You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের অর্থনীতি
শরণার্থীদের আগমন ও ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয়
সুব্রত গুপ্ত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে এবং নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর জঙ্গী পাকিস্তান সরকারের আক্রমণের ফলে যে ৫০ লক্ষ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহজেই অনুমান করা চলে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের নরমেধ যজ্ঞের তুলনা নেই-শরণার্থীদের আগমনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর এ ধরনের চাপ সৃষ্টি হবার নজিরও আর দেখা যায়নি। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং আশু প্রয়ােজন মেটাবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তবুও এই সমস্যা জর্জরিত করেছে পশ্চিম বঙ্গের অর্থনীতিকে। শরণার্থীদের দেখাশােনা করার ভার রাজ্য সরকারের উপর। সেনাবাহিনী সরাসরি শরণার্থীর ভার নিতে অনিচ্ছুক। শরণার্থীদের পুরা দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। ভারত সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য যে সাহায্যের আবেদন করেছেন, তার পক্ষে কিছু সাড়া পাওয়া গেলেও আশানুরূপ সাহায্য এখনও পাওয়া যায়নি। এই সমস্যার তীব্রতা যে এখন কত বেশি হয়েছে-তা ভাষায় বােঝানাে সম্ভব নয়। শকুনে কুকুরে লাশ নিয়ে কাড়াকাড়ি অবসাদ ও ক্লান্তিতে মৃত্যু কলেরা ও বসন্ত প্রভৃতি মহামারী প্রকোপ-সব মিলিয়ে যে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার সম্মুখীন হতে হয়েছে ভারত সরকারকে। মানবতার খাতিরে এবং বাংলাদেশের অধিবাসীদের প্রতি বন্ধুত্বের জন্যই ভারত সরকারকে এই সমস্যার সমাধান করার পথ খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় তা কতটা সম্ভব?
১৯৭১-৭২ সালের বাজেটে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ভারত সরকার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। ভারতের বর্তমান আর্থিক অবস্থায় তার বেশি টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় এই বরাদ্দ খুবই সামান্য। গত বাজেটে বেকার সমস্যার সমাধানকল্পে নতুন প্রকল্প তৈরি করার জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যদি পাকিস্তানের বর্বরােচিত নরমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত না হত, তবে ভারতের উপর শরণার্থীদের এই চাপ পড়ত না এবং বেকার সমস্যার সমাধানকল্পে আরও ৬০ কোটি টাকা বিনিয়ােগ করা সম্ভব হত। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভাবা যাক। ভারতে বেকার সমস্যার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে; কলকারখানয় অশান্তি, শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি কলকাতা শহরের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা-সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক জীবন গত কয়েক বছর ধরে বিপর্যস্ত। কিন্তু বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ আজ এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ভাইবােনদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য। যদিও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের মনে বাংলাদেশের দুর্গতের জন্য সহানুভূতি ও মমতার শেষ নেই তবুও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সঙ্গতি এতই সীমিত যে, সমস্যার সমাধানের জন্য উল্লেখযােগ্য কিন্তু করা তার পক্ষে অসম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেও এই বিপুল ব্যয়ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক প্রায় দুই কোটি টাকার প্রয়ােজন হচ্ছে শরণার্থীদের খাদ্য ও আশ্রয়ের সংস্থান করার জন্য। কেন্দ্রীয় সরকার নানা অঞ্চলে এবং বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। যারা সরকারের নির্দেশে নতুন জায়গায় যাবেন-তাদের ভরণপােষণের ব্যবস্থা কিভাবে হবে? যারা কৃষক তাদের দিতে হবে নতুন জমি, যুবকদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা এখন সরকারের ক্ষমতার বাইরে; অর্থাৎ দিনের পর দিন বিপুল অর্থব্যয়ে শরণার্থীদের জন্য আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ভারত সরকারের পক্ষে এককভাবে সম্ভব কি? বিদেশী রাষ্ট্রগুলি যদি এই সমস্যার সমাধানের জন্য সক্রিয়ভাবে এগিয়ে না আসেন তবে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামাে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উত্থান্ট শরণার্থীদের ত্রাণকার্যের জন্য ভারতকে মুক্ত হস্তে সাহায্য দেওয়ার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রকেই আহ্বান জানিয়েছেন, তবুও এই আবেদনের সাড়া এখন পর্যন্ত উল্লেখযােগ্য হয়নি। বরং এখনও বহু দেশ মনে করে পাকিস্তানের রক্ত-পিপাসু জঙ্গী শাসকচক্র ঠিক কাজই করেছে।
ভারত সরকারের পক্ষে শুধু বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করেই শরণার্থীদের ত্রাণকার্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অনেকে মনে করেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের প্রহরাধীনে বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত অঞ্চল মুক্ত করে শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসন করা। যদিও এই কাজের বিরাট ঝুকি রয়ে গেছে এবং তার ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে পুনরায় যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়ে গে শেষ পর্যন্ত হয়ত তা না করে ভারত সরকারের পক্ষে কিছুতেই শরণার্থীদের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। ২৪ বছর আগে অবিভক্ত ভারতের যারা নাগরিক ছিলেন, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তারাই আজ ভারতে শরণার্থী। রাজনৈতিক ভুলের মাশুল শুধু বাংলাদেশের অধিবাসীদেরই দিতে হয়নি-দিতে হচ্ছে ভারতের সব অধিবাসীকে। দেশ-বিভাগের পরিণতি আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা আরও জটিল। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়-সীমান্তবর্তী আটটি জেলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাও শরণার্থীদের চাপে বিপর্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ যেখানে দুবেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতে হিমসিম খাচ্ছে-সেখানে অনেকেরই আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আত্মীয়দের বাড়িতে এসেছেন, জিনিসপত্রের সরবরাহ ক্রমেই কমে যাচ্ছে এবং দামের উধ্বগতিও ক্রমেই অপ্রতিরােধ্য হয়েছে। ভারত সরকার কি এখনও কবে পাকিস্তানের বর্বরােচিত জঙ্গী শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত জাগ্রত হবে তার অপেক্ষায় থাকবেন? যে ত্রাণ সামগ্রী বিদেশ থেকে পাওয়া গেছে এবং আরও যা পাওয়া যেতে পারে সমস্যার সমাধানের পক্ষে তা খুবই সামান্য। সমস্যার সমাধানের পথ ভারত সরকারকেই খুঁজে নিতে হবে এবং এজন্য প্রয়ােজন হলে রাজনৈতিক ঝুঁকিও নিতে হবে। কারণ মানবতার দাবিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সূত্র: দেশ ॥ ৪ আষাঢ় ১৩৭৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!