ঘরে বাইরে
সােনার বাংলার ছেলেমেয়ে
শ্রীমতী
ওর নাম আর কিছু। বাবা মা ডাকতেন ‘গুল’ বলে। তাই আমিও সেই নামটাই পছন্দ করেছি। কারণ প্রথম দেখাতেই ও আমাকে ‘মাসিমা ডেকেছে। পরম আন্তরিক সে ডাক। মনেই হয় না আমি সত্যি ওর মাসিমা নই। সেদিনই জিজ্ঞাসা করেছিলাম একটু চা খাবে?’ চা না মাসিমা, আমারে যদি খাওয়াইবেনই তবে মাছভাত। কতকাল যে মাছভাত পাই নাই।’
সােনার বাংলার সােনারচাদ ছেলে। বয়স বাইশ চব্বিশের বেশি নয়। শিক্ষায়, কৃষ্টিতে ঝলমল করছে তার দৃষ্টি। ধারকরা চোঙ্গ প্যান্টের চপলতা নয়, আপন ঐতিহ্যের প্রকাশ পরিপূর্ণ। শিক্ষা সমাপন করে কর্মস্থলে একা থাকতাে। ঘরে ছিল দুখানা বড় ছবি। একটি ওর বাবার আর একটি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর কথায় সে উচ্ছল হয়ে উঠলাে। Charismatic নেতা বঙ্গবন্ধু। পােলিটাকাল সায়েন্সে Charismatic Leader কাকে বলে বােঝাচ্ছিল। গুল্ পােলিটিকাল সায়েন্সের ছাত্র । আমার মাথায় ঢুকছিল না তাই অভিধান খুলে দেখলাম। সহজ কথায় charisma হচ্ছে personal magic of leadership নেতৃত্ব করার ব্যক্তিগত জাদু। তার পাশে বাবার ছবি। বাবাকে যে শ্রদ্ধা করতে পারে না, জগতে সে কাউকে শ্রদ্ধা করতে পারবে না। শ্রদ্ধাহীন জীবনে সার্থকতার সম্ভাবনা কই? গুল-এর কথাগুলি কেমন আমার নূতন নূতন ঠেকলাে। অনেকদিন যেন এসব শুনিনি।
সংগ্রামে সফল হতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু মানুষ্যত্বের মাপ ও মর্যাদায় ওরা অবলীলাক্রমে অগ্রসর হয়েছে কারও সাধ্য নেই পিছনে টানা। যখন অন্যত্র রবীন্দ্রনাথের অবমাননা হয়, তখন রবীন্দ্র সংগীত শুনবার জন্য জান দেয়। তাই তাে বুদ্ধিজীবীরা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরতার প্রথম বলি।
গুন্ এর মত দুচারজন এসেছে দুনিয়ার দরজায় কিছু সত্য পেশ করতে। বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে ভারতবিরােধী গুলতান করছে পাকিস্তান সরকার—তার প্রচারের পথ বন্ধ করতেও এরা ব্যস্ত। নইলে সুস্থ সবল যুবক তাে বিশেষ আসেনি। তারা রয়েছে ত্ৰাস্ত ভীতকে আশ্বাস দিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতেই এই যে বিশ-বাইশ লক্ষ লােক নিজের দেশঘর ছেড়ে এসে শরণার্থী শিবিরে পথেঘাটে পড়ে আছে, তাদের শতকরা আশিজনই মেয়ে, শিশু, বৃদ্ধ বা অসুস্থ মানুষ। তাদের তাে এরাই বলেছে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার কথা। কত মসজিদ, মন্দির, বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয়েছে কামানের গােলায়, কত নারী সয়েছে চরম নির্যাতন। নিপীড়ন আর নিগ্রহের প্রতিশােধে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশের যুবশক্তির সামনে এও এক কঠিন পরীক্ষা।
সব সংকট পার হয়ে যে মেয়েরা ভারতসীমা অতিক্রম করেছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাহিনী পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী। এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে ৩০টি মহিলা ও শিশু সীমানা অতিক্রম করে এলেন নদীয়ায়। এবারের শরণার্থীর এরাই প্রথম। পুরুষ যারা সঙ্গে এসেছিলেন তারা এদের এগিয়ে দিয়ে ফিরে গেছেন আপন কর্তব্য স্থানে। সেই ৩০ থেকে আজ একমাত্র ত্রিপুরাতেই শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৩০ হাজার।
