You dont have javascript enabled! Please enable it! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আকস্মিক কোন ঘটনার প্রতিঘাতে জাতির নেতা হয়ে বসেননি। ছাত্রবয়স থেকেই তিনি দেশের দুর্গতি প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন। দেশের শােষণ এবং দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের নির্মম আক্রমণে তার হৃদয় গভীরভাবে মথিত হয়েছে। শেখ মুজিব আবাল্য ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও মানবতার পূজারী।
আর এজন্যই শাসক শ্রেণীর সঙ্গে তিনি হাত মেলাতে পারেননি কোনদিনই।
তার এই আদর্শের জন্যই পাকিস্তানের শাসকচক্র দু দুবার তাঁকে দশ বছরকাল কারাগারে আটক করে রেখেছে। আর এই নির্যাতনের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবর তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন। তিনি তাঁর এই সঙ্কল্পে দৃঢ়তর হয়েছেন যে, তাঁর ‘সােনার বাংলা’কে মুক্ত করতেই হবে, স্বাধীন করতে হবে। জনতার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেও পাক সরকার মুজিবের, অসাধারণ জনপ্রিয়তা একটুকুও ক্ষুন্ন করতে পারেননি। তাঁর জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। নিপীড়ন ও নির্যাতনে পুড়ে পুড়ে তিনি নিজেকে খাঁটি সােনায় রূপান্তরিত করেছেন।
মুজিবরকে তাঁর গুণমুগ্ধ দেশবাসী আদর করে বঙ্গবন্ধু’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। তিনি কাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত সে সম্পর্কে তিনি সর্বদাই সজাগ ছিলেন।
ফরিদপুর জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯২২ সালের ২২ মারচ শেখ মুজিবর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। এক বিদেশী শাসনে হিন্দু ভূমাধিকারিগণ কর্তৃক গরীব মুসলমান কৃষক সম্প্রদায় শােষিত হচ্ছেন দেখে তার হৃদয়ে প্রথম বিদ্রোহের ভাব জাগে।
তিনি মাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে এসে ভরতি হলেন। এখান থেকেই তিনি বি এ পাস করেছেন। এই সময় তিনি মুসলিম লীগ নেতা স্বৰ্গত এইচ এস সুরাবর্দির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারাভিযান চালান। বিহারে দাঙ্গার সময় তিনি শান্তি মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে শ্রীহট্টে যে গণভোেট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মুসলমানরা যাতে পাকিস্তানের অনুকূলে ভােট দেন, এজন্য তিনি শ্রীহট্টে কাজ করেন।
দেশ বিভাগের পরই মুজিবর তার কর্মকেন্দ্র ঢাকায় স্থানান্তরিত করলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে যােগ দিলেন। কিন্তু তিনি পড়াশুনা আর চালাতে পারলেন না। পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে দেখা দিল তার বিরােধ। পাকিস্তানের শাসকরা চাইলেন উরদুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে। শেখ মুজিব প্রমুখ ছাত্রনেতারা তার বিরােধী। স্বভাবতই তিনি নেমে পড়লেন সরকার-বিরােধী আন্দোলনে। সেটা ১৯৪৮। মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠান হল।
মুক্তির পর মুজিব হসটেলে ফিরে এলেন। জোর আন্দোলন শুরু করলেন। তিনি ধর্মঘট ও নানাপ্রকার প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আয়ােজন করলেন। ফলে তাকে জেলে যেতে হল। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর মুজিবকে জেলে কাটাতে হল। ওই সময়ে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শ্রীনুরুল আমিন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর চলল গুলি। কাল স্থায়ী হয়। ১৯৫২ সালে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে জেনারেল আইয়ুব রাজনৈতিক দলগুলির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে মুজিব হলেন দেশের অবিসম্বাদি নেতা। তাঁর দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরােধী দল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে শ্রীমতী ফতিমা জিন্নাকে সমর্থন করেন। কিন্তু বুনিয়াদী গণতন্ত্রীদের সহায়তায় আইয়ুবই জিতলেন। আবার শুরু হল মুজিবের উপর নির্যাতন।
