ভােমরা পেরােলেই সাতক্ষীরা
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
গাদাগাদি একটা গ্রাম্য বাসে আমাদের সঙ্গে চলেছে জন তিরিশ পেঁয়াে মানুষ। অধিকাংশের পরনে লুঙ্গি, কেউ কেউ হাঁটুর ওপর মালকোঁচা মেরে ধুতি পরেছে। মাটিমাখা মাত্র দুচারজনের পায়ে হাওয়াই চপ্পল, নতুনই বটে। এ-রকম ধ্বস্ত রাস্তা, যাতে লােকবােঝাই বাস উঠছে মিনিটে দুবার তড়াক তড়াক করে লাফিয়ে, ফুটপাথের শহুরে চটির খুব একটা পুরনাে হবার এখানে সুযােগ কই। ক্যাম্প থেকে সুতীর খাকি সােয়েটার সকলে পায়নি। মাত্র দশজনের কাঁধে রাইফেল। তবু এরা যােদ্ধা, এরা সৈন্য; হেঁড়া নােংরা, আপরুচি জামা কাপড়ের নিচে এরা সকলেই সেই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ইউনিফর্ম পরে আছে যার ডাকনাম চামড়া। ভােমরা বডির ক্রশ করতেই হ্যান্ডেল ধরে জানালায় ঝুঁকে পড়ল মহম্মদ ইউসুফ (বয়স ৩৫), “উই দ্যাখেন বাংলাদেশ।” সত্যি তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল, অদ্ভুত আকস্মিকতায় ভরা, সেই জাদু ঝলক ছিল সেখানে যা নদীর নামউচ্চারণ করলেই চারদিক প্রতিভা হয়ে ওঠে নদী… কথা ছিল, তবু বনরাজিনীল, শস্যশ্যামল, নদীমাতৃক পূর্ব বাংলা সে আমাদের দেখতে পারে না। বলতে বলতেই তার চাষীভুষাে রুখু মুখে তাই ছায়া এসে পড়ে। জানালা থেকে সকালবেলা ময়লার রােদুর সরে যায়। বাংলাদেশ বলতে আর কিছু নাই, দ্যাখেন শুধু মাটি।’ বুক খালি করে সে এবার দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস ফেলে, “মরুভূমিতে শােনা যায় খালি বালু। আর এখানে পােড়া ঘাসের কাছে খালি পােড়া ঘাস। কেউ ধান করতে পারে নাই। উই দ্যাখেন পাট, এখন শুকনা লকড়ি কেউ কাটে না। একটা পাখি নাই, দ্যাখেন।” কাঁধে লগ্ন থ্রি নট থ্রির বিমর্ষ রঙে ভরা ব্যারেলের উপর চেপে বসে যায় তার মুঠি যখন সে আরাে বলে, “তবু দ্যাখেন কিছু করতে পারে নাই। বাংলাদেশ ঠিকই আছে। বৈশাখ অব্দি অভাব অভিযােগ থাকবে আইজ্ঞা। তারপর আর থাকবে না। তারপর ধান হবে।” শূন্যে বুক দুই ইঞ্চি বেশী ফুলিয়ে বােধ হয়তাে সে আবারাে নিশ্বাস নেয়, “এখন কিছু কিছু ইরি করতে পারবে।” ইউসুফের বাড়ি ছিল বরিশালের বানরিপাড়ায়। চাষী ছিল। পিকচার প্যালেস সিনেমায় এ বছর জানুয়ারীর গােড়ায় সে স্ত্রীর সঙ্গে শেষবার ছবি দেখতে গিয়েছিল। তার ছােটবেলায় হলটির নাম ছিল নীলা। এখন তারা বিচ্ছিন্ন। না, তাদের সন্তান হয়নি। ছবিটির নাম ছিল ‘মােমের আলাে। “উই দ্যাখেন একটা পাখি,” ডাকনিয়া গ্রামের কাছে ব্যারেল থেকে দক্ষিণ বাহু তুলে নিয়ে ইউসুফ জানালা দিয়ে তর্জনী বাড়িয়ে দেয়, “আমরা বলি ফেচুয়া।” দেখি কাঁচা বাঁশের ইলেকট্রিক পােস্টের মাথায় একটা ফিঙে বসে। আরাে দূরে পােড়া ঘাসের জঙ্গল থেকে ধানের স্বয়ম্ভ ছড়া খোজে বেড়াচ্ছে চাষী। অভ্যাসবশত জেলে আজো জলায় জাল ফেলছে। ওদিকে মেঠো রাস্তা থেকে পাকা সড়কে উঠছে চারটি ছই ঢাকা গরুর গাড়ি, তার পেছনে দিগন্ত পর্যন্ত সারবন্দি পুটলি মাথায় মানুষ, সাইকেল, সাইকেল রিকশার পা দানিতে হাঁড়িকুঁড়ি। দু ধারে বিধ্বস্ত পীলবক্স ও বাঙ্কারের মধ্যে দিয়ে ওরা ঘরে ফিরে আসছে। “একটা ফেচুয়া থাকলে ইউসুফ বলে যাচ্ছে, “সে গাঁয়ে কাক থাকতে পারে না। আমরাও অমি।” রাইফেলের হাতে সে হাত বােলায়, “একটা গেরিলা থাকলে সে গাঁয়ে