You dont have javascript enabled! Please enable it!

শােকাশ্রু
অন্নদাশংকর রায়

পঁচিশে মার্চের ঘটনার পর থেকে আমার মনকে আমি এই বলে শান্ত রেখেছিলুম যে, কদবার সময় এটা নয়, এটা লড়বার সময়। লড়ছে যারা তাদের লড়তে সাহায্য করতে হবে। বল জোগাতে হবে। নিজে শক্ত হতে হবে। আগে তাে যুদ্ধ শেষ হােক, দেশ মুক্ত হােক, তারপরে নিহতের জন্যে শােক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে। এখন যদি আমি আমার উগত অরােধ করতে না পারি তবে সেটা মানুষমাত্রেরই স্বভাবধর্ম। এখন যদি না কাঁদি তাে কাদব কখন! গীতা কোরান বাইবেল একবাক্যে বলে যে মৃত যাদের মনে হচ্ছে তারা কেউ মৃত নয়, তাদের আত্মা অমর। তা সত্ত্বেও মানুষের জন্যে মানুষের কান্না থামে না। আর এ তাে একজন দুজন নয়। কমবেশী দশ লাখ লােক।
সকলেরই জন্যে আমি শােকাকুল, তবু বিশেষ করে তাদের জন্যে যাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল। ফরাসীতে যাদের বলে এলিৎ। সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক গায়ক বাদক অভিনেতা চিত্রকর ভাস্কর ডাক্তার উকিল হাকিম এনজিনীয়ার অধ্যাপক শিক্ষক ছাত্র। অন্যান্য দেশেও এঁদের মতাে লােকের উপর নির্যাতনের নজীর মেলে কিন্তু সে নজীর অন্যায়ভাবে কণ্ঠরােধ করার, আটক করার, কারাদণ্ড দেওয়ার, বিচারপূর্বক প্রাণদণ্ড দেওয়ার। তালিকা তৈরি করে হানা দিয়ে হত্যা করার নজীর কি ইতিহাসের অন্য কোনাে অধ্যায়ে মিলবে? নাৎসীরা যাকে সন্দেহ করত থাকে সরাসরি খুন করত সেটা ঠিক। কিন্তু একটা দেশের সমগ্র এলিৎকে নির্মূল করার পরিকল্পনা নাৎসীদেরও ছিল না বােধহয়।
পঁচিশে মারচের ঘটনার পরও বহু বুদ্ধিজীবী প্রাণ নিয়ে দেশে বাস করছিলেন। কর্তারা তাঁদের আনুগত্যের বিনিময়ে তাঁদের অভয় দিয়েছিলেন। কর্তাদের উপর বিশ্বাসই তাদের কাল হলাে। পরাজয় আসন্ন দেখে পাকিস্তানী ফৌজ আবার এক তালিকা তৈরি করে ও তাদের তাঁবেদার বাহিনীর হাতে দেয়।
শােনা যায় তাতে ছ’ হাজার নাম ছিল। তাদের সবাইকেই সময় পেলে বধ করা হতাে, ভারতীয় সৈন্য হঠাৎ গিয়ে হাজির হওয়ায় অধিকাংশই প্রাণরক্ষা হলাে। যতদূর জানা গেছে শতিনেক বুদ্ধিজীবী নিহত বা নিখোঁজ। এক ঢাকাতেই তার অর্ধেক! এঁদের অনেকেই সাহিত্যে সুপরিচিত। এঁদের লেখা আমি পড়েছি, অন্তত নাম শুনেছি। এঁদের জন্যে আমি বিশেষ শােকার্ত।
অবিশ্বাস্য শােক মানুষকে হতবাক করে। হতবাক হই যখন পড়ি যে নিহতদের একজন মােফজজল হায়দার চৌধুরী। আগের বারেও মােফজুজল হায়দারের নাম পড়েছি, এমন কি তার জন্যে শােক প্রকাশ করে লেখা নিবন্ধও পড়েছি, অভিভূত হয়েছি। কিন্তু পরে জানা গেল ওটা ভুল খবর। এবারেও কি তাই? মনে হচ্ছে এবারকার খবরটা ঠিক। নয়তাে এতদিনে তার বিপরীতটা জানা যেত।
মােফজল বাংলা সাহিত্যের পরীক্ষায় শান্তিনিকেতনের মুখােজ্জ্বল করেছিলেন। তখনকার দিনে পরীক্ষা দিতে হতাে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মােফজল বি এ পাশ করেন প্রথম শ্রেণীর অনারস পেয়ে। তাঁর ছাত্র অবস্থায় আমি সেখানে ছিলুম না, পরিদর্শনকালে যতদূর মনে পড়ে একবার তাকে ছাত্রহিসাবে দেখেছি। পরবর্তীকালে আমার শান্তিনিকেতনের বাসায় তিনি সস্ত্রীক এসে দেখা করেন। ততদিনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন, কিছুদিন বিদেশ ভ্রমণ করে দেশে ফেয়ার পথে শান্তিনিকেতনে এসেছেন।
কতরকম কথাবার্তা হলাে মােফজজলের সঙ্গে। মনে প্রাণে বাঙালি, বাংলা সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী, রবীন্দ্রনাথের পরমভক্ত, অনুরাগী রবীন্দ্রনাথের পরমভক্ত, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে প্রীতির ডােরে বাঁধা। আমার ছেলেমেয়েদের মতাে আশ্রমের সব ছেলেমেয়েদের অতি আপন হায়দারদা’। অধ্যাপকদের অতি প্রিয় “মুখােজ্জ্বল” সম্মুখে তার আরাে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। একদিন তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার চেয়ার অলঙ্কৃত করতেন। দূর থেকে আমরা পুস্পবৃষ্টি করতুম। মােফজল যে উদার আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছিলেন আর কারই বা সেরূপ সুযােগ জুটেছিল! সেইজন্যে তার কাছেই আমাদের প্রত্যাশা ছিল সর্বাধিক। তিনিই ওপারের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে উদারতর করতেন। হিন্দু-মুসলমানে লেশমাত্র ব্যবধান রাখতেন না। ঢাকা হতে সর্বতােভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যতীর্থ।
