You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশে শিক্ষা পুনর্বিন্যাস সমস্যা- আবদুল গাফফার চৌধুরী | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে শিক্ষা পুনর্বিন্যাস সমস্যা
আলেকজানডার কবে পাকিস্তান অভিযান করেছিলেন?
আবদুল গাফফার চৌধুরী

বাংলাদেশ সরকার দেশে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত করেছেন। ঢাকার একজন সরকারী মুখপাত্রের বরাত দিয়ে খবরটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের সমস্যা একটি গুরুতর সমস্যা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সােভিয়েট ইউনিয়নের লেনিনগ্রাড যতটা বিধ্বস্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ হয়ত ততটা বিধ্বস্ত হয়নি, কিন্তু এর পুনর্গঠনের সমস্যা লেনিনগ্রাড ও স্ট্যালিনগ্রাডের চাইতে অনেক বেশি। জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। প্রাসঙ্গিকভাবে শিক্ষা সমস্যার কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের সমস্যা ধ্বংসপ্রাপ্ত ইস্কুল কলেজ গৃহের কড়ি বরগা সংগ্রহ বা ভবনটি মেরামতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, গত চব্বিশ বছর ধরে যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে উদ্দেশাপ্রসূত অসত্য ও অর্ধসত্য দ্বারা বিকৃত করা হয়েছে তাকে গােড়া থেকে আবার ঢেলে সাজানোের সমস্যা হল এটি। গত চব্বিশ বছর ধরে বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যে বিকৃতি সাধনে চেষ্টা হয়েছে এবং ধর্মীয় শিক্ষার নামে সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট শিক্ষার বিষবাষ্প দ্বারা শিক্ষাদান ব্যবস্থায় গােটা পরিবেশকে দূষিত করা হয়েছে, তার প্রভাব ও পরিবেশ পালটিয়ে নতুন ব্যবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি চাট্টিখানা কথা নয়।
সমস্যাটির গভীরতা অনেকে হয়ত সহসা উপলব্ধি করতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের সমস্যা সত্যই জটিল এবং এই সমস্যা সমাধানে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং ইতিহাস ও সমাজ-পাঠমূলক বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন পাঠ্যসূচি তৈরি করা অবিলম্বে প্রয়ােজন হবে। বাংলাদেশে শিক্ষা-ব্যবস্থা পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের সমস্যা যদি সুষ্ঠুভাবে মীমাংসা হয়, তাহলে জাতি গঠনের কাজ অর্ধেকটা এগিয়ে গেলে এবং প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাঙালি সমাজ-মানস গঠনের ভিত্তি পাকা হল একথা অনায়াসে কবুল করা চলবে।
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনে কিভাবে ঔপনিবেশিক ছাচে বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজীয় শিক্ষাকে বিকৃত করা হয়েছে এবং অসত্য ও অর্ধসত্যকে ইতিহাস ও সমাজপাঠের নামে চালানাে হয়েছে, তার একটা উদাহরণ দি। ১৯৬৯ সালে ঢাকার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক ছাত্র তার ইস্কুলের একটি প্রশ্নপত্র আমাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করেন, এই প্রশ্নপত্রের দুটি প্রশ্ন পরস্পর-বিরােধী কিনা এবং প্রকৃত উত্তর কি হবে? প্রশ্ন দুটি হল- এক. ১৯৪৭ সালের চৌদ্দই আগস্ট তারিখে পাকিস্তান নামে একটি নতুন দেশ বিশ্বের মানচিত্রে। প্রথম স্থান লাভ করে কিভাবে এবং কার নেতৃত্ব তােমার নিজের ভাষায় তা বিবৃত কর। দুই. খ্রিস্টপূর্ব কত সালে গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা আলেকজানডার পাকিস্তান আক্রমণ করেছিলেন এবং এই আক্রমণের ফলাফল কি হয়েছিল, তা অনধিক একশাে শব্দের মধ্যে বর্ণনা কর।