শত্রু থাকতে পারে না।” কুদোয় হাত রেখে যেন প্রতিজ্ঞা করে সে বলল, “এই বন্দুক দিয়ে ২১ জন খতম করেছি। ৪টে কেটেছি।” পরক্ষণেই হাত রাখে বুকে, “তবু জুড়ায় নাই।” একটা সিগারেট দিতে গেলে ডান হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে, বাঁ হাতে মুখ লুকিয়ে সে এক ধরনের হাসতে লাগল। কিসে যে ওর অমন নারী সুলভ সুন্দর লজ্জা হল বুঝলুম না। ও সব ভুলে গেছি আইজ্ঞা।” ইউসুফের হয়ে জবাব দিল কেরাম আলী (৪০)। ইউসুফের পাশে বসন্তক্ষেতে যার মুখ দেখে এতক্ষণ মনে হয়েছিল অজস্র বন্টু মারা একটি বন্ধ দরজা, পাল্লা খুলে এবার সহাস্যে বেরিয়ে আসে, সময় কোথা বাবু। রাত নাই, দিন নাই, খালি তাে ছুটে ছুটে বেরিয়ে যেতে হত। দুই সপ্তাহ সে স্নান করেনি, কেরামৎ জানায় যা তার দাঁতের ময়লা দেখে বিশ্বাস হয়। তার চোয়াড়ে মুখে ধীরে, অতি ধীরে, প্রায় অলক্ষ্যে, বীরের নিস্পাপ আত্মগরিমা ফুটে ওঠে। “এখানে তিন দিন লড়াই করেছি। সব আমরা ধ্বংস করেছি।” ডাকনিয়ার বিধ্বস্ত বাঙ্কারগুলাে দেখিয়ে যখন সে বলে। সে ছিল পশ্চিম রংপুরে ইউপি-পির একজন হাবিলদার কেরামৎ আলি (নং ১৪৫৭)। একটা টাইপ করা পরিচয়পত্র পকেট থেকে বের করে সে আমাকে দেখায়। ‘সার্টিফায়েড দ্যাট’, তাতে লেখা, কেরামৎ আলি ৪/0 লেট মেহের আলিখান, ভিলেজমুসুরিয়া, পােস্ট-দেহেরঘাটি, পি,এস-বাবুগঞ্জ, ডিস্ট্রিক্ট-বরিশাল, কেম টু মাই ক্যাম্প উইথ সিক্সটি ফোর হাবিলদার্স অ্যাজ এ গ্রুপ লীডার অ্যান্ড আফটার ট্রেনিং হ্যাজ বিন ডিউলি পােমােটেড টু দা র্যাংক অব প্লেটুন কমান্ডার। হী ইজ এ বােনাফাইড ফ্রীডম ফাইটার। অল কনসার্নড আর রিকোয়ার্ড টু হেল্প অ্যান্ড কোঅপারেট।’ সীলমােহর। স্বাক্ষর ক্যাপ্টেন আব্দুল বারি। ক্যাম্প ইনচার্জ। ধলচিতা। আরে শবনমও উঠেছে যে, ঠাসা ভিড়ের মধ্যে দেখতেও পাইনি ওকে। ওদিকে দরজার পাশে বসেছে। “এতক্ষণ দেখনি!” উচ্চারণ করে আমি আমাকে বলি। পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই ওর দাদা। এপারে ইটিন্ডার পৌছে শবনম আমাকে বলেছিল, ও অপেক্ষা করছে দাদার জন্য। দাদার বগলে ওটা কী? দাদার হাতের নাগাল না পেয়ে ও কীসের বাট ধরে আছে শবনম ? আজ ভাের বেলা ইছামতীর ওপর মাঝ বরাবর আমরা তখন কুয়াশার ভেতর থেকে সহসা বের হয়ে এটা নৌকা হুশ করে আমাদের পিছনে রেখে কুয়াশার ভেতর ঢুকে যায়। নৌকাটি ছিল আরােহীবিহীন, নৌকায় এবটা রিকশা ছাড়া ঘন কুয়াশার মধ্যে আমি প্রথমত কিছুই দেখতে পাইনি। এই সময় কুয়াশা ভেঙ্গে রােদ এসে পড়লে রিকশার কারুকাজ থেকে টিন চকচকিয়ে ওঠে ও, যেন সিংহাসনে, না রিকশার ওপর একটি ফুটফুটে কিশােরী বসে আসছে দেখতে পাই। এবং সেই তার সঙ্গে প্রথম চোখাচেখি। এবং সেই তার প্রথম হেসে ফেলা। ভিড়ের ভেতর থেকে শবনমের চোখ দুটো খুঁজে বের করি। ওই স্বভাব মেয়েটার। এমনিতে ভীষণ গম্ভীর, কিছুতেই চোখের দিকে তাকাবে না। খালি ফাঁকি দিবে। এবং চোখাচোখি না হলে কিছুতেই হাসবে না। ফিক করে হেসে বাসের একমাত্র মহিলাযাত্রী গম্ভীরমুখে আবার বাইরে তাকায়। দাদাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে আসে। ওর নাম সিরাজুল। সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ওরা বাড়ি যাচ্ছে। আম্মা আর আব্বা ফিরেছেন পরশু।
“ওটা কী ?”
“অ্যা!” “শর্ট মেসিন গান।”
“শর্ট ? মেসিন ? গান?”
