ইয়াহিয়া-ভুট্টো কেন মুজিবের ছয়দফা রুখতে চেয়েছেন
অমিতাভ গুপ্ত
গত ডিসেম্বর মাসে তার বিখ্যাত ছয় দফা ম্যানিফেস্টোর উপর পাকিস্তান-এর সাধারণ নির্বাচন লড়েই শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগ এর অভূতপূর্ব বিজয়। জাতীয় পরিষদ’-এর ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়ে আওয়ামী লীগ হল ‘গণ-পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সে সময় কথা ছিল : যথা সময়ে জাতীয় পরিষদ’-এর অধিবেশনে দেশের নয়া সংবিধান রচনা করা হবে। শেখ মুজিবর বললেন : আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য হবে তাদের ছয় দফা ভিত্তিতেই একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে শেখ সাহেবের সঙ্গে রাজনৈতিক আলােচনা সেরে প্রকাশ্যে ঘােষণা করলেন : দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমান-ই পাকিস্তানের ভাবী উজির-এ-আজম্।
কিন্তু এর পরই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দল পিপলস পারটির (জাতীয় পরিষদে এদের ৮২ জন সদস্য- সকলেই পনজাব ও সিন্ধু প্রদেশের) নেতা জুলফিকর আলি ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবরের ঢাকাবৈঠক হল ব্যর্থ।
এ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘােষণা করলেন : ‘গণ-পরিষদ’-এর অধিবেশন ঢাকায় শুরু হবে। তারিখ ৩ মার্চ।
কিন্তু এর পর ভুট্টো, তাঁর দোসর মুসলিম লীগ-এর ঘাের প্রতিক্রিয়াশীল নেতা কাইয়ুম খান ও সামরিক চক্রের একদল বাঙালি-বিদ্বেষী অফিসারের প্ররােচনায় ও চক্রান্তে এমন সব ঘটনা অতি দ্রুত ঘটতে লাগল যে, সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগের ছয় দফা পিছনে সরে গেল- সামনে এসে দাঁড়াল শেখ মুজিবর রহমানের নয়া চার দফা শর্ত- যে শর্তগুলি পূরণ না হলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানাল। এই নতুন চার দফা হল
১. পূর্ববঙ্গে ফৌজকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া
২. ২ মার্চ থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে ফৌজী বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার তদন্ত,
৩. জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ,
৪. মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার।
যে-সব ঘটনার ফলে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, সামরিকভাবে হলেও শেখ মুজিবরের অপ্রতিরােধ্য ছয় দফা’র জায়গায় নয়া চার দফাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তার সূত্রপাত হয়ে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানেই। প্রধানত দুটি ঘটনা-(১) ভারতীয় বিমান হাইজ্যাকিং” ও “ধ্বংস করে সারা দেশে ক্ষ্যাপা “হিন্দুস্থান”বিরােধী মনােভাব সৃষ্টির চেষ্টা, (২) ভুট্টোর পরামর্শে প্রেসিডেন্টের “জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ৩রা মারচ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে কোন কথাবার্তা না বলেই সংখ্যালঘু দলের প্ররােচনায় অকস্মাৎ “গণ-পরিষদের অধিবেশন এভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া স্থগিত রাখার ২ মার্চ থেকে “বাংলাদেশ” যে ব্যাপক কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান দেখা দিল তা দমন করতে ফৌজী বাহিনী যে নির্মম নিষ্পেষণ চালাল তার তুলনা পাকিস্তানের ইতিহাসে নেই বললেই হয়।
প্রতিবাদে গর্জে উঠে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর ৭ মার্চ ঢাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে তার নয়া “চার দফা” শর্ত ঘােষণা করলেন।” শুরু করলেন, তাঁর ‘অহিংসা’ ও ‘অসহযােগ আন্দোলন। বাংলাদেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিলেন শেখ মুজিবর। তার ধানমন্ডীর বাসভবনই হয়ে দাঁড়াল পূর্ব-বাংলার ‘গভর্নমেন্ট হাউস।
‘বঙ্গবন্ধু’ ঘােষণা করলেন : আগে আমার নয়া চার দফা। তারপর ‘জাতীয়-পরিষদ’-এ যাব কিনা সে কথা। অর্থাৎ ঘটনাচক্রে সাময়িকভাবে হলেও চার দফাই হয়ে দাঁড়ল বাংলাদেশের মুখ্য দাবি।
কিন্তু কেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্ররােচনার জাতীয়-পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ এভাবে পিছিয়ে দিয়ে আজকের এই নিদারুণ সঙ্কট’-এর সৃষ্টি করলেন?
‘গণ-পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে ভুট্টোর কি বাধা ছিল? কেন তিনি অধিবেশনে বয়কট করার হুমকি দিলেন? বললেন, ‘জাতীয় পরিষদ’ বসলে তিনি করাচী থেকে খাইবার পাস পর্যন্ত অচল করে দেবেন?