ছাত্রটির প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তার বক্তব্য, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যদি পাকিস্তান নামে নতুন দেশটি জন্মলাভ করে থাকে, তাহলে খ্রিস্টের জন্মের আগে ম্যাসিডনের রাজা আলেকজানডার সেই দেশ আক্রমণ করেন কি করে? প্রশ্নপত্রের প্রশ্ন দুটি তাই তার মতে পরস্পর-বিরােধী এবং উত্তর তৈরী করার ব্যাপারে ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত, বিভ্রান্তিকর। এই বিভ্রান্তি বাংলাদেশের স্কুল-পাঠ্য প্রতিটি বইয়ে কম-বেশি ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে আধুনিক সমাজ পাঠ নামক বইয়ের ইতিহাস অধ্যায়ে একটি পরিচ্ছেদের নাম ‘আলেকজানডারের পাকিস্তান আক্রমণ।’ বইটি ইস্ট পাকিস্তান ইসকুল টেকসট বুক বােরড কর্তৃক প্রকাশিত। পাকিস্তান একটি অখণ্ড ভৌগােলিক ইউনিট নয় এবং তা আলেকজান্ডারের আক্রমণ যখন ভারত আক্রমণ নামে পরিচিত-ছিল, তাকে পাকিস্তানী পাঠ্য বইয়ে পাক-ভারতের উপমহাদেশ রূপে চিহ্নিত করা শুরু হয়। সংবাদ পত্র বেতার ও টেকসট বুক বােরডের উপরও কঠোর সরকারি নির্দেশ প্রদান করা হয় যে, পাকিস্তানের জন্মের আগের ইতিহাস বর্ণনাতেও ভারত নামের ব্যবহার চলবে না, পাক-ভারত’ কথাটির ব্যবহার করতে হবে। এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ঢাকার একটি বিদেশী প্রকাশনা সংস্থাকে এক সময় অত্যন্ত ব্ৰিত অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। আমেরিকার ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের ঢাকা অপিস বেশ কয়েক বছর আগে রেড ইনডিয়ানদের সম্পর্কে একটি ইংরেজী বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। অনুবাদক সরকারি নির্দেশের কড়াকড়ির কথা জানতেন। হয় অতি সতর্কতা নয় অবজ্ঞার জন্য তিনি আমেরিকার রেড ইনডিয়ান উপজাতিদের নাম বাংলায় অনুবাদ করেন লাল পাক-ভারতীয় উপজাতি। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর এক হাস্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং প্রকাশনা সংস্থাকে লাল পাকভারতীয় উপজাতি কথার স্থলে আবার রেড ইনডিয়ান কথাটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে হয়।
* * *
শুধু ইতিহাসের বইয়ে নয়, ইস কলেজের অধিকাংশ পাঠ্য বইয়ে রয়েছে এই ধরনের তথ্য ও সত্য বিকৃতির ভুরি ভুরি উদাহরণ। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং বাঙালি শিক্ষার্থীদের নিজেদের মনে নিজেদের সম্পর্কে হেয় ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা। যেহেতু বাংলাদেশে সরকারী সংস্থা ইস্ট পাকিস্তান ইসকুল টেকসট বুক বােরডই ছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার একমাত্র পাঠ্য পুস্তক প্রণেতা ও প্রকাশক এবং এই বােরডের কর্তৃত্ব সরাসরি সরকারের হাতে ছিল, ফলে এক শ্রেণীর অনুগৃহীত লেখক (বাঙালি), দ্বারা সরকারের পক্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ইসকুলের পাঠ্য বইয়ে কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিশেষ ধর্মান্ধতা জিইয়ে রাখা এবং বাঙালি মুসলমানের জন্য অবমাননাকর মন্তব্য ও কল্পিত তথ্য যযাজনায় কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি। আমার কাছে এই প্রবন্ধ লেখার সময় বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসকুল পাঠ্য বই না থাকায় মাত্র দু’ একটি বই থেকে এই ধরনের বিভেদ ও বিশ্বের সৃষ্টি এবং সাম্প্রদায়িতার বিষবাষ্পে শিক্ষার্থীদের মন ও মস্তিষ্ক প্রভাবিত করার অপচেষ্টার সামান্য নমুনা উদ্ধৃত করছি। টেকসই বুক বােরড কর্তৃক পঞ্চম শ্রেণীর জন্য পাঠ্যহিসাবে নির্ধারিত ইতিহাস গ্রন্থে বাংলায় রাজা গণেশ ও তার বংশধরদের শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, “রাজা গণেশ দিনাজপুর জেলার ভাতুরিয়া পরগণার একজন প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন এই সময় ইলিয়াসশাহী বংশে গৃহবিবাদ চলিতে থাকে। এই সুযােগে ১৪১৩ খৃস্টাব্দে এই বংশের আলাউদ্দীন ফিরােজ শাহকে হত্যা করাইয়া তিনি নিজে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। রাজা গণেশ মুসলমান আলেমদের উপর ভীষণ অত্যাচার করিতেন। হজরত নূর কৃত্ববুল আলম এই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ দরবেশ ছিলেন। মুসলমানদিগকে রাজা গণেশের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য তিনি জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শরকির সাহায্য প্রার্থনা করেন। ইবরাহিম শরকি বাংলার মুসলমানদের রক্ষা করিবার জন্য গণেশের রাজ্য আক্রমণ করিলেন।” (ইতিহাস, পঞ্চম শ্রেণী, পৃ. ২৬ জানুয়ারি ১৯৭০ সংস্করণ)।
