You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.08 | “ত্রাণ” হইতে পরিত্রাণ | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

“ত্রাণ” হইতে পরিত্রাণ

“কী চান, আমাদের কাছে কী প্রত্যাশা আপনার?” “বাংলাদেশের সংগ্রামী আত্মাকে এই প্রশ্ন যদি করা যাইত, তবে সম্ভবত আর্তস্বরে একটিই উত্তর উঠিয়া আসিতঃ “ত্রাণ হইতে পরিত্রাণ।” ওধারে কোটি কোটি মানুষ রক্তের অক্ষরে যখন স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকারের ঘােষণাপত্রটি লিখিয়া চলিয়াছে, এধারে তখন ভাবে সব ডুবুডুবু, দশাগ্রস্তদের বিভাের নাচ শুরু হইয়াছে। আরও লজ্জা যে, সবটাই ত্রাণের নামে। যিনি যেখানে পারেন চাঁদার খাতা খুলিয়া বসিয়াছেন, ব্যাপারটা যেন শুভ হালখাতা বা পুণ্যাহ জাতীয় ব্যাপার। ছােট-বড় নানা দল-উপদল যথারীতি এক-একটি করিয়া কমিটী বসাইয়াছেন- উদ্দেশ্য আর-কিছু নয়, আত্মপ্রচার, ফলাও করিয়া কাগজে নাম ছাপাননা। মনে রাখিতে হইবে যেখানে আজ দুর্যোগের অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে সেটা রাষ্ট্রীয় সীমানার ওপারে। কোনও প্রাইভেট চ্যারিটি, ব্যক্তিগত খয়রাতি, কোনও সদিচ্ছা বা শুভেচ্ছার হাত সহজে ওই পারে পৌছাইয়া দেওয়া যাইবে না। প্রয়ােজন আমাদের রাষ্ট্রের সক্রিয় সহায়তার।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কেন্দ্রীয় কমিটী গঠিত হইয়াছে। শাখা-প্রশাখা এখানে-ওখানে দেখা দিতেছে দিক, তবু ইহাও ঠিক সকলের সংগ্রহ মূলে গিয়া সমৰ্পণ করিতে হইবে। যাহারা সত্যই সাহায্য করিতে চান তাহারা সমন্বয়ের কথাটা ভাবিয়া দেখুন, নহিলে সব সহায়তাই ছত্রখান হইয়া যাইবে। এ ছাড়া যাহারা এই মওকায় শুধু কিছু গুছাইয়া লইতে চায়, তাহাদের সংখ্যাও কম নহে। তাহাদের মতলব, এক কথায় তহবিল-তছরূপ।
তাহাদের বাক্সে চাদা দেওয়া আর ঠিকানাহীন খামে চিঠি পাঠানাে একই কথা। পরােপকারও এই দেশের কপালগুণে একটা আনলিমিটেড কোম্পানির ব্যবসায় হইয়া ওঠে বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদির বেলায় অতীতে বহুবার তাহা দেখা গিয়াছে, বিশ্বের এক অশ্রুতপূর্ব সংগ্রামে লিপ্ত পূর্ববঙ্গকে লইয়াও তাহার পুনরাবৃত্তি ঘটিলে আমাদেরই জাতীয় লজ্জা।
লজ্জাবােধ অবশ্য এ দেশে সর্বজনীন একটা লক্ষণ নহে। হইলে হরিদাসপুর ইত্যাদি সীমান্তগুলিকে শখের পিকনিকের জায়গা করিয়া তােলা হইত না। দলে দলে “সাহায্য-দাতারা সেখানে ছুটিতেছেন, অনেকেরই আসল লক্ষ্য বিনি পয়সার মজা। কোনও কোনও “বীর” আবার শরণার্থীদের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া আমাদের সীমান্তরক্ষীদের কঠিন কাজ কঠিনতর করিয়া তুলিতেছে।
এই “পকেট-বিপ্লবের মূলুকে এই ধরনের বীরত্ব অবশ্য অবাক বা আজব কাণ্ড কিছু নহে। বােঝ উচিত ছিচকে চুরিতে হাত-পাকানাে আর দুঃসাহসিক মরণরতসাধন ঠিক এক বস্তু নহে। অপ্রস্তুত মানুষকে মারা অরক্ষিত ট্রাম বাস জ্বালানাে আর পেটো-পটকা ছোঁড়া- সীমান্তে? এপারে বিপ্লবের এই বিকলাঙ্গ সংস্করণ চলিতেছে চলুক, কিন্তু ওদিকে মুহুর্মুহ কামানগর্জন, বিমানের হানা, ঝলকে ঝলকে গােলা আর আগুনে আঁকা মৃত্যুর প্রতিমার ভিতরে মৃত্যুঞ্জয় প্রাণের পরিচয় লেখা। লিখিত হইয়াই চলিয়াছে। সাত দিন, দশ দিন অতিবাহিত হইয়া গেল, সাঙ্গ হয় নাই, সহজে বুঝি হইবেও না।
আমরা তাহার কী বুঝিব, কী বুঝিতে পারি। আমাদের ধারণা, আন্দাজ আর হিসাব সব-কিছু, ছাপাইয়া ওখানে বৃহৎ এক ইতিবৃত্ত-কথা রচিত হইয়া চলিয়াছে। “বাংলাদেশের সৈনিকদের কী চাই, তাহাও কি ভাবিয়া দেখিয়াছি? খসখসে ছাপানাে নােট নয়, চাই আহতের ঔষধ আর সােজাসুজি লিখিয়া দেওয়াই ভাল অস্ত্র। বুলেট, ডিনামাইট, ফ্রেমথ্রোয়ার কিংবা তার চেয়েও ভারী হাতিয়ার। এ সব না দিয়া শুধু বুকে কালাে ব্যাজ ঝুলাইলে সে কালি আমাদেরই মুখে পড়িবে, কেবলই শ্লোগান দিলে সেই চিৎকার আমাদেরই টিটকারি দিবে।
আরও কিছু দিলে হয়তাে ভাল হয়- দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনী। ইতিহাসে তাহার স্বীকৃতি আ আমাদের রাষ্ট্র সংগ্রামী সরকারকে দিতে পারে স্বীকৃতি। মােটের উপর যা দিতে হয় তাড়াতাড়ি নতুবা “সােনার বাংলা” গানটি কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিলেও পরে কূল পাইব না। “সােনার বাংলা” শুশান হইয়া গেলে আমাদের করিবার আর বাকী থাকিবে কী? তখন কি তাহার চিতায় মঠ তুলিয়া দিব, আর সেই মঠের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লিখিয়া রাখিব “বড় ভালবাসি”।

সূত্র: আনন্দ বাজার : ৮.৪.১৯৭১