You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | বিপন্ন মানবতার ত্রাণে | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

বিপন্ন মানবতার ত্রাণে

একটি দেশ একদা দুই হইয়াছিল। দুই-ই আছে, কিন্তু আজ আবার ‘এক হইয়াছে- আবেগে। রাষ্ট্রিক যা রাজনৈতিক কোনও অর্থে নহে। হইয়াছে মানবিক অনুভূতির প্রতিকম্পনে। বুধবার আমাদের সংসদে গৃহীত প্রস্তাবটির যদি কোনও অর্থ, কোনও সার্থকতা থাকে, তবে তাহা এইখানে। জাতির মর্মবাণীকে ভাষা দিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং, সব দল এক হইয়া ঐতিহাসিক এক অভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানাইয়াছেন। এই ঘটনাও ঐতিহাসিক।
তবু শুভেচ্ছা শুধুই করুণাঘন একটি মুখশ্রী, বাহির হইতে দেখিতে সুন্দর। তাহার কার্যকরতাও আছে কি না সেটা জানিতে ভিতরে দাঁত আছে কি না সেটাও পরখ করিয়া দেখিতে হয়। না থাকিলে “পাশে দাঁড়ানাের প্রতিশ্রুতিটা নেহাতই রূপক হইয়া দাঁড়ায়। পাশের ঘরে একটি জাতি যখন জীবন-মরণের সংগ্রামে জড়িত, তখন তাহার প্রয়ােজন আর প্রত্যাশা লইয়া হাল্কা কথার বেসাতি করার অধিকার আমাদের কেহ দেয় নাই।
আবেগের স্থান হৃদয়ে, যে-হৃদয় দুলিয়া ওঠে। আর সাহায্য অগ্রসর হইয়া আসে প্রসারিত হাতে। সেই হাতের দুইটা রূপ সম্ভবত। এক-বজ্রমুষ্টি। দুই-ত্রাণের দান মুঠি খুলিয়া ঢালিয়া দেওয়া। দ্বিতীয়টা যে কত জরুরী তাহা প্রধানমন্ত্রীর অন্য একটি বিবৃতিতেই স্পষ্ট। জাতি-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়িয়া তােলার কথা তিনি বলিয়াছেন। বিপন্ন মানবতার সংকটে এই সংস্থা অর্থ তুলিবে, ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপন করিয়া রক্ত দিবে।
এই বিবৃতির প্রয়ােজন ছিল। আজ সারাদেশে যখন হৃদয়ানুভূতি উদ্বেল হইয়া হইয়াছে, সকলেই কিছু না-কিছু করিতে চায়, দিতে চায়, তখন সেই সুযােগে কিছু কিছু সুযােগবাজও কাজ গুছাইয়া লওয়ার তালে আছে। করুণার ভাণ্ডার ভরিয়া উঠুক সবাকার ঘরে ঘরে, কিন্তু একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যেন থাকে, আর যেহেতু বাংলাদেশ” রাষ্ট্রিক বিভাজন রেখার ওপারে, সুতরাং সরকারী স্তরের আনুকূল্য নহিলে কোনও দানই পৌছিবে না। দাতা আর গ্রহীতারা সে-কথা যেন মনে রাখেন। মানুষের ভাবাবেগ ভাঙানাের তুল্য মানবিক অপরাধ অল্পই আছে। আজ প্রয়ােজন সর্বার্থসাধক একটি পরিকল্পনার, সমন্বয়ের। নহিলে বেননা, জল সব ভাসাইয়া লইয়া যাইবে।