এবার বঙ্গ বিজয়ের ইতিহাস। “বিহার জয় করিবার পর তাহার (মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির) রাজা জয়ের আকাক্ষা বাড়িয়া চলিল। ১২০১ খৃস্টাব্দে তিনি একট সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী লইয়া বঙ্গদেশ জয় করিতে অগ্রসর হইলেন। তিনি অতি দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিয়া তাহাদের আদর্শ- অর্থাৎ ইমান ও ঐক্যের কথা ভুলিয়া গেলেন। ইহার ফলেই কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়িয়া উঠিল না। ইহাতে মুসলমানেরা বিরাট শক্তি হিসাবে গড়িয়া উঠিতে পারিলেন না। ইসলাম ধর্ম মানিয়া চলিলে এইরূপ ঘটনা ঘটিত না।” (আধুনিক সমাজ পাঠ, পৃঃ ৮, জানুয়ারী ১৯৭০ সংস্করণ)।
আর উদাহরণ সম্ভবত বাহুল্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার দেশীয় রাজা ও সামন্তদের কাপুরুষ, অত্যাচারী এবং কোথাও বা দস্যু হিসাবে এবং বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের প্রত্যেককে জাতীয় বীর হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এই অবমাননাকর শিক্ষা-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে প্রতিবাদ দানা বাধতে শুরু করে ষাটের মাঝামাঝি সময় থেকেই।
‘ভারত ও ভারতবর্ষ’ কথা দুটির সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র ভাষার ক্ষেত্রে ছাড়া “বাংলা” কথাটির ব্যবহারও বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কার্যত নিষিদ্ধ হয়েছিল। বাংলা বা পূর্ববাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম ব্যবহারের কঠোর নির্দেশ সবক্ষেত্রে পালিত হয়। ইসকুল-পাঠ্য সাহিত্য গ্রন্থ থেকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনা সর্বত্র বর্জন করা হয়, অজুহাত দেখানাে হয় এরা পশ্চিমবঙ্গ অর্থাৎ ভারতের লেখক। দীর্ঘ দু যুগকাল বাংলাদেশের শিশু ও কিশােরদের পাঠ করতে হয়েছে খালেদ তারেক প্রমুখ আরব দেশীয় বীর এবং জিন্না ও ইকবালের জীবনী। বাংলাদেশের দেশবন্ধু, জগদীশচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, মাইকেল মধূসূদন, অতীশ দীপঙ্কর, তীতুমীর, সূর্য সেন এসব নাম ও জীবনকথা তাদের কাছে …….. অপরিচিত। পাঠ্যবই ও ইসকুল কলেজের চৌহদ্দীর মধ্যে এসব নাম ঢুকতে দেয়া হয়নি। তাই স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রাস্তাঘাট বা ইসকুল কলেজের ভবন মেরামত যত সহজ কাজ, শিক্ষা-ব্যবস্থা পুনর্গঠন তত সহজ কাজ নয়। এ অবস্থায় অতি দ্রুত উদারমনা শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ নিয়ে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। শুধু বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্থার নয় শিক্ষার কারিকুলাম ও পাঠ্য বই দ্রুত পুনলিখিত ও পুনঃ প্রকাশের ব্যবস্থা করা দরকার। ইতিহাস, ভূগােল, সমাজ পাঠ আবার নতুনভাবে তথ্য ও সত্যের বিকৃতি দূর করে লেখা প্রয়ােজন। সাহিত্য গ্রন্থে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা এবং বাংলার জাতীয় বীরদের জীবনী সংযােজিত হওয়া আবশ্যক। এক কথায় শুধু পাঠ্য বই নয়, পাঠ্য সূচী নতুনভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানাে অবিলম্বে দরকার। একমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থার দ্রুত সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস দ্বারাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার মূল্যোচ্ছেদ এবং গণতান্ত্রিক জাতীয়তার ভিত্তি স্থায়ী ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠ করা সম্ভব।

আনন্দবাজার : [নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় নি।]
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