বাংলাদেশ রাজনীতি
বাঙালির সহিষ্ণুতায় বিদ্বেষী বিদেশীরা নিরাশ
বরুণ সেনগুপ্ত এ
এই ঢাকা শহরে বসেই বােঝা যায় বাংলাদেশের ব্যাপার-স্যাপার দেখে একদল বিদেশী কতটা হতাশ হয়েছেন।
নানা কারণে তাঁরা হতাশ। প্রথম হতাশার কারণ হল এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ। তারা ভাবতেই পারেননি বাংলাদেশ সত্যিই এত তাড়াতাড়ি মুক্ত হবে। ধরে নিয়েছিলেন, লড়াই বেশ কিছু দিন চলবে এবং পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনী অন্তত রাজধানী ঢাকা অঞ্চলে বেশ কিছুদিন তাদের দখল বজায় রাখতে পারবে। নিয়াজি তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন : পদ্মা এবং মেঘনার মাঝখানের অঞ্চলে পাক প্রতিরােধ ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ়- ভারতীয় সেনাবাহিনীর এবং মুক্তি বাহিনী মাস খানেক চেষ্টা করেও এই বৃহ ভেদ করতে পারবে না। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু বিদেশীরা সবাই দেখলেন, সেই “সুদৃঢ় প্রতিরােধ ব্যবস্থা” তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ল- লড়াই শুরু হওয়ার এগারাে দিনের মধ্যেই নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন। তাই দেখে তারা “মরমে মরিয়া গেলেন।”
তারপর এল স্বাধীন বাংলাদেশে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ওই সব হতাশ-বিদেশী একটা নতুন আশা নিয়ে বসে রইলেন। তারা আশা করলেন, এবার বাংলাদেশের ভেতরে একটা প্রচণ্ড অরাজকতা দেখা দিচ্ছেঅবাধ খুনােখুনী চলবে, মুক্তি বাহিনী ও সাধারণ ক্ষিপ্ত মানুষ অবাধে অবাঙ্গালি এবং পাক দালাল বাঙ্গালিদের খুন করতে শুরু করবে, হাজার হাজার মানুষ মরবে, ভয়ে ব্যবসা বাণিজ্য অফিস কাছারি গাড়িঘােড়া সব বন্ধ হয়ে যাবে এবং সব মিলিয়ে গােটা বিশ্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা তীব্র জনমত গড়ে উঠবে।
কিন্তু হায়, তাও হল না
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বাংলার মুক্তি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা নেই। ১৬-১৭ তারিখ আমি ঢাকায় হাজার হাজার মুক্তি বাহিনীর ছেলেকে দেখেছি। অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদসহ। ওই দুদিন যদি তারা অবাঙ্গালি প্রধান এলাকা মীরপুর-মহম্মদপুরের উপর ঝাপিয়ে পড়তেন তাহলে কেউ অবাঙ্গালিদের রক্ষা করতে পারত না। ওই দুদিন ঢাকা শহরে খুব বেশি ভারতীয় সৈন্যও ছিল না- যারা ছিল তারাও প্রধানত আত্মসমর্পণকারী পাক সেনাবাহিনীকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ওই ১৬-১৭ তারিখেই মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা এবং ঢাকার বাঙ্গালিরা শুনেছিলেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ভয়াবহ কাহিনী। তারা এও জানতেন যে ওই হত্যাকাণ্ড চলেছিল প্রধানত মীরপুর মহম্মদপুর এলাকায়। কিন্তু তবু তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মীরপুর মহম্মদপুরে অবাঙ্গালিদের খুন করতে ছােটেননি।
* * *
গােটা বাংলাদেশে কোথাও কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণতার পরিচয় দেয়নি, ১৬ তারিখের পর বাংলাদেশের কোথাও কোনও খুন হয়নি একথা আমি বলব না। হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু গত ন’ মাসে পাক বাহিনী এবং পাকিস্তান সমর্থক উগ্রপন্থী অবাঙ্গালি ও বাঙ্গালিরা যে অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা বাংলাদেশের উপর চালিয়েছে। তার তুলনায় কতটুকু প্রতিহিংসাপরায়ণতা মুক্তি বাহিনী বা বাংলাদেশ সমর্থকরা দেখিয়েছেন? ১৬-১৭ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ খবর শুনেই বা ক’জন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে পাক সমর্থকদের আক্রমণ করেছেন? এমন নয় যে তাঁদের হাতে অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল, এমন নয় যে গােলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল, এমনও নয় যে কেউ সঙ্গে সঙ্গে এসে তাদের বাধা দিতে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তবু তারা ব্যাপক প্রতিহিংসাপরায়ণতায় মত্ত হয়ে খুন করতে ছুটে যাননি।
ভুলে গেলে চলবে না যে প্রত্যেকটি মুক্তিসেনা অত্যাচারিত- প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে। তাদের পরিবার পরিজন অত্যাচারিত। তাদের বহু প্রিয়জন নিহত। পশুরা ন’ মাস ধরে বাংলাদেশের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। অন্তত দশ লক্ষ মানুষ নিহত। অন্তত বিশ লক্ষ মানুষ আহত। কত লক্ষ মহিলা যে অত্যাচারিত হয়েছেন তার কোনও হিসেব নেই। বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার পাক রাজাকার, পাক সেনাবাহিনী এবং পাক দালালদের অত্যাচারে জর্জরিত। এরা সবাই যদি শুধু হাতেও আজ বদলা নিতে ছুটে আসেন কেউ তাদের আটকাতে পারবে?
