You dont have javascript enabled! Please enable it!

রক্তে-রাঙা শহিদ-সড়ক

যশােহর শহরের একটি প্রশস্ত সড়কের নাম সম্প্রতি পালটাইয়া গিয়াছে। আগে এই রাস্তার যে নাম ছিল, এখন আর তাহা নাই। নূতন নাম হইয়াছে ‘শহিদ সড়ক’। নামান্তরের মূলে আছে তাৎপর্যময় একটি ঘটনা। এই সড়কেরই বুকের উপরে কয়েকদিন আগে পাক সৈনিকের বুলেটের আঘাতে যশােহরের মুক্তি-সংগ্রামের প্রথম শহিদের বুকের রক্ত ঝরিয়াছিল। সেই শহিদের নাম চারুবালা। বলা বাহুল্য যশােহরের মুক্তিকামী জনতা তাহার পরেও অনেক পথে তাহাদের বুকের রক্ত অনেক ঢালিয়াছেন; জঙ্গী শাসকদের কামান আর রাইফেল সেখানে আরও জনেক পথের ধুলাকে রক্তে-রক্তে রাঙাইয়া দিয়াছে। কিন্তু প্রথম আত্মাহুতির এই ঘটনার তাৎপর্য তবু অপরিমেয়; এবং সেই তাৎপর্য তবু অপরিমেয়; এবং সেই তাৎপর্যকে সম্মান জানাইবার জন্যই পুরানাে একটি সড়ককে আজ নূতন নামে ডাকা হইতেছে।
শুধু যশােহর বলিয়া কথা নাই, শুধু একটি সড়ক বলিয়াও না; শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি-পাগল বাংলাদেশের অনেক গ্রাম, অনেক গঞ্জ, অনেক শহর, অনেক নদী আর অনেক প্রান্তরই তাে আজ অসংখ্য শহিদের রক্তে রাঙা; সুতরাং নূতন নামে ধন্য হইতে পারে তাহাদের অনেকেই। তবু-সত্য লক্ষ-মানুষের পায়ের চিহ্ন আঁকা পথের উপরে যখন রক্ত ঝরে, মানুষের কল্পনা তখন যেন একটা আলাদা রকমের প্রেরণা পায়। হেতু আর-কিছুই নয়, পথ আসলে সেই উপায়, মানুষকে যাহা তাহার লক্ষ্যে পৌছাইয়া দিবার প্রতিশ্রুতি দিতেছে। মানুষ জানে ঘরে বসিয়া লক্ষ্যে পৌছানাে যায় না, পৌছিবার জন্য পথে নামিতে হয়। ঠিক যে, ঘরের চাইতে পথের বিপদ অনেক বেশী, কিন্তু স্থির কোনও লক্ষ্য যাহাকে ডাক দিয়াছে, বিপদ বরণ না করিয়াই তাহার উপায় কী? গৃহাঙ্গনের সীমা ছাড়াইয়া পথের উপরে পা না না বাড়াইয়া কোনও উপায়ই তাহার নাই।
এক-একজন কবি এক-এক চোখে পথকে দেখিয়াছেন। জানালায় চোখ রাখিয়া রবীন্দ্রনাথের যেমন “পথ চাওয়াতেই আনন্দ”, তেমনি আবার পথ চলাতেও তাহার আনন্দ কিছু কম ছিল না উপরন্তু মানুষেমানুষে পথই যে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি বাধিয়া দেয়, তাহার কথাও তিনি সমান আগ্রহে শুনাইয়াছেন। বিদেশী কবি হুইটম্যানের কণ্ঠেও পথ-চলা সম্পর্কে এই একই শ্রদ্ধার উচ্চারণ শুনি। তাঁহার ‘খােলা পথের গান’ কবিতার উপসংহার তিনি ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করেন, “তুমি কি নিজেকে উৎসর্গ করিবে? তুমি কি আমার পথের সঙ্গী হইবে?” প্রশ্ন বলা যায়, আহ্বানও বলা যায়; এবং বলিলে নিশ্চয় অত্যুক্তি হইবে না যে, ‘বাংলাদেশ’-এর জাগ্রত জনতার উদ্দেশে মুজিবরও এই একই আহ্বান জানাইয়াছিলেন। “তােমরা কি নিজেদের উৎসর্গ করিবে? তােমরা কি আমার পথের সঙ্গী হইবে?” দুর্জয় জনতা সেই ব্যাকুল ডাকে সাড়া দিয়া পথে নামিয়াছেন। সেই পথের উপরে অনেক রক্ত ইতিমধ্যে ঝরিয়াছে, এবং আরও অনেক অনেক রক্ত হয়তাে ঝরিবে, কিন্তু পথটা যখন শহিদ সড়ক, তখন লক্ষ্যেও তাহারা পৌছিলেন ঠিকই।

সূত্র: আনন্দ বাজার : ৮.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!