সীমান্তে হাঙ্গামা বাধাতে পারেন ইয়াহিয়া
ইয়াহিয়া বেপরােয়া। তার ভারত বিদ্বেষী প্রচারযন্ত্র উচ্চগ্রামী। পাক-সৈন্যদের স্পর্ধা অসহনীয়। তারা বনগাঁ সীমান্ত থেকে তিনজন ভারতীয় রক্ষীকে টেনে নিয়ে গেছে। এই অতর্কিত হামলার জন্য কেউ তৈরী ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু কার কাছে এই প্রতিবাদ? বুদ্ধিভ্রংশ পাক-ডিকটেটর কূটনৈতিক ভাষা আগেও বুঝেন নি, এখনও বুঝবেন না। তিনি বুঝেন, বুলেটের ভাষা। এই ভাষায় নয়াদিল্লী যতদিন কথা বলতে না শিখবেন ততদিন ইসলামাবাদের কাছ থেকে পাবেন শুধু বিশ্বাসঘাতকতা। ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক মােটেই সুখের নয়। তাসখন্দ চুক্তিও এ দুটি রাষ্ট্রের বিরাট ব্যবধান বুজাতে পারে নি। কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রশ্ন আলাদা। মুজিবুর সত্য ভাষী ভদ্রলােক। তাকে রাজনৈতিক আলােচনায় ব্যস্ত রেখে তলে তলে ইয়াহিয়া চালাচ্ছিলেন সমর প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতি সম্ সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে পশ্চিমা সৈন্যদল। নিজের দেশের সংখ্যাধিক্যের নেতার সঙ্গে যারা করতে পারেন চরম বিশ্বাসঘাতকতা দুনিয়ায় যেকোন জঘন্য ষড়যন্ত্র তাদের পক্ষে সম্ভব ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়ত দীর্ঘস্থায়ী হবে। নিয়ন্ত্রণ বাঙালির হাতে দুর্ধর্ষ পশ্চিমারা যে বাপের নাম ভুলাননা মার খাবে- একথা স্বপ্নেও ভাবেন নি ইয়াহিয়া খান। ইসলামাবাদের জানােয়ারদের বড় বড় শহর এবং ক্যান্টনমেন্টগুলাের খাঁচায় পুরে রেখেছেন মুজিব-বাহিনী। ওরা মাঝে মাঝে খাচা ছেড়ে বেরিয়ে এসে জনপদ তছনছ করে আবার আঁচায় ফিরে যায়। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জমি স্বাধীন বাংলাদেশের বীর যােদ্ধাদের করায়ত্ত। আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠার দিন আসন্ন। ইয়াহিয়ার জঙ্গীবুদ্ধি দেউলিয়া। বাংলাদেশ প্রায় হাতছাড়া যতটুকু কর্তৃত্ব অবশিষ্ট আছে তাও মুছে যেতে দেরী নেই। ভাড়াটিয়া ঘাতকদল দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাগে রাখা চলে না। এ সত্য আজ দিনের মত পরিষ্কার। ইয়াহিয়ার চোখের সামনে নিদারুণ বিভীষিকা। যারা বাংলাদেশে চালাচ্ছে গণহত্যা এবং ধ্বংস করছে ক্ষেত খামার তাদের মৃত্যুর হাতিয়ার তৈরী হচ্ছে ঘরে ঘরে। হৃত শাবক বাঘিনীর মত গর্জে উঠেছেন বাংলাদেশের হাজার হাজার কৃষক রমণী। লাঙ্গল ছেড়ে বন্দুক ধরেছেন পল্লী অঞ্চলের জওয়ান কৃষকেরা। তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছেন গােটা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। গােটা জাতি পশ্চিমা ফ্যাসিস্ত পঙ্গপালের বিরুদ্ধে সঙ্বদ্ধ। যেসব জনপথ আজ বাঙালির শবে পরিপূর্ণ সে-সব জনপথে শীঘ্রই দেখা যাবে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের প্রাণহীন নিশ্চল দেহ। যেসব কৃষিক্ষেত ধ্বংস করছে ইসলামাবাদের বর্বর দল সে-সব কৃষিক্ষেতের সার তৈরী হবে পশ্চিমাদের দেহাশ্রিত মাংস থেকে। মানব দ্রোহিতার কঠিন শাস্তি এড়াতে পারবে না কেউ। এই অনিবার্যকে ঠেকাবার জন্য ইয়াহিয়া হয়ত শেষ চেষ্টা করবেন। তার পায়তারা উদ্বেগজনক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আত্মবিশ্বাসে আত্মহারা। চণ্ডীগড়ে তিনি বলেছেন, ভারত আক্রমণের মত হঠকারিতা ইয়াহিয়া করবেন না বলেই তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মূল্য কতটুকু? নয়াদিল্লী কি বিশ্বাস করেছিলেন, আয়ুব খান কচ্ছের উপর ঝাপিয়ে পড়বেন? নয়াদিল্লী কি বুঝতে পেরেছিলেন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান যুদ্ধ বাধাবে?