তখন তাে আমি ভাবতেই পারিনি যে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহল থেকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী এত স্বল্পকালের মধ্যে হটে যাবে। মােফজলকেই মনে হয়েছিল একক যােদ্ধা। কিন্তু বছর পনেরাে বাদে দেখা গেল তিনি আর একক নন, অধিকাংশ অধ্যাপক ও ছাত্র তারই মতাে মনে প্রাণে বাঙালি, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত। এমন দিনও এল যেদিন সকলেরই কণ্ঠে “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।” যেখানে সবাই যােদ্ধা সেখানে মােফজ্জল সকলের একজন। সবাই মিলে সাম্প্রদায়িকতাকে হটিয়ে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এককালে আমরা মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়” বলে বিদ্রুপ করতুম। সাম্প্রদায়িকতার সেই পীঠস্থান কেমন করে যে ধর্ম-নিরপেক্ষতার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলাে তার ইতিহাস একদিন লেখা হবে । লিখলে দেখা যাবে যে মােফজজল হায়দারের মতাে উধারমনা অধ্যাপকদের নীরব নিঃশব্দ সাধনাই তার মূলে কাজ করেছে। শুধুমাত্র বাংলাভাষার দাবীতে অত বড়াে একটা পরিবর্তন ঘটতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে গেছে যেসব ছাত্র ও ছাত্রী তারাও পরিবর্তনের জন্যে দায়ী। ইতিহাস একদিন তাদের প্রাপ্য তাদের দেবে। তা বলে মৃত্যু। মৃত্যু তাদের কারাে প্রাপ্য বলা যায় না। “মুক্তধারা”র অভিজিৎকেও তাে মৃত্যুবরণ করতে হয়। কে জানে হয়তাে আমাদের বর্তমান ট্র্যাজেডীর অভিজিৎ আর কেউ নয় শান্তিনিকেতনে ছেলেমেয়েদের চিরদিনের সেই “হায়দারদা”।
হীদুল্লা কায়জারের কায়সার] নামও নিহতদের তালিকায় দেখে আমি হতবাক। আগে তাে শুনেছিলুম তিনি আনডার-গ্রাউনডে। এখন শুনছি তিনি বাইরেই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, চিঠিপত্রও লেখালেখি হয়নি। বছরখানেক আগে জসীমউদ্দীন সাহেব কলকাতা আসেন তখন তারই ভাষণে শুনি যে শহীদুল্লা কায়জার “সংশপ্তক” বলে একখানি উপন্যাস লিখেছেন, ওটি নাকি বাংলা সাহিত্যের একটি সেরা উপন্যাস। এপারের সঙ্গে তুলনায় ওপার আর পেছিয়ে নেই। শােনা অবধি আগ্রহ ছিল, পরে বন্ধুবর মনােজ বসু বইখানি সংগ্রহ করে আমাকে পড়তে দেন ও আমার অভিমত জানতে চান। বেঙ্গল পাবলিশারস পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট কোনাে সাহিত্যিককে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করবেন বলে স্থির করেছেন। “সংশপ্তক” আকারেও যেমন বিপুল প্রকারে তেমনি বিচিত্র। সাহিত্যকীর্তির জন্যে শহীদুল্লা কায়জার নিশ্চয়ই পুরস্কারযােগ্য। মনােজবাবুকে আমার এই অভিমত জানাতেই তিনিও একমত হন। পুরস্কার নিতে শহীদুল্লাহ কায়জার স্বয়ং উপস্থিত হতে পারেন না, তার আগেই পঁচিশে মারচ ঘটে গেছে। তিনি নিখোজ। পুরস্কারের টাকা বাংলাদেশের কমিশনে গচ্ছিত থাকে। ইচ্ছা ছিল সুদিন এলে তাকে আমন্ত্রণ করে আনা যাবে। কে জানত যে এইভাবে তাকে আমরা হারাব! তবে কি সেই পুরস্কার তার নিধনের কারণ হলাে। জানিনে কী তার অপরাধ । বাংলা সাহিত্যে অসামান্য হওয়াই যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে। মানুষ চিরদিন বেঁচে থাক না। তার কীর্তি বেঁচে থাকে। শহীদুল্লা কায়জার নিজেই নিজের কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করে গেছেন। ‘সংশপ্তক” তাকে অমর করবে ।

আনন্দবাজার : (নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় নি)
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!