দিল্লি-পিণ্ডি-পিকিং : ত্রয়ীর তৃতীয়টি এখন কী করবে
অমিতাভ গুপ্ত
একদিকে ঢাকা, অন্যদিকে পিণ্ডি । প্রশ্ন উঠতে পারে, পিকিং কোথায়? সে কি পাক জঙ্গী-চক্রের সঙ্গে এখনও গাটিছড়ায় বাঁধা? ১৯৫৪-৫৫ সন থেকেই চীন নিজ স্বার্থে পাকিস্তানকে তাদের দুজনের দুশমন ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দেবার নীতি স্থির করে। ফিরে যান বানদুঙে। সেদিনকার সিয়াটোচুক্তি নিদারুণ চীনবিরােধী। তবু চু এন-লাই পাকিস্তানের তৎকালীন উজিরে আজম বগুড়ার মহম্মদ আলীকে ‘গুড ফ্রেন্ড’ বলে ডেকেছিলেন। ১৯৬৫ সনের সেপ্টেম্বরে, ভারত দেখেছিলেন, একা পাকিস্তানে রক্ষা নেই, পিকিংও দোসর। দোসর হয়নি হতে পারত, হবে বলে হুমকিও দিয়েছিল।
চলে আসেন সম-সময়ে : পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র সাতাশ দিন আগে পিকিং-এ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে যে রাজকীয় সম্বর্ধনা জানানাে হয়েছিল, তা সাম্প্রতিককালে চীনে কোন বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের ভাগ্যে জোটেনি। এ থেকে এটাই স্পষ্ট যে, চু এন-লাই সে সময় বেশ ভালভাবেই জানতেন, যেমন জানতেন পাক-প্রেসিডেন্ট নিজেও, সে এক মাস পরে নির্বাচন হােক বা না হােক, কোন অবস্থাতেই জেনারেল ইয়াহিয়া গদি ছাড়ছেন না। তাই প্রেসিডেন্টের এই সফরের সময়ই চীন পাকিস্তানকে ১১০ কোটি টাকা নতুন ঋণ মঞ্জুর করল, আর পিকিং-এর ‘পিপলস গ্রেট হলে” ইয়াহিয়া চু এন-লাই মােলাকাতের পর চীনা প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করলেন যে, চীন পাকিস্তানের “সংহতি” বা অখণ্ডতা (integrity) সংরক্ষিত করার জন্য দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাবে। ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া-শাহীর জঙ্গীশাসনের স্থায়িত্বই” যে চীনের কাম্য পাকিস্তানের নির্বাচনের সাতাশ দিন আগে এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিতেই পিকিং-এ “ইয়াহিয়া-বরণের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেল। কাজেই ইয়াহিয়াপতনের কোন সম্ভাবনা যে আপাতত চীনের অভিপ্রেত হতে পারে না তা প্রায় সুনিশ্চিত।
দীর্ঘদিন ধরেই চীনের নীতি : পাকিস্তানের বর্তমান ‘জঙ্গী’ ও ‘ভারতবিদ্বেষী কেন্দ্র অর্থাৎ রাওয়ালপিন্ডি যতদিন স্থায়ী’ ও ‘সরল, নয়াদিল্লি ততদিন ‘ব্রিত’ ও নানাভাবে দুর্বল। কিন্তু পিকিং হালে অত্যন্ত আশঙ্কিত হয়ে উঠেছে যে, তাদের সহচর রাওয়ালপিন্ডির যখন নিদারুণ সংকট, তখন তাদের দুয়েরই ‘সাধারণ শত্রু’ গণতান্ত্রিক ভারতে অত্যন্ত দৃঢ় ভিত্তিতে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাধিক্যে নির্বাচন দিতে স্থায়ী সরকার গঠন করেছেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও সে চীন ‘ভঙ্গুর পাকিস্তানকে ছেড়ে ভারতের দিকে এগিয়ে আসতে পারে, এ সম্ভাবনা কম। তারা হয়তাে বাংলাদেশের হাতে লাঞ্ছিত’ কিন্তু ক্ষিপ্ত পিনডির সামরিকচক্রকে তাদের অপমানের পরাজয়ের শােধ তােলবার জন্য মরীয়া হয়ে ভারতকে ব্রিত করার জন্য নতুন করে প্ররােচিত করবে। ভারতের অপরাধ : তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে এছাড়া লড়কে লেংগে কাশ্মীর এই জিগির তাে বাংলাদেশ’ চলে গিয়েও আছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রের আজ দুটি নিদারুণ সমস্যা :
১. নির্মমতম সামরিক ব্যবস্থায় বাংলা দেশ’কে সম্পূর্ণ নিষ্পেষিত করা- যে চেষ্টা ওরা ওদের
পশুশক্তি দিয়ে করছে,
২. বাংলা দেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া।
কিন্তু পিনডি জানে যে, প্রথম পন্থাটিতে অর্থাৎ জঙ্গী-পথে সমস্যা-সমাধান করতে গেলে তারা ক্রমে এমন এক ‘অকল্পনীয় সংকটের মধ্যে জড়িয়ে পড়বে যে, সাহায্যের জন্য তাদের শক্তিমান দোসর চীনের শরণাপন্ন হতেই হবে।
এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, কোন দেশের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন নিষ্পেষিত করতে কোন মদৎ দেওয়া চীনের আদর্শের পরিপন্থী হওয়া উচিত, কিন্তু যতদিন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক অক্যুনিস্ট শেখ মুজিবর রহমান, ততদিন পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি বিষয়ে তাদের মূল্যায়ন হতে পারে : এ আন্দোলন ‘মারকিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সংশােধনাবাদ’ ও ‘ভারতীয় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি।
আবার, রাওয়ালপিনডি যদি পূর্বেবাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করেও নেয়, তবুও সেই নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতি তাদের নীতিও নতুনভাবে নির্ধারিত করার প্রয়ােজন হবেই। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর সামনে তখন দৃষ্টি বিকল্প।
১. মূল “দুই জাতি”-তত্ত্ব যে অলীক তা উপলব্ধি করে ভারতের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে স্বাভাবিক প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক স্থাপন করা, অথবা
২. যেভাবে পার হিন্দুস্থানকে জব্দ কর’, এই জিগির আরও জোরদার করে কাশ্মীর দখল করে পূর্বপাকিস্তানকে হারানাের ক্ষতিপূরণ করা।
একজন বীরাঙ্গনা ও একটি প্যাট ট্যাংক-ইউ এন আই
আগরতলা, ৩১ মার্চ- গত শুক্রবার ঢাকা ওমেনস কলেজের প্রথম বার্ষিকীর ছাত্রী কুমারী রােশেনারা বেগম বুকে মাইন বেঁধে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তানী ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রাণ দিয়ে তিনি একটি প্যাটন ট্যাংক উড়িয়ে দিলেন। ঢাকার একজন সাংবাদিক গতকাল এখানে সেই বীরাঙ্গনার এই কাহিনী বলেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র ও তাদের সহচরদের যা অতীত ও বর্তমান তাতে প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, তারা দ্বিতীয় বিকল্পটিই বেছে নেবে, এবং সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে চীন রাওয়ালপিনডির রাজনীতি ও সমরনীতিতে আরও ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে। কাশ্মীর উদ্ধারের প্ররােচনা দিয়ে তারা বাংলাদেশকে হারিয়ে বিপর্যস্ত ও পঙ্গু পশ্চিম পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ কবজা করে ফেলতে পারে।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের পরই মুজিব-বিরােধী পশ্চিম পাকিস্তানী শিবিরে এই অদ্ভুত আওয়াজ উঠেছিল যে, হিন্দুস্থানই নাকি শেখ মুজিবর রহমানকে দিয়ে তাঁর ছয়-দফা দাবি তুলিয়েছে, কারণ পূর্ব-পাকিস্তান দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তারা স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত ও চীনের মধ্যে একটি বাফার স্টেট’-এ পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছে।
শেখ মুজিবর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন, এটা চীনের কখনই অভিপ্রেত ছিল না। অথবা পূর্ববঙ্গের মত সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি রাষ্ট্র স্বাধীন হয়ে পূর্বাঞ্চলে ভারতের মিত্র হােক, এও চীন হয়তাে চায় না।
এছাড়া চীন কোনদিনই শেখ মুজিবর রহমানকে সুনজরে দেখেনি। মুজিবর কমিউনিস্ট নন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উগ্র চীন-পন্থীদের বিরােধী তাই চীনের চোখে শেখ সাহেব ঘাের “প্রতিক্রিয়াশীল” এবং চীনের এত ভয় যে, তার ক্ষমতায় আসা পূর্ববঙ্গে চীনের অনুচরদের পক্ষে বিরাট বাধা।
অবশ্য পূর্ববঙ্গে’র ‘স্বাধীনতা’, ‘স্বাতন্ত্র চীনও হয়তাে সমর্থন করবে যদি তা আসে ‘লাল’ মৌলানা ভাসানি বা তাদের বিশ্বস্ত অন্য কোন উগ্রপন্থীর নেতৃত্বে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলাদেশের কোটি কোটি ‘স্বাধীন মানুষের নেতৃত্ব থেকে বিচ্যুত করতে পারে এমন কোন শক্তিই আজ পৃথিবীতে নেই। সেজন্যই সম্ভবত মৌলানা ভাসানি স্বাধীন বাংলার রণাঙ্গন থেকে ঘােষণা করেছেন : মুজিবই আমার সর্বাধিনায়ক।
সূত্র: আনন্দবাজার : ১.৪.১৯৭১