নয়াদিল্লী কি একবার ভেবেছিলেন, তাসখন্দ চুক্তি জঞ্জালের ঝুড়িতে স্থান পাবে? পাক-ডিকটেটরদের সারা অঙ্গে শঠতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার ছাপ। বাংলাদেশের গণহত্যায় তাঁরা ধিকৃত। হাজার হাজার নির্যাতিত নরনারীর ভারত সীমান্ত প্রবেশ তার জাজ্বল্য প্রমাণ। আন্তর্জাতিক জটিলতা সৃষ্টি ইসলামাবাদের অন্যতম লক্ষ্য। এটা সম্ভব হলে চাপা পড়বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। পাক-বেতারের উচ্চগ্রামী ভারত বিদ্বেষী প্রচার এবং আবােল-তাবােল মিথ্যা অভিযােগ হয়ত তার পূর্বাভাস। ইয়াহিয়া তাঁর উত্তরসুরী আয়ুব খানের চেয়েও সাংঘাতিক। আয়ুব খান ছিলেন সাধারণ দানব। আর ইয়াহিয়া অতি-দানব। ভারত সীমান্তে হাঙ্গামা বাধানাে তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। ইসলামাবাদের বড় ভয় ভারত। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে নয়াদিল্লীই দেবেন প্রথম স্বীকৃতি। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা পাবেন আনুষঙ্গিক সাহায্য। এ সম্ভাবনা ভাসছে ইয়াহিয়ার চোখের সামনে। তিনি হয়ত একটা অঘটন ঘটাবেন। বাইরের দৃষ্টিতে যা হঠকারিতা, ইয়াহিয়ার কাছে তা আত্মরক্ষা। বাংলাদেশ হাতছাড়া হলে কিম্বা বিশ্ব চাপ প্রবল হয়ে উঠলে তার গদীচ্যুতি অনিবার্য। ইয়াহিয়ার শয়তানী চক্র দ্রুতগতিতে ঘুরছে। বাংলাদেশে যারা হিমশিম খাচ্ছে তারাই অপহরণ করেছে বনগাঁ সীমান্ত থেকে ভারতীয় রক্ষী। এ দুঃসাহস কি চরম হঠকারিতা নয়? বিশ্বাসঘাতকদের উপর আস্থা রাখা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। সর্বাত্মক প্রস্তুতি অবশ্য কর্তব্য। অপহৃত ভারতীয় রক্ষীদের উদ্ধার করতে হবে। আপােষে সম্ভব না হলে প্রতিশােধের দরকার পড়বে। নয়াদিল্লী সম্ভাব্য বিপদের জন্য তৈরী থাকুন। একটি পাকিস্তানী সৈন্য অস্ত্র হাতে ভারতের মাটিতে পা দিলে তার কলিজা যেন অক্ষত না থাকে। অস্ত্রের শাণিত ভাষায় জবাব মূলত রাখুন কেন্দ্রীয় সরকার। দুষমনের দুর্বল স্থান হৃৎপিণ্ড। ইয়াহিয়া ভারতের দুষমন। জওয়ানদের বন্দুকের নিশানা যেন এই হৃদপিণ্ড থেকে কোন মতেই সরে না যায়।
আনন্দবাজার : [নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায়নি।
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