এরা বাস্তুহারা নয়। সকলেই আপন ঘরে ফিরে যাবার জন্য উন্মুখ। সােনার বাংলা যেদিন ফিরে যাবার মত হবে, সেদিনই তারা আর পরবাসে থাকবে না। আজকের মত চাই ক্ষুধার অন্ন, রােগে সেবা আর শােকে মানুষের কাছে মানুষের মত সান্ত্বনা। অঞ্জলিভরে সাধারণের সহানুভূতি রয়েছে তাদের জন্য। শুনেছি যেখানেই তারা ভারতের দুয়ার পেরিয়ে অন্দরে এসেছেন, কি পশ্চিমবঙ্গ, কি মেঘালয় বা ত্রিপুরা অথবা আসাম, পথের মানুষও ডেকে নিয়ে গেছে তাঁদের। তারা দিয়েছেন অন্ন, দিনের পর দিন দিয়েছেন আশ্রয়। সরকার যা করছেন তার বাড়তি এগুলি। শরণার্থীরা সবাই ঐ একই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যাশী। ভারতের মানুষ নিরন্ন দরিদ্র মানুষ ভাগ করে খাচ্ছে তাদের সামান্য যা কিছু সম্বল। বিদুরের দেশ শরণার্থীকে বিমুখ করে না। কিন্তু সারা বিশ্ব শয়তানির শত স্বাক্ষর উপেক্ষা করে চলেছে। কোথায় বা গেল আটচল্লিশ সালের Declaration of Human Rights, আর কোথায় বা জেনেভা কনভেনশন। ওঁরা কঙ্গোদেশের বেলায় যেমন বায়ুবেগে এগিয়ে এলেন, বঙ্গদেশের বেলায় তেমন হলাে কই? UNICEF দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিধ্বস্ত দেশগুলিতে শিশুদের জন্য কত না করেছেন। এখন সামান্য সাহায্য পাঠিয়েছেন। মুখে বলছেন, “What counts at this age of an emergency is speed.” বর্তমান যুগে নাকি ক্ষিপ্রতাই সবার আগে গণ্য। কোথায় সে ক্ষিপ্রতা? শিশুরা শিবিরে শিবিরে মহামারীর কবলে পড়বার সম্ভাবনাময় অবস্থায় সে ক্ষিপ্রতার ভরসায় আছে।
নিত্য ভিক্ষা ভিন্নও শরণার্থীদের কত সমস্যা। আয়েষা হােসেন নামে একটি ১৩ বছরের মেয়ে অনবরত অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাপ ও ভাই-এর সঙ্গে কুষ্টিয়াতে থাকতাে সে। পাকিস্তানি সৈন্য তার সামনে বাপ ভাইকে হত্যা করেছে। সে উভ্রান্ত অবস্থায় গায়ে গায়ে ঘুরছিল। আমাদের সীমান্ত রক্ষীরা দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছে। এখন শ্রীমতী হােসেন আলির তত্ত্বাবধানে আছে। কোথাও বা ভারতীয় সীমান্তবাসিনী তরুণীকে পর্যন্ত পাক দস্যু পাশবিক অত্যাচারের পর হাটেমাঠে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। ৬ই মে তারিখে চারটি তরুণীকে ঐভাবে হাকিমপুরের কাছে পাওয়া যায়।
নারীর অপমানও বিশ্ববাসীর কাছে এখন অবজ্ঞার ব্যাপার। নারী যেন তার মর্যাদা স্বয়ং রক্ষা করতে পারে, এ শিক্ষা সবার আগে প্রয়ােজন হয়েছে। নাসিম রহমানের মত মেয়ে যদি গড়ে উঠতে পারে তবে ভাবনার বােঝা অনেক কমবে। নাসিম চাটগার ছাত্রী। পরীক্ষার পর ছুটিতে রাঙ্গামাটি গিয়েছিল। সেখানে তার বাবা ছিলেন পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট। ত্রিপুরা সীমান্তে এসেছে পরিবারটি। নাসিম রহমান সীমান্তে একটি ছােট হাসপাতাল খুলে মুক্তিফৌজের আহত সৈনিকের সেবা করছেন। ১৬টি রােগীকে রাখা হয়েছে একটি বাড়িতে। দিনে শতাধিক রােগীর চিকিৎসা ওঁরা করে থাকেন। নাসিমের কলেজ থেকে আরও দুটি মেয়ে এসেছে সাহায্য করতে। বাংলাদেশের একটি নার্সও যােগ দিয়েছে। এখন পুরােদমে সেবা চলেছে। আয়ােজন সামান্য, উৎসাহ উদ্যম অসীম। খুব বেশি জটিল সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে পাঠানাে হয়। গুল এর মুখে চোখে যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত তার সহমর্মী হবার যােগ্য মেয়ের অভাব নেই। কামান দিয়ে এদের কমাননা কি কম কথা?
সূত্র: দেশ
২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