“জী।”
“সাদা পােষাকে ইন্ডিয়ান আর্মি নাকি তুমি সিরাজুল? ” আমি হেসে জানতে চাইলাম। সবাই হাসি থামালে সিরাজুল একা হাসল “জী না। আমি সিরাজুল। সিরাজুল ইসলাম।” মুক্ত সাতক্ষীরায় আজ বড় মিটিং সে জানে। কিন্তু তার যাওয়া হবে না। বােনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই সে ক্যাম্পে রিপাের্ট করবে।
“গায়ে একটা কচুগাছ থাকলে তার আড়ালে আমি লড়তে পারি। ওরা পারবে?” তার কথা শুনে চমকে উঠি। আল মাহমুদও তাই বলতে চেয়েছিল। আল মাহমুদের সদ্য প্রকাশিত ক্যামােফ্লাজ’ কবিতাটি আমার স্বতঃই মনে পড়ে যায়, যেখানে পরিখার ভেতর থেকে আস্ত বনানী সহ জেগে উঠছে একজন মুক্তি সেনানীর সতর্ক হেলমেট! কথা শেষ করে সিরাজুল এতক্ষণে হাসে, হাঃ হাঃ ওই স্বভাব সিরাজুলের। ভিয়েতনামে ৮ বৎসরে যা পারেনি, আমরা ৮ মাসেই তা পেরেছি। মুক্তিফৌজ পিছু হটতে জানে না।” বলল সিরাজুল। সিরাজুলের অপরাভূত মুখশ্রীকে তুলে ধরার জন্য সিরাজুলের ঘাড়ের পেশী ফুলে উঠতে দেখি। মামুদপুরে একটি মিলিটারী ট্রাক ঢালে পড়ে গেছে। সেটিকে রাস্তায় তুলে দেবার জন্য বাসটির সাহায্য চাইলেন আর্মির একজন অফিসার। বাস খালি করে আমরা নেমে পড়লাম। অপেক্ষা না করে মুক্তিফৌজ মার্চ করে বেরিয়ে যায়। মুক্তিফৌজ অপেক্ষা এই অবসরে জাল ফেলে জলা থেকে উঠে এল মামুদপুরের শােভান আলি (২৫)। সে প্রায় জোর করে গাঁয়ের ভেতরে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। গাঁয়ের প্রান্তে প্রবহমান খাল ধরে একটা লম্বাপানা গর্তের চারিদিকে ইতস্তত নরকঙ্কাল, হাড় ও খুলি পড়ে আছে। মাটির সঙ্গে পচা মাংস মিশে আছে। একটি ভাঙ্গা চশমা আমরা সকলেই দেখেছি। গর্তের মধ্যে কিছুই নেই। একটা সাড়ে চার ফুট কেউটের অটুট খােলস পড়ে আছে। কেউটেটা নেই। শােভান আলির কোমর পর্যন্ত ভিজে, গায়ে ফতুয়া। শীতে কাঁপতে কাঁপতে গর্ত দেখিয়ে শােভান আমাদের বলল, “এইখানডা।” এইখানে একজনকে শুইয়ে গুলি করেছে, আর একজনকে তুলতে বলেছে। তারপর তাকে বলছে শুতে। “এইরমভাবে গেল হপ্তায় ২০/২৫ জনকে মেরে ফেলতে আমরা দেখেছি। গন্ধে এদিক গরু আসত না।” গত ৮ মাসে এদিক সেদিক থেকে অন্তত ১২০০ লােক এক এই মামুদপুরে মারা হয়। বেশিরভাগ বেয়নেট চার্জ করে। কেউ কেউ দেড় থেকে দুইহাজারও বলেছেন। সাতক্ষীরা রােডের দিকে ফেরার পথে একজন গ্রামবাসী একান্তে আমাকে একটা কথা বলে, যা প্রকাশ করায় সব পাপ আমার , যে জন্য আমি তার কাছে পুনঃপুনঃ ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, সত্যের খাতিরেই আমাকে এটা করতে হচ্ছে। “আমাদের গাঁয়ে ওরা মেয়ে ছেলে পায় নাই। শেষ রাতে পুকুর থেকে দাদী গােসল করে উঠছে কী বলব বাবু বলা যায় না- সে আমাকে বলেছিল। বলতে বলতে বুকের ওপর ঝুলে পড়েছিল তার যুবাবয়সী মুন্ডু। যেতে যেতে মামুদপুরে ৩টে ছই ঢাকা গরুর গাড়ি ঢােকে, পুরুষরা হেঁটে যাচ্ছে। পুকুরে জাল পড়ছে। ওদিক দিয়ে অনেকগুলাে হাঁস জলে নেমে পড়ে মামুদপুরের পর তালবেড়ে। তালবেড়েতে ফেলে আসা বাসটিকে আমরা পেয়ে যাই ও ছেড়ে দিই। মানুষজনের জয় বাংলা ধ্বনিতে পূর্ববৎ ফেটে পড়েছিল বাসটি। আজ সাতক্ষীরায় আঞ্চলিক প্রশাসনের উদ্বোধন, বিকেলে সভা, ওরা যাচ্ছে সেখানে। আলিপুর বাজার, গায়ে জলের জন্য বাস দাঁড়িয়ে। এখানে একটি বড়সড় হাইস্কুল রয়েছে। চা ও পানবিড়ির দোকানে বেশকিছু লােক। ট্রানজিস্টরে ১টা ২৫ এর ভারতীয় খবর শুনছে। এখান থেকে ভারতীয় আধুলি দিয়ে ঢাকায় তৈরী এক প্যাকেট পৃথিবীর সুলভতম সিগারেট কিনে ফেলি নাম-রূপালি। নামটি ছিল বাংলা অক্ষরে। উত্তর পশ্চিম দিক থেকে সুদীর্ঘভাবে কালীগঞ্জ রােড এখানে মিশেছে। দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়। ১৫/২০টি গরুর গাড়ি আসছে। আলিপুরের পর তীর মােহনা। তারপর বাকাল পােল যা পালাবার আগে পাক সৈন্যরা গুড়িয়ে দিয়ে যায়। গ্রামের লােকে সানন্দে পুননির্মাণ করে দিয়েছে। ধ্বংস থেকে নির্মাণের ব্যবধান মাত্র ২ দিন। তারপর পটাগাছা। ইটাগাছার এনায়েৎ খানের (৮১) বাড়ি