইয়াহিয়া চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ কা ভাতিঝা হ্যায়) এবং ইয়াহিয়া চেয়ারম্যান এক হ্যায় এবং ইন্দিরা চেয়ারম্যান দোনাে হ্যায়। তাই আমরা ভারতকে চীনের গ্রাসে ঠেলে দিয়ে ভারত আর চীনে এক সরকার কায়েম করতে চাই। মাও সে তুঙ যুগ যুগ জীও। ক্লিয়ার?
চাচা, এই বৃদ্ধ বয়সে এই সাইডে এসে প্রাণপাখিটাকে যদি খাচায় আটকা রাখতে চান, তবে আমাদের লাইন ধরে চলুন, কেবল আমাদের মত পিংপং খেলুন।
সূত্র: দেশ ॥ ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