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল বিশেষত পাঞ্জাবী গােষ্ঠি জঙ্গী-চক্র ও তাদের তল্পীবাহক জুলফিকার আলি ভুট্টোর সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা’। এঁরা নির্বাচনের আগে কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। ছয় দফার স্রষ্টা শেখ মুজিবরের আওয়ামী লীগ একাই সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ছয় দফারই ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করার মত রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করবে। নির্বাচনের পরে এঁদের সব হিসেবে গােলমাল হয়ে গেল। ওঁরা একজোট হলেন ছয় দফা’কে রুখতে হবে।
কিন্তু কেন ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্র ছয় দফাকে রুখতে চেয়েছিলেন?
ওঁরা ভয় পেয়েছিলেন ছয় দফার সংবিধান হলে :
ক. কেন্দ্র ‘দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং দুর্বল’ কেন্দ্রের হাতেও যা থাকবে অর্থাৎ দেশরক্ষা ও বৈদেশিক
সম্পর্ক তাও নিয়ন্ত্রণ করবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালিরা।
খ. বাঙালিদের কাছে কাশ্মীর অনেক দূরে। কাজেই এরা ‘দুষমন হিন্দুস্থানের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করে
নিলে কাশ্মীর-সমস্যা যবনিকার অন্তরালে চলে যাবে।
গ. “ছয় দফা” অনুযায়ী প্রদেশ গুলি স্বাধীনভাবে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারলে বাংলাদেশ; প্রথম সংযােগেই ভারত বিশেষত নিকটতম প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে দেবে। ফলে ‘আগে কাশ্মীর- তারপর হিন্দুস্থানের সঙ্গে অন্য সম্পর্ক জঙ্গীশাহীর বর্তমান এই ফরেন পলিসিই ধুলিসাৎ হয়ে যাবে।
ঘ, প্রদেশগুলির হাতে ‘করধার্য করার ক্ষমতা থাকলে বাংলাদেশ’ পশ্চিম পাকিস্তানে কাশ্মীর-উদ্ধারের জন্য রাখা বিশাল ফৌজি বাহিনীর বিপুল খরচের জন্য টাকা জোগান কমিয়ে দেবে। কারণ একই : বাংলাদেশের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়নই ‘আজাদ-কাশ্মীরে’ লড়াই করার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা।
কিন্তু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় প্রতিরােধে বিচলিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন যে, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা মেনে না নিলে বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য হারাতে হবে। শেখ মুজিবরেরই ভাষায় পূর্ব পশ্চিমের মধ্যে হবে মুখদেখাদেখি বন্ধ।
প্রেসিডেন্ট ঢাকায় গত নয় দিনে এও বুঝেছেন যে, শেখ মুজিবর রহমান তার ছয় দফায় বজ্রের মতই অটল’ এবং তিনি বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত।
তাই ঢাকার সর্বশেষ খবর :
ক. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের নয়া চার দফা’ নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন,
খ. তিনি হয়তাে ছয় দফারই ভিত্তিতেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন-ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা ভাবছেন, এবং
গ, পরে যাতে ছয় দফা বা জাতীয় পরিষদ’ বসা নিয়ে ‘ভুট্টো চক্র আবার জল ঘােলা না করে, এবং
কেন্দ্রে অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকারে পশ্চিম পাকিস্তানের কি ‘অংশ’ বা ‘দায়িত্ব থাকবে তা আগে-ভাগেই স্থির করে একটা মতৈক্যে আসবার উদ্দেশ্যেই ভুট্টো সহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে ঢাকায় শেখ মুজিবর ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কথাবার্তা চলছে।
জুলফিকর আলি ভুট্টো নিজেই সােমবার রাত্রে ঢাকায় বলেছেন যে, শেখ মুজিবরের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটা ব্যাপক মতৈক্য হয়েছে কিন্তু সঙ্কটের শেষ সমাধান এখনও নির্ভর করছে পিপলস পার্টির সঙ্গে সমঝােতার উপর।
চিরকাল চমক-প্রিয় জুলফিকর একথা বলার পর সােমবার সারা রাত এবং মঙ্গলবার সারা দিন ধরে তার বারােজন সহকারীর সঙ্গে ‘অবিরাম বৈঠকে বসেও নাকি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। দেশের জন্য দুঃশ্চিন্তায় নাকি তিনি আহার-নিদ্রা দুইই ত্যাগ করেছেন।
ভুট্টো সাহেব মঙ্গলবার ঢাকায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তাঁর দলের অন্যান্য নেতার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানেও যেতে হতে পারে। কিন্তু ভুট্টোর স্বরূপ ও অতীত যারা জানেন তারা (১) কোন সিদ্ধান্তে আসতে তার এত দৌড় ও (২) পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার ইঙ্গিতকে মােটেই সুলক্ষণ বলে মনে করছেন না। এঁদের আশংকার একবার বাংলাদেশের সীমানা ত্যাগ করলে ভুট্টো সাহেব হয়তাে একেবারে উল্টো সুরে গাইবেন। কাজেই ঢাকায় কথা উঠেছে : ভুট্টোর সাগরেদরাই যেন দরকার হলে ঢাকায় আসেন।
সূত্র: আনন্দবাজার
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