থেকে পাঞ্জাবী সেনারা ঘড়ি, বন্দুক, ট্রানজিস্টর সব নিয়ে গেছে। গরু ছাগল টেনে নিয়ে গেছে। বাড়ির মেয়েরা এখনাে ফেরেনি। বৃদ্ধের দেখাশােনার জন্য শুধু একটা দাসী ছিল। ডাক্তারী মতে সে তখনাে রমণী হয়নি, যখন ৪ জন পাঠান তাকে ধরে নিয়ে যায়। সাতক্ষীরার একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার এখন মেয়েটিকে চিকিৎসা করছে। মুসলিম মেয়েদের নাম কি মিষ্টি হয়! এর নাম সাবিহা মানে নাকি ভােরের হাওয়া। আশা করি বসন্তের ? ওই ভাবা যায়! শােনা গেল পাশেই কার্তিক বােসের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। “ও! কার্তিক বােস? আই নাে।” “ক্রিকেটার নাকি? ” “আরে না মশায়।” বৃদ্ধ মহম্মদ আলির সামনে তারাপদ রায় আমাকে চাপা ধমক দেয়। “আচ্ছা ঘটি তাে আপনি, এ সব বাঙালে কান্ডােয় আপনি ঢুকে পড়েছেন কী করতে। কার্তিক বােসের ল্যাবরেটরী না শােনেন নি? আমার বাবার পায়ে কড়া হয়নি? কনহীলার লাগাতে দেখেননি? টাঙ্গাইলে থাকতে আমার বাবার পায়ে কড়া হয়েছিল। বাড়িটি ধুলিসাৎ, কিন্তু একতলা ছিল শুনে আমি একটু ঘটিসুলভ গােয়েন্দাগিরি না করে পারি না। ক্রিকেটার অবশ্যই নয়। কিন্তু ফার্মাকোলজিস্টও না। ইটাগাছার সায়ীদুল ইসলাম (২৫) আমাকে জানালেন সাতক্ষীরা বাজারে কার্তিক বােসের একটি কাপড়ের টহল (স্টল) ছিল। একটা ছােট্ট সংসার ছিল। এক ভাই ছিল। স্ত্রী ও বাচ্চা ছিল দুটি। এখন নেই। কিছু নেই। কেউ নেই। ইটগাছার কার্তিকচন্দ্র বােস, বয়স ২৫, দোহারা কালাে বেটে খাটো। ডান গালে মস্ত আচিল। আপনার বন্ধু ও পাশের বাড়ির ইটগাছার সাইদুল ইসলাম জানাচ্ছেন, আপনি যেখানেই থাকুন সপরিবারে ফিরে আসুন। আপনার ছােট্ট ধানের গােলাটি আশ্চর্যজনকভাবে আজো অক্ষত থেকে গেছে। একটা সীমগাছ কয়েকটি হলুদ ফুলসহ বেড় দিয়ে লতিয়ে উঠে গােলাটি এখনাে আপনার জন্য রক্ষা করছে। বেলা দুটো। সাতক্ষীরা এখান থেকে ১ মাইল। একজন সাইকেল আরােহীকে লিফট দিতে বলি। বাকি রাস্তা আমিই চালিয়ে নিয়ে যাই। বন্ধুরা একটু পিছিয়ে পড়লেন, পদব্রজে বহু মানুষজন সাইকেল অন্তত ৩০টি, সকলেই তার মহার্ঘতম পোেষাকটি পরে বেরিয়ে পড়েছেন। সকলেই চলেছে সাতক্ষীরার মিটিংয়ে। আর্মির একটি জীপ আসতে দেখে আমি নেমে সরে দাঁড়াবার প্রস্তাব দিই। “না না ওরাই পাশ দেবে, সরে যাবে। ” আব্দুস সবুর (১৭) উদ্ভাসিত মুখে জানায়। “আজ ৮ মাস পরে সাইকেল চাপছি।” বৃদ্ধ এনায়েত খানও তাই বলেছেন। এরা বন্ধুর মতাে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান আর্মি। ফেরার সময় বিকেলবেলা রিকশাচালক গফুরও (৩৫) একটি আর্মার্ড কার আসতে দেখে গতি কমায়নি। রাতদুপুরে তার বাড়িতে পাঠান সেনার মাতাল পদাঘাত, “ইধর দুশমন হ্যায়?” সাইকেলের রডে বসে আবদুস সবুরও অনুরূপ কাহিনী শােনাল। সে আসছে ভারােখালি থেকে। সাতক্ষীরা পৌছলুম ২ টা নাগাদ। রােদ উঠেছে ভালােই, উত্তরের উপভােগ্য হাওয়ায় বাড়িতে বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা থেকে উড়ছে ঘনসবুজ ও লাল সােনালী। অনেকেই বেরিয়ে পড়েছে। এক জায়গায় আহারাদির পর বাড়ির সামনে রােদে মাদুর পেতে বরাবরের কুড়েমি করছে কয়েকজন। তাদের সামনে পানের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে পসারিনী বুড়ি পান সেজে দিচ্ছে। ট্রানজিস্টরে রেডিও বাংলাদেশ বেজে চলেছে। এখান থেকে সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের চওড়া দেওয়ালের বুলেট বিক্ষোভ। বুকে আটকানাে দুটি বড় বড় পােস্টারের অক্ষুন্ন মহাত্মা চোখে পড়ে। উল্টোদিকে কালীপদ রায়চেীধুরীর দালান কোঠার ধ্বংসস্তুপ চোখে পড়ে। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (MPA) মুসির আহমেদ এর বাড়ি রয়েছে দরজা জানালা সব পােড়া। ভেতরে ঢুকে দেখি একটাও ঘর নেই এমন দোতলা বাড়িতে মনে হয় দুঃস্বপ্নে আগে একবার ঢুকে ছিলুম। সিলিং পর্যন্ত ঝলসানাে। শুধু উঁচু উঁচু দোতলা দেওয়াল। স্তুপাকার ধ্বংসের ওপর একটি কুকুর ঘুমিয়ে। গত ২২ শে এপ্রিল সাতক্ষীরা ঢুকে পাঠান সৈন্যরা এই বাড়িটায় প্রথমে আগুন লাগায় সাতক্ষীরা এলে শেখ সাহেব বরাবর এই বাড়িতে উঠতেন। সুরাবর্দি, ভাসানি কে না এসেছেন। শেখ সাহেব এসেছিলেন ১৯ শে নভেম্বর। মুসির আহম্মেদ এর বাড়ির ভেতরে টলটলে পুকুর। পুকুরে মাছ নেই। ১০/১২ টা নারিকেল গাছ পুকুর পাড়ে। মুসীর সাহেবের বড় দাদা আনিস আহমদ (৭০) সম্পন্ন চাষী। তার গােলা থেকে এই ৮ মাসে ৩০/৩২ বস্তা ধান এবং ২০/২২ বস্তাবস্তা চাল নিয়ে গেছে। সালােচনে বললেন, “বাবারা এই বুড়াে মানুষকে বললে ডাব পাড়তে। বললাম আমি জানি না ডাব পাড়তে। তখন বুকে পিস্তল ধরলে। জীবনে প্রথম গাছে চড়ে ডাব পেড়ে দিয়েছি বাবা। নিচে থেকে হুকুম দিলে, মুচিগুলাে ভেঙ্গে দাও। নিজের হাত পােতা এইসব গাছ….ও হাে হাে হাে হাে হাে।” তারপর যতক্ষণ ছিলুম এ কান্না থামেনি। খবর পেয়ে মুসির আহমেদ (৪২) এসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে গা থেকে ছাই ঝেড়ে সে কী লাফে লাফিয়ে এল সাতক্ষীরার নেড়িকুত্তা, কোন এক অতি শারিরীক উপায়ে দু পায়ে প্রভুর কাঁধ বরারর বিছিয়ে দিল তার দুটি হাত যেন গলা জড়িয়ে ধরতে চায়। তার ব্যতিব্যস্ত আদর শাসন করার জন্য গলা চড়িয়ে মুসির আহম্মেদ হাঁকতে লাগলেন, “টাইগার, টাইগার…”। এই একটা স্মৃতি থেকে গেছে, বিষন্ন হেসে বললেন আমাদের। “আমাদের ভালাে লাইব্রেরী ছিল আমার বুঝলেন। অনেক রে আর বই ছিল যা আর পাওয়া যাবে না। অম্মেদকরের ‘থটস অন পাকিস্ত নি’ বইটা কজনের আছে তা জানি না।” মুসীর আহম্মেদ এর শ্বশুর হলেন জালাল উদ্দিন হাশেমী। অবিভক্ত বাঙলার ডেপুটি স্পীকার ছিলেন, যাকে বলা হত খোড়া হাসেমী। ওয়েলিটিং স্কোয়ারের সেই বিখ্যাত সভার মঞ্চ থেকে সুভাষচন্দ্র। গ্রেফতার হবার পরেই খোঁড়া পায়ে অকুতােভয়ে এগিয়ে যিনি যে পাঠ করেছিলেন সুভাষের অসমাপ্ত ভাষণ। পুলিশের ভ্যান থেকে জনতার দিকে লাঠি ছুড়ে দিয়ে হাসেমী পুলিশকে বলেছিলেন, “বাট ইট কান্ট অররেস্ট মাই ক্রাচ।” হাসেমীর ছেলে কামাল বখৎ জাতীয় পরিষদের সদস্য (MNA)। মধ্যবয়সী, মুখে হাসি, চামড়া লাবণ্যময়, রঙ টকটকে ফর্সা। পরনে লাখেনৗ পাঞ্জাবী আর ঢিলে পায়জামা। ঠোট দুটো অসম্ভব পাতলা, অমনই রাঙ্গা পান একদম খান না। এর ভাই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কবি সিকান্দার আবু জাফর,‘সমকাল’ নামে অসাধারণ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক। যা ডাকযােগে অজ্ঞাত পরিচয়ে আমাকে বারংবার উপহার পাঠিয়েছেন। বাবার গল্প কামাল বখৎ সাহেবের মুখেই শুনলুম। মুসির আহম্মেদ আবার হাসেমীর জামাই। শালা ভগ্নীপােত দুজনেই আজকের সভায় বক্তৃতা করবেন। আমাদের সঙ্গে ছিল ডিম, পাউরুটি, সেদ্ধ আলু আর কলা। মুসির আহম্মদের পােড়া বাড়ির বারান্দার বদনার জলে হাত মুখ ধুয়ে আমরা মধ্যাহ্নভােজনে বসলুম। বৃদ্ধ আনিসের হাতে ট্রে হাতে ও কে? শবনম না। “এ হচ্ছে আমাদের মুসিরের ছােট মেয়ে।” জ্যাঠামশাই আলাপ করিয়ে দেন। গুডনেস। সিরাজুল তাহলে কে? ওর ফুফাতাে ভাই। কোথায়? নেই , সে ক্যাম্পে ফিরে গেছে। কপট নমস্কারের ভঙ্গিতে কাঁধের ওপর দুহাত জড়াে করে আমি শবনমের সঙ্গে পরিচিত হই। সে প্রতি অভিবাদন করে না। সে হাসে না। একবারও চোখের দিকে না তাকিয়ে ফাকি দিয়ে গম্ভীর মুখে সাতক্ষীরার বিখ্যাত ছানার মুড়কীর ৪টে প্লেট শবনম এক এক করে এগিয়ে দেয়। আনিস আহম্মেদ এখনাে কাঁদছেন। পাঞ্জাবীর হাতা ভিজে ঢােল হয়ে গেছে। “১০০ জন লােক এলে আমার বাড়ি থেকে ১০০ টা প্লেট বেরুতাে আর আজ ৪টের বেশী ও হাে হাে হাে হাে হাে।” কিন্তু তখন কে শুনে বৃদ্ধের বিলাপ। শবনম আবার হেসে ফেলেছে। এবার হাসিয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক এল এনামুল হকের বাড়ি থেকে। মুক্তিফৌজের সঙ্গে আবার ভরাপেটে খেতে বসতে হল ভাত ও মাংস। খেতে খেতে আলাপ হল পঙ্কজ মিত্রের সঙ্গে। ইনি ছিলেন রাজশাহীর বিখ্যাত সারদা পুলিশ একাডেমীর চীফ ইনস্ট্রাক্টর। বাংলাদেশ সরকার পরশুদিন একে খুলনা জেলার এস পি নিযুক্ত করেছেন। কালই তিনটি