আর সত্য কথা বলিতে কী, পূর্ববাংলার কোটি কোটি মানুষ আজ প্রায় শূন্য হাতে যে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছে তাহাতে তাহাদের প্রয়ােজন অন্য কিছুর। বস্ত্রদান অথবা মুষ্টিভিক্ষা তাহাদের অপমান। এ সেই যুদ্ধ, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। এ সেই যুদ্ধ, যাহা চুলচেরা বিচার, হিসাব, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, লাজলজ্জায় জড়াইয়া পড়িলে সবই ব্যর্থ হইয়া যাইতে পারে। “জয় বাংলা” বাহিনী একটার পর একটা রণাঙ্গনে অলৌকিক এক প্রাণের পতাকা প্রতিষ্ঠিত করিয়া চলিয়াছে। এ কথা যতটা সত্য, ততটা সত্য ইহার বিপরীত চিত্রটা আমরা এ দেশে এতকাল যাহারা কফি হাউসে বসিয়া টেবিলে টুকটাক প্রগতির গৎ বাজাইয়াছিল, যাহারা সকালের ছােট-হাজরির সঙ্গে বিপ্লব মাখনের মতাে মিলাইয়া লইয়াছি, তাহারা সত্য যে কত রুদ্র, কত দৃঢ়, কত রক্তাক্ত তাহা সহজে বুঝিব না। একটা সম্পূর্ণ সশস্ত্র বাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আর এয়ারপাের্ট ছিনাইয়া আনা “মুখেন মারিতং জগৎ” জাতীয় ব্যাপার নয়। ওঁরা পারিতেছিল, হয়তাে পারিবেন- হয়তাে কেন, পারিবেন নিশ্চয়ই কিন্তু এখনও পারেন নাই।
সর্বশেষ সংবাদ দেখাইয়া দিতেছে যে পিণ্ডির জঙ্গীচক্র এসব দৈত্য নহে তেমন। স্থলে জলে অন্তরীক্ষে হানাদার বাহিনী মরণ-কাপড় দিবে বলিয়া ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের কামানের গর্জনে সঙ্গে পাল্লা দিয়া চলিয়াছে তাহাদেরই বিমানের গর্জন। আগামীকাল অবশ্যই বাংলাভাষী বাংলা দেশবাসীর- কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তাহাদের বাঁচাইবে কে? দুনিয়া শীততাপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে বসিয়া যেন দর্শকের মতাে দূর হইতে দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করিতেছে। আজ এমন কেহই কি নাই, কোনও জাতি কি নাই যে সাহসের সঙ্গে ইসলামাবাদী শাসকনায়কদের কঠোর কণ্ঠে বলিয়া দিতে পারে, “এই নিধনযজ্ঞ তােমাদের থামাইতেই হইবে।” যদি না বলে, যদি এমন কেহ না থাকে, তবে বৃথাই সভ্যতার আস্ফালন, বৃথাই গণতন্ত্রের নামে গলাবাজি, বৃথাই সকলের চঁাদায় চলা রাষ্ট্রপুঞ্জ নামক সংস্থাটির অস্তিত্ব ও জীবন। আর-কেহ না বলে তাে, অন্তত ভারত বলুক। যেহেতু সে সবচেয়ে কাছে, তাহারই চোখের সম্মুখে মানবতা দলিত, পিষ্ট, ধর্ষিত ও নিহত হইয়া যাইতেছে। যেহেতু বাংলাদেশের ঘটনা অন্য দিকে মােড় লইলে ভারতের রাজনীতি, রণনীতি, অর্থনীতির উপরও আঘাত আসিয়া পড়িতে পারে। পিণ্ডিচক্র এত নিশ্চিন্ত হইয়া পশ্চিম-সীমান্ত হইতে পুবে সৈন্য চালান দিতেছে কী করিয়া, সেও একটা প্রহেলিকা। সঙ্কোচের শালীন সংযমে জড়াইয়া থাকা দিনে দিনে অর্থহীন হইয়া উঠিতেছে, কেননা এই লেখাটা শেষ করার ঠিক আগের মুহূর্তে খবর পাওয়া গেল পশ্চিম-পাকিস্তানের ইয়াহিয়াশাহী ইতিমধ্যেই ভারতের দিকে আঙুল তুলিয়া নালিশ জানাইয়াছে। ভারত চাক বা নাই চাক, ভারতকে সে আগেভাগে সরাসরি জড়াইয়াছে।

সূত্র: আনন্দ বাজার : ০২.০৪.১৯৭১