ইতিমধ্যে মুজিব তার রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ছটি দফার মধ্যে রূপায়িত করলেন। ১৯৬৬ সালে লাহােরে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে মুজিব তার ছ দফা দাবির কর্মসূচি পেশ করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই কর্মসূচির অন্যতম হল পাকিস্তানের উভয় অংশের স্বায়ত্তশাসনাধিকার। শেখ মুজিবর এবং তার আওয়ামী লীগ এই ছ দফা দাবির জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিষ নজরে পড়লেন। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের যে ২৩টি পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া শােষণ চালাচ্ছেন, তাঁরা কেউই এ ব্যবস্থা চান না।
মুজিবর তাসখন্দ চুক্তিকে স্বাগত জানানােতে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদও চটে গেলেন।
১৯৬৬ সালে মুজিবকে আবার গ্রেফতার করা হল। ঢাকার সেসন জজ তাকে জামিনে মুক্তি দিলেন। কিন্তু তিনি বাড়ি পৌছবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হল। এবার শেখ মুজিবকে শ্রীহট্টে পাঠান হয়। সেখানেও জজ তাকে মুক্তি দেন। পুলিশ আবারও তাকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ পাঠায়। ময়মনসিংহের সেসন জজ পুলিশের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করে শেখ মুজিবরকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছলেন, সেই মুহূর্তেই পুলিশ তার বাড়িতে এসে হানা দিল এবং তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠাল। বিচারের পর ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবরের মুক্তির আদেশ হল, কিন্তু গবরনর মােনেম খাঁ ঘােষণা করলেন, যতদিন তিনি গবরনর থাকবেন, ততদিন মুজিবরকে জেলে থাকতে হবে। এর পর তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল।
পাকিস্তান সরকারের সাজানাে আগরতলা ষড়যন্ত্র মােকর্দমায় শেখ মুজিবর রহমানকে প্রধান আসামী ও মস্তিষ্ক বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই সরকারী অভিযােগ : ভারতের পূর্ণ সহযােগিতায় এঁরা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠনের ষড়যন্ত্র করেছেন। এই ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানের সামরিক ও নৌবাহিনীর ব্যক্তিবর্গ, দুজন সংখ্যালঘু এবং তিনজন উচ্চপদস্থ সি এস পি অফিসারকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলে এই মামলার আসামীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয়।
এ দিকে সারা পাকিস্তানে স্বাধিকার আন্দোলন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার জন্য আন্দোলন প্রচণ্ড রূপ ধারণ করল।
১৯৬৯ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন এবং আসামীদের মুক্তি দিলেন।
মুক্তির পর শেখ মুজিবর রহমানকে ঢাকায় এক অদ্ভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানানাে হয়। দশ লক্ষ লােকের এক জনতা তাকে সংবর্ধনা জানায়। এমন বিরাট সমাবেশ নাকি ঢাকায় স্মরণাতীত কালের মধ্যে দেখা যায়নি। এই সমাবেশই শেখ মুজিবরকে বঙ্গবন্ধু’ আখ্যায় আখ্যায়িত করলাে।
শেখ মুজিবরকে রাওয়ালপিনডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে আলােচনায় যােগ দিতে রাজী করাতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁর ব্যক্তিগত দূত হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিনকে ঢাকায় পাঠান।
সারা পূর্ববঙ্গে সেদিন সে ব্যাপক গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, তা শান্ত করার জন্য আইয়ুবশাহী নতিস্বীকার করে শেখ মুজিবরের সাহায্য চাইলেন।
‘দেশের শত্রু’ বলে বর্ণিত শেখ মুজিবরের ভাষণ ঢাকা বেতারে প্রচার করে জনগণকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছিল।
১৯৬৯, ২৫ মারচ। আইয়ুব বিদায় নিলেন। এলেন ইয়াহিয়া খা। বহু প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। আওয়ামী লীগ বিপুল ভােটে বিজয়ী হল।
ঢাকায় এসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলাপ আলােচনা চালাবার মাঝেই ১৯৭১, ২৫ মারচ রাতে তার সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে ইসলামাবাদে চলে গেলেন।
শুরু হল মুক্তির সংগ্রাম। ২৫ মারচ গভীর রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেওয়া হয়। পরে আদালতে বিচার হবে। পুরাে নয় মাসে মুজিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দী। তার অনুপস্থিতিতে স্থাপিত হল মুজিবের স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি ভুট্টো ঘােষণা করলেন শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হবে।

আনন্দবাজার পত্রিকা (তারিখটি জানা যায় নি)

সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