থানায় ইনি তিনটি নতুন ওসি, নিয়ােগ করেছেন। এস ডি ও মহঃ শাহজাহান আলি, সাতক্ষীরার ও সি মি. এইচ এম হান্নান, সেকেন্ড অফিসার মােয়াজ্জেম খান সবাই পাত পেড়েছেন। আব্দুল রহিম অ্যাডভােকেট। বললেন,কোর্ট আজ কালের মধ্যেই খুলবে। আব্দুল গফফুর মাদ্রাসার শিক্ষক গুনাগারকাটি। মাদ্রাসা খুলেছে। আব্দুস শােভান, অধ্যাপক রাজনীতি বিজ্ঞান সাতক্ষীরা কলেজ। ৮ মাস পরে কলেজ খুলেছে। হাজিরা ৫০%। শেখ আব্দুস আহাদ। “টাইমস প্রিসিশান” নামে সাতক্ষীরা বাজারে ভূতপূর্ব ঘড়ির দোকানের মালিক। ২২শে এপ্রিল ১২০০০ টাকার জিনিস খানেরা লুঠ করে। চাবুক খেয়েছেন দুবার। কালিদাস চক্রবর্তী এনেছে ২০ বছর পর ভিটে দেখাতে। টেলিফোন অফিসে ইঞ্জিনিয়ার শেখ ম হাসান জানালেন, ৪ দিন হলাে পাওয়ার সাপ্লাই এসেছে-ব্যাটারী চার্জ কমপ্লিট-৯৮টি টেলিফোনই চালু করেছেন। “রাস্তার প্রতিটি লাইট পােস্ট জ্বলছে। এবং আজ থেকে বিল্ডিং এ আলাে জ্বলবেই-বললেন ওয়াটার এন্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ডিভিশন ওয়ানের কর্তা আফাজ উদ্দিন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলুম ২২শে এপ্রিল থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত খানসৈন্যরা ছিল। ৬ই পালায়। পালাবার আগে ৪ঠা ডিসেম্বর ভাের ৪টের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, যেন ভূমিকম্পে থরথর করে কেঁপে উঠল গােটা সাতক্ষীরা টাউন। ২০টা মাইন একসঙ্গে ফাটিয়ে ওরা বাকাল নদীর সুইস গেটটি ভেঙে দিয়ে যায়। ৩০ ফিট কীটের ওপরে ছিল গেটটি। ২৭টা গ্রামের পানি ভাঙত। আগামী বর্ষায় নির্মাণ কাজ না করলে গ্রামকে গ্রাম ডুবে যাবে। লােনা জল ঢুকবে। ও ধান হবে না। বিকেলে সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের পেছনে শহীদ রাজ্জাক পার্কে জনসভা। আগে নাম ছিল চিলড্রেনস পার্ক। মার্চের উত্তাল অসহযােগ আন্দোলনের সময় জাকারিয়া লজের সামনে বাস স্ট্যান্ডের কাছে গুলি চলল। সাতক্ষীরায় এবারের আন্দোলনে সেই প্রথম শহীদ, শহীদ রাজ্জাক একজন রিকশাচালক। মিটিং এর ভিড় এড়িয়ে পার্কের একদিকে চলে যাই- সেখানে তার স্মৃতিস্তম্ভ ছিল। স্রেফ বুটের লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলা হয় স্তম্ভটি। স্তম্ভের পরেই ঈদগার ঘেরা জায়গা। যেখানে মােনাজাৎ করা হত। শুয়ােরের বাচ্চারা গরু ধরে এনে এখানে নিলামে চড়াত।” জমিতে থুতু ফেলে বললে সৈয়দ নওসাদ এরতেজা (২২)। সাহাপাড়ার কজন হিন্দু ভাইকে এই এরতেজা আশ্রয় করে বাঁচায়। তার বন্ধু, কেষ্ট পাল , নরেন, খগেন, বাটলু পূর্ণ স্যার তারক (পুরােহিত) মােট ১৫ জন হিন্দুকে জলপাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে, তারপর জলে ফেলে দেয়। এদের মধ্যে শরৎ পাল ছাড়া আর কাউকে বাঁচাতে পারে নি। কি ধার দুশমন হ্যায়?” সেনারা তাকে প্রশ্ন করে। “দুশমন ইধুর নেহি মিলেগা”-সে বলে । পরিত্যক্ত কুমাের পাড়ায় একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে তারা ঠাকুরঘরে যায়। সমস্ত কুমাের পাড়া জ্বলে ওঠে। মাটিতে মিশে যায়। “আমাদের একটা দালাল দেখিয়ে দিয়েছিল, “মাথা নিচু করে এরতেজা বলল। সােনার বাংলা গান দিয়ে সভার শুরু হয়ে গেছে। তারপর গীতা ও কোরান পাঠ । বাংলায় কোরান পাঠ এই প্রথম শুনলুম। পছন্দে এমন চমৎকার অনুবাদ ছাপানাে হয়েছে নাকি! আমি সভায় সবার পিছনে। পাশেই রাস্তা। রাস্তার ধারে পাকাবাড়ির ছাদ ও বারান্দা। সেখানে দুই করতল জড়াে করে নারীরা মােনাজাত করছেন। সেই একতলার বাড়িটার ছাদে কে আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কে! মােনাজা শেষে উনি হাত ছাড়লেন। মিটিং এ তখন বন বন স্লোগান উঠেছে :
জঅঅঅয় বাংলা।
ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীজিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!
সাত কোটি মানুষের আর এক নাম মুজিবর রহমান! মুজিবর রহমান!
জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব!
জঅঅঅয় বাংলা!