কিন্তু না, বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী ওই ব্যাপক প্রতিহিংসার পথে যাননি। এবং না গিয়ে তারা ভালই করেছেন। বিদেশীরা যারা ওৎ পেতে বসেছিলেন তারা হতাশ হয়েছেন। বাংলাদেশের, বাঙালির মর্যাদা বিশ্বে বেড়েছে।
আমি মাঝখানে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলাম। কয়েকদিন হল আবার ঢাকা এসেছি। প্রথম বার ১৬ থেকে ২৪ ডিসেম্বর যেসব অবাঙ্গালিকে ইনটারকনটিনেনটাল হােটেলে দেখেছিলাম, যারা ভয়ে হােটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে অনেকেই যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। কয়েকজনার সঙ্গে ঢাকা ফিরে দেখা হল। তারা এখন সবাই বুঝেছেন, বাঙ্গালি প্রতিহিংসাপরায়ণ জাতি নয়। বলব না, ওইসব অবাঙ্গালির সব ভয় কেটে গিয়েছেই- কিন্তু এটা তাে সত্যি যে তারা এখন যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন, গাড়ি চেপে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহ শুরু করেছেন।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, বাঙ্গালি রক্ত পিপাসু জাতি নয়, সাধারণ বাঙ্গালি খুন জখম পছন্দ করে না এবং বাঙ্গালি প্রতিহিংসাপরায়ণতার পাগল হয়ে বদলা নিতে ছােটে না। গােটা বাঙ্গালি জাতের মধ্যে যে সহিষ্ণুতা, নির্বিরােধ মনে ভাব এবং মহত্ত রয়েছে বাংলাদেশে আবার তা প্রমাণিত হল।
* * *
বিদেশীদের আর একটা আশা বাংলাদেশে এবার প্রচণ্ড আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরােধ দেখা দেবে। বিরােধ দেখা দেবে আওয়ামী লীগের ভেতরে, বিরােধ দেখা দেবে ছাত্র ও যুবকদের সঙ্গে প্রবীণদের, বিরােধ দেখা দেবে মুক্তি যুদ্ধের সমর্থক বিভিন্ন পকেটের ভিতরে।
সব দেশেই যেমন থাকে বাংলাদেশেও তেমনি নানা জনে, নানা নেতায়, নানা দলে, নানা বয়সের মানুষে মতপার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গীর। একনায়কত্বে পরিচালিত দেশ ছাড়া আর সর্বত্র যেমন তা প্রকাশিত হয় এখানেও তেমন তা হচ্ছে। কিন্তু মতপার্থক্য মানেই বিরােধ নয় এবং বিরােধ মানেই একে অপরের উপর ঝাপিয়ে পড়া নয়।
এই একে অপরের উপর ঝাপিয়ে পড়াটা এখনও শুরু হচ্ছে না দেখেই কিছু কিছু বিদেশী এখনই কিছুটা হতাশ হয়েছেন। তবু অবশ্য তারা আশা ছাড়েননি। এখনও বলতে শােনা যায় “দেখবে আওয়ামী লীগের ভেতরে মারামারি শুরু হবেই”, “রবমাখনরা তৈরী হচ্ছে, আর বেশি দেরি নেই”, “আওয়ামী লীগের উগ্রপন্থীরা ন্যাপের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারেও বিদেশীরা হতাশ হবেন। বাংলাদেশের সবাই তাদের সকল মতপার্থক্য সত্ত্বেও মূল কাজে আত্মনিয়ােগ করবেন। সেই কাজ লুণ্ঠিত ধর্ষিত, বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন।
সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। তিনি এই নতুন জাতির পিতা। জাতির জনক জাতির প্রাণকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হলেই পুরােদমে নতুন জাতির নতুন যাত্রা শুরু হবে।
আর, সেই ষাঁড়ের পেছন চাটা শেয়ালের মত বাংলাদেশ বিদ্বেষী বিদেশীরা আরও বেশ কিছুদিন হাপুস নয়নে বাংলাদেশের পেছনে পেছনে ছুটতেই থাকবেন।
আনন্দবাজার : নির্দিষ্ট কোন তারিখ পাওয়া যায়নি
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