সাচ্চা দাসের কণ্ঠস্বর
ইয়াহিয়া খা বাংলাদেশে নাকি একজন কুইসলিং-এর সন্ধান পাইয়াছেন; সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে মাত্র একজন। তিনি স্বনামধন্য- নূরুল আমিন। মুসলিম লীগের কুখ্যাত নেতা, পিণ্ডির বাদশাহদের পুরানাে বন্দা ঢাকা বেতারে তাহার কণ্ঠস্বর শােনা গিয়াছে। অবশ্য গলা তত চড়া নয়, বক্তব্য নাতিদীর্ঘ, কিন্তু পুরােপুরি হিজ মাস্টার্স ভয়েস। ভারত পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছে ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করিতে চায়, তিন মিনিটব্যাপী, ইত্যাদি নানা শিখানাে বুলি। বিন্দুমাত্র মর্যাদাবােধ থাকিলে নূরুল আমিন নিশ্চয় বুঝিতে পারিতেন তাহার এই ভাষণে ভারতের কোনও ক্ষতি নাই, কিন্তু বাংলাদেশের হাজার হাজার শহীদের অপমান। পূর্ব বাংলার কোটি যােদ্ধার রণধ্বনির মধ্যে নূরুল আমিন নামক জনৈক দাসের এই কণ্ঠস্বর হয়তাে ইথার-তরঙ্গে হারাইয়া যাইবে, কিন্তু ইতিহাস তাঁহাকে নিশ্চয় ভুলিয়া যাইবে না। কুইসলিংকে কেউ ভােলে না।
সার্থক তুলনা। নরওয়ের কুইসলিং আর বাংলার নূরুল আমিন। নরওয়ের রাজনীতিক ভিদকুন কুইসলিং অভিধানে ঠাই পাইয়াছেন বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসাবে। কে জানে, হয়তাে বিভীষণের মত, মীরজাফরের মত নূরুল আমিনও বাংলা-অভিধানে পরিণতিলাভ করিবেন প্রতীকে। নাৎসীরা যখন নরওয়ে আক্রমণ করে কুইসলিং তখন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মুহুর্তে তিনি নিজেকে ঘােষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁহার বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী সেখানেই শেষ নয়। দখলদার নাৎসী ফৌজ যখন দেশের আর সব রাজনৈতিকদলকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে তখন একমাত্র মুক্ত দল কুইসলিংয়ের ফ্যাসিস্টগােষ্ঠী- ন্যাশনাল সামলিং। নাৎসীদের কোলে বসিয়া কুইসলিং একটি তাঁবেদার সরকারও গঠন করিয়াছিলেন সেদিন। মস্ত পদবী মিলিয়াছিল তাহার-মিনিস্টার প্রেসিডেন্ট। নুরুল আমিনও কি সেই প্রত্যাশায়ই আছেন? তাহা নাহইলে আর সকলে যখন কারাগারে কবরে, অথবা রণক্ষেত্রে তখন শুধু তিনিই কেন খা-সাহেবদের খাস কামরায় ইয়াহিয়া অতুলনীয় এক তাবেদারের সন্ধান পাইয়াছেন সন্দেহ কী! জাতীয় পরিষদে নূরুল আমিনের দল ডেমোেক্র্যাটিক পার্টির একজনই সদস্য, এবং একমেবা অদ্বিতীয় সেই পুরুষই ইনি- নূরুল আমিন। একজনের দল, নিজেই নায়ক, নিজেই সমর্থক। সুতরাং, বাংলা তরফে কথা বলিবার মত হকদার তাহার মত কে আর?
মর্মাহত হওয়ার কিছু নাই। কুইসলিং, নুরুল আমিন- এ জগতে সবই সম্ভব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসে এমন কাহিনীও আছে যখন দেখা গিয়াছে মুক্ত প্যারিসের রাস্তায় জনতার বিদ্রুপ এবং ঘৃণাকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া বন্দী নাৎসী বাহিনীর পিছু পিছু নিঃশব্দ চরণে হাঁটিয়া চলিয়াছে একাকিনী এক ফরাসী রূপােপজীবিনী। বিচ্ছেদ তাহার কাছে অসহ্য। ফরাসীদের মুক্তি সংগ্রাম এই পেশাদার অর্থলােলুপ রমণীর জন্য আটকাইয়া যায় নাই, পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধও নুরুল আমিনের জন্য থমকিয়া দাঁড়াইবে না। কুইসলিংয়ের মতই নিয়তি তাহার জন্য অপেক্ষায় থাকিবে। কুইসলিং দেশবাসীর বিচারের মৃত্যুদণ্ড লাভ করিয়াছিলেন, তাহার পরিণতি খুবই করুণ। নূরুল আমিনকেও অবশ্যই একদিন ইতিহাসের রায় মাথা পাতিয়া লইতে হইবে।
এখন যদি তিনি বলেন, যা বলিয়াছেন সত্য বলেন নাই, স্বেচ্ছায় বলেন নাই, তাহাতেও জাতীয় সংকটের একটি দিনে জাতির সঙ্গে বেইমানির প্রায়শ্চিত্ত হইবে না। অনেকে আমার হাতে তামাক খাইয়া গিয়াছে এটা বাতুল যুক্তি এবং শঠতা। বক্তারা চরিত্র-দৌর্বল্যে সূচিত করে মাত্র।
সূত্র: আনন্দবাজার : ৮.৪.১৯৭১