অলিন্দ থেকে নারী ও শিশুরা উত্তর দিচ্ছে। ধন্য মুজিবর ভােমার অপার বিস্ময় আমার কাছে এই যে, একটা গােটা জাতকে তুমি উপহার দিয়েছ দু দুটি নতুন শব্দ, জয় ও বাংলা, এবং শিশু বৃদ্ধবনিতাসহ এক গােটা জাত, বড় গরীব কৃতজ্ঞ চিত্তে তা গ্রহণ করে বহু কাল পরে উপহৃত হবার আনন্দ পেয়েছে। দীঘির পাড়ে সুভাষ মুখােপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পাশপাশি চুপচাপ বসে। খুব কাছে থেকেই সুভাষ মুখােপাধ্যায় আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেমন লাগছে?” নীরব থাকাই আমি ভেবেছিলাম শ্রেয়। কেননা আমার মনে হয়েছিল ওর পুরু লেন্সের ভিতর দিয়ে এত দূরের জিনিস উনি এর আগে কখনাে দেখেননি, মাঝখানে এতটা ব্যবধান রেখে সুভাষদা আমাকে আগে কখনাে ডাকেননি। উনি এখনাে ডুবে রয়েছেন। কবির মগ্নচেতনায়, আমি টের পেয়েছিলাম। বাস্তবিক এই কবিকে আমি সর্বত্রই দেখেছি-দেখেছি কবি সভায়, পানশালায়, একাডেমি পুরস্কার হাতে ওর চলচ্চিত্র দেখেছি। ১৯৫৫-য় বাগনানে কৃষকসভার পর এই দ্বিতীয়বার আবার আমি ওকে দেখলুম গ্রামবাংলার মানুষজনের সঙ্গে এবং এখানে ছাড়া সত্যত এই কবিকে আমার মতে কোথাও কখনাে মানায়নি। পুকুরের চারাগাছের মতন এখানেই গ্রামবাংলার এই ধনী প্রকৃতি ও খুব বেশি গরীব বােকা সােকাদের মধ্যেই উনি ওর সাম্প্রতিক কবিতার শ্রেষ্ঠ পঙক্তিতে যেমন, হানকান করে বেড়ে ওঠেন। বস্তুত ঐ দীঘির পাড়ে নীরেনদার পাশে সেই একবার তারপর আজ সুভাষ মুখােপাধ্যায়কে আমরা খুঁজে পাইনি। থেকে গেলেন মনে হয়।
সভা চলছে। ছােট ছােট বক্তৃতা করে চলছেন এম পি এ ও এম এন এর মমতাজ মিঞা (সাতক্ষীরা), আলাউদ্দিন (কনিষ্ঠতম সদস্য-২৪), ফজলুল হক (শ্যামনগর), আব্দুর রহমান (বাগেরহাট), কামাল বখৎ ও আব্দুর রব সেরনিয়াবৎ শেষােক্ত দুজন এম এন এ অর্থাৎ আমাদের এম পি শেখ আব্দুল আজিজ এম এন এ ও খুলনা জেলার আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। বক্তৃতা আমি কখনাে শুনি না। কিন্তু ছাত্রলীগের অতি তরুণ নেতা নসীম ময়না (১৮) আমাকে বাধ্য করেছিল শুনতে যখন সে একটা রাইফেল তুলে ধরে বক্তৃতা নয়, চিৎকার করছিল “ভায়েরা আমার আমি আর কিছু জানি না। আমার আর কিছু বলার নাই। শুধু বলছি ২৫শে মার্চ যুদ্ধ শুরু করেছি- এখনাে যুদ্ধ করছি এবং দরকার হলে সারাজীবন যুদ্ধ করব, ইনশাআল্লাহ! এজন্য জাতির পিতা শেখ মুজিবের কাছে আমি ওয়াদাবদ্ধ। সম্ভবত মাইকটি অকারণেই তার সামনে রাখা হয়েছিল, এত চিৎকার করে শির ফুলিয়ে সে কথাগুলাে বলে। দীর্ঘতম সময় জুড়ে করতালি আর উল্লাস সেই পেয়েছিল। আমি কোট করেছি তার বাক্যগুলি। পার্কের কাছে রিকসার হুড়ােহুড়ি। সভা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে গ্যারেজ ব্রীজ পেরিয়ে আমি খাল পর্যন্ত চলে যাই। হসপিটাল রােডের দুধারে সারি সারি দোকান- সাখাওয়াত মেডিক্যাল স্টোরস, মমতাজ হােটেল, হ্যানিম্যান হােমিও ফার্মেসী, সাইকেলের দোকান, ঘড়ির দোকান, লন্ড্রি সব ভােলা। একটি জীপ আসছিল। রিকশাঅলার মন্তব্যের কথা আগে বলেছি। দুজন জওয়ান জীপ থামিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানে ঢুকে আনাচারেকের মত চানাচুর কিনল । রিকশা দাঁড় করিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখলুম। মিটিং-এ ফিরে এলুম। এখন সভা ভাঙ্গার মুখে। নীরেনদা আমাকে কাছে ডাকলেন। হেসে বললেন, ওদিকে এতক্ষণ কী দেখলি? আমি মুখ খােলার আগেই বললেন, “চুপ” তারপর অদূরে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললেন, “ঐ দ্যাখ পার্কে ঘুগনিওয়ালা এসেছে। এবং তার পেছনে এত বড় মিটিংকে কুছপরােয়া জ্ঞানে ছেলে মেয়েরা পার্কের একদিকে স্লিপ খাচ্ছে, দোলনা দুলছেস্কিপিং করছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। পাখিদের মতােই সন্ধ্যা হলে ছেলে পিলেদের চাচামেচি বেড়ে যায় । আকাশে ছেড়া মেঘ। দীঘির পাড়ে সারি সারি বাবলাপাতা থরথর করে কাঁপছে-গােধূলির এরকম আলােতেই নিশ্চয়ই হাওয়া তাে নেই! একটা সাপ ঐ দীঘির মাঝ বরাবর পৌছে গেলে আমি দেখি, খেলা নয়, ওপার অবধি যাবে বলে মনে হয়। কলকাতা ফিরে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে কী দেখলে? আমি বলব হাওয়া বিনা বাবলা পাতার ঐ কাপনের মতই কিছুটা আশচর্যজনক জীবন এখানে।
সভা ভেঙ্গে গেছে। সব লাইট পােস্টে আলাে জ্বলে উঠছে। হ্যা, ব্ল্যাকআউট ফাউট নেই, বাড়িগুলােতে ও দোকানপাটে জ্বলছে-আজকের মধ্যেই জ্বলার কথা ছিল। ল্যান্ডরােভারে ওঠার আগেই একজন বৃদ্ধ শুধু এর নাম ও বয়সই আমার জানা হয়নি- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সােয়ােটারের হাত চেপে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়তে চান না। সাঞনয়নে তিনি কেবলই বলেছিলেন, “বাবা এই তাে গেল হপ্তায় ঠিক এমনি একটি মিটিং হয়েছিল…লােকজনও এসেছিল সেখানে। এমনি কোরান পড়েছিল। ঠিক এমনি হয়েছিল বাবারা।” আমাকে একটা কথা বলতে দিন। আমি কোনাে রাজনৈতিক দলে নেই, এখনাে নেই। যে কোনাে রাজনৈতিক দলের কর্মী যারা সুবাতাস ও সমুজ্জ্বল সমাজ চেয়েছে, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তবু একটি নিষিদ্ধ রাজনীতি আমি করি, যা আমি এখন প্রকাশ করছি। গত ১০ বছর ধরে কলকাতার প্রায় প্রতিটি বড় জনসভার মঞ্চের পিছনে একা দাড়িয়ে পশ্চাৎদেশ থেকে মহিলানেত্রীসহ ছােট বড় মেজো সকল নেতাকে আমি দেখেছি। দেখে আমার মনে হয়েছে যারা সামনে বসে রয়েছে তাদের প্রত্যেকের উচিৎ পশ্চাৎদেশ থেকে মঞ্চটাকে একবার দেখা এক একটি বামনবতার সব, যে যার রণ-পা’র ওপর দাঁড়িয়ে। আমি দেখেছি। আমি বলতে চাই একটি শিশু রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ইতিহাস জন্ম দিয়েছে অতি রহস্যময় এক শিশুকে। এখন এই শিশুর হাত থেকে তারা দূরে থাকুন যাদের পৃথিবীর সকল শিশুর কাছ থেকে তফাতে থাকা দরকার। ঐ নামহীন বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর। ঐ কণ্ঠস্বর শুনুন। ওর আবেদনের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে। এই নতুন রাষ্ট্রের যারা দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তাঁরা যদি ওই অরুন্তুদ আবেদনকে মর্যাদা না দেন তাহলে, আমি সাবধান করে দিচ্ছি এবার সর্বনাশা পরিণতি হবে। নসীম ময়না ২৫শে মার্চ এবারের যুদ্ধ ঘােষণা করেছে। যুদ্ধ করছে। এবং দরকার হলে সারাজীবন সে যুদ্ধ করতে সে ওয়াদাবদ্ধ ইনশাআল্লাহ।
পরিশিষ্ট
ঐ গাড়িতে আমরা ফিরিনি। ঐ গাড়ি তথা আমাদের এবারের এই হামসফরের উদ্যোক্তা নিরঞ্জনের (হালদার) চেষ্টা ও সাফল্যের আনুপাতিক হলাে ১০:১। তার এক একটি সাফল্যের সঙ্গে অন্তত দশটি ইমম্যাকুলেট ব্যর্থতা জড়িয়ে থাকবেই। এটা সেই কলেজ জীবন থেকে দেখে আসছি। সাতক্ষীরা পেরিয়ে মাইলখানেক যেতে না যেতেই তাই নিরঞ্জন প্রযােজিত গাড়িখানা কোনােরূপে ভনিতাবিনাই মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। তাতে নাকি আর কোনাে পেট্রোলই নেই। এদিকে মাইল তিরিশেকের মধ্যেই তুমূল যুদ্ধ হচ্ছে। রাজাকাররাও থেকে গেছে।
একে অমাবস্যার রাত, শীত তার ওপর শহর ছাড়তেই পাড়াগাঁর প্রাকৃতিক ব্ল্যাক আউট। ৭টা নাগাদ মুক্তিযােদ্ধা বােঝাই একটা লরি এসে পড়ে। বস্তুত লরি নয়। হেডলাইট নিভিয়ে একটা লরি গা গা ছুটে আসছে। নসিরঙা ময়লা চাদর তার মিনি বুকের ওপর আড়াআড়ি ক্রশ করে এঁটে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে নিরঞ্জনই সেটি থামায়। কিন্তু ভালাে করে থামার আগেই আমরা কজন দুর্ভাগা বলে তার টায়ার ধরে ঝুলে পড়ি। রােককো, রােককো বলতে বলতে ছুটে এসে নিরঞ্জন কোনােক্রমে চড়ে। লরিটা শেষবধি ইছামতী তীর পর্যন্ত পৌছেছিল। কিন্তু এ খােলা লরিতে স্থানাভাবের দরুন অবলম্বনহীন গাদাগাদি দাঁড়িয়ে গাছের ডালের গুঁতাে ও বাবলা গাছের আঁচড়ানি খেতে খেতে মাইল মাইল মেঠো পথ, দুই দিকে হু হু শীতের হাওয়া ও অন্ধকার এবং একমাত্র অন্ধকার সুনীলের মতাে ডানপিটের ভাষাতেও তার জীবনের ‘মােস্ট পেরিলাস জার্নি’ এই ভয়ংকর ফেরাই ও তৎসহ ১০০ মজাকে মর্যাদা দেবার যােগ্যতা আমার নেই। এটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং না লিখলে পাঠক সত্যিই বঞ্চিত হবেন। বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভারতীয় জওয়ানরা কাগজপত্র দেখতে গাড়ি থামিয়েছিলেন দুবার। গ্রাম পড়লেই ঘন অন্ধকার থেকে গর্জে উঠেছিল রাতের কল্লোল- জঅঅঅয় বাংলা!’ এবং একটা ভয়াবহ পােল পেরােবার সময় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হাঁক দিয়ে বলেছিলেন, “বন্ধুরা! সকলেই পড়বার চেষ্টা করুন তাহলেই দেখবেন কেউ পড়ছেন না। শুনে হাসতে হাসতে সেই মুত্যুফাঁদ পেরিয়ে যাই। যার পাটাগুলাে টায়ারের বিপুল চাপে কড়মড় কী যেন কামড়াতে চাইছিল। সেটা ছিল ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না এবং হেডলাইট নিভিয়ে লরি চলছিল। তখন মাত্র দিন পাঁচেক হল সাতক্ষীরা মুক্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা বনগা রােডের দুধার থেকে এখনাে সব মাইন কুড়ানাে হয়নি।
সূত্র: দেশ : ৯ পৌষ, ১৩৭